সপ্তাহ দুয়েক আগে একটি ইউরোপীয় সংবাদপত্রকে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন চিলির প্রেসিডেন্ট সেবাস্তিয়ান পিনিয়েরো। তিনি বলেছিলেন, ‘ল্যাটিন আমেরিকার দিকে তাকান। আর্জেন্টিনা আর প্যারাগুয়েতে মন্দা চলছে, মেক্সিকো এবং ব্রাজিলে অর্থনীতি থমকে দাঁড়িয়ে, পেরু ও ইকুয়েডর গভীর রাজনৈতিক সঙ্কটে, এই প্রেক্ষাপটে চিলিকে দেখে মনে হয় মরূদ্যান, কারণ আমাদের গণতন্ত্র সুস্থিত, অর্থনীতির সমৃদ্ধি ঘটছে, আমরা কর্মসংস্থান তৈরি করছি, কর্মীদের মাইনে বাড়াচ্ছি এবং আমরা সামগ্রিক অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছি।… এটা কি সহজ কাজ? না, সহজ নয়। কিন্তু এর জন্য লড়াই চালানো সার্থক।’

পক্ষকালও কাটেনি, পিনিয়েরোর গদি টলমল করছে। তিনি গোটা মন্ত্রিসভাকে পদত্যাগ করতে বলে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। এবং সোমবার স্বীকার করেছেন, ‘গত এক সপ্তাহে চিলি পাল্টে গেছে।’

এই পরিবর্তনের সূত্রপাত আপাতদৃষ্টিতে দিন দশেক আগে। শুরু হয়েছিল মেট্রো রেলের ভাড়া বাড়ানো নিয়ে। ভাড়া বাড়ানো হয়েছিল ৩০ পেসো। পেসো হল চিলির মুদ্রা। মোটামুটি ৭০০ পেসো দিলে ১ ডলার পাওয়া যায়। তার মানে, বোঝাই যাচ্ছে, ভাড়াবৃদ্ধির অঙ্কটা খুব কম। পঞ্চাশের দশকে কলকাতায় এক পয়সা ট্রাম ভাড়া বাড়ানোর বিরুদ্ধে বিরাট আন্দোলন হয়েছিল, আগুন জ্বলেছিল। সেই সময়কার কলকাতায় এক পয়সার তুলনাতেও এখনকার চিলিতে ৩০ পেসোর দাম অনেক অনেক কম। কিন্তু ওই যে একটা কথা আছে— ‘লাস্ট স্ট্র’। বোঝা বাড়তে বাড়তে এমন একটা পরিস্থিতিতে পৌঁছয় যখন আর একগাছি খড় চাপালেও সেটা অবহনীয় হয়ে যায়। দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম প্রান্তে সাড়ে চার হাজার কিলোমিটার লম্বা আর দুশো কিলোমিটারেরও কম চওড়া, এক ফালি লঙ্কার মতোই দেখতে ওই দেশটিতে সেটাই ঘটেছে। বহু দিন ধরে লোকের মনে যে ক্ষোভ জমছিল, ওই ৩০ পেসোর ধাক্কাতেই তা ফেটে পড়েছে। ক্ষোভ ছিল নানা ব্যাপারে। জ্বালানির খরচ বেড়েই চলেছে, স্কুলকলেজে পড়াশোনার খরচ আকাশছোঁয়া, চিকিৎসার ব্যয়ও তথৈবচ, সেই তুলনায় মজুরি কম, পেনশন সীমিত। আর তার পাশাপাশি বিপুল আর্থিক বৈষম্য। ল্যাটিন আমেরিকা জুড়েই বৈষম্য বেশি, তার মধ্যে আবার চিলি একেবারে প্রথম সারিতে, বড়লোক মানে সেখানে অস্বাভাবিক বড়লোক, অধিকাংশ মানুষের থেকেই তাদের আর্থিক অবস্থা অনেক অনেক ওপরে। চিলির গড় জাতীয় আয় ভাল, কিন্তু সেই গড়ের আড়ালে আছে ওই বিরাট ফারাক। ক্ষোভের বারুদস্তূপ বিরাট উঁচু হয়েছিল, তাতে অগ্নিসংযোগ করল ৩০ পেসো।

প্রথমে সান্তিয়াগো শহরে ছাত্রদের বিক্ষোভ, তার পরে দেখতে দেখতে সেই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে দেশের অন্য শহরগুলিতেও, তাতে যোগ দেয় শ্রমিক, নিম্ন মধ্যবিত্ত, বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সংগঠন। শেষ পর্যন্ত এই শুক্রবার সান্তিয়াগোতে এক জনসমাবেশ হয়, সরকারের হিসেবেই তাতে যোগ দেয় দশ লক্ষ মানুষ। আসল সংখ্যাটা আরও অনেক বেশি। প্রথম কয়েক দিন সেবাস্তিয়ান পিনিয়েরোর সরকার রক্তচক্ষু দেখিয়ে এই আন্দোলন দমনের চেষ্টা করেছিল— লাঠি, গুলি, পুলিশের পাশে সেনাবাহিনী, রাত্রিবেলায় কারফিউ, আপৎকালীন অবস্থা, বেশ কিছু মানুষ নিহত, আহত আরও অনেকে, কয়েক হাজার গ্রেফতার। অবশেষে প্রমাদ গুনেছেন পিনিয়েরো। ট্রেনের ভাড়াবৃদ্ধি আগেই রদ হয়েছিল, আরও নানা দাবিদাওয়াও মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি, তাতেও যখন আগুন নিবল না, তখন তিনি ঘোষণা করলেন মন্ত্রিসভার সব সদস্য পদত্যাগ করছেন, তিনি সরকারকে ঢেলে সাজাবেন, সরকারি নীতিও বদলাবেন। জরুরি অবস্থাও প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে।

আন্দোলন এতে থামবে কি না, বলা শক্ত। পিনিয়েরো তাঁর গদি রক্ষা করতে পারবেন কি না, সেটাও অনিশ্চিত। সবচেয়ে কঠিন এ কথা বলা যে, এই আন্দোলনের ধাক্কায় বড় রকমের কোনও নীতি পরিবর্তন ঘটবে কি না। কিন্তু সে সব ভবিষ্যতের কথা। আপাতত চিলির প্রতিবাদী মানুষ বলতেই পারেন, তাঁরা হার মানেননি, সরকারকে মাথা নোয়াতে বাধ্য করেছেন। সেটা কম কথা নয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *