মধ্যবিত্তের জীবন থেকে সাবেক রান্নাবান্না কী কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে, তা নিয়ে তক্কাতক্কি আর চুলচেরা বিচার কিছু কম হয়নি। দলিল-দস্তাবেজ হাতড়ে বনেদিবাড়ির রেসিপি ঢুঁড়ে বের করার লোকেরও অভাব নেই। ঝলমলে টিভি শো আর ঝকঝকে পত্রিকার চা-চামচ টেবিল-চামচ মাপা রেসিপিতে সে সব গুহ্য কথা দেখেশুনে চোখে চালসে আর কানে তালা ধরে গেল, কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয় না। মাঝখান থেকে অমুক বাড়ির মোচা পাতুরি আর তমুক ঘাটের মুরগিকষার টোপ গেঁথে বিয়ের বাজেট চড়িয়ে দিল কেটারার কোম্পানির ম্যানেজার। বিপণনের ধাপ্পাবাজিতে বেহদ্দ বোকা বনার ফাঁকতালে কবে যে খোয়া গিয়েছে রসনা-ঐতিহ্যের দুর্মূল্য গুলিসুতো, তা টেরই পায়নি বাঙালি। ঘরে-বাইরে ওস্তাদ রাঁধিয়ের যেমন আকাল লেগেছে, তেমনই সরেস তেল-মশলা পরখ করে ভাঁড়ারে তোলার ইচ্ছে আর সময়, দুটোই আজ বাড়ন্ত। এখন কে-ই বা পাঁচ ফোড়ন আর তিন ফোড়নের তফাৎ বোঝে, কারই বা শিল-নোড়ায় আড়াই পেষা সরষের ঝাঁজ বের করা ধৈর্যে কুলোয়। খাদ্যরসিকরা তাই আক্ষেপ করেন, তেলের ঘানি আর শিল-নোড়া বিদায় করার সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি হেঁশেল থেকে স্বাদলক্ষ্মীও মুখ ফিরিয়েছেন। কথাটা নেহাৎ ফেলনা নয়।
সাত-আট বছর বয়স তখন, ঠাকুমার সঙ্গে তাঁর পিসতুতো ভাইয়ের বাড়ি গিয়েছিলাম চাকদায়। সে বাড়ি কেমন ছিল, কাদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, ভুলে মেরে দিয়েছি। শুধু মনে আছে ছড়ানো বাটিতে সরষের ঝোলে আধডোবা সরপুঁটির কথা। বলতে বাধা নেই, তার আগে অমন আস্ত একটা মাছকে কখনও বাগে পাইনি। কিন্তু তাকে ছোঁয়া দূরের কথা, ঝোলমাখা ভাতের গ্রাস মুখে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড দুলে উঠেছিল। সরষেবাটা দিয়ে রান্না পদ আগে খাইনি, এমন নয়। কিন্তু বাড়ির কচিকাঁচাদের জন্য স্বভাব-চরিত্রে সে সব বেশ মেনিমুখো গোত্রের। চাকদার ঝোলে, বাটা-সরষের রুদ্ররূপ কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে চোখ-নাক-মুখ দিয়ে সহস্রধারা ঝরিয়েছিল। চোখের কোল আর ঘাড়ের ভাঁজে বিনবিনে ঘামের ফোঁটারা ডেগে উঠলে মরিয়া হয়ে জল খুঁজতে গিয়ে আধমণি কাঁসার গেলাস উল্টে কেলেঙ্কারি কাণ্ড বাধিয়েছিলাম, তা-ও ভুলিনি।
পৃথিবীজুড়ে সরষের কদর ঐতিহাসিক কাল থেকে চলে আসছে। কালো, বাদামি, গাঢ় ও ফিকে হলুদ, বিভিন্ন প্রজাতির সরষের এক এক রকম ব্যবহার। বড় দানার কালো বা বেনারসী সরষের চল আচার ও দক্ষিণ ভারতীয় রান্নার ফোড়নে বেশি। সাদা সরষের সঙ্গে তার গুঁড়ো মিশিয়ে টেবল-মাস্টার্ড বানানোর রীতি বহু কাল থেকে ইউরোপে চালু রয়েছে। এই একই মিশেল কাজে লাগিয়ে মৃদু ঝাঁঝের মাস্টার্ড স্যসও তৈরি হয়, যা ইংরেজ ও ফরাসি সমাজে সেই ত্রয়োদশ শতাব্দিতেও দারুণ জনপ্রিয় ছিল। আলেকজান্দার দ্যুমার ‘ডিক্শনারি অফ কুইজিন’-এর পাতায় তার উল্লেখ মনে করিয়ে দিয়েছেন স্বয়ং রাধাপ্রসাদ গুপ্ত তাঁর ‘কলকাতার ফিরিওয়ালার ডাক আর রাস্তার আওয়াজ’ কেতাবে। শাঁটুলবাবু লিখেছেন, ‘…আজকের কথা নয়, সেই সুদূর ১৩শ শতাব্দীতে মাস্টারড্ বা রাইয়ের ফিরিওয়ালারা ঠিক রাত্তিরে লোকরা খেতে বসবার আগে প্যারিসের রাস্তায় রাস্তায় অলিতে গলিতে চমৎকার ভাল ভিনিগার, মাস্টারড্ ভিনিগার, মাস্টারড্ সস্, স্ক্যালিয়ন সস্, ভেরজুস সস্ বলে চিৎকার করে ছুটে ছুটে বেড়াত। সেই ডাক শুনে গিন্নিবান্নীরা জানলা খুলে মাংসের সঙ্গে মেখে খাবার জন্যে পছন্দমত রাই আর সস কিনতেন।’
ফরাসি গিন্নিদের মতো ফিরিওয়ালার ঝাঁকা থেকে মাস্টার্ড স্যস কেনার কেতা হালে উঠলেও সেকেলে বাংলায় অকল্পনীয় ছিল। তা ছাড়া ঘরে ঘরে শিকেয় ঝোলানো কাসুন্দির হাঁড়ি মজুত থাকতে কোন দুঃখেই বা মা-ঠাকুমারা বাজারি জিনিসের পরোয়া করবেন! কাসুন্দি তৈরি অবশ্য তখনও যার-তার কম্ম ছিল না। পাঁজি দেখে, তিথি মেনে, স্নান করে, সাফ-সুতরো শাড়ি পরে মন্তর-টন্তর আউড়ে সে কাজে হাত দেওয়ার প্রথা পালন করতে হত। কাসুন্দির জন্য চাই মাঝারি দানার নিকষ কালো বা কালচে-বাদামি দানার ইন্ডিয়ান মাস্টার্ড বা রাই। উত্তর প্রদেশ, বিহার আর বাংলার খেতে আদিকাল থেকে সরষের এই প্রজাতিরই চাষ হয়। কিন্নর রায়ের লেখনীতে কাসুন্দি তৈরির চমৎকার আখ্যান দেখি—
“বৈশাখের মাঝামাঝি অক্ষয় তৃতীয়ার দিনটিতে পূর্ববঙ্গের ঢাকা-ফরিদপুরে পাছদুয়ারের পুকুরে বাড়ির মেয়ে-বউয়েরা স্নান সেরে শুদ্ধ কাপড়ে, নতুন গামছায় কালো সর্ষে ধুতেন। গামছায় আড়াই-তিন সের সর্ষে। সঙ্গে সামান্য হলুদ, তেজপাতা, জিরে, ধনে- বারো রকম মশলা।… মেয়েরা পুকুরের স্বচ্ছ জলে বার বার সর্ষে ধুয়ে পরিষ্কার করতে করতে বলতেন, ‘চিনি চিনি মধু মধু হইও, বারে বারো বছছর থাইকো। হগ্গলের ভালো দেইখখো।’’
তারপর সেই ধোয়া সরষে, মশলা আর আম কাসুন্দির জন্য কাঁচা আমের সঙ্গে পেতলের কলসি ভরে পুকুরের জল এনে রাখা হত উঠোনে। কিন্নর রায় জানিয়েছেন, কলসির সেই জলকে আর ‘জল’ না বলে ‘মধু’ বলা হত। উনুনের আঁচে বসানো পেতলের হাঁড়িতে সেই ‘মধু’ ফুটে নির্দিষ্ট মাপে পৌঁছনোর ফাঁকে ঢেঁকিতে ভেজা সরষে কুটে তোলা হত। কোটা সরষে আর আন্দাজ মতো নুন হাঁড়ির জলে মিশিয়ে আবার চলত ফোটানোর পালা। খেজুরের পাতাখসা ডাল দিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে হাঁড়ি থেকে চোখে জ্বালা-ধরানো ঝাঁঝ বেরোতে থাকত। বেশ কিছুক্ষণ ফোটানোর পরে হাঁড়ি ভরতি কাসুন্দি এনে রাখা হত উঠোনের গোবর নিকোনো নির্দিষ্ট কোণে। হাঁড়ির মুখে পরিষ্কার ন্যাকড়া বেঁধে হাতায় করে তার ওপরে ঢেলে দেওয়া হত জ্বাল দেওয়া সরষের ক্কাথ। জল ঝরে গিয়ে এক সময় কাপড়ের ওপরে পাতলা সরষের পরত পড়ত। বেশ কিছুক্ষণ রোদে শুকিয়ে তোলার পরে তা চেঁছে তুলে রাখা হত খুরিতে ঢাকা মাটির ঘটে। এবার খুরির ওপর ফের ন্যাকড়া বেঁধে টাঙিয়ে দেওয়া হত শিকেয়। তবে তার আগে ‘… শিকেয় তুলে রাখার আগে নবীন দুব্বোর গুছি হাতে নিয়ে বাড়ির মেয়েরা কেউ কেউ বলতেন, দুব্বা দিয়া রাজার মুখ বাঁধলাম। রানীর মুখ বাঁধলাম।’
লেখক আরও জানিয়েছেন, তিন দিন পরে ফের ‘স্নান সেরে শুদ্ধ কাপড়ে’ শিকে থেকে কাসুন্দির ঘট নামাতেন মেয়েরা। শাঁখ বাজিয়ে, উলুধ্বনি দিয়ে, মন্ত্র পড়ে কাসুন্দির ঘটের ‘সাধ’ দেওয়া হত। তারপরে আবার শিকেয় ফিরে যেত ঘট। তখন চাকা চাকা কাঁচা আমের টুকরো মিশিয়ে আম কাসুন্দি তৈরিও ছিল ডেলিক্যাসি বিশেষ। আবার তেঁতুল কাসুন্দিরও হদিশ দিয়েছেন কিন্নর রায়।
কিরণলেখা রায়ের ‘বরেন্দ্র রন্ধন’-এ কাসুন্দি তৈরির বিস্তারিত বিবরণে সরষেই মূল উপাদান লেখার সঙ্গে সঙ্গে পরিষ্কার জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, ‘আচারেও সরিষার গুঁড়া ব্যবহৃত হয় কিন্তু সে গৌণভাবে। কাসুন্দিতে সরিষার গুঁড়ার সহিত ভাজা ‘ঝালের’ ও ‘বার-সজের’ গুঁড়া প্রযুক্ত হয়, কিন্তু আচারে ঝালের গুঁড়ার বদলে কালজিরা এবং মোরিই ব্যবহার্য্য এবং ক্ষেত্র বিশেষে তৎসহ আদা (এবং রশুন)ও মিশান হইয়া থাকে।’
সে তো বুঝলাম, কিন্তু এই ‘বার-সজের’ গুঁড়ো বস্তুটি কী? বলা হয়েছে, ‘বরেন্দ্র ধনিয়াকে সাধারণতঃ ‘সজ’ বলিয়া থাকে। এই হেতু ধনিয়াদি অপরাপর সমধর্ম্মাপন্ন মশল্লাকেও কাসুন্দি উঠানের পরিভাষাতে ‘সজ’ বলা হয়। এই সজের সংখ্যা যে ঠিক বার তাহা নহে। ব্যক্তিগত রুচি এবং স্থলগত সুলভতা অনুসারে সজের সংখ্যা কমি বেশী হইয়া থাকে। আমাদের বাটীতে যে যে মশল্লায় বার-সজ পূরণ করা হয় তাহা এই:— (১) ধনিয়া- এক পোয়া, (২) জিরা- এক পোয়া, (৩) গোলমরিচ- এক পোয়া, (৪) পিপুল- ১ তোলা, (৫) শুক্নালঙ্কা- ১ সের, (৬) তেজপাতা- আধ পোয়া (৭) রাঁধনী- এক ছটাক (৮) শলুপ শাকের বীজ- আধ পোয়া, (৯) মৌরী- এক পোয়া, (১০) কালজিরা- ১ তোলা, (১১) মেথি- ১ তোলা, (১২) জবাইন- এক ছটাক (১৩) বড় এলাচী- এক ছটাক, (১৪) গুজরতী বা ছোট এলাচী- এক ছটাক, (১৫) লবঙ্গ-আধ ছটাক, (১৬) দারুচিনি- এক ছটাক (১৭) জৈত্রী- আধ তোলা এবং (১৮) জায়ফল- ২টি হিসাবে। দশ সের সরিষার গুঁড়ায় লওয়া হয়।’
সোজা কথায়, কিন্নর রায়ের লেখায় ছা-পোষা গেরস্তর বারো রকম মশলায় কাসুন্দি তৈরির একশো বছরেরও আগে জমিদারবাড়ির পরম্পরায় সরষের সঙ্গে আঠারো রকম উপাদান মিশিয়ে কাসুন্দি বানানোর চল ছিল। কে না জানে, বিত্ত ও কৌলীন্যের ফারাকেও বদলে যায় রসনাতৃপ্তির আয়োজন। তবে সেখানেও মূল পদ তৈরির পাশাপাশি উদ্বৃত্ত উপাদান থেকে মুখরোচক কিছু বানিয়ে ফেলার তাগিদ ছিল।
এমনই এক অনবদ্য উল্লেখ ‘ফুল-কাসুন্দি’। কিরণলেখার বর্ণনায়, ‘আম-কাসুন্দি প্রস্তুতের সময় কুটা সরিষা এবং ভাজা বার-সজের গুঁড়ার অবশিষ্ট ‘মলিখায়’ এবং তৎসহ নুণ ও হলুদ মিশাইয়া লইলেই ‘ফুল-কাসুন্দি প্রস্তুত হইবে। ইহাকে অম্লস্বাদ বিশিষ্ট করিতে ইচ্ছা হইলে এতৎসহ আরও আমচুর মিশাইবে। এই ‘ফুল-কাসুন্দি’ ফোড়ন দিয়া পাবদা মাছের ‘কাসুন্দ-পোড়া’ ঝোল অতি উপাদেয় হয়। মোটা মাছের শুকতেও ইহা ফোরন দেওয়া হইয়া থাকে।’ বাঙালির কাল চেতনার মানদণ্ড শ্রীচৈতন্য ছিলেন কাসুন্দির রসিক সমঝদার। নীলাচলের শেষদিনগুলোয় ভক্তদের তীর্থযাত্রার ছবি ঠিকঠাক আঁকা হলে গরুর গাড়িতে কলস ভর্তি আম কাসুন্দি, আদা কাসুন্দি, ঝাল কাসুন্দি আর লেবু কাসুন্দির হদিশ পাওয়া যেত বটে কিন্তু সে স্বাদ এখন কল্পনাতেও ধরা দেয় না। তবে দুধের স্বাদ বাঙালির বরাবর ঘোলে মেটানোরই অভ্যাস। কাব্য করে সে সুখ তারা মিটিয়ে নিয়েছে—
“আম কাসুন্দি আদা কাসুন্দি ঝাল কাসুন্দি নাম
নেম্বু আদা আম্রে কোলি বিবিধ সন্ধান।”
একলাফে নিজের শৈশবকালে পৌঁছে দেখি, প্রতি বছর সাইকেল ক্যারিয়ারে অ্যালুমিনিয়ামের ঢাউস একজোড়া ক্যানেস্তারা ঝুলিয়ে হাজির ফটফটে সাদা ধুতি আর নাপতে-নীল জামা পরা গৌরকাকা। পোয়ায় মেপে চিনেমাটির বড় বয়ামে কাসুন্দি ঢেলে দেওয়ার আগে স্বাদ পরখ করতে ঠাকুমার বাড়ানো হাতের তেলোয় চামচেখানেক স্যাম্পল পড়ত। ছোট বয়ামে রাখা হত অন্য ক্যানেস্তারায় ভরা আম কাসুন্দি। শাকভাজায় সেই কাসুন্দি পড়লে বেশি ভাত মেখে ফেলতাম। আবার আম কাসুন্দি দিয়ে মাখা মুড়ির সঙ্গে ঝাল ঝাল ডালবড়া বর্ষার ম্যাজমেজে বিকেল চাঙ্গা করত। কাসুন্দি ঢেলে মাছের ডিমের অম্বলেরও স্বাদ ফেরানো হত আমাদের রসুইয়ে। আর কখনওই ভোলার নয় পান্তাভাতে ছড়িয়ে দেওয়া কাসুন্দির স্বাদকাহন।
গেরস্তর সংসার থেকে সে সব দিন কবেই হারিয়ে গিয়েছে। দেশভাগের ঠেলায় ভিটেমাটি হারানো গ্রাসাচ্ছাদনের চিন্তায় আকুল বাঙালি রসনাবিলাসীর পরিচয় ভুলে মিনিকেট, সয়াবিনের বড়ি আর চারাপোনায় অভ্যস্ত হতে শিখেছে। ঠাঁইনাড়া পরিবারে খোরাকি জোটানোর চক্করে পানের ডাবর, সুপুরির জাঁতি, বড়ি-আচারের বয়াম, হামান-দিস্তা আর ধামা-কুলোর স্মৃতি কুলুঙ্গিতে তুলে আয়ের পথে পা বাড়াতে বাধ্য হয়েছেন মেয়েরাও। হন্তদন্ত জীবনে প্যাকেটজাত গুঁড়ো মশলার চটজলদি সমাধানের গুঁতোয় প্রয়োজন ফুরিয়েছে বাটা মশলার। তাই ফ্ল্যাটবাড়ির কিচেন-খোপে আজ বড়ই বেমানান জগদ্দল শিল-নোড়া বা জবরদস্ত হামান-দিস্তারা। অথচ কয়েক দশক আগেও রান্নাঘর বা ভাঁড়ারে তাদের অবিচ্ছেদ্য উপস্থিতি ছাড়া সংসারধর্ম পালন অকল্পনীয় ছিল। এই কারণে বিয়ের তত্ত্বেও শিল-নোড়া পাঠানোর রীতি ছিল।
আমাদের পুরনো বাড়িতে জোড়া শিল-নোড়ার ব্যবহার ছিল বরাবর। বড় শিল ব্যবহার হত রোজের মশলাবাটার কাজে, আর ছোটটি ভাঁড়ারঘরে একটু গা-বাঁচিয়ে তোলা থাকত পুজো-আচ্চায় কাজে লাগবে বলে। জ্ঞানগম্যি হওয়ার পর থেকে দেখেছি, প্রতি সকালে শিল-নোড়ায় নাদা নাদা বাটনা বাটত মঙ্গলা ঝি। প্রতিদিন শিলপাটার ওপরে নোড়া বসলেই তার মুখে কুলুপ পড়ত। হুড়মুড় করে হলুদ জিরে ধনে শুকনো বা কাঁচালঙ্কা বেটে ফাটাচটা হাতে সাপটে তুলে কলাই করা বাটিতে রাখার সময় কোনও দিন তার থমথমে মুখে টুঁ শব্দ শুনিনি। শুধু কুরনো নারকেল, কাঁচালঙ্কা আর সরষে পিষে মানকচু বাটার সময় মণ্ড যত মিহি হতে থাকত, দাঁতউঁচু মঙ্গলাপিসির মুখেও আস্তে আস্তে মোলায়েম হাসি ফুটে উঠত। তার শ্যেনদৃষ্টি এড়িয়ে টুকটুকে লঙ্কাবাটায় মোহিত আমি একবার আঙুল ছুঁইয়ে মুখে পুরেছিলাম। মনে আছে, জোড়া বাতাসা ঠুসেও সেই গগনভেদী হাহাকার থামাতে বাড়ির লোক হিমশিম খেয়েছিল। এই বিপদ সম্পর্কে বিলক্ষণ আন্দাজ ছিল বলেই হয়তো কোনও দিন নিজে কোমর বাঁধলে শিল থেকে লঙ্কাবাটা তোলার সময় খেজুরপাতার চাঁচর ব্যবহার করতে দেখেছি ঠাকুমাকে।
কল্যাণী দত্ত তাঁর ‘থোড় বড়ি খাড়া’ বইয়ে লিখেছেন, তাঁদের সাবেক বাড়ির দাওয়ায় অন্তত তিনটি শিল রাখা থাকত। একটিতে শুকনো মশলা পেষা ও নুন গুঁড়োনো, একটায় জল-বাটনা আর একটায় নারকোল আর ছানা-ক্ষীর বাটা হত। খুব সম্ভব ওই তৃতীয় শিলেই সিদ্ধি বেটে গোলাপজল মিশিয়ে বিজয়াদশমীর সন্ধ্যায় মেলা তরিবতে তৈরি হত মিছরির ঘন সরবত, যা ‘এক কুশী করে বামুন দিদিমা খাইয়ে দিতেন।’ এই ত্রয়ী ছাড়াও ‘একখানা পাথরে পেঁয়াজ আর মাছ বাটা হত।’ চতুর্থ অবতারের ভূমিকা সম্পর্কে কিছুটা আভাস পাওয়া যায় যখন পড়ি, ‘চেতল মাছও একটা মিষ্টি মাছ। মাছ কোটার সময় কেউ কেউ বড় ঝিনুক দিয়ে এর শাঁসটা কুরে বার করে নেন, মাথা বা মুড়ো বলে কিছু থাকে না। কাকিমাকে দেখেছি উঠোনে মাছ ধুয়ে সেখানেই শিলে বেটে তখুনি শাঁসটা চট করে তুলে নিতেন, কাঁটাখানা পড়ে থাকত, ছুটে বেড়াল আসত খেতে। চেতল মাছের গরম বড়া আর বড়ার ঝাল খুব সুখাদ্য।’
ছোটবেলায় সকালে উনুনে আঁচ দেওয়ার কিছু পরে মহল্লার সব বাড়িতেই শিল-নোড়ার গুড় গুড় আওয়াজ উঠত। তখনও গোটা মশলার রমরমা বহাল রয়েছে। প্যাকেটভরা গরম মশলার চল তেমন হয়েছিল বলে মনে পড়ছে না। তবে রোজকার হলুদ লঙ্কা জিরে ধনের ব্যাপারে গমকলে পেষাই করা মশলাগুঁড়োয় মোটে আস্থা ছিল না গিন্নিদের। বাড়ির মাসকাবারি ফর্দে অবশ্য মশলার নাম থাকত না। গণেশ কাটরার কোনও গুপ্ত ঠেক ঘেঁটে সে সব এনে দিতেন বাটার দোকানের কর্মচারী পাশের বাড়ির বিশুকাকু। কখনও-সখনও মাসশেষে না-যাই পড়লে গলির মুখে দিনা লালার দোকান ভরসা ছিল। সার দেওয়া মুখকাটা তেলের টিনে রাখা গোটা হলুদ, দুই রকম শুকনো লঙ্কা, ধনে, জিরে, মেথি, কালো সরষে, পাঁচফোড়ন, তেজপাতা, দারচিনি, কাঁচা ছোলা, বাদাম, পাঁচ-ছয় রকম ডাল, নুন, ভেলিগুড়ের ডেলা, সোডা, বাংলা গোলা সাবান ছাড়াও কত কী যে থাকত তা গুণে শেষ করার নয়। সাইনবোর্ড কোনও কালে ছিল না, অদ্ভূত পাঁচমিশালি গন্ধই সে দোকানের পরিচয়। স্মৃতির ঘ্রাণ হাতড়ে বুঝি, গণেশ কাটরার বনেদিয়ানা না থাকলেও এখনকার শপিং মলে সাজানো স্বচ্ছ মোড়কের তাবৎ মিক্স-এর চেয়ে ঢের খাঁটি ছিল তার পসরা।
আমাদের মশলা বাটা শিলের মাথা ছিল মাইল ফলকের মতো গোল। আবার কোনও বাড়িতে তেকোনা মুড়োর শিলও দেখেছি। নোড়া অবশ্য সব জায়গাতেই একই রকম, বিশেষ হেরফের চোখে পড়েনি। তবে পেল্লায় এক শিল ছিল পাড়ার রায়বাড়িতে। চক-মেলানো সে বাড়ির রসুইঘরের দরজার বাঁ-পাশে প্রায় হাত আড়াই লম্বা আর দেড়হাত চওড়া চাঙড় বসানো থাকত একজোড়া প্রমাণ সাইজের পাথুরে ইটের ওপরে। শুনেছিলাম, সে পরিবারের কর্তা না কি ইংরেজ আমলে কলকাতায় ট্রামলাইন পাতার ঠিকাদারি করতেন। সেই সুবাদেই হাতে এসেছিল এই দানবীয় শিলাখণ্ড, যার গুরুত্ব আঁচ করতে পেরে সটান বাড়ির অন্দরমহলে তিনি তাকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ওজনের কারণে সেই শিল নড়ানোর সাধ্য কারও ছিল না। এমনকি শিল কুটনেওয়ালাকেও তার সামনে ছেনি-হাতুড়ি হাতে নতজানু হতে দেখেছি।
শিল কোটার সময় সাধারণত দু’রকম নকশা ফোটানো হত। একেবারে মাঝখান জুড়ে গোটা মাছ, না হলে পদ্মফুল। আর তাদের ঘিরে সিঙ্গল বা ডবল বর্ডার। বাকি জায়গা ভরাট হত স্কুলের ড্রইং খাতায় যে ভাবে বৃষ্টির ফোঁটা আঁকতাম, হুবহু সে রকম আড়াআড়ি টেরচা খুদে খুদে দাগে। একমাত্র রায়বাড়ির শৌখিন কর্তামায়ের ফরমাশে অতিকায় শিলের মাঝে খোদাই করানো হত হুমদোমুখো লক্ষ্মীপেঁচা, আর চার কোণে স্বস্তিকা। গরমকালে খাঁ খাঁ গলিতে সেই ‘শিল কাটাও-ও-ও’ হাঁক বহু কাল হল আর শোনা যায় না। সেই একান্নবর্তী সংসার এখন একান্ন টুকরো হয়ে নানা দেশের হরেক কিসিমের শহরে সিঁদিয়েছে। ঘরে শিলই নেই, তো কুটবে কে!
জন্ম ইস্তক কলকাতায়। শিক্ষা দিক্ষার খতিয়ানে ঘোর বিড়ম্বনার আশঙ্কা রয়েছে বলে আপাতত উহ্য। নোলা-সর্বস্ব জীবন। যে কোনও মুলুকের হরেক কিসিম পদ চেখে দেখার নেশা আশৈশব। পাকযন্ত্র চালু রাখা বাদে আরও কিছু সযত্নলালিত বদভ্যাস - হকেনকে খুন্তিবাজিতে সহবাসীদের নাকাল করা। বাতিক - ইনসমনিয়া কাজে লাগিয়ে রাত্তির জেগে বইপত্তর ঘাঁটা। তাতে হাঁফ ধরলে তল্পিতল্পা গুটিয়ে নিরুদ্দেশ হওয়ার কুমতলব হামেশাই দেখা দেয়। জুতসই বিষয় আর দোসর জুটিয়ে কাজ ফেলে খোশগল্প আর হল্লা করার দুর্নাম বরাবর। প্রকাশিত বই - খ্যাঁটনসঙ্গী।