২৭ বছর বয়সী, একটু গোলগাল শ্রাবণী হাঁসফাঁস করে চেম্বারে ঢুকল। হাঁপাতে হাঁপাতে কোনওমতে বলল, 

– “ডাক্তারবাবু, আমার সিস্ট হয়েছে।

মাঝে মাঝে মাথায় বদবুদ্ধি চাগাড় দেয়; আবার মাঝে মধ্যে হাল্কাচালে কথা বলি রোগীর দুশ্চিন্তা কমানোর জন্যে। ক্ষেত্রে দুটোই কাজ করল, “মাথায় সিস্ট হয়েছে? নাকি …”

–  “ডাক্তারবাবু, আমি মরছি আমার নিজের জ্বালায়, আর আপনি মজা করছেন?”

– “একদম না। আপনি যে সিস্টের কথা বলছেন তাশরীরের বহু জায়গায় হতে পারেমাথায়, মুখে, লিভারে, কিডনিতে এবং আরও অনেক জায়গায়।

– “আমার ওভারিতে সিস্ট হয়েছে।

– “ওভারিতে অনেক রকম সিস্ট হতে পারে, ডারময়েড সিস্ট (Dermoid cyst), সিস্টএডেনোমা (Cystadenoma), চকোলেট সিস্ট (Chocolate Cyst), আরও কত রকমের।আমার মনে হয়েছে, এই ভাবে বললে, ভুল ধারণাকে দূর করা সহজ হয়

– “কিন্তু ডাক্তারবাবু, আলট্রাসাউন্ড তাই বলছে

– “শুনুন, শরীরে তরল পদার্থ ভরা অংশকে সিস্ট বলে, ঠিক যেন, জল ভরা বেলুন। আপনি বরং বলুন, আপনার অসুবিধে কী; তাতে আমার বুঝতে সুবিধে হবে।

– “ডাক্তারবাবু, আমার সন্তান চাই। আমার ওভারিতে কিছু একটা সিস্ট আছে, আমার বান্ধবী সীমার পলিসিস্টিক ওভারি আছে, ডাক্তার বলেছে PCOS, আর বলছে যে স্বাভাবিক ভাবে গর্ভবতী হতে পারবে না। সব শুনেই তো আমি চিন্তিত।

– “আপনি শুধু শুধু চিন্তা করবেন না। আমাকে আগে বুঝতে দিন আপনার ঠিক কী হয়েছে। আপনার কথা অনুযায়ী PCO অথবা PCOS, না কি অন্য কোনও কারণ আছে যার জন্যে আপনি গর্ভবতী হতে পারছেন না।” 

– “তার মানে PCO আর PCOS আলাদা?”

– “অবশ্যই। আর আপনার বান্ধবী সীমাকে বলবেন যে PCO অথবা PCOS থাকলেও স্বাভাবিক ভাবে গর্ভবতী হওয়া সম্ভব যদি অন্যান্য সব কিছু ঠিক থাকে।

এই ধরনের ভুল ধারণা রোগীদের মধ্যে প্রায়শই দেখতে পাই। একজন পূর্ণবয়স্ক মহিলার প্রতি মাসে ওভারি থেকে একটা ডিম্বাণু নির্গত হয় ওভারিতে থাকা একটা জলীয় পদার্থ ভরা থলি থেকে। এই ডিম্বাণুটা ফ্যালোপিয়ান নালীতে প্রবেশ করে। সেই সময় যদি স্বামীর সাথে দৈহিক সংসর্গ হয় তাহলে গর্ভধারণ হতে পারে। ওভারি দুধরনের হরমোন তৈরি করে; ডিম্বাণু নির্গমনের আগে ইস্ট্রোজেন (Estrogen) আর পরে প্রজেস্টেরোন (Progesterone)। মহিলা যদি গর্ভবতী না হন, তাহলে এই দুই হরমোনের যুগলবন্দীতে ঋতুস্রাব হয়। যদি ডিম্বাণু নির্গত না হয়, তাহলে জলীয় পদার্থ ভরা থলিসুদ্ধু ডিম্বাণু থেকে যায় ওভারিতে। মাসের পর মাস এই অবস্থা চলতে থাকলে যা হয় তা পলি (বহু) সিস্টিক ওভারি (PCO)। যেহেতু ডিম্বাণু নির্গত হয় না, তাই প্রজেস্টেরোন হরমোন তৈরিও হয় না। ইস্ট্রোজেন হরমোন বিরহের একক সঙ্গীত গায়, তাই ঋতুস্রাব নাও হতে পারে

– “হ্যাঁ ডাক্তারবাবু, মাসের পর মাস আমার পিরিয়ড হয় না।

– “আর সেই সঙ্গে মুখে, বুকে অত্যাধিক লোম দেখা যেতেও পারে।

– “ঠিক বলেছেন। সীমার গালে দাড়ির মতো আছে। আচ্ছা, সীমা কি কোনওদিন গর্ভবতী হতে পারবে?”

– “আমার পক্ষে এই বিষয়ে মতামত দেওয়া খুবই অসুবিধাজনক। আমি তো ওঁর সম্বন্ধে বিশদে কিছুই জানি না। গর্ভধারণ না করার অন্য কারণও থাকতে পারে।

আসলে এই ধরনের মহিলাদের ক্ষেত্রে, পুরুষ হরমোন বেশি পরিমাণে থাকে। এর সঙ্গে যোগ হয় ডিম্বাণু নির্গত না হওয়ার কারণ, ফলে সন্তানধারণ সম্ভব হয় না

– “কারুর যদি পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম (PCOS) থাকে, তাহলে তার সঠিক চিকিৎসাবিধি মেনে চলা উচিত, না হলে ভবিষ্যতে ডায়াবিটিস এবং অন্যান্য বিপাকীয় (metabolic) কিছু অসুখ হতে পারে।

– “তাই বুঝি! সিন্ড্রোম কী?”

– “ হ্যাঁ, তাই। সিন্ড্রোম হলো বিভিন্ন অসুখের লক্ষণ, যেগুলি একই সঙ্গে উপস্থিত থেকে নির্দিষ্ট কোনও অসুখের প্রতি দিকনির্দেশ করে। পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোমএর সঠিক কারণ এখনও আমাদের অজানা, তবে কিছু কিছু ধারণা/অনুমান করা হয়; বংশগতি, ইন্সুলিন হরমোন প্রতিরোধ এবং শারীরিক স্থূলতা এর সম্ভাব্য কারণ হতে পারে

– “ডাক্তারবাবু, PCOS হলে কী করা উচিত?”

– “বেশি ওজন থাকলে তা কমাতে হবে, ফাস্ট ফুড বা জাঙ্ক ফুড খাওয়া উচিত নয়, প্রতি দিন অন্তত ২০ মিনিট জোরে হাঁটা, অ্যারোবিক ব্যায়াম, আর অবশ্যই ডাক্তারবাবুর কথা শুনে চলা।

– “তাহলে বলছেন, আমার যদি PCOS থাকে তাহলে দুশ্চিন্তার কিছু নেই?”

– “অবশ্যই নেই। জানবেন, দুশ্চিন্তা অসুখ সারায় না। সঠিক সুস্থ জীবন যাপন করুন, আনন্দে থাকুন আর ডাক্তারবাবুর কথা মেনে চলুন। জীবন আপনাকে সব দেবে

ছবি সৌজন্য: Mymed

Ashok kumar Ghosh Author

স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, পাহাড়িয়া এবং ভ্রামণিক, আলোকচিত্র শিল্পী (জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রাপ্ত), ললিত কলা একাডেমী পুরস্কার প্রাপ্ত (অনার মেন্সান), ‘Federation International de la Arte Photograhoque’ থেকে Excellence Honors প্রাপ্ত (EFIAP)। এছাড়াও তিনি একজন প্রকৃতি প্রেমিক ও পুষ্পপ্রেমিক। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের পুষ্প প্রদর্শনীর বিচারক। ওঁর লেখা প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়।

12 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *