মুচমুচে মখমলের আস্তরণ, সঙ্গে মিষ্টি বা ফলের পরতের যুগলবন্দি, মুখে দিতেই এক অন্য আনন্দলোক। না। মিষ্টিমুখ মানেই বাঙালির একচেটিয়া অধিকার, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। এখানে যে মিষ্টির কথা উল্লেখ করা হচ্ছে সেটি অবশ্য সুদূর প্রবাস থেকে এসে এখন অবশ্য বাঙালির পাতেও জায়গা করে নিয়েছে।
আজ ১৪ মার্চ। এ দিনটা মার্কিন দেশে ‘পাই ডে’ নামে খ্যাত। গণিতের সম্ভবত সবথেকে বিখ্যাত ধ্রুবক হল Pi (পাই)। এই পাই-এর সঠিক মান এখনও নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। তবে সাধারণ ব্যবহারের জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে এর মান ধরা হয় ৩.১৪। মার্কিনি কায়দায় তারিখ লেখার রীতি হল আগে মাস ও পরে দিন। সেই অর্থে ৩.১৪ হল ১৪ মার্চ। তাই এই দিনটি পাই-এর সম্মানার্থে সারাবিশ্বে উদযাপিত হয় ‘পাই ডে’ বলে। উপরন্তু বিশ্ববরেণ্য বৈজ্ঞানিক অ্যালবার্ট আইনস্টাইন এই দিনে জন্মেছিলেন বলে এর কৌলীন্য আরও বেড়েছে। শুনতে Pi আর Pie একইরকম বলে অনেকেই মজা করে এই দিনটি পালন করেন পাই খেয়ে।
১৯৮৮ সালে ল্যারি শ’ নামে একজন পদার্থবিদ সান ফ্রানসিসকো এক্সপ্লোরেটোরিয়াম-এ প্রথম এই দিনটি উদযাপন করেন। আসলে, পাই-এর সঙ্গে বৃত্তের সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ। কারণ কোনও বৃত্তের পরিধি ও ক্ষেত্রফল নির্ণয়ের ক্ষেত্রে পাই-এর ব্যবহার অপরিহার্য। পাই খাবারটাও ঘটনাচক্রে গোলাকার। তাই সান ফ্রানসিসকো এক্সপ্লোরেটোরিয়ামের কর্মীরা সেদিন গোল করে দাঁড়িয়ে কুচকাওয়াজ করে পাই দিবস পালন করেছিলেন। শেষে সবাই মিলে ফ্রুট পাই ভক্ষণ! সেই থেকে চলছে এই রীতি। ২০১৯ সালের নভেম্বরে ইউনেস্কো এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক গণিত দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।

কালক্রমে এই অনুষ্ঠান যেমন পেয়েছে নতুন মাত্রা এবং বহুল জনপ্রিয়তা, তেমনই আবার পাই-এরও রূপ-ধরন-স্বাদের বদল ঘটেছে বিস্তর। যে কোনও জনপ্রিয় খাবারই বিভিন্ন পাতে পাতে এবং হাতে হাতে ঘুরতে ঘুরতে নতুন রূপ পায়। পাই-এর ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। প্রথমে মাংস দিয়ে তৈরি হলেও পনেরো শতক নাগাদ কাস্টার্ড এবং ফ্রুট পাই আত্মপ্রকাশ করে। রানি প্রথম এলিজাবেথকে চেরি পাই খাইয়ে ফ্রুট পাইয়ের সূচনা করা হয়।
মার্কিন মুলুকে ইংল্যান্ডের তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে সঙ্গে পাইও পুরোদস্তুর আস্তানা বানিয়ে নেয়। এরপর ব্রিটিশরা ক্যারিবীয়ান দ্বীপে উপনিবেশ স্থাপন করে। সেখানে চিনি খুব সুলভ। ফলে মিষ্টি পাই-এর রমরমা বৃদ্ধি পায়। একসময় গুড় দিয়েও পাই ভরাট করার প্রচলন হয়, যদিও উত্তরের দিকে মেপল সিরাপেরই বেশি রমরমা।
ফলের পাই-এর মধ্যে সবথেকে জনপ্রিয় হল অ্যাপেল পাই। তার কারণ ইংল্যান্ড-আমেরিকায় বিভিন্ন ধরনের আপেল সহজলভ্য আর শুকিয়ে মজুত করতেও সুবিধা। এমনই জনপ্রিয়তা এই পাই-এর যে কথায় কথায় লোকের মুখে ফেরে– ‘there are few things as American as apple pie’। নিউ মেস্কিকোতে একটি শহরের নামকরণও করা হয়েছে ‘পাই টাউন’।
তবে আপেলের পাইয়ের পাশাপাশি আরও বাহারি ফলের, বিভিন্ন ধরনের মিষ্টির ফিলিং দিয়েও তৈরি হয় পাই। আমাদের দেশে যেমন নারকেল, ক্ষীর, সুজি, সন্দেশের পুর দিয়ে পিঠে তৈরি করা হয়, আমেরিকাতেও যার ঘরে যা থাকে তারই পুর দিয়ে তৈরি হয় পাই। সাধারণতঃ ফ্রুট পাই পরিবেশন করার সময় সঙ্গে এক স্কুপ আইসক্রিম দেওয়ার রীতি প্রচলিত। উত্তর আমেরিকাতে এটি ‘পাই আ-লা-মোড’ নামে খ্যাত।
এবার আস্তে আস্তে পাইয়ের বেকিং শৈলির দিকে যাওয়া যাক। আমেরিকার যখন এত প্রিয় অ্যাপেল পাই, তারই প্রণালী থাক। ‘অ্যাজ় ইজ়ি অ্যাজ় পাই’— প্রবাদটা মুখে মুখে ঘুরলেও কয়েকটি ছোট ছোট টিপ্স বলে রাখি প্রথমে। নয়তো বলা যায় না, পাকেচক্রে এগুলোই গোল পাকিয়ে দেবে।

প্রথমেই বলি লাল মিষ্টি আপেলের বদলে একটু টক জাতীয় আপেল বা সবুজ আপেল ব্যবহার করুন। মিষ্টি আপেলে ব্যাপারটা একটু ঘেঁটে যেতে পারে। দুই, পাইয়ের ওপরে কাঁটাচামচ দিয়ে একটু ছোট ছোট ছিদ্র করে দেবেন। তিন, পাই-এর ওপরের আস্তরণ অর্থাৎ ক্রাস্ট যাতে না ফেটে যায় সেদিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। ওভার কুকিং বা ফাস্ট কুলিং এ দুটোর একটিও করলে এমন দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।
চার, ঠান্ডা মাখন ব্যবহার করলে ক্রাস্ট ভাল হয়। পাঁচ, খুব নরম ডো হলে কিন্তু চলবে না, ঝুরঝুরে হতে হবে। যদি দেখেন ম্যানেজ করা যাচ্ছে না, সেক্ষেত্রে রেফ্রিজারেট করে সেট করে নিন। শেষমেশ, বেলবার সময় মাঝখান থেকে কোণার দিকে বেলবেন।
পাই-এর দু’ধরনের ক্রাস্ট হয়। ওয়ান ক্রাস্ট পাই ও টু ক্রাস্ট। ওয়ান ক্রাস্টে নীচে একটি স্তর থাকে। তার ওপর পুর। টু ক্রাস্টে এর ওপরেও বসে একটি স্তর। টু ক্রাস্টে পুরো আচ্ছাদন দেওয়া একটি স্তর যেমন হয়, আবার খোপ খোপ করে একটি স্তর সাজানো হয় যা ‘ল্যাটিস’ নামে পরিচিত। ময়দা, ঠান্ডা মাখনের কিউব, চিনির গুঁড়ো আর অল্প ঠান্ডা জল দিয়ে বেশ ঝুরঝুরে একটি ডো তৈরি হবে।
এটিকে পার্চমেন্ট পেপার বা রোলিং পেপারে মুড়ে রেখে দিতে হবে। তারপর ক্লিন ফয়েলে মুড়ে ঢুকিয়ে দিতে হবে ফ্রিজে, কমপক্ষে এক ঘণ্টা। এরপর বার করে একদম ঘরের তাপমাত্রায় এনে বেলতে হবে। এরপর বেক করে নিলে ক্রাস্ট তৈরি।

এরপর পুর ভরা, যাকে বলে পাই ফিলিং। আপনার যেমন খুশি ফলমূল বা কাস্টার্ড, ক্রিম, এমনকী খোয়াক্ষীরও ট্রাই করতে পারেন। অ্যাপেল পাই-এর ক্ষেত্রে আপেল ক্রাম্বল দিয়ে যেমন পুর তৈরি করতে পারেন, তেমনই আবার আপেল ছোট টুকরো করে কেটে সঙ্গে জয়িত্রী আর দারচিনি গুঁড়ো মিশিয়েও অতীব উপাদেয় পুর তৈরি করা যায়। চাইলে সঙ্গে কয়েক ফোঁটা লেবুর রসও দিতে পারেন। ওপরে একটি স্তর তৈরি করে পুরোটা ঢেকে দিতে পারেন আবার ক্রিসক্রস ল্যাটিসও বানাতে পারেন। সব দিয়ে বসিয়ে দিন আভেনে।
আর যদি জিভ চায় আরও একটু বেশি মিষ্টি, তাহলে চারটে ডিমের মধ্যে একটু ঠান্ডা দুধ, ভ্যানিলা এসেন্স, কর্নফ্লাওয়ার, চিনির গুঁড়ো আর একটু মাখন ভাল করে ফেটিয়ে ফুটিয়ে ঠান্ডা করে ঢেলে দিন ক্রাস্টে। আরও মনোহারী রূপ দিতে হুইপড ক্রিমের বাহারি ফুলেল সাজে সাজিয়ে দিন। রেফ্রিজারেট করে পরিবেশন করুন। আর বাড়িতে কাস্টার্ড পাউডার থাকলে তো কেল্লাফতে। একটু ঘন করে কাস্টার্ড বানিয়ে ঠান্ডা করে পাই ক্রাস্টে ঢেলে দিয়ে সেট করে নিন। হুইপড ক্রিমের বদলে রংবেরঙের ফল দিয়ে সাজিয়ে পাতে দিন পাই!
*ছবি সৌজন্য: tasteofhome.com, foodnetwork.com, Pinterest
বর্ণিণী প্রেসিডেন্সীর প্রাক্তনী। তারপর সাংবাদিকতায় আসা। চাকরির ফাঁকে রবীন্দ্রসঙ্গীতে স্নাতকোত্তর। দীর্ঘ ১৪ বছর সাংবাদিকতা করছেন। বাংলার একটি অন্যতম জনপ্রিয় সংবাদপত্রে বহুবছর কাজ করেছেন, কখনও ছোটদের পাতার দায়িত্বে, কখনও বা মেয়েদের বিশেষ পাতার দায়িত্বে। গান শোনা, গান গাওয়া, বই পড়া এবং নানা ধরনের মিষ্টি খাওয়াতে আগ্রহ।