আমাজন প্রাইমে পঞ্চায়েতের দ্বিতীয় সিজন আসছে যেদিন থেকে বিজ্ঞাপন দেখেছি, ক্যালেন্ডারে তারিখ দাগানো শুরু করেছিলাম সেদিন থেকেই। তার সঙ্গে অবিশ্যি প্রথম সিজনের পর্বগুলো ঝালিয়ে নিতেও ভুল হয়নি। কিন্তু, যতই সেগুলো দেখছিলাম আর ২০ মে এগিয়ে আসছিল শম্বুকগতিতে, উত্তেজনার পাশাপাশি একটা চাপা উদ্বেগও যে মনে শিকড় ছড়াচ্ছিল, সেটা অস্বীকার করি কি করে?
প্রথমত, ম্যাজিক দিয়ে শুরু করে, লেবু চটকে তেতো করে, চাট্টি সামাজিক বাণী দিতে গিয়ে এত অপূর্ব শিল্পসৃষ্টিকে পরবর্তীকালে এমন অনিবার্যভাবে ধ্যাড়াতে দেখেছি, যে এখন সব সময়েই এসব ক্ষেত্রে বুকটা একটু দুরু দুরু করে। দ্বিতীয় কারণ হল, অনায়াস আলস্যের যে নির্মেদ তীক্ষ্ণতা নির্মাতারা প্রথম সিজনে সফলভাবে এনেছিলেন, সেটা একটু ভাবলেই বোঝা যায়, কী দুঃসাধ্য ব্যাপার। তাই সেটা আরও একবার হবে কিনা, তা নিয়েও বেশ সন্দিহান ছিলুম মনে মনে। তবে ২০ মে রাত বারোটা সাড়ে তিন মিনিট (নেটওয়ার্ক ইস্যুর জন্য একটু দেরি হল) থেকে দেখা শুরু করার আধঘণ্টাখানেকের মধ্যেই বুঝলাম, নির্মানশৈলী, শিল্পনির্দেশনা এবং অন্যান্য প্রযুক্তিগত দিক থেকে অন্তত টিম পঞ্চায়েত আমার মতো অবিশ্বাসীদের মুখে জুতো ঘষে দিয়েছেন।
কাঠামোটা মোটামুটি এই। অভিষেক ত্রিপাঠী গতবছর ম্যানেজমেন্টের পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ায় তাঁকে আর এক বছর থাকতে হচ্ছে ফুলেরার পঞ্চায়েত সচিব হয়ে। নতুন বন্ধুদের কল্যাণে (এবং হয়তো গত সিজনের শেষে প্রধান-কন্যার দেখা পাওয়ায়) গ্রাম্য জীবন কিছুটা সহনীয় হলেও এখনও তাঁর কাছে অত্যন্ত বিরক্তিকর, এবার পরীক্ষা দিয়ে এখান থেকে শহরে পালাতে তিনি বদ্ধপরিকর।

প্রথমেই বলা দরকার দীপককুমার মিশ্রের পরিচালনা আর চন্দন কুমারের চিত্রনাট্যের কথা। আগেরবারের মতোই শাণিত ঝকঝকে, এমনকী ক্ষেত্রবিশেষে হয়তো অভিজ্ঞতায় আরো পরিণত। আর তাঁদের যোগ্য সহযোগিতা করেছেন ক্যামেরায় অমিতাভ সিং ও সম্পাদনায় অমিত কুলকার্নি ও হর্ষিত শর্মার যুগল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, অভিষেক ত্রিপাঠী ও নর্তকী স্বপ্নার রাস্তায় অপেক্ষা করার সময়ে যে অস্বস্তিকর নৈঃশব্দ্য, বা নেশাগ্রস্ত গাড়ি চালকের সচিবের অফিসে বসে বিলাপ, কিংবা শেষদিকে উপপ্রধান প্রহ্লাদ পান্ডের যে পাথর হয়ে যাওয়া শোক ও শেষে ভেঙে পড়া– এবং এরকম আরো বহু দৃশ্য যে মমতা ও মুন্সিয়ানা দিয়ে ক্যামেরাবন্দি করেছেন এঁরা, তা এককথায় অনবদ্য।
আর ফুলেরার জীবনের নানা ঘোরপ্যাঁচ, রাজনীতির নীচেও তার আসল সুর যে এক অকৃত্রিম, দীর্ঘসূত্রী আলস্য, সেটা প্রথমবারে ধরতে যে দিগন্তব্যাপী মাঠের লঙ শট ব্যবহার হয়েছিল, তার সঙ্গে এবার আরো নিপুণভাবে ব্যবহার হয়েছে দিন আর রাতের শটের ব্যবহার। অবশ্যই এতে প্রতিপদে যোগ্য সঙ্গত করে গিয়েছে অনুরাগ শইকিয়ার সঙ্গীত এবং শব্দগ্রহণের গোটা ইউনিট। আকবর খানের শিল্পনির্দেশনা ও প্রিয়দর্শিনী মুজুমদারের সাজসজ্জা অত্যন্ত প্রশংসার্হ। মূল চরিত্রগুলি তো বটেই, তার সঙ্গে প্রতিটি ছোটবড় দৃশ্য ও চরিত্রের শিল্পসজ্জা ও পোশাকে যে পরিমাণ যত্ন ও ডিটেলিং, তা লক্ষণীয়। অভিনয়ের কথায় ঢুকব, তবে তার আগে আর একটা কথা বলে নেওয়া এখানে জরুরি।
এমন অসাধারণ সর্বাঙ্গীন প্রযোজনা সত্ত্বেও একটা অভাববোধ আমার রয়ে গেল। প্রথম সিজনের একটা বিরাট, সম্ভবত সবচেয়ে শক্তিশালী দিকগুলোর একটা আমার মনে হয়েছিল চরিত্রনির্মাণ। সচিব অভিষেক ত্রিপাঠী, উপপ্রধান প্রহ্লাদ পান্ডে, কর্মচারী বিকাশ এবং অবশ্যই প্রধান-পতি বৃজভূষণ দুবে ও প্রধান মঞ্জু দেবী– এই মূল পাঁচটি চরিত্রের কাঠামোর যে তিল তিল করে উন্মোচন ও পরতে পরতে তাতে রক্তমাংস ও প্রাণসিঞ্চন এই পাঁচজনের অভিনয়ে স্মরণীয় হয়ে উঠেছিল, তা সম্ভবত প্রথম সিজনের সবচেয়ে বড় সম্পদগুলোর একটা। এবারেও তাঁরা প্রত্যেকেই অসাধারণ, কিন্তু একমাত্র প্রহ্লাদ পান্ডে ছাড়া তাঁদের কারো চরিত্রেই সেরকম কোনও নতুন মাত্রা যোগ হয়নি, কারণ চিত্রনাট্যে তার বিশেষ অবকাশও নেই। দু’এক জায়গায় অভিষেক ও বৃজভূষণের ক্ষেত্রে কিছু ঝলক দেখা যায় বটে, এবং অবশ্যই সেগুলো খুবই সূক্ষ্ম, সুচারুভাবে পরিবেশিত। কিন্তু সেটাও খানিকটা সীমিত। আর এই সিরিজে আধা কেন্দ্রীয় যে নতুন চরিত্রগুলো এসেছে, সেগুলো অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক হলেও তাদের উন্মোচন বা সিরিজের মধ্যে বিবর্তন ততটা হয়নি। যাই হোক, এই অপ্রাপ্তির সঙ্গে কিছু বড় প্রাপ্তিও কিন্তু আছে। সেগুলোর কথা যথাস্থানে বলব।

অভিনয়ের প্রসঙ্গে আসি। একটু আগে যা বললাম, মূল চরিত্রগুলির অভিনয় সম্বন্ধে নতুন করে কিছু বলার নেই। প্রথম সিজনের সময়ে কিছুটা নবাগত হিসেবে জীতেন্দ্র কুমার তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। আজ অবশ্য বেশকিছু সিনেমা ও সিরিজের দৌলতে তিনি নতুন যুগের সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিমান অভিনেতাদের অন্যতম। এখানেও প্রত্যাশা যথাযথভাবে পালন করেছেন। তবে তাক লাগানোর ব্যাটনটা তাঁর হাত থেকে যিনি তুলে নিয়েছেন এই সিজনে, তিনি সম্ভবত এ পর্বের অন্যতম বড় প্রাপ্তি। বৃজভূষণের কন্যা রিঙ্কির চরিত্রে সান্বিকা। নায়িকা হিসেবে তথাকথিত অর্থে হয়তো পরমাসুন্দরী বলা যাবে না তাঁকে। তবে তাঁর হাসিটি বুকে শেল বিঁধিয়ে দেয়।
কিন্তু তার চেয়েও যেটা বড় কথা, সেটা তাঁর চার্ম। ‘নায়িকা’সুলভ স্টিরিওটাইপড ন্যাকামি থেকে হিন্দি সিনেমা ও সিরিজের অভিনেত্রীদের উত্তরণ বেশ কিছুদিন হল ঘটছে। ভূমি পেডনেকর, তিলোত্তমা সোম, রিচা চাড্ডা, রাধিকা আপ্টে– ইত্যাদি বহু অভিনেত্রীর যোগ্য সম্মান পাওয়াই তার জ্বলন্ত প্রমাণ। সেই তালিকায় নিজের নামটা জুড়বার দিকে কিন্তু একটা বড় পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে রাখলেন সান্বিকা। তাঁর বাহুল্যবর্জিত সংলাপ ডেলিভারি, সহজ শরীরী ভাষা এবং সুক্ষ্ম অভিব্যক্তি চরিত্রটিকে এবং তার সঙ্গে অভিষেকের অধোবদন, প্রায়-অদৃশ্য অনুরাগের টানাপোড়েনকে আলাদা মাত্রা ও মর্যাদা দিয়েছে। গ্রামীণ সারল্যের সঙ্গে আধুনিকতার এক দুর্দান্ত মেলবন্ধন ঘটেছে তাঁর অভিনয়ে।

মঞ্জুদেবী আর বৃজভূষণের চরিত্রে নীনা গুপ্তা আর রঘুবীর যাদবের অভিনয় নিয়ে নতুন করে কিছু বলার অপেক্ষা রাখে না। মমতাময়ী অথচ কড়া মঞ্জুদেবী এবং বদান্য, নিরীহ বৃজভূষণের যুগলবন্দি এই সিজনেরও অন্যতম মূল্যবান সম্পদ। বিকাশের ভূমিকায় চন্দন রায় আর প্রহ্লাদ পান্ডের ভূমিকায় ফয়জল মালিক যথাযথ। বিশেষ করে শেষ দুটি পর্বে ফয়জলের অভিনয় অনন্য। কারণ বুঝিয়ে বলতে গেলে স্পয়লারের আশংকা আছে, তাই সেটা বরং থাক। তবে এইখানে তাঁর চরিত্র একটা অন্য মাত্রা পেয়েছে, যা এই সিরিজে পায়নি এর আগে, এটা বলা রইল।
নতুন দুটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ঢুকেছে সিরিজে। ভূষণের চরিত্রে দুর্গেশ কুমার এবং তাঁর প্রচন্ড ঝগড়ুটে স্ত্রী ক্রান্তি দেবীর চরিত্রে সুনীতা রাজোয়ার। ক্রান্তি দেবী হলেন পঞ্চায়েত দখলের দৌড়ে মঞ্জুদেবীর প্রধান প্রতিপক্ষ। সেই অর্থে এঁরা দু’জন এই সিরিজের প্রথম প্রায় পুরোপুরি নেগেটিভ চরিত্র। তাঁদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, চিমটি দেওয়া সংলাপ ডেলিভারি এবং দেঁতো হাসির সাহায্যে ফুলেরার প্রসন্ন নিস্তরঙ্গতায় দারুণ বৈপরীত্য এসেছে। শুধু তাই নয়, গ্রামীণ আন্তরিকতা যে আদতে রাজনীতি বা বিবাদকে ছাপিয়ে যায়, শেষদিকে সেইটে প্রতিষ্ঠা করতেও তাঁদের অবদান অনস্বীকার্য। সাধুবাদ দুজনকেই।
যাই হোক, এ তো গেল মূল, বা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রগুলোর কথা। ছোটখাটো চরিত্রও যে চিত্রনাট্য আর অভিনয়ের গুণে কিরকম প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে, সিরিজে তার উদাহরণ ভূরি ভূরি। প্রথমেই বলতে হবে একটি পর্বে নেশাগ্রস্ত জিপ ড্রাইভার বলরাম যাদবের ভূমিকায় সিরিজের অন্যতম প্রযোজক অভিষেক ঝা-র কথা। আপাতদৃষ্টিতে ওরকম মলিন, ক্লেদাক্ত, বীভৎস একটা মানুষের প্রতি যে দর্শকদের এতখানি মায়া জন্মায় মাত্র কুড়ি মিনিটের মধ্যে, তার পিছনে প্রধান কারণ সচিবের ঘরে অভিষেকের অভিনয়। কোনও আবহ ছাড়া একজন প্রাপ্তবয়স্ক, অপরিশোধিত, পোড়খাওয়া মানুষের ভলকে ভলকে বেরিয়ে আসা সর্দিমাখা কান্না যে কতখানি বেদনা বহন করতে পারে, তা এই দৃশ্য থেকে শেখার বিষয়।

তারপরে ধরা যাক সিরিজের দ্বিতীয় নেগেটিভ চরিত্র– অভদ্র, অসৎ বিধায়ক চন্দ্রকিশোর সিং-এর কথা। এই অভিনেতা পঙ্কজ ঝা অবশ্য পরিচিত মুখ। দুঁদে অভিনেতার পারদর্শিতায় তিনি বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছেন সিরিজের দ্বিতীয় ‘ভিলেন’ এবং সম্ভবত পরের সিজনের প্রধান নেগেটিভ চরিত্রকে। আসলে এ ধরনের চরিত্রে সাম্প্রতিককালে আর এক পঙ্কজ (ত্রিপাঠী) যে মানদণ্ড সৃষ্টি করেছেন, তার সঙ্গে প্রতিযোগিতা খুবই দুঃসাধ্য। তবু ঝা মশাই বেশ দাগ কেটেছেন।
এরকম প্রত্যেকের কথা বলতে গেলে এই রিভিউ শেষ হতে হতেই তৃতীয় সিজন রিলিজ হয়ে যাবে। মহিলা নর্তকী স্বপ্নার ভূমিকায় পূজা ঝা, ইটভাটা শ্রমিকের চরিত্রে সর্বজ্ঞ, অভিষেকের শহুরে বন্ধু সিদ্ধার্থের চরিত্রে সতীশ রায়, এমনকি ছাগল-হারানো গ্রামবাসী মাধবের সামান্য ভূমিকায় বুল্লু কুমার যে অসাধারণ সঙ্গত দিয়েছেন মূল কাহিনীকে, তা অনবদ্য। একটি চরিত্রকেও স্টিরিওটাইপ বলা যাবে না, যদিও আশানুরূপ কিছু বৈশিষ্ট্য সবকটিতেই আছে। সিজন ২ তে যে এক মুহূর্তের জন্য ছন্দপতন হয় না এত নতুন চরিত্র সত্ত্বেও, তার পিছনে চিত্রনাট্যের পাশাপাশি এঁদের প্রত্যেকের ভূমিকা অসাধারণ। আর এটাই সম্ভবত এই সিজনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
শেষে বলি, প্রথম সিজনের রিভিউ যখন লিখেছিলাম, তখন মনের কোণে একটা ক্ষীণ আশা তাও ছিল, যে দু-তিনজন হয়তো এমন থাকবেন, যাঁরা সেটা পড়ার আগে সিরিজটা দেখেননি। জানি এবারে তা নিতান্তই দুরাশা। তাও যদি একজনও এইটে পড়ে নতুন চোখ দিয়ে আর একবার উঁকি দেন ফুলেরার পঞ্চায়েত আপিসে, তাহলেই এ লেখা সার্থক মনে করব।
*ছবি সৌজন্য: Koimoi, Prime Video, Amazon
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত
পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। তিতিবিরক্ত হতে হতেও আইটি শিল্পতালুকে মজদুরি করতে বাধ্য হন। কিন্তু সবচেয়ে পছন্দের কাজ হাতে মোবাইলটি নিয়ে আলসেমি করে শুয়ে থাকা। চেহারাছবি নিরীহ হলেও হেব্বি ভালোবাসেন অ্যাকশন ফিলিম, সুপারহিরো আর সাই ফাই। সঙ্গে চাই সুরেশের রাবড়ি, চিত্তরঞ্জনের রসগোল্লা-পান্তুয়া, কেষ্টনগরের সরভাজা ইত্যাদি নানাবিধ মিষ্টান্ন।
যথার্থ review ।মন ভাল ক’রে দেও
য়া series.
সঠিক বলেছে আমি ও ভীষন ভাবে উপভোগ করছি।