গত বছর একটা অনুষ্ঠানে ভারতের ‘ব্যাডমিন্টনের ভগবান’ নন্দু নাটেকরকে বলতে শুনেছিলাম যে ব্যাডমিন্টনে এখন আমাদের স্বর্ণালী অধ্যায়। মেয়ে খেলোয়াড়দের বেজায় প্রশংসা করেছিলেন তিনি বিশেষ করে সাইনা নেহওয়াল আর পি ভি সিন্ধুর। আর আজকে সত্যি করে সেই পুসরলা ভেঙ্কট সিন্ধুই সোনা নিয়ে এলেন ভারতে।
কর্মসূত্রে পি ভি সিন্ধুর সঙ্গে এক বার কথা হয়েছিল, ২০১৭-র ব্যাডমিন্টন ওয়র্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ-এর পর। লম্বা, ছিপছিপে,শ্যামলা মেয়েটিকে এক নজরে ভাল লাগতে বাধ্য। একটুক ঔদ্ধত্য নেই।নম্র, বিনয়ী মানুষ। ফাইনালে হেরে যাওয়ার পরও কী অসম্ভব আত্মবিশ্বাসী দেখাচ্ছিল তাঁকে। চোখের ভাষাই বলে দিচ্ছিল, যে কতটা অনমনীয় তাঁর জেতার জেদ। তখনই মনে হয়েছিল বিশ্বচ্যাম্পিয়নের খেতাব পাওয়াটা স্রেফ সময়ের অপেক্ষা।
আর আজ ঠিক দু্’বছর পর ২০১9৯-এর টুর্নামেন্টের ফলটাকে পুরো উলটে দিলেন আর তা-ও প্রবল দাপটে। ২০১৭ সালে যাঁর কাছে পর্যদুস্ত হয়েছিলেন, জাপানের সেই নোজেমি ওকুহারাকে রীতিমতো নাস্তানাবুদ করলেন সিন্ধু। প্রথম থেকেই একেবারে বিধ্বংসী মেজাজে ছিলেন উনি। এ রকম একপেশে ফিনালে আগে কখনও হয়েছে কি না সন্দেহ। সোজা ২১-৭, ২১-৭ সেটে হারিয়ে সোনার পদক জিতে সিন্ধু স্বভাবতই উচ্ছ্বসিত। জন্মদিনে মা-কে এ রকম একটা উপহার দিতে পেরেছেন বলে বেজায় খুশি। নিজেই জানিয়েছেন সেই কথা। আর অবদান স্বীকার করেছেন নিজের কোচ পুলেল্লা গোপীচাঁদ। প্রথম ভারতীয় হিসেবে যে নজির গড়লেন সিন্ধু তা সত্যিই দেশবাসীর কাছে অত্যন্ত গর্বের বিষয়। কারণ এর আগে কোনও ভারতীয় এই খেতাব জয় করতে পারেননি।
তবে ব্যাডমিন্টন নয়, সিন্ধুর প্রথম ভালবাসা ছিল ভলিবল। উচ্চতা ছিল প্লাস পয়েন্ট। কিন্তু পুল্লেলা গোপীচন্দের খেলা দেখে ব্যাডমিন্টনকে ভালবেসে ফেলেন। তখন কিন্তু তাঁর বয়স মোটে আট। কিন্তু ভাল খেলার একটা অদম্য খিদে ছিল ওঁর মধ্যে। ছোট থেকেই বেজায় ডিসিপ্লিনড ছিলেন। প্রতি দিন ৫৬ কিলোমিটার যাতায়াত করতেন গোপীচাঁদের অ্যাকাডেমিতে খেলা শিখতে আসার জন্য। আসলে বাড়িতে বরাবরই খেলাধুলো নিয়ে উৎসাহ পেয়েছেন। বাবা পি ভি রামানা ও মা পি বিজয়া দুজনেই জাতীয় স্তরে ভলিবল খেলেছেন। ওঁর দিদি পেশায় ডাক্তার হলেও জাতীয় পর্যায় হ্যান্ডবল খেলেছেন। ফলে ছোট থেকেই বাড়িতে খেলাধুলো, অনুশাসন, নিয়মানুবর্তিতার পরিবেশ পেয়েছেন। আর সেটাই ওঁর খেলায় চোখে পড়ে। গোপীচাঁদও মনে করেন সিন্ধুর ‘নেভার সে ডাই স্পিরিটই’ ওঁকে অন্যদের চেয়ে কয়েক ধাপ এগিয়ে রাখে। ছোট থেকেই বহু টুর্নামেন্ট জিতেছেন সিন্ধু। আন্তর্জাতির মঞ্চে মাত্র ১৬ বছর বয়সে আত্মপ্রকাশ করার পর থেকেই নজর কেড়েছেন তিনি। তবে ২০১৬-র অলিম্পিকে রূপোর মেডেল প্রাপ্তি আলাদা করে মনে রাখার মতো। ইতিমধ্যে অর্জুন পুরস্কার, রাজীব গাঁধী খেল রত্ন পুরস্কার ও পদ্মশ্রী-র মতো সম্মানে ভূষিত হয়েছেন তিনি। কিন্তু আজকের এই জয় আর সমস্ত কিছুকেই বোধহয় ছাপিয়ে গেছে। কারণ এই গল্প তো একটা লড়াই-এর। নিজেকে নিরন্তর প্রমাণ করার লড়াইয়ের। ২০১৭, ২০১৮-র ফাইনালে হেরে যাওয়ার পর নানা মন্তব্য, বিদ্রুপ শুনতে হয়েছিল তাঁকে। প্রশ্ন উঠেছিল তাঁর জেতার মানসিকতা নিয়েও। আজ সেই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিলেন তিনি। কতটা শারীরিক এবং মানসিক পরিশ্রম করেছেন জানিয়ে দিলেন নিজের র্যাকেটের দাপটে। মাত্র ২৪ বছর বয়সেই সিন্ধু বুঝিয়ে দিলেন যে উনি সত্যি বড় মঞ্চের খেলোয়াড়। শাবাশ সিন্ধু!