মাতৃত্ব বোধহয় সব মেয়ের জীবনেই অন্যতম সুন্দর অধ্যায়। বাড়িতে ছোট একজন সদস্য আসছে, এই খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একজন মহিলা আস্তে আস্তে মা হয়ে ওঠেন। শিশুকে নিয়েই তখন তাঁর চাওয়া-পাওয়া। যে এখনও আসেনি, তাকে ভাল রাখার জন্য় ওয়ার্কাহলিকরাও নিয়ম মেনে খাওয়াদাওয়া করেন, পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমোন, স্ট্রেস থেকে নিজেকে দূরে রাখেন। আর ন’মাস পর যখন তার আবির্ভাব হয়, তখন সদ্য মা হওয়া মেয়েটির যেন নব জন্ম হয়। বাচ্চার খাওয়া, ঘুম, তার ভাল থাকাটাই প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। নিজের ইচ্ছে, চাহিদা,আকাঙ্ক্ষাগুলো কেমন করে যেন ব্যাকফুটে চলে যায়। যে মেয়েটা হয়তো বাথরুমে পাক্কা এক ঘণ্টা থাকতো, সেই আজকে কোনওরকম স্নান সেরে বেরিয়ে আসে। যাঁর হয়তো মাসে দু’বার পার্লার না গেলেই চলত না, তাঁর এখন আর রূপচর্চায় কোনও মন থাকে না। তাঁর যাবতীয় সুখ শুধুমাত্র এখন সন্তানকে কেন্দ্র করে।

তবে মা হয়ে ওঠার রাস্তাটা বোধহয় সব সময় এত মসৃণ হয় না। অনেকেই হঠাৎ করে তাঁর বদলে যাওয়া পৃথিবীর সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেন না। ন’মাস সকলের আকর্ষণের মধ্যমণি থাকার পর যখন সমস্ত মনোযোগ বাচ্চার উপর এসে পড়ে, তখন তাঁরা চট করে এই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেন না। তখন মন খারাপ লাগে, কথায় কথায় কান্না পায়, সন্তানের সঙ্গে সময় কাটাতেও ইচ্ছে করে না। মন জুড়ে তখন শুধুই অবসাদ। ডাক্তারি পরিভাষায় একই বলে পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশন। কারও ক্ষেত্রে কাউন্সেলিং করাতে হয়, কারও আবার নিজের থেকেই সময়ের সঙ্গে মনের মেঘ কেটে যায়।

অনেকেই ভাবেন মাতৃত্বের সঙ্গে কোনওরকম নেতিবাচক আবেগের সম্পর্ক থাকতে পারে না। এ শুধুই এক সুন্দর অনুভূতি। কিন্তু দেখা গেছে মাতৃত্ব স্ট্রেসের অন্যতম কারণ হতে পারে। আসলে একজন সন্তানকে তিলে তিলে পরম আদরে বড় করা, সারাক্ষণ তার সুবিধে-অসুবিধের কথা ভাবা, নিজের খেয়াল না রাখা, সব মিলিয়ে মাদের স্ট্রেস হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কারণ সব মা-ই চান নিজের সন্তানকে শ্রেষ্ঠটা দিতে।  অথচ এই স্ট্রেসের কারণেই নষ্ট হয়ে যেতে পারে মা আর সন্তানের সম্পর্ক। অজান্তেই তৈরি হয়ে যায় দূরত্ব। সম্প্রতি এক গবেষণাতে এই চাঞ্চল্যকর তথ্যই উঠে এসেছে।

সিঙ্গাপুরের ‘নানইয়াং টেকনলজি ইউনিভার্সিটি’-র গবেষকরা জানতে চেয়েছিলেন যে আদৌ মা ও সন্তানের সম্পর্কে স্ট্রেসের কোনও ভূমিকা আছে কি না। ইউনিভার্সিটি সহকারী অধ্যাপক ও গবেষণার অন্যতম লেখক গিয়ানলুকা এসপোসিটো জানিয়েছেন, ” আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি যে অতিরিক্ত পেরেন্টিং স্ট্রেসের কারণে মা ও সন্তানের মধ্য়ে যোগোযাগ বিচ্ছিন্ন হতে পারে। বাচ্চা যখন সবে বাইরের সমাজে মিশতে শিখছে, এই সময় যদি মা-র মধ্যে বাচ্চাকে বড় করা নিয়ে খুব বেশি মাত্রায় স্ট্রেস দেখা যায়, তা হলে তা মা এবং সন্তানের সম্পর্কে প্রভাব পড়তে পারে। অনেক সময় মায়েরা তখন বাচ্চার দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে পারেন না। এতে কিন্তু বাচ্চার মনের উপর চাপ পড়ে এবং এ ভাবে চলতে থাকলে মা ও সন্তানের সম্পর্ক ক্রমশ খারাপ হতে থাকে। ”

গবেষণাটি মূলত করা হয়েছে ৩১টি মা-সন্তানের জুটির উপর। এক সঙ্গে বসে কার্টুন দেখার সময় ফাংশনাল নিয়ার-ইনফ্রারেড স্পেকট্রোস্কোপি ক্যাপ (fNIRS,এক ধরনের নন ইনভেসিভ প্রক্রিয়া) পরিয়ে ব্রেনে তাঁদের রক্তের পরিমাণ মাপা হয়। এর থেকে ব্রেন অ্যাক্টিভেশন লেভেল কতটা তা হিসেব করে নেন গবেষকরা। পরীক্ষা শুরু করার আগে মা-দের কিছু প্রশ্ন করে তাঁদের পেরেন্টিং স্ট্রেস লেভেল জেনে নেওয়া হয়। তারপর মা-সন্তান দু’জনকেই ক্যাপ পরিয়ে দেওয়া হয়। সন্তানকে কোলে বসিয়ে এর পর তাঁদের দেখানো হয় ‘পেপা পিগ’, ‘দ্য ইনক্রেডিবলস’-এর মতো অ্যানিমেটেড সিনেমার টুকরো দৃশ্য।

তারপর বাচ্চা এবং মা-র ব্রেন অ্যাক্টিভিটি তুলনা করে দু’জনের মস্তিষ্ক একই রকম ভাবে কাজ করছে কি না দেখা হয়েছে। অর্থাৎ তাঁদের ব্রেন সিঙ্ক্রোনাইজড কি না তা মাপা হয়েছে। দেখা গেছে যে সব মায়েরা বাচ্চাকে নিয়ে বেশি স্ট্রেসড থাকেন, সেই সব ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের প্রি-ফ্রন্টাল করটেক্সে মা ও সন্তানের ব্রেন সিনক্রোনি একেবারেই নেই। কিন্তু যাঁদের স্ট্রেস কম, তাঁদের ক্ষেত্রে ব্রেন সিনক্রোনি নিয়ে কোনও সমস্যা দেখা যায়নি। এর থেকে গবেষকরা অনুমান করেছেন যে সকল মায়েদের স্ট্রেস লেভেল বেশি, তাঁদের মধ্যে মাতৃত্বের সূক্ষ্ম অনুভূতি ভাল মতো কাজ করে না। তাঁরা অনেক ক্ষেত্রেই বাচ্চাকে এমন শাস্তি দিয়ে ফেলেন যা বাচ্চার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এর ফলে তাঁদের সম্পর্কের মাধুর্য অনেকটাই খর্ব হয়।

সুতরাং মায়েদের বলব, বাচ্চার ভাল-মন্দ দেখাটা আপনাদের দায়িত্ব নিশ্চয়, কিন্তু তা নিয়ে নিজেদের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে ফেলবেন না। অনেক সময় সন্তানকে সব ক্ষেত্রে সেরা দেখার জন্য তাদের উপর অতিরিক্ত চাপ দিয়ে ফেলি আমরা। এবং নিজেরাও সেই চাপ নিয়ে ফেলি। মায়েরা চাইবেনই তাঁর সন্তান পারফেক্ট হোক। কিন্তু পারফেকশনের কি কোনও সংজ্ঞা আপনাদের জানা আছে? এক একজনের কাছে পারফেকশনের মানে তো এক একরকম হতে পারে। সুতরাং অন্য কারওর সন্তানের সঙ্গে নিজের সন্তানের তুলনা টেনে এনে, নিজেকে মানসিক কষ্ট দেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। তার চেয়ে আপনার সন্তানকে নিজের মতো করে বেড়ে উঠতে দিন না। দেখবেন আপনাদের সম্পর্কও কী সুন্দরভাবে গড়ে উঠছে!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *