বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী রবীন্দ্রনাথকে বাঙালি বিশ্বকবির পরিচয়ের মধ্যে আবদ্ধ করে এক অদ্ভুত আত্মপ্রসাদ লাভ করেছে। তাঁর লেখনীর গুণগান শোনা গিয়েছে অতীতে এবং আজও শোনা যায়, আশা করি ভবিষ্যতেও শোনা যাবে। কবির দৃশ্যশিল্পের চর্চা অবশ্য শুরুও হয়েছিল জীবনের প্রান্তসীমায় এসে। বেঙ্গল স্কুল অফ আর্টের যে ধারা, সেই ধারার বাইরে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ শিল্পচর্চা করে গিয়েছেন। আবার সত্যজিৎ রায় তাঁর কর্মজীবন শুরু করেছিলেন কমার্শিয়াল আর্টিস্ট হিসেবে। তাঁকে ক্যালিগ্রাফিস্টও বলা যায়। সেই কাজ করতে করতেই চলচ্চিত্রজগতে তাঁর প্রবেশ। কিন্তু অনেকেই জানেন না, নাটক এবং চলচ্চিত্রের পেশাদার অভিনেতা হয়েও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর অবসর সময়ে কাটিয়েছেন রং-তুলি নিয়ে।
শিল্পের কোনও প্রথাগত শিক্ষা না থাকলেও দৃশ্যশিল্পের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ মুগ্ধতা। ছবি আঁকার প্রতি এই গোপন ভালোবাসাই তাঁকে টেনে নিয়ে এসেছিল চিত্রশিল্পের জগতে। বিয়ের উপহার হিসেবে সত্যজিৎ রায় তাঁর হাতে তুলে দিযেছিলেন দুটি আর্টের বই। সম্ভবত ২০১৪ সাল নাগাদ বর্ষিয়ান এই অভিনেতা ও বাঙালির অন্যতম আইকন, সত্যজিতের ফেলু মিত্তির যে একজন চিত্রকর, সেটা সবার গোচরে আসে। কারণ শিল্পী যোগেন চৌধুরীর আগ্রহে কলকাতার আই.সি.সি.আর-এ আয়োজিত হয় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের একক ছবির প্রদর্শনী। ছবিগুলি নির্বাচন করে দিয়েছিলেন আর এক বিখ্যাত চিত্রকর রবীন মণ্ডল।

আমি নিজে শিল্পী নই বা শিল্পে বিশেষজ্ঞ নই। ছবির গুণমান সম্পর্কে মতামত দেওয়াটা ধৃষ্টতামাত্র। আর টেকনিক্যাল কোনও জ্ঞান তো দূরের কথা। যতটুকু জানি, সেটাও শোনা কথার পাণ্ডিত্য। কিন্তু ছবি দেখতে ভালো লাগে আর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের আঁকা ছবি যখন, তখন আগ্রহ থাকাটা স্বাভাবিক। সেদিনের সেই প্রদর্শনীতে দেখা ছবিগুলোর মধ্যে ল্যান্ডস্কেপগুলো বড়ই ভালো লেগেছিল। প্রতিটি ছবিতে রঙের ব্যবহার দেখে অবাক হয়েছিলাম। প্রথাগত শিক্ষা ছাড়া এমন ছবি কী করে আঁকলেন! নানা প্রতিভার অধিকারী মানুষেরা বোধহয় এমনই হন!
অভিনয় জীবনে শিশির ভাদুড়ির পরে সত্যজিৎ রায় ছিলেন তাঁর মেন্টর। তিনি একজন কর্মাশিয়াল আর্টিস্ট, সুতরাং সত্যজিতের শিল্পের প্রভাব তাঁর মানসপুত্রের ওপর পড়াটা খুবই স্বাভাবিক। পাশাপাশি হাওড়ায় থাকাকালীন শিল্পী রবীন মণ্ডলের কাজও তাঁকে আকৃষ্ট করত। মাঝে মাঝে বলতেন হাওড়া ময়দানে নেহরুর জনসভার এক কোণে দাঁড়িয়ে রবীন মণ্ডলের ছবি আঁকার কথা। সেই ছবি অবশ্যই নেহরুকে কেন্দ্র করে। নিজের দৈনন্দিন কাজের ফাঁকে বিরতির সময়টুকুই শিল্পী করে তুলেছিল সৌমিত্রকে। বাড়ির নির্জন এক কোণে টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ে একটার পর একটা ছবি এঁকে যেতেন। বেশিরভাগই ওয়াশের কাজ। কখনও প্রকৃতির বিভিন্ন রূপ, আবার কখনও পরিচিত-অপরিচিত মানুষের মুখমণ্ডল প্রকাশ পেয়েছে ড্রইয়ের খাতায়। এছাড়াও জীবনের প্রতিটি সংকটে যাঁর কথা মুখে না বলেও মনের অন্দরে অনুভব করতেন, সেই রবীন্দ্রনাথের মুখও তাঁর হাত ধরে ভেসে উঠেছে ছবি আঁকার খাতায়।
নিজের কাছে আসা বৈচিত্রময় আর নানা আকৃতির আমন্ত্রণপত্রগুলি এক সময় হয়ে উঠেছে তাঁর ছবির মাধ্যম। সেগুলি একটা বিশেষ আকারে কেটে তিনি পেজমার্কের আকার দিতেন। তারপর কখনও মার্কার, আবার কখনও ডট বা ফাউন্টেন পেন দিয়ে সেইসব পেজমার্কের ওপর চলত আঁকিবুকি। কাছের মানুষ আর আপনজনেদের মাঝেমধ্যে তাঁর তৈরি করা পেজমার্ক উপহার দিতেন ভালোবেসে। কয়েক বছর পর পর শীতের সকালে তাঁর সামনে বসে ধূমায়িত কফির কাপে চুমুক দেবার সময় ‘ঝিন্দের বন্দি’র ময়ূরবাহনের হাত থেকে বেশ কয়েকটি পেজমার্ক পাওয়ার অভিজ্ঞতা সযত্নে ধরে রেখেছি মনের মণিকোঠায়।
প্রকাশ্যে বা অন্দরে কোনওদিনই কিন্তু অভিনেতা বা শিল্পী সৌমিত্র নিজেকে চিত্রকর বলে দাবি করেননি। বারে বারে বলেছেন ছবি আঁকা তাঁর অবসরযাপন। আবার বলেছেন নিজের ব্যক্তিগত খেলা। সবার কাছে বলতে সংকোচবোধ করেছেন। জীবনের অনেক চরিত্ররা তাঁর নাটকের চিত্রনাট্যে এবং কবিতাতেও হয়তো স্থান পায়নি, কিন্তু জায়গা করে নিয়েছে তাঁর ছবিতে।

বহু ছায়াছবিতে এবং নাটকে কাজ করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, কিন্তু অপার স্বাধীনতা পেয়েছেন তাঁর কবিতায়। আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়েছে এই ছবি আঁকার বিষয়টিও ছিল তাঁর স্বাধীনতার আরও একটা বৃত্ত। যৌবনে অনেক চিত্রশিল্পী বন্ধুর সঙ্গে সময় কেটেছে। তাঁদের ইচ্ছেকে মান্যতা দিয়ে ছোটখাটো স্কেচও করেছেন, কিন্তু ভাবেননি যে ছবি আঁকার প্রথাগত শিক্ষা নেবেন। তাছাড়া মনে ছিল সংকোচ যে সেটা করলেও আদৌ সফল হবেন কি না? বারে বারে বলতেন মানুষের মুখ তাঁকে আকৃষ্ট করে। তাই যত ছবি এঁকেছেন, তার মধ্যে মানুষের মুখের আধিক্যই বেশি। সেখানে সকলের মিত্র সৌমিত্র তাঁর ইচ্ছেমতো জায়গা করে দিয়েছেন ড্রইংয়ের লাইনে। তাঁরা সবাই আনটাইটেলড। একেকটা ছবি দেখে মন খারাপ হয়েছে। ছবি না বলে সেই ছবির রং বলাই ভালো। সেইসব রঙের হাত ধরে সন্ধে ঘনিয়ে আসে। বোধহয় জীবনের নানা পর্বের মনোবেদনার প্রকাশ ঘটত সেই রঙের ব্যবহারে। মনোজগতের লালিত্যবোধ যেমন তাঁর কবিতায় উঠে এসেছে, তেমনই ছবির ভাষাতেও ঘটেছে তার প্রকাশ। তাঁর একাকিত্ববোধ থেকে মুক্তি ঘটিয়েছে এই ছবির জগত।
এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, জীবনের বাকি কটা দিন এমন কিছু কাজ করতে চান যেগুলো অতীতেও করেছেন, তার মধ্যে অবশ্যই ছবি আঁকা নিয়ে কাটাতে চান বেশিরভাগ সময়, কারণ এই চিত্রচর্চা তাঁকে স্নিগ্ধতা দেয়, মুগ্ধ করে। অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন ছবিই যখন আঁকলেন, ভাস্কর্য নির্মাণের দিকে গেলেন না কেন? তাঁর নিজের মনে হয়েছিল সেটা একটা সম্পূর্ণ নতুন মাধ্যম, সেটা নিয়ে চর্চা করতে গেলে যে সময়ের প্রয়োজন, সেটা আর তাঁর সামনে নেই। আশি বছর উত্তীর্ণ করে অপেক্ষা করছিলেন একটা অন্তিম পরিণতির জন্য, যা অবশ্যম্ভাবী। সত্যিই তাই সময় আর বেশি ছিল না। দিনান্তবেলায় অজস্র মুখের ভিড়ে মগ্ন হয়ে থাকতেন।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় হয়ত ভারতীয় দৃশ্যশিল্পের জগতে বিস্ফোরণের মতো প্রকাশিত হননি, কিন্তু এ কথা বলতে কোনও সংকোচ নেই যে তাঁর ছবিকে অবহেলাও করা যাবে না। তাঁর প্রতিটি ছবিতে রয়েছে পরিণত দক্ষতার ছোঁয়া। হয়ত ভবিষ্যতই তার উপযুক্ত মূল্যায়ন করবে। আজ যখন শীতেরবেলায় প্রকৃতি কুয়াশার অবগুণ্ঠনে ঢাকা, তখন সৌমিত্রর ৮৮ তম জন্মদিনে মনে হল তাঁর ছায়াছবির জগত থেকে খানিক ছুটি নিয়ে রং-তুলির জগত নিয়েই নাহয় দু-কথা বলি। এই বলায় পরিণত বিশেষজ্ঞের দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ না থাকলেও, রয়ে যাবে কিছু স্মৃতির মুহূর্ত…
ছবি সৌজন্য: প্রতাপ দাশগুপ্ত।
Special thanks to Soumitra and Deepa Chatterjee Foundation
অরিজিৎ মৈত্র পেশায় সাংবাদিক। দৈনিক যুগশঙ্খ পত্রিকায় সিনিয়র সাব-এডিটার পদে কর্মরত। তপন সিংহ ফাউন্ডেশনের সম্পাদক অরিজিৎ পুরনো কলকাতা নিয়ে চর্চা করতে ভালবাসেন। নিয়মিত লেখালিখি করেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। প্রকাশিত বই: অনুভবে তপন সিনহা, ছায়ালোকের নীরব পথিক বিমল রায়, চিরপথের সঙ্গী - সত্য সাঁই বাবা, বন্দনা, কাছে রবে ইত্যাদি।