রবিশঙ্করের সবচেযে বড় পরিচয় এই যে, তিনি বাঙালি হয়েও একজন বিশ্বনাগরিক। সাধারণত বাঙালিদের প্রতিভা থাকে, বুদ্ধি থাকে, কিন্তু তা সম্বল করে নিজেকে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠা করার উদ্যম, সাহস ও বীক্ষা থাকে না। তখন সে হয় অভিমান করে বলে, হায় আমার প্রকৃত মূল্য বুঝে কেউ আমাকে কোলে করে তুলে বিশ্বমঞ্চে বসিয়ে দিলে না। অথবা ব্যঙ্গ করে বলে, অত বেশি উচ্চাকাঙ্ক্ষা যার থাকে সে নিতান্ত লোভী। কিন্তু কোনও কোনও বাঙালি এই সব ক্ষুদ্রতা অতিক্রম করে, নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে ঠিক ধারণাটি তৈরি করে, তারপর একটা পরিকল্পনা করে নেন, কী ভাবে এই ক্ষমতাকে আন্তর্জাতিক মানের সৃষ্টির বাহন করতে হবে। আর সেই পরিকল্পনা মতো চলতে গেলে যে অতিমাবিক পরিশ্রম করতে হবে, তা থেকে পালান না। রবিশঙ্কর এই বিরল প্রজাতির বাঙালি।

তিনি উদয়শঙ্করের দলের সঙ্গে দিব্যি পৃথিবী ঘুরে বেড়াচ্ছেন। একজন বিদেশি যুবার মতোই তাঁর কেতা। এই সময়ে নিজের শিল্পকে ঠিকঠাক গড়ার জন্য আলাউদ্দিন খাঁ-র তিরস্কার শুনে এঁদো গ্রামে চলে আসেন। বছরের পর বছর অনুশীলন করেন। আবার, যখন অল ইন্ডিযা রেডিয়োর সঙ্গীত নির্দেশকের কাজ করছেন, ইউরোপ ও আমেরিকায় ঘুরে সেতার বাজানোর সুযোগ আসতেই সেই চাকরি ছাড়তে এতটুকু দ্বিধা করছেন না। অর্থাৎ, যখন শিকড় তৈরি করতে হবে, তখন তিনি বিলাস ত্যাগ করে শৃঙ্খলা ও চরম সাধনার ক্ষেত্রে আসছেন। আবার যখন শিকড় কেটে উড়াল নিতে হবে, তখন একটুও ভয় না পেয়ে ও পিছুটান না রেখে অনায়াসে পাশ্চাত্যে পাড়ি দিচ্ছেন। এই মুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি না থাকলে, এই প্রসারিত নজর না থাকলে, বিশ্বনাগরিক হওয়া যায় না। আর সেই জন্যেই তিনি প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের সঙ্গীত মিলিয়ে নিরীক্ষা করতে পিছপা নন। তিনি ডোভার লেনে বাজালেও লোকে ছুটে গিয়েছে, আবার আমেরিকার কড়া রক অধ্যুষিত জলসায় যখন তিনি সেতার ধরেছেন, লোকে সম্মোহিত হয়েছে। ভারতীয় যন্ত্র বাজাতে তিনি লজ্জা তো পানইনি, উল্টে এমন প্রভাব বিস্তার করেছেন যে বিটলস দলের সদস্যরা চেষ্টা করেছে তাঁর কাছ থেকে ভারতীয় সঙ্গীতের কিছু রহস্য শিখে নিতে।

রবিশঙ্কর আজীবন ভারতীয় মার্গসঙ্গীতের প্রতি থেকেছেন শ্রদ্ধাশীল। আর বারে বারে পাশ্চাত্যের উপযোগী করে তাকে পরিবেশন করেছেন। আবার জাপানি সঙ্গীতের সঙ্গে তাকে মিলিয়েও, দুই দেশের বাদ্যযন্ত্রের সম্মিলিত ব্যবহার করে নিরীক্ষা করেছেন। সারাক্ষণ, সব শুচিবায়ু ভেঙে, তিনি মেলানোর, মেশানোর, চেষ্টার, কৌতূহলের রাজ্যের বাসিন্দা হতে চেয়েছেন। এই প্রাণশক্তি আর প্রতিভার মিশ্রণেই, তিনি বিদেশের কাছে ভারতীয় মার্গসঙ্গীতের মুখ। আর ভারতের কাছে, পাশ্চাত্যের জৌলুসযুক্ত তারকা। আসলে এই স্তরের লোকেরা নিজেদের কর্মক্ষেত্রটাকে প্রথম থেকেই কোনও মানচিত্রে আটকে রাখার কথা ভাবেনই না। এই স্তরের চলচ্চিত্রকার ভাবেন না, বাংলা বাজারে সম্মান পেলেই হবে। তিনি নিজের সহকর্মী ও প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করেন সারা বিশ্বের সবচেয়ে নামজাদা চলচ্চিত্রকারদের। রবিশঙ্কর নিজেকে পৃথিবীর একজন সঙ্গীতসাধক মনে করতেন। সমগ্র বিশ্বকে তাঁর সৃষ্টিক্ষেত্র হিসেবে উপলব্ধি করতেন। সব উৎস থেকেই তিনি প্রাণপণে প্রেরণা শুষে নেবেন এবং তা প্রকাশ করতে যে কোনও ধরন বা পদ্ধতিই প্রয়োগ করবেন, প্রাচ্য বা পাশ্চাত্যের ঘেরাটোপে আটকে থাকবেন না, আত্মঘাতী অভিমানে বদ্ধ হবেন না, এই ছিল তাঁর প্রতিজ্ঞা। নিশ্চয়ই তাঁর অনেক সমালোচনা হয়েছে, হবে। অমুকটা তেমন করতে পারেননি, বা তমুকটা ঠিক কাজ করেননি। কিন্তু তাঁর এই পরিব্যাপ্ত দৃষ্টিপরিধির, এই সাহস ও প্রাণপ্রাচুর্যের প্রশস্তি না করে থাকা যায় না। সংকীর্ণতার পুজো করতে ব্যস্ত বাঙালি যদি তাঁর কাছ থেকে এর সিকি ভাগও শিখতে পারে, তবে বহু সেতারঝংকার তার জীবনকে সমৃদ্ধ করবে।

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায় হাসিখুশি, এমনকী যখন সেই মোড-এ থাকেন না, নিজেকে ঠেলে হিঁচড়ে হিহিহোহো’তেই ল্যান্ড করানোর চেষ্টা করেন। জাপটে ভালবাসেন আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, সিরিয়াল, গান, রাস্তায় নেড়িবাচ্চার লটরপটর কান। পড়াশোনার সময় ফিল্ড করেছেন, হাতুড়ি দিয়ে পাথর ভেঙেছেন, গ্রামবাসীদের তাড়া খেয়েছেন, এক বার পাহাড় থেকে অনেকটা হড়কে পড়ে মুচ্ছো গেছিলেন, উঠে দেখেন, কবর! এক বার ম্যানেজমেন্ট কোর্সের অঙ্গ হিসেবে চিন গেছিলেন, রাত্তির দুটোয় সাংহাইয়ের রাস্তায় হারিয়ে গিয়েও কাঁদেননি। ফিউজ সারাতে পারেন, পাখার কার্বন বদলাতে পারেন, কাগজের চোঙ পাকিয়ে গাড়িতে পেট্রল ঢালতে পারেন, চিনেবাদাম ছুড়ে দিয়ে মুখে নিপুণ লুফতে পারেন। ব্যাডমিন্টন খেলার ইচ্ছে খুব, কিন্তু জায়গা ও র‌্যাকেট নেই। অরোরা বোরিয়ালিস যারা দেখেছে, তাদের একাগ্র ভাবে হিংসে করেন। দেশের বাড়িটা উনি বড় হওয়ার পর ছোট হয়ে গেছে বলে, আর আমির খান এক বার কার্টুন এঁকে দিয়েছিলেন— সে কাগজ হারিয়ে গেছে বলে, জেনুইন কষ্ট পান। এক বার ঈগলের রাজকীয় উড়ান আগাগোড়া খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *