স্বাধীনতা পরবর্তী ভারত তথা বাংলার শিল্পকলা জগতে অতুল বসু এক বিস্মৃতপ্রায় নাম। অথচ অনস্বীকার্যভাবে তিনি আজও ভারতের অন্যতম প্রধান পোট্রেট শিল্পীদের একজন। অবশ্য শুধু এটুকু উল্লেখ করলে শিল্পী অতুল বসু সম্পর্কে কিছুই বলা হয় না। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী কুড়ি ত্রিশের দশকে এদেশের ফাইন আর্টস ক্ষেত্রে একটা স্পষ্ট বিভাজনরেখা তৈরি হয়েছিল। পরাধীন দেশে স্বাধীনতার দাবি জোরালো হচ্ছে সেসময়। স্বদেশি মিলের কাপড়, স্বদেশি নুনের মতো শিল্পক্ষেত্রেও উঠে আসছে স্বদেশিয়ানার কথা। শিল্পচর্চার মাধ্যমে প্রাচ্যের নিজস্ব সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের শিকড়ে ফিরতে চাইছেন অবন ঠাকুরের মতো প্রথিতযশারা। অন্যদিকে পাশ্চাত্য রিয়্যালিটির আদর্শকে সামনে রেখে দেশিয় ভাবালুতার বিরুদ্ধে গর্জে উঠছেন শিল্পীদেরই একাংশ। নিও-ন্যাচারালিজমের সেই আন্দোলনের অন্যতম কুশীলব ছিলেন অতুল বসু। তাঁর সহযোদ্ধা ছিলেন যামিনী রায়, হেমেন মজুমদারের মতো শিল্পীরা। যামিনী রায়ের শিল্পভাবনা পরবর্তীতে ভিন্ন খাতে বয়ে গেলেও আজীবন স্বধর্মে স্থির থেকেছেন যাঁরা, তাঁদের অন্যতম শিল্পী অতুল বসু।

Atul Basu-Jamini Roy
সতীর্থ যামিনী রায়ের সঙ্গে অতুল বসু

১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দের ২২ ফেব্রুয়ারি অবিভক্ত বাংলার ময়মনসিংহে জন্মেছিলেন অতুল বসু। বাবা শশিকুমার বসুর ছিল বদলির চাকরি। সেই সূত্রেই ঢাকা বিক্রমপুরের ভদ্রাসন ছেড়ে বসু পরিবার উঠে আসেন ময়মনসিংহে।

ছোট থেকেই শিল্পী হওয়ার প্রবল বাসনা তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াত অতুল বসুকে। ময়মনসিংহে প্রাথমিক পড়াশোনার পাট চুকতেই কিশোর অতুল বসু চলে এলেন কলকাতায়। সেটা ১৯১০ সাল, বঙ্গভঙ্গ পরবর্তী নানান রাজনৈতিক আন্দোলনে বিক্ষুব্ধ ব্রিটিশ রাজধানী। সেই অস্থির সময়ের প্রভাব পড়ে ১২ বছরের কিশোরের উপরও। ওই অল্পবয়সেই বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েন অতুল বসু। এর কিছুদিন পরেই তাঁকে ভর্তি করা হয় জুবিলি আর্ট একাডেমিতে। রণদা গুপ্তের হাতে তৈরি এই আর্ট একাডেমির পড়াশোনার ধরন ছিল বাংলার আর দশটা ইস্কুল-কলেজের থেকে একেবারে আলাদা। আর্টের প্রতি আগ্রহ বাড়ার পাশাপাশি এই জুবিলিতেই তিনি সহপাঠী হিসাবে পেয়েছিলেন হেমেন্দ্রনাথ মজুমদার, ভবানীচরণ লাহাকে।

জুবিলি আর্ট একাডেমিতে বছর তিনেক পড়াশোনার পর তিনি ভর্তি হলেন গরাণহাটার গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টসে। ততদিনে শিল্পী হওয়ার বাসনা পাকাপাকি জায়গা করে নিয়েছে অতুল বসুর মনে। সরকারি আর্ট স্কুলে সেসময় রথী মহারথীর ভিড়। এখানেই শিক্ষক হিসাবে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও পার্সি ব্রাউনের সাহচর্য পান অতুল বসু। এখানকার ছাত্র থাকাকালীন সময়ে তিনি লন্ডনে অধ্যয়ন এবং ইউরোপ জুড়ে বিশেষ ভ্রমণের বৃত্তি পান। পরিচিত হয়ে ওঠেন বিশ্বজোড়া শিল্পভুবনের সঙ্গে।

Atul Basu family
আলিপুর চিড়িয়াখানায় স্ত্রী দেবযানীর সঙ্গে অতুল বসু

১৯১৮তে আর্ট কলেজ পাশ করেন অতুল বসু। ঠিক এক বছর পর, ১৯১৯-এ হেমেন্দ্রনাথ মজুমদার গড়ে তুললেন ইন্ডিয়ান একাডেমি অফ আর্ট। গোড়া থেকেই এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন অতুল বসু। ১৯২১-এ তাঁর ঐকান্তিক চেষ্টায় আর ভবানীচরণ লাহার সহযোগিতায় জন্ম হল সোসাইটি অফ ফাইন আর্টসের। কিন্তু দেশিয় চিত্রশিল্পের সীমিত গণ্ডিতে আটকে থাকার মানুষ ছিলেন না অতুল বসু। তাঁকে টানছিল পাশ্চাত্য শিল্পের বিরাট আকাশ। রবি বর্মাসুলভ ফিগার ড্রয়িং বা পোট্রেট শিল্পের দেশিয় ধারাকে অস্বীকার করে পাশ্চাত্য রিয়্যালিস্টিক শিল্পকলার সপক্ষে জোর সওয়াল শুরু করেন অতুল বসু। এর কিছুদিন পরেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘গুরুপ্রসন্ন বৃত্তি’ পেয়ে বিলেত পাড়ি দেন তিনি, ভর্তি হন লন্ডনে, রয়্যাল একাডেমির ছাত্র হিসেবে। 

অতুল বসুর বিখ্যাত তৈলচিত্রে, পোট্রেটে এমনকি ল্যান্ডস্কেপেও পশ্চিমী ঘরানার শিল্পকলায় প্রভাব নিঃসন্দেহে প্রবল। মানবশরীরের সূক্ষ্ম রেখা, ভাঁজ, ছোট ছোট অ্যানাটমিক ডিটেইল মূর্ত হয়ে উঠত তাঁর ছবিতে। এই প্রসঙ্গে অবশ্যই উল্লেখ করতে হয় তাঁর ১৯২১ সালে আঁকা ‘The Bengal Tiger’ নামের আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের বিখ্যাত স্কেচটির কথা। একটা গল্প প্রচলিত আছে এই ছবিটি নিয়ে। শোনা যায়, বাংলার বাঘ আশুতোষ মুখার্জির এই আবক্ষ ছবিটি মাত্র ১৫ মিনিটে এঁকেছিলেন অতুল বসু। আজও এক দক্ষ শিল্পীর পেনসিলের আঁচড়ের সাক্ষ্য বহন করে ছবিটি।

Atul Basu 1
'The Bengal Tiger', আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের বিখ্যাত স্কেচ

১৯২৪-২৬, টানা দুবছর ছাত্র হিসাবে রয়্যাল একাডেমিতে কাটান অতুল বসু। সেখানে থাকাকালীন পোস্ট ইমপ্রেশনিস্ট ওয়াল্টার সিকার্টের কাজ নতুন করে প্রভাবিত করে তাঁকে। এইসময় উইন্ডসোর দুর্গ এবং বাকিংহাম প্রাসাদে সংরক্ষিত একাধিক ছবির প্রতিকৃতি আঁকেন তিনি। বিলেতের মাটিতে ছবি আঁকার স্বীকৃতিস্বরূপ পান বিখ্যাত ‘আইভরি’ পুরস্কার। আজও তাঁর আঁকা বহু প্রতিকৃতি রক্ষিত আছে লন্ডনের বাকিংহাম প্রাসাদে। 

অতুল বসুর বিখ্যাত ছবিগুলোর অধিকাংশই তেল রঙে আঁকা। পাশাপাশি রয়েছে কিছু অসাধারণ পেন অ্যান্ড ইংকের কাজ। মূলত পোট্রেটশিল্পী হিসাবে তাকে দাগিয়ে দেওয়া হলেও তাঁর ঝুলিতে রয়েছে বেশ কিছু অসাধারণ ল্যান্ডস্কেপ, রয়েছে সমকালের দলিল শ্রমজীবী মানুষের ছবি। এই প্রসঙ্গে খুব স্বাভাবিকভাবেই এসে পড়ে নোয়াখালির দাঙ্গার সময়ে তাঁর আঁকা গান্ধীজীর চিন্তামগ্ন পোট্রেট বা ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষের পটভূমিকায় আঁকা famine সিরিজের কথা, যেখানে পেনসিল আর ইংক মিডিয়ামে একের পর এক উঠে এসেছে মুমূর্ষু কংকালসার মানুষের ছবি।

Atul Basu 3
Famine সিরিজের অন্যতম একটি ছবি

বিলেত থেকে ফিরেই তিনি যোগ দিলেন কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজের শিক্ষক হিসাবে। শিল্পী রথীন মৈত্রের সঙ্গে আঁকাও শেখাতেন একাডেমি অফ ফাইন আর্টসে। তাঁর সহজ উপস্থাপনার গুণে ফিগার ড্রয়িংয়ের নানা খুঁটিনাটি সহজ হয়ে যেত আর্টের ছাত্রদের কাছে। শিক্ষক হিসাবেও অতুল বসু ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। 

১৯২৬-১৯৪০ এই সময়কালকে বলা চলে শিল্পী অতুল বসুর জীবনের স্বর্ণযুগ। এই গোটা সময়কাল জুড়েই একের পর এক ছবি, স্কাল্পচারের কাজ করে গেছেন নিরলসভাবে। শুধু ছবি আঁকাই নয়, শিল্প প্রতিষ্ঠান গঠনেও বিশেষ ভূমিকা পালন করেন তিনি। ১৯৩৩ সালে প্রদোৎকুমার ঠাকুরের উদ্যোগে একাডেমি অফ ফাইন আর্টস গড়ে ওঠার ক্ষেত্রেও পাশে ছিলেন অতুল বসু। ১৯৪৫-৪৮ সাল পর্যন্ত তিনি গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টসের অধ্যক্ষও ছিলেন। দেশকালের সীমার ঊর্ধ্বে উঠে সারা পৃথিবীর শিল্প ভুবনকে আত্মস্থ করতে চেয়েছিলেন অতুল বসু। বাঙালি হয়েও সর্বার্থেই তিনি ছিলেন এক আন্তর্জাতিক উচ্চতার শিল্পী।

ছবি: পুত্রবধূ ইলোরা বসুর পারিবারিক অ্যালবাম থেকে

Saswati Sanyal Author

একের দশকের বাংলা কবিতার পরিচিত নাম। পেশায় সাংবাদিক। পেয়েছেন বাংলা আকাদেমি শক্তি চট্টোপাধ্যায় সম্মাননা সহ একাধিক পুরস্কার। আগ্রহ আছে থিয়েটার ও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *