লকডাউনের বাজারে বাস-ট্রাম-মেট্রো নেই, তাই লাট্টুর (নাম পরিবর্তিত) বাজারও খারাপ। যে কাজ করে তার দানাপানি, তার জন্য ভিড় দরকার। ভিড় মানেই পকেট এবং প্রব্যাবিলিটির কঠিন হিসেব শিরোধার্য করেও রোদ ঝলমল দিনে তার যা হয়, তাতে দিব্যি চলে যায়। বিছানার তোষকের নীচে তার ভল্ট। লাট্টুর নিজের জামা বা প্যান্টে পকেট নেই। এহেন ওস্তাদ প্যান্ডেমিকের বাজারে মুষড়ে পড়বে তা বলাই বাহুল্য। তারওপর স্যানিটাইজার ঘষে ঘষে হাতের তালুর যা দশা হয়েছে, বাজার খুললে পরের ধন হাতে আটকালে হয়। সুতরাং চিন্তায় রাতে ঘুম আসে না। ছুরি, কাঁচি, ব্লেডে মরচে পড়ে।

মুখের ভাষা ভোল পাল্টে বোতল থেকে সোজা গলায় নামে। লাট্টু যে সাতসকালে ঈষৎ টিপসি অবস্থায় গঙ্গার ঘাটে বসে রোমন্থন করে এটা সবাই জানে। কেউ তাকে ঘাঁটায় না, কারণ সে ওস্তাদ। এবং নতুন জেনারেশনের গুরুসম। কিন্তু সেদিন বৃষ্টিভেজা সকালে সে একটু বেশিই স্মৃতিমেদুর  হয়ে পড়েছিল, নাহলে খালি গা, গামছা-পরিহিত প্রাজ্ঞ পুরুতমশাইয়ের পকেট কেউ মারতে যায়? 

গামছার যে পকেট থাকে না, সে কথা হামাগুড়ি দেওয়া বাচ্চাও জানে। তবু লাট্টু পুরুতমশাইয়ের কোমরের কাছে হাতড়ে চলে। পুরুতমশাই তখন চোখ বন্ধ করে কালী, শনি, শিব ও রাধাকৃষ্ণর কমবো মন্ত্রোচ্চারণে ব্যস্ত। ওদিকে শ্লীলতা যায় যায়। পাড়ার ছেলেরা (অর্থাৎ লাট্টুর ছাত্রেরা) এসে তাঁকে উদ্ধার করে। সার্কিটে ওস্তাদের নামে ঢিঢি পড়ে যায়। পুরুতমশাই প্রথমে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেও করোনার ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে লাটটুকে ক্ষমা করেন এবং একটি প্রসাদী প্যাঁড়া দেন। লাট্টু বাড়িতে ফিরে (তখনও টিপসি) সেটি তোষকের খাঁজে রেখে দেয়। এই ঘটনার সত্যতা বিচার করতে গিয়ে জানা গেল যে যুগে যুগে লাট্টুরা কঠিন সময়ে (প্লেগ, মহামারি, দাঙ্গা, ধর্মঘট ইত্যাদি) এই মানসিক চাপের মধ্যে দিয়ে গেছে। এবং কোনও না কোনওদিন তারা গামছা, লুঙ্গি কিংবা ধুতি হাতড়েছে পকেটের সন্ধানে। পকেটমারের মতো পকেটেরও নাকি জাত-ধর্ম নেই। মেরে দিলেই হল। যাঁরা ট্যাক্স দেন তাঁরা এই সত্য অনুধাবন করেছেন, লাট্টুর অবিশ্যি সেই দায় নেই। সে হাতেকলমে এই শিক্ষা পেয়েছে।      

Pickpocket
পকেটমারের মতো পকেটেরও নাকি জাত-ধর্ম নেই। মেরে দিলেই হল

পকেটমার হতে গেলে যে স্কিলের প্রয়োজন, তা অনেক প্রফেশনেই প্রয়োজন হয় না। অথচ রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট-এর কোনও নিশ্চয়তা নেই। একটু এদিক-ওদিক হলেই শ্রীঘর অথবা পাবলিক ঠ্যাঙানি। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বে এই স্কিলের কোনও অ্যাপ্রিসিয়েশন নেই। অথচ প্রথম বিশ্বের দেশগুলিতে পকেটমারি শিল্পের মর্যাদা পেয়ে আসছে সেই ত্রেতা যুগ থেকে। সতেরোশো শতাব্দীর শুরু থেকেই পুরুষ এবং মহিলা পকেটমারের সংখ্যাবৃদ্ধি ইউরোপে, বিশেষ করে ব্রিটেনে। সেই সময় পকেট জামা বা প্যান্টের সঙ্গে জোড়া থাকত না। টাকা-পয়সার থলি পোশাকের গায়ে সেলাই করা থাকত। স্টাইল যেভাবে বদলেছে, চ্যালেঞ্জও বেড়েছে এবং পকেটমারের হাতের খেলাও পালটেছে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে। শুধু এই প্রফেশনে রিস্ক নেওয়ার মূল কারণটি এক-ই থেকে গেছে– অর্থাভাব।

চার্লস ডিকেন্সের অবিস্মরণীয় উপন্যাস ‘অলিভার টুইস্ট’-এর একটি চরিত্র ‘জ্যাক ডকিন্স’ পকেটমার। বইটি ১৮৩৮ সালে প্রকাশিত হয়। ড্যানিয়েল ডেফোর উপন্যাস ‘মল ফ্লানডারস’-এর প্রধান চরিত্র এক পকেটমার। এই উপন্যাসের প্রকাশকাল ১৭২২। বিখ্যাত ফরাসি চিত্রপরিচালক রবার্ট ব্রেসোঁর সিনেমা ’পিকপকেট’ মুক্তি পায় ১৯৫৯ সালে। সিনেমাটি এখনকার সমালোচকরাও একটি ক্লাসিক হিসেবে গণ্য করেন। সিনেমার শেষার্ধে নায়ক মিশেল রেসের মাঠে সাদা পোশাকের পুলিশের কোটের পকেটে রাখা গোছা গোছা টাকা আত্মসাৎ করতে গিয়ে ধরা পড়ে। সে কিন্তু বুঝতে পেরেছিল ফাঁদ পাতা আছে, তবু এক জটিল মনস্তত্বের তাড়নায় সে হাত বাড়ায় টাকার দিকে। এখনও প্রথম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এথিকাল পকেটমারির শো হয়। জনতা নগদ খরচা করে টিকিট কেটে নিজেদের পকেট ফাঁক করতে আসে। এই পকেটমাররা পারফরমার হিসেবে স্বীকৃত হন। ডাল-চালের জন্য তাদের লাট্টুর মত গামছা হাতড়াতে হয় না।

পকেটমার কখনও একক শক্তি, কখনও বা সঙ্ঘবদ্ধ। পাবলিক ট্রান্সপোর্টে তারা স্বচ্ছন্দ অথবা বাস স্ট্যান্ডে, স্টেশনে, এমনকী শেয়ার ট্যাক্সিতেও। যাঁদের পকেট ফাঁকা হয় তাঁরা পুরুষ হলে প্যান্টের অথবা জামার দোষ দেন, আর মহিলারা মূলতঃ হ্যান্ডব্যাগের চেনের। কখন, কোন পরিস্থিতিতে   কোন দেশীয়, জাতীয়, আবালবৃদ্ধ বা বনিতা কাস্টমার এসে পড়বে সে ব্যাপারে আগাম ধারণা করার কোনও সুযোগ না থাকায় পকেটমারদের সবরকম স্কিলই আয়ত্ত করতে হয়। পকেটে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনা, পকেটের বোতাম খুলে তারপর অন্বেষণ, ব্যাগের চেন কাটা ইত্যাদি স্কিল শেখার জন্য নাকি তাদের স্কুল আছে, যেখানে মাস মাইনে দিয়ে পড়তে হয়। ৯৯% পেলে তুমি একাই বাঘ, নাহলে শেয়ালের মতো দলে ভিড়ে ব্যবসা ধরতে হবে। লং ডিস্ট্যান্স দৌড় প্র্যাকটিস করা প্রয়োজন এবং রানিং বাস-ট্রাম থেকে লাফিয়ে নামা। ল্যাম্পপোস্টের গায়ে বাঁধা অবস্থায় মার খাওয়ায় পারদর্শী হলেও ত্রিফলার জন্য নতুন করে বডি বানাতে হবে। মাসের পর মাস অনুশীলনের পরই পাতে দেওয়ার মতো পকেটমার হওয়া সম্ভব। 

প্রথম বিশ্বের দেশগুলিতে পকেটমারি শিল্পের মর্যাদা পেয়ে আসছে সেই ত্রেতা যুগ থেকে। সতেরোশো শতাব্দীর শুরু থেকেই পুরুষ এবং মহিলা পকেটমারের সংখ্যাবৃদ্ধি ইউরোপে, বিশেষ করে ব্রিটেনে। সেই সময় পকেট জামা বা প্যান্টের সঙ্গে জোড়া থাকত না। টাকা-পয়সার থলি পোশাকের গায়ে সেলাই করা থাকত। স্টাইল যেভাবে বদলেছে, চ্যালেঞ্জও বেড়েছে এবং পকেটমারের হাতের খেলাও পালটেছে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে। 

এই ব্যবসায় আর একটি সমস্যা হল টার্নওভার। বিশেষ করে আমাদের মতো দেশে। একে মধ্যবিত্ত ছাড়া কেউ বাসে-ট্রামে চড়ে না, তাও কিছুদিন আগে পর্যন্ত যে ক্যাশ পাবলিক সঙ্গে রাখত, ডিজিটালের চাপে সেখানেও হাত পড়েছে। গরিব দেশে রাজনীতি করলে বোধহয় এর চেয়ে বেশি লাভ। ড্রোন উড়িয়ে পকেট থেকে টাকা তুলে নেওয়া যাবে। এসি ঘরে বসে শুধু ক্যাশ গোনো। প্রথম বিশ্বে, বিশেষ করে ইউরোপে, এই সমস্যা নেই। সচ্ছ্বল জনগণও বাস-মেট্রো চেপে অফিস-বাড়ি করে এবং সঙ্গে ক্যাশ না পেলেও ঘড়ি, মোবাইলে পুষিয়ে দেয়। সেই কারণে ওই দেশগুলোয় হাতের কাজও অন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে। রোজগার বেশি তাই শেখার উদ্দীপনাও বেশি। ব্যবসার রমরমা।

সুইডেন থেকে মহিলা বিজ্ঞানী মিলানে এসে পৌঁছলেন। বাসে করে এদিক ওদিক। একটু দ্য ভিঞ্চি তো এট্টুস ডলচে গাবানা। ক্লান্ত পায়ে ফুটপাথে ক্যাফে। বিল মেটাতে গিয়ে চোখ কপালে। ভ্যানিটি ব্যাগের ভিতর থেকে পার্সটি হাওয়া। আবার যত্ন করে চেনও টেনে দিয়েছে। ওদিকে প্যারিসে মেট্রোয় চাপার ঠিক আগে হিপ পকেট হাল্কা লাগে এক মার্কিন বাঙালি ইঞ্জিনিয়ারের। ঘুরেই দৌড়। ওই পালাচ্ছে… ধর, ধর। কিন্তু ইঁদুর দৌড়ে চ্যাম্পিয়নের এই দৌড় অভ্যাস নেই। হাঁফ ধরে। সেই ফাঁকে ক্রেডিট কার্ডে হাজার ডলার চোখ রাঙায়। ওদেশে ওটিপির ব্যাবস্থা নেই। 

অথবা ভোম্বলদা। পাড়ার রকে বসেছিলেন। মুখে পান, হাতে চারমিনার। ওপাড়া থেকে এসে তুলে নিয়ে গেল ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস। সোজা রোম। যৌবনে যত পাপ করেছেন ভাটিখানায়, ধুয়ে ফেলবেন পোপের ছোঁয়ায়, ভ্যাটিকানে। বাসের লাইনে একটু সরে দাঁড়িয়েছিলেন। শিশু কোলে ক্রন্দনরতা এক মহিলা এলেন। দুর্বোধ্য ভাষায় কী সব চাইছেন আর চাদরের খুঁট দিয়ে চোখের জল মুছছেন। ভোম্বলদা মনোবেদনায় কাতর হলেন এবং একটু কাতও। স্লিং ব্যাগ থেকে খুচরো বের করার জন্য। পরমুহূর্তে তিনি চাদরে আবৃত এবং শরীরের ঊর্ধ্বাংশে দুটি হাত যেন কাতুকুতু দিচ্ছে। ভোম্বলদা হাসতে হাসতে পাসপোর্ট খোয়ালেন। আর কয়েকটি কড়কড়ে ইউরো।  

Pickpocket
পকেট কাটা পড়লে মহিলারা দোষ ধরেন হ্যান্ডব্যাগের চেনের

মধ্যবিত্তের দুই প্রধান দোষ– অম্বল ও আক্ষেপ। ছোটবেলা থেকে সে দেশ-বিদেশের পকেটমারির গল্প শোনে আর হতাশায় জেলুসিল খায়। হায়! আমার কেন পকেটমারি হয় না! সে নিজে পকেটমার হতে পারবে না কোনওদিন। কিন্তু তা বলে এইটুকু অভিজ্ঞতাও সঞ্চয় করতে পারবে না? পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কী রেখে যাবে তাহলে? লোকে বলে, বিয়ে করলে ভাগ্য ফেরে। তাই সে বিয়ের তোড়জোড় করে। একদিন হয়েও যায়। বউ যায় বাপের বাড়ি। সে প্রেমের তাড়নায় রানাঘাট লোকালে চেপে বসে। উল্টোডাঙা স্টেশন থেকে। 

তালেগোলে ভেন্ডর কামরায়। ডান পকেটে মানিব্যাগ, বাঁয়ে মোবাইল ফোন। সে নিজে, ভিড়ের চাপে স্থাণু। দমদমে ভিড় বাড়ে। ধাক্কা সামলাতে দুই হাতে রড চেপে ধরতে হয়। ঊর্ধ্ববাহু হয়ে মনেও আকুতি আসে। ওদিকে পকেটে খুসখুস। বাঁ পকেট। জান থাকতে ফোন দেবে না। কোনওরকমে একটা হাত বেঁকিয়ে পকেটে ঢোকায়, মোবাইল চেপে ধরে। একটা ভিনগ্রহী আঙুলও আছে যেন। চিপে দেয়। উঃ। বেলঘরিয়া স্টেশনে চলন্ত ট্রেন থেকে কারা নেমে যায়। ঠাহর হয় ডান পকেট খাঁ খাঁ। বাঁ হাতে সবেধন ফোন নিয়ে জামাই ইন-লজ়ের দরজায় টোকা মারে। মুখে দিগ্বিজয়ের হাসি।

 

*ছবি সৌজন্য: Freepic, Alamy Facebook

অনুব্রত নামী বহুজাতিক সংস্থায় অতি উচ্চপদে আসীন ছিলেন। কিন্তু মনে মনে এখনও স্কটিশের সেই লেখা-পাগল ছাত্রটি। লেখালিখি তাঁর হাড়ে-মজ্জায়। নিয়মিত লেখেন পত্রপত্রিকায়। শখ, সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ানো আর ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *