দু’হপ্তার ওপর হয়ে গেল গোটা ভারতবর্ষ লকডাউন। বাঙালির তালাবন্ধ জীবন মোটে ভালো লাগে না। রান্নাঘর ছাড়াও বাঙালির পায়ে এত সর্ষে ছিল জানতাম না। আলসে দুপুরে কবিতা লেখা ল্যাদখোর বাঙালির বিপ্লবী মার্কা স্বপ্ন দেখা, দক্ষিণী সিনেমা দেখার বদভ্যাস, লুকিয়ে চুরিয়ে নীলছবি-চর্চা, এসব বরাবরই ছিল। আজ যেন হঠাৎই সব কিছু থমকে গিয়েছে। ঘরের ভেতরও বাঙালি যেন আপাদমস্তক লকডাউন। “কী করি আর ভেবে না পাই, পথ হারিয়ে কোন বনে যাই” গুনগুন করতে করতে দাড়ি চুলকে অর্ধ-কনফিউজড এই সভ্য হোমো স্যাপিয়েন্স গভীর ভাবনায় উপলব্ধি করার চেষ্ঠা করছে “পোড়া দেশটার কী হবে!” যে কখনো ভাবেনি দেশের কথা, ভাবেও না, আদ্যোপান্ত মাছের ঝোল খাওয়া এই জাতির সন্ধ্যার চপ-কালচার থিতু হয়ে পড়েছে। শুকনো মুড়িতে আশ না-মেটা এই শান্ত প্রজাতির নেশাকর্মে ক্রাইসিস ঘটেছে। ভাটিশালা মাটি হয়ে যাওয়ায় কাঠি করতে লেগে পড়েছে ফোনে। সিগারেটের সাপ্লাইয়ে ব্যঘাত ঘটায় লোকাল ডিস্ট্রিবিউটার ও দোকানদাররা খিস্তি খাচ্ছে দেদার। ছ’টাকার গোল্ড ফ্লেক সাত-আট টাকায় ছাড়ছে। পুরনো স্টকের মালও বেশি দামে বিক্রি করছে স্থানীয় দেবুদা, নিতাইদাদের মতো ব্যাবসায়ীরা। 

সকাল সাতটা-আটটা থেকে একটা-দেড়টা পর্যন্ত স্থানীয় বাজার চত্বর লোকারণ্য থাকছে, যেন সেই সময়টায় করোনা ঘুমন্ত থাকে। ভিড় হলে নো প্রবলেম। যেন, একটার পর বাবাজি রাস্তায় বেরোবেন ঘাড় মটকাতে। গৃহকর্মী মালতীর মা, পচার মা-রা এখন ছুটিতে। কাজে আসছে না। ফলে ঘরের মা-কাকিমা দের চাপ বেড়ে গিয়েছে। ফোনে ফোনে মা মাসিদের রেসিপি সাপ্লাই হচ্ছে। এ মরণ সংগ্রামের দিনে যুগে যুগে ফেলে দেওয়া আলুর খোসাও হয়ে উঠতে পারে আপনার আজকের দুপুরের কন্টিনেন্টাল ডিশ!  

অপব্যয়ের হিসেব কষে ফিরিস্তি দিতে শুরু করেছেন বাজার চলতে দেখা হয়ে যাওয়া প্রতিবেশি ভদ্রমহোদয় কাকা জ্যাঠারা। “আর বলবেন না দাদা, এই আকালের সময়ে ছেলে মেয়েদের কোনো জ্ঞান বুদ্ধি হল না মশাই! খাবারের বায়নাক্কা কমে না! এটা খাবো না ওটা খাবো না ! ওরে দু’দিন বাদে তোর বাপ যে আর খাওয়াতে পারবে না, একটু বোঝার চেষ্টা কর”…. এই জাতীয় বাক্যালাপ পাড়ার দুই কাকুর মধ্যে, বাবা-জ্যাঠার মধ্যে আপনি শুনবেন মধ্যবিত্ত বাঙালি ঘরে। ছাদে উঠে আকাশটা দেখবেন, কী ফর্সা দেখাচ্ছে ক’দিন ধরে। ঝকঝকে, সজীব এই মেঠো বসন্তের মেঘমালা দিয়ে গাঁথা ভারতবর্ষের আকাশ কত প্রাণবন্ত। যেন কলকারখানার দস্যুর হাত থেকে রেহাই পেয়ে তৈরি করেছে শান্ত বীথিপথ। 

সুমনের গান যেন পাল্টে গেল এক লহমায়। এই ফাটকাবাজির দেশে স্বপ্নের পাখিগুলো বেঁচে উঠল! নির্জীব, নিশ্চল শহুরে করোনার কয়েক সেকেন্ডে থামিয়ে দেওয়া এই “ব্রহ্মাণ্ড” ঘটকের কথা অনুযায়ী পুড়ছে ঠিকই, কিন্তু শুদ্ধ করে দিল ছোট ছোট যাপনের একাকী মুহূর্তগুলো।  

পরিবারের সব লোকজন আজ একঘরে। ভাবা যায়! যে বাড়ির চরম দুর্দিনেও ঘরের সব ব্যাটা একমুখো হয় না, তারা আজ এক সঙ্গে এক ভাবে এক জায়গায় ঘুম থেকে উঠছে ও ঘুমোতে যাচ্ছে। সকালের কচুরি কালচারে অভ্যস্ত ছেলেমেয়েদের শিরে সংক্রান্তি। যদিও শোনা গেল কিছু কিছু মিষ্টির দোকান এবার থেকে খোলা থাকবে। তাতে রবিবার সকালে জিলিপি আগমনের একটা হালকা সুসংবাদ আছে। খবরের কাগজ অনেক জায়গায়ই বন্ধ ছিল, কিন্তু এখন দিচ্ছে নিয়মিত। কুড়ি বাইশ পাতার আনন্দবাজার কয়েকদিনের জন্য ন’দশ পাতা হয়ে গেল। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে লোকাল চায়ের ঠেকে যাওয়া পাড়ার বুদ্ধিজীবী কাকুদের বাণী প্রচার লকডাউন হয়ে যাওয়ায় পাঁচ মিনিটের জায়গায় কুড়ি মিনিট বাথরুমে থাকেন এখন। তারপর অনেক্ষণ বাদে বেরিয়ে এসে চায়ের পেয়ালা হাতে খবরের চ্যানেল খোলেন তাঁরা। 

মাঠভর্তি হুল্লোড় চলত যে একরাশ কচি ছেলেমেয়েদের পায়ের ধুলোয়, নিষ্প্রাণ, নিশ্চুপ, শান্ত সেই সুবিস্তীর্ন প্রান্তর একাকী কোয়ারেন্টিন যাপন করছে। এই ভাবে একফালি বিকেল ভেঙে সন্ধ্যা নামার মুহূর্তগুলো পাল্টে গেল হঠাৎ করে। নিত্য সংগ্রামী, খাটুনি মানুষগুলোর ঘেমো গন্ধওলা সুবিখ্যাত সেই বনগাঁ লোকাল, হাসনাবাদ লোকাল নিয়ম করে আর চলছে না। এক সেকেন্ডে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তোলপাড় করে দেওয়া, প্রেসিডেন্ট, চিফ মিনিস্টার সবাইকে নাচিয়ে তোলা, লাখখানেক বিশ্ববাসীর প্রাণ কেড়ে নেওয়া এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র চিনা আগন্তুক বাঙালির পায়ের তলার আটপৌরে নিকোনো উঠোন সরিয়ে নিতে চলেছে! 

ভীত, সন্ত্রস্ত আপামর বদহজমে ভোগা ষাটোর্ধ্ব প্যানিকগ্রস্ত মেসোমশাই, পিসেমশাই, জ্যাঠামশাইরা চাপ খেয়ে গেল বেশি। 

“আমি শুনেছি তোমরা নাকি এখনও স্বপ্ন দেখ, এখনও গল্প লেখ গান গাও প্রাণ ভরে”… ওরা কি ফেলে আসা দিনগুলোর কথা ভাবছে! ফেলে আসা বিপ্লবের সঙ্গে তুলনা করছে এই বিশ্বযুদ্ধের? নাকি এটা কোনও যুদ্ধ নয় আদৌ। সেনা মজুত নেই, ঘোড়সাওয়ার নেই, পাইক বরকন্দাজ নেই! আছে খালি সরকারি হাসপাতালে নার্স ও ডাক্তারা। কিন্তু ওরা সৈনিকের থেকে কম কিছু কি? অপর্যাপ্ত মাস্ক, পিপিই, টেস্টিং কিট, এত অভাবলাঞ্ছিত যন্ত্রণাবিদ্ধ সময়ে রেগুলার হাসপাতালের অসুস্থ, বুনো গন্ধ গায়ে মেখে কাজ করে যাওয়া প্রত্যেক চিকিৎসক আজ নতুন তীর্থের সংগ্রামী। এসো কড়িবরগার নীচে খড়খড়ি ফাঁক করে অন্তরমহলেই গেয়ে উঠি “we shall overcome!”

অশান্ত জোৎস্নালোকে নিভু নিভু হুতাশন পৃথিবীতে ক্রমে আলো আসুক।

ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজে পেইন্টিং বিভাগে পাঠরত। আধুনিক বাংলা কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ পড়তে ভালোবাসেন। এ ছাড়া দেশবিদেশের সিনেমা দেখার নেশা। রবীন্দ্রনাথের গানগুলো আরো গভীর ভাবে জানার চেষ্টা। রোজকার জীবনের ছোটো ছোটো টুকরো বিষয় নিয়ে লেখালিখি। কিন্তু এগুলো কোনওটাই অবসরযাপন হিসেবে নয়, রোজকার কাজ ভেবেই ধরি। তাই অবসরের শখ বলতে বন্ধুমহলে তর্ক-বিতর্ক-আড্ডা দেওয়া।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *