আগের পর্বের লিংক:
[১] [২] [৩] [৪] [৫] [৬] [৭] [৮] [৯] [১০] [১১] [১২] [১৩] [১৪]
জন্তুদের মধ্যে ফ্রেডরিক বিরোধী মনোভাব দিন-কে-দিন বেড়েই চলল। এক রবিবার সকালবেলা হঠাৎ করে নেপোলিয়নের উদয় হল গোলাঘরে। সকলকে সে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিল যে, পড়ে থাকা ওই গাছের গুঁড়ি ফ্রেডরিকের কাছে বিক্রি করার কথা কখনও তার সুদূর কল্পনাতেও আসেনি। এমন হাড়-বজ্জাত লোকের সঙ্গে কোনওরকম কারবার করাটাও তার কাছে যথেষ্ট অসম্মানজনক।
যে-পায়রাগুলো আশেপাশের খামারে বিপ্লবের জোয়ার ছড়িয়ে বেড়ায় তাদের ফক্সউডের ধারও মাড়াতে বারণ করে দেওয়া হল। পায়রাদের স্লোগান ছিল ‘মানবজাতি মুর্দাবাদ’। সেটাকে বদলে ‘ফ্রেডরিক মুর্দাবাদ’ করার হুকুম জারি হল।
স্নোবলের আরও একটা ষড়যন্ত্রের কথা ফাঁস হল গ্রীষ্মের শেষ দিকে। এ-বছর গমের ক্ষেতে প্রচুর আগাছা জন্মেছে। আবিষ্কৃত হল, স্নোবল তার কোনও এক নৈশ অভিযানের সময় এই কুকর্মটি করেছে। গমের বীজের সঙ্গে বেশটি করে আগাছার বীজও মিশিয়ে রেখে গেছে। একটা রাজহাঁস স্নোবলকে গোপনে এ-কাজ করতে সাহায্য করেছিল। সে স্কুইলারের কাছে এসে সব দোষ স্বীকার করল এবং বিষাক্ত তিতবেগুনের ফল খেয়ে তৎক্ষণাৎ আত্মহত্যা করল।
জন্তুরা এখন জানতে পেরেছে যে স্নোবলকে না কি কখনওই ‘প্রথম শ্রেণীর জানোয়ার বাহাদুর’ খেতাব দেওয়া হয়নি। যদিও তাদের কয়েকজন মনে করে ব্যাপারটা সত্যি। কিন্তু আসলে তা নয়। এটা একটা গল্প মাত্র, যা স্নোবল নিজেই প্রচার করেছিল গোয়ালঘরের যুদ্ধের পরে। স্নোবলকে সম্মান জানানো তো দূর-অস্ত বরং গোয়ালঘরের যুদ্ধে কাপুরুষের মতো আচরণ করার জন্য ভালোমতো তিরস্কার করা হয়েছিল তাকে।
এ-সব কথা শুনে একদল জন্তু তো ফের হতভম্ব হয়ে গেল। তখন মাঠে নামল স্কুইলার। সে তুরন্ত জন্তুদের বুঝিয়ে ফেলল যে, তাদের স্মৃতিশক্তি মোটেই ভালোভাবে কাজ করছে না। তারা অনেক কিছুই ভুলে গেছে।

শরৎকালে ফসল কাটার সময় জন্তুরা মুখে রক্ত তুলে পরিশ্রম করল। ফলে শুধু ফসল কাটাই নয়, হাওয়া-কলের কাজও একইসঙ্গে শেষ হয়ে গেল। তবে এখনও কোনও যন্ত্রপাতি বসানো হয়নি। সে-সব কেনার ব্যাপারে হুইম্পার দরাদরি চালাচ্ছে। তবে মূল কাঠামোটা যে খাড়া করা গেছে, সেটাই নিশ্চিন্ত। তাদের অনভিজ্ঞতা, মন্দ ভাগ্য, সেকেলে হাতিয়ার বা স্নোবলের বিশ্বাসঘাতকতা— এতসব বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও তারা একেবারে কাঁটায়-কাঁটা মিলিয়ে নির্দিষ্ট দিনেই হাওয়া কলের কাজ শেষ করেছে।
জন্তুরা এখন ক্লান্ত হলেও গর্বিত। ওরা নিজেদের তৈরি সেই অপূর্ব শিল্পকর্ম ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল। প্রথমবারের চেয়েও এবারের হাওয়া-কলটা যেন আরও বেশি সুন্দর ঠেকছে তাদের চোখে। দেওয়ালগুলো আগের চেয়ে দ্বিগুণ পুরু হয়েছে। বিস্ফোরক বাদে এবার আর কোনও কিছু দিয়েই এ-দেওয়াল টলানো যাবে না।
জন্তুদের মনে পড়ছে ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। কী অমানুষিক পরিশ্রমটাই না তারা করেছে! হতাশার ঢেউ তাদের উপর আছড়ে পড়েছে বারংবার, তবু তারা নতুন উদ্যমে কাজ চালিয়ে গেছে। হাওয়া-কল চালু হলে, যেই না ডায়নামো চলতে শুরু করবে, অমনি একেবারে আমূল বদলে যাবে তাদের জীবনটা। এসব ভাবতে ভাবতেই তাদের শরীরের ক্লান্তিভাব যেন বেমালুম উবে গেল। আনন্দে আত্মহারা হয়ে তারা তিড়িং-বিড়িং করে লাফাতে লাফাতে আর জয়ধ্বনি দিতে দিতে হাওয়া-কলের চারপাশে চক্কর দিতে লাগল। স্বয়ং নেপোলিয়ন তার সেই বাচ্চা মোরগটি সহ, কুকুর পরিবেষ্টিত হয়ে হাওয়া-কল পরিদর্শনে এল। সে ব্যক্তিগতভাবে জন্তুদের অভিনন্দন জানাল তাদের সাফল্যের জন্য এবং ঘোষণা করল হাওয়া-কলটার নাম দেওয়া হবে ‘নেপোলিয়ন মিল’।
দু’দিনের মাথায় একটা বিশেষ সভার জন্য জন্তুদের ডেকে এনে একজোট করা হল গোলাবাড়ির উঠোনে। সেখানে নেপোলিয়ন ঘোষণা করল যে, কাঠের পাঁজাটা সে ফ্রেডরিককে বিক্রি করেছে। আগামীকাল থেকেই ফ্রেডরিকের গাড়ি এসে কাঠ নিয়ে যেতে শুরু করবে। জন্তুরা এ-কথা শুনে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। সবাই এতদিন ধরে ভাবছিল পিলকিংটনের সঙ্গে নেপোলিয়নের সদ্ভাব রয়েছে, ওদিকে নেপোলিয়ন গোপনে চুক্তি করেছে ফ্রেডরিকের সঙ্গে!
জন্তুদের মনে পড়ছে ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। কী অমানুষিক পরিশ্রমটাই না তারা করেছে! হতাশার ঢেউ তাদের উপর আছড়ে পড়েছে বারংবার, তবু তারা নতুন উদ্যমে কাজ চালিয়ে গেছে। হাওয়া-কল চালু হলে, যেই না ডায়নামো চলতে শুরু করবে, অমনি একেবারে আমূল বদলে যাবে তাদের জীবনটা। এসব ভাবতে ভাবতেই তাদের শরীরের ক্লান্তিভাব যেন বেমালুম উবে গেল।
ফক্সউডের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে দেওয়া হল। অপমান করে চিঠি লেখা হল পিলকিংটনকে। পায়রাদের বলা হল পিঞ্চফিল্ড খামার এড়িয়ে চলতে। তাদের স্লোগানটাকেও বদলে ‘ফ্রেডরিক মুর্দাবাদ’ থেকে ‘পিলকিংটন মুর্দাবাদ’ করে দেওয়া হল। একই সঙ্গে নেপোলিয়ন জন্তুদের এই বলে আশ্বস্ত করল যে, অ্যানিম্যাল ফার্ম-এর উপর আক্রমণ হতে পারে বলে যে-কথা রটেছে তা পুরোপুরি মিথ্যে। এমন কোনও সম্ভাবনাই নেই। এমনকি ফ্রেডরিক তার খামারের জন্তুদের উপর যে নির্দয় অত্যাচার করে বলে জানা গেছে সে-খবরও অনেকটাই রং চড়ানো। এ-সব গুজব স্নোবল আর তার সাঙ্গোপাঙ্গরা মিলে ছড়িয়েছে। এবার এটাও বেশ বোঝা যাচ্ছে যে, স্নোবল আর যেখানেই থাকুক না কেন, পিঞ্চফিল্ডে তো নেই। সে জীবনেও কোনওদিন সেখানে যায়নি। বরং সে রয়েছে ফক্সউডে। শুধু রয়েছে তা-ই নয়, দিব্যি বিলাসিতায় জীবন কাটছে তার। আসলে সে গত কয়েক বছর ধরেই পিলকিংটনের কাছ থেকে পেনশন পাচ্ছে।

নেপোলিয়নের চালাকির নমুনা দেখে শুয়োরদের আনন্দ আর ধরে না। পিলকিংটনের সঙ্গে একটা বন্ধুত্বের ভাব দেখিয়ে সে ফ্রেডরিককে কাঠের দাম বারো পাউন্ড বাড়াতে বাধ্য করেছে। তবে স্কুইলারের কথা অনুযায়ী নেপোলিয়নের বুদ্ধিমত্তার সবচেয়ে বড় পরিচয় এখানেই যে, সে কাউকেই বিশ্বাস করে না। এমনকি ফ্রেডরিককেও নয়। ফ্রেডরিক কাঠের দাম দিতে চেয়েছিল চেক-এ। চেক কী? চেক আর কিছুই নয়, একটা কাগজের টুকরো মাত্র। তাতে যে টাকার অংকটা লেখা থাকে সেই পরিমাণ টাকাই না কি পাওয়া যায়! কিন্তু ও-সব চালাকি নেপোলিয়নের কাছে কখনও চলে! সে দাবি করল তাকে পাঁচ পাউন্ডের নোটে সমস্ত টাকা আগে মিটিয়ে দিতে হবে, তবে গিয়ে সেই কাঠের পাঁজা হাতবদল হবে।
ফ্রেডরিক ইতিমধ্যেই তার দাবি মেনে টাকা দিয়ে দিয়েছে। হাওয়া-কলের যন্ত্রপাতি কেনার জন্য সেই টাকা যথেষ্ট। পরদিন থেকে ফ্রেডরিকের গাড়ি এসে খুব দ্রুত কাঠ সরানো শুরু করে দিল। ওদের যেন বড্ড বেশি তাড়া। দেখতে দেখতে কাঠের পাঁজা পুরো খালি হয়ে গেল। তখন আবার একটা বিশেষ সভা ডাকা হল গোলাঘরের উঠোনে। এই সভায় ফ্রেডরিকের দেওয়া ব্যাংক নোটগুলোর প্রদর্শনী করা হবে জন্তুদের সামনে। মঞ্চের খড়ের গাদায় আধ-শোয়া হয়ে রয়েছে নেপোলিয়ন। সে আজ তার দু’টি মেডেলই বুকে ঝুলিয়ে রেখেছে। মুখে পরিতৃপ্তির হাসি। তার ঠিক পাশেই খামারবাড়ির রান্নাঘর থেকে আনা চিনেমাটির পিরিচে টাকাগুলো যত্ন করে সাজানো। জন্তুরা সারি বেঁধে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে, তারপর আশ মিটিয়ে দু’চোখ ভরে দেখছে। বক্সার পালা এলে সে তার নাক নামিয়ে এনে শুঁকে দেখতে গেল টাকাগুলোকে। টাকার সাদা ফিনফিনে কাগজ তার নিশ্বাসের দমকে ফরফর করে উঠল।
দিন-তিনেক পরে ভয়ানক হুড়দঙ্গল শুরু হল। হুইম্পার দ্রুতবেগে সাইকেল চালিয়ে এসে হাজির হল খামারে। তার মুখটা পুরো মড়ার মতো ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। সাইকেলটাকে উঠোনের একপাশে কোনওমতে ফেলে দিয়ে সে এক দৌড়ে খামারবাড়ির ভেতর ঢুকে গেল। তার পরমুহূর্তেই নেপোলিয়নের ক্রুদ্ধ কণ্ঠের আর্তনাদ শোনা গেল। কী কাণ্ডটা ঘটেছে সে-খবরও ক্ষণিকের মধ্যেই দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল খামার জুড়ে। ব্যাংক নোটগুলো সব জাল! অর্থাৎ ফ্রেডরিক সেই কাঠের পাঁজা একেবারে মুফতেই হাসিল করে নিয়ে গেছে।
পরদিন থেকে ফ্রেডরিকের গাড়ি এসে খুব দ্রুত কাঠ সরানো শুরু করে দিল। ওদের যেন বড্ড বেশি তাড়া। দেখতে দেখতে কাঠের পাঁজা পুরো খালি হয়ে গেল। তখন আবার একটা বিশেষ সভা ডাকা হল গোলাঘরের উঠোনে। এই সভায় ফ্রেডরিকের দেওয়া ব্যাংক নোটগুলোর প্রদর্শনী করা হবে জন্তুদের সামনে। মঞ্চের খড়ের গাদায় আধ-শোয়া হয়ে রয়েছে নেপোলিয়ন। সে আজ তার দু’টি মেডেলই বুকে ঝুলিয়ে রেখেছে। মুখে পরিতৃপ্তির হাসি।
নেপোলিয়ন সব জন্তুদের একজোট করে রক্ত-জল-করা গলায় ফ্রেডরিকের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করল। বলল, ফ্রেডরিককে ধরতে পারলে জ্যান্ত সেদ্ধ করা হবে। সেই সঙ্গে সকলকে সাবধান করল— একবার যখন এমন বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে তখন এর চেয়ে খারাপ কিছু ঘটারও সম্ভাবনা থাকতে পারে। হয়তো ফ্রেডরিক আর তার দলবল মিলে যেকোনও সময় অ্যানিম্যাল ফার্ম আক্রমণ করবে, যে-আক্রমণের কথা তারা এতদিন ধরে আশঙ্কা করে এসেছে। খামারে ঢোকার সমস্ত পথে পাহারা বসানো হল। সঙ্গে চারটি পায়রাকে পাঠানো হল ফক্সউডে, সন্ধি প্রস্তাব-সহ। আশা করা যায় এতে করে পিলকিংটনের সঙ্গে পুরনো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কটা আবার ফিরে পাওয়া যাবে।

ঠিক পরদিন সকাল থেকেই আক্রমণ শুরু হল। জন্তুরা তখন সবেমাত্র জলখাবারে মুখ দিয়েছে এমন সময় পাহারাদারেরা ছুটতে ছুটতে এসে খবর দিল যে, ফ্রেডরিক আর তার দলবল পাঁচ-গরাদের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়েছে। জন্তুরা তৎক্ষণাৎ হই-হই করে ছুটে গেল ওদের আটকানোর জন্য। কিন্তু গোয়ালঘরের যুদ্ধে যতটা সহজে জেতা গিয়েছিল, এবার কিন্তু তেমনটা হল না। উল্টো দিকে পনেরোজন মানুষের দল, তাদের সঙ্গে আবার হাফ ডজন বন্দুক৷ পঞ্চাশ গজের হাতার মধ্যে কোনও একটা জন্তুকে পেলেই তারা দমাদ্দম গুলি চালিয়ে দিচ্ছে৷ জন্তুরা বন্দুকের সেই আগুন-ঝরা গর্জন আর গুলি-বৃষ্টির সামনে একেবারে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। নেপোলিয়ন আর বক্সার অনেক চেষ্টা করেও তাদের একত্র করতে পারল না৷ বাধ্য হয়ে সকলকেই পিছু হটতে হল৷ ইতিমধ্যেই অনেক জন্তু আহত হয়েছে। বিপদ বুঝে ওরা খামারবাড়ির ভেতরে ঢুকে আশ্রয় নিল৷ তারপর ফাঁক-ফোকরে চোখ লাগিয়ে সাবধানে দেখতে লাগল বাইরে কী ঘটছে। বিশাল ঘাসজমি থেকে শুরু করে হাওয়া-কল পর্যন্ত সবই এখন শত্রুদের কব্জায়৷ সেই মুহূর্তে নেপোলিয়নও যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছে বলে মনে হল। লেজটা তার সোজা হয়ে উঠে কাঁপছে তিরতির করে। কোনও কথা না বলে সে অস্থিরভাবে ঘরময় পায়চারি করছে আর মাঝে মাঝে ব্যাকুল চোখে ফক্সউডের দিকে তাকাচ্ছে। পিলকিংটন আর তার দলবল যদি এসে সাহায্য করে, তা হলে হয়তো এখনও জেতার সম্ভাবনা আছে।
ঠিক সেই সময়েই যে-চারটি পায়রাকে গতকাল ফক্সউডে পাঠানো হয়েছিল তারা ফিরে এল। সঙ্গে পিলকিংটনের তরফ থেকে একটা চিরকুট। তাতে লেখা— ‘বেশ হয়েছে৷’
ইতোমধ্যে ফ্রেডরিক আর তার দলবল গিয়ে জুটেছে হাওয়া-কলের কাছে৷ সেই দেখে জন্তুদের মধ্যে একটা চাপা আতঙ্কের ফিসফিসানি ছড়িয়ে পড়ল। ফ্রেডরিকের দলের দু’জন লোক শাবল আর লম্বা হাতলওয়ালা একটা হাতুড়ি তুলে নিয়েছে। ওরা এবার হাওয়া কলটাকে ভেঙে ফেলবে৷
নেপোলিয়ন চিৎকার করে উঠল, “অসম্ভব! আমরা যে-রকম পুরু করে দেওয়াল বানিয়েছি তাতে ওরা এক সপ্তাহেও ওটা ভেঙে উঠতে পারবে না৷ ভরসা রাখো, কমরেডস।”
বিপদ বুঝে ওরা খামারবাড়ির ভেতরে ঢুকে আশ্রয় নিল৷ তারপর ফাঁক-ফোকরে চোখ লাগিয়ে সাবধানে দেখতে লাগল বাইরে কী ঘটছে। বিশাল ঘাসজমি থেকে শুরু করে হাওয়া-কল পর্যন্ত সবই এখন শত্রুদের কব্জায়৷ সেই মুহূর্তে নেপোলিয়নও যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছে বলে মনে হল। লেজটা তার সোজা হয়ে উঠে কাঁপছে তিরতির করে। কোনও কথা না বলে সে অস্থিরভাবে ঘরময় পায়চারি করছে আর মাঝে মাঝে ব্যাকুল চোখে ফক্সউডের দিকে তাকাচ্ছে। পিলকিংটন আর তার দলবল যদি এসে সাহায্য করে, তা হলে হয়তো এখনও জেতার সম্ভাবনা আছে।
বেঞ্জামিন একমনে বাইরের মানুষগুলোর কার্যকলাপ দেখছিল৷ শাবল আর হাতুড়িওয়ালা লোক দুটো এখন হাওয়া-কলের ভিতের কাছে একটা গর্ত খুঁড়ছে। সেই দেখে ধীরে ধীরে নিজের লম্বা মুখটা দোলাতে লাগল বেঞ্জামিন। যেন খুব মজার ব্যাপার হয়েছে কিছু একটা৷
সে বলল, “ঠিক ধরেছিলাম৷ তোমরা কি এখনও বুঝতে পারছ না ওরা কী করতে চাইছে? দেখো, ওরা এবার গর্তটায় বিস্ফোরক পাউডার ঠেসে দেবে৷”
তুমুল আতঙ্কে জন্তুরা দম বন্ধ করে অপেক্ষা করতে লাগল৷ খামারবাড়ির এই নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে এই মুহূর্তে বাইরে বেরোনোর কোনও প্রশ্নই ওঠে না।
কয়েক মিনিটের মধ্যে দেখা গেল মানুষগুলো হাওয়া-কল ছেড়ে যে যেদিকে পারল পড়িমড়ি করে দৌড় দিল৷ তারপরেই এক ভয়ঙ্কর কান-ফাটানো শব্দ! পায়রাগুলো আকাশে চক্কর দিতে লাগল৷ নেপোলিয়ন বাদে বাকি জন্তুরা সব উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে মুখ ঢেকে ফেলল৷ যখন তারা ফের মাটি ছেড়ে উঠল, ততক্ষণে হাওয়া-কলের জায়গাটা ঘন কালো ধোঁয়ায় ঢেকে গেছে। ধীরে ধীরে হাওয়ার তোড়ে সেই ধোঁয়া উবে যেতেই দেখা গেল হাওয়া কলটা আর নেই।

সেই দৃশ্য দেখে জন্তুদের মাথায় একেবারে যেন রক্ত চড়ে গেল৷ এতক্ষণ ধরে ভয় আর হতাশার যে বোধটা তাদের উপর চেপে বসেছিল, তা যেন এক লহমায় মিলিয়ে গেল। তার জায়গা নিল ভয়ংকর রাগ। গর্জন করে উঠল জন্তরা, প্রতিশোধ চাই। এই ঘৃণ্য কাজের বদলা নিতে হবে৷ কেউ কোনও নির্দেশের অপেক্ষা করল না আর৷ একজোট হয়ে শত্রুপক্ষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। শিলাবৃষ্টির মতো গুলি ঝরে পড়ছে, তবু তারা ভ্রূক্ষেপ পর্যন্ত করল না। যুদ্ধ শুরু হল৷ নৃশংস, তিক্ত এক যুদ্ধ৷
মানুষের দল বারংবার গুলি চালাচ্ছে৷ জন্তুরা কোনওক্রমে তাদের কাছে গিয়ে পড়লে হয় লাঠির বাড়ি মেরে, নইলে বুট জুতোর লাথি কষিয়ে হটিয়ে দিচ্ছে৷ এরই মধ্যে একটা গোরু, তিনটে ভেড়া আর দুটো রাজহাঁস মারা পড়েছে৷ অল্পবিস্তর আহত হয়েছে সকলেই৷ এমনকি নেপোলিয়ন, যে কি না একেবারে পেছন থেকে যুদ্ধের নেতৃত্ব দিচ্ছিল তারও পর্যন্ত লেজের ডগা উড়ে গেছে গুলি লেগে৷ তবে মানুষের দলও যে একেবারে অক্ষত রয়েছে তা নয়৷ বক্সারের খুরের ঘায়ে তিন জনের মাথা ফেটেছে। একজনের পেট ফুঁড়ে গেছে গোরুর শিং-এর গুঁতো খেয়ে৷ জেসি আর ব্লুবেল একজনের পাতলুন ফর্দাফাঁই করে দিয়েছে৷ একসময় নেপোলিয়নের দেহরক্ষী সেই ন’টা কুকুর তার নির্দেশমতো ঝোপের আড়ালে গা-ঢাকা দিয়ে ঘুরপথে পৌঁছে গেল মানুষদের কাছাকাছি। তারপর রক্ত জল করা গর্জন করতে করতে বেরিয়ে এল ঝোপ থেকে৷ এবার মানুষেরা ভয় পেয়ে গেল৷ তারা দিব্যি বুঝতে পারল বিপদ তাদের ঘিরে ধরছে একটু একটু করে৷ ফ্রেডরিক চিৎকার করে সকলকে সময় থাকতে থাকতে কেটে পড়তে বলল। পরমুহূর্তেই দেখা গেল শত্রুপক্ষ ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’ বলে কাপুরুষের মতো দৌড় দিয়েছে। জন্তরা মাঠের প্রান্ত পর্যন্ত ওদের ধাওয়া করে গেল৷ এমনকি মানুষের দল যখন কাঁটাঝোপের মধ্যে দিয়ে হ্যাঁচর-প্যাঁচর করে পালাচ্ছিল তখন ওদের শেষবারের মতো কয়েকটা লাথি কষাতেও ছাড়ল না।
তারা জিতেছে বটে কিন্তু সকলেই বড্ড ক্লান্ত আর রক্তাক্ত৷ তারা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ধীর পদক্ষেপে খামারের দিকে ফিরে চলল৷ তাদের মৃত সঙ্গীদের দেহ ঘাসের উপর ইতি-উতি ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে৷ সেই দেখে কারও কারও চোখে জল এল৷ সকলেরই মন ভার৷ সেই অবস্থাতেই ওরা যেখানে একসময় হাওয়া-কলটা ছিল সেখানে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। দুঃখ মেশানো নীরবতায় ছেয়ে গেল চারিপাশ৷ সব শেষ! তাদের পরিশ্রমের অন্তিম চিহ্নটুকুও মুছে গেছে৷ এমনকি ভিতটা পর্যন্ত অনেকখানি ধ্বংস হয়ে গেছে৷ যদি তারা আবার হাওয়া কলটাকে বানাতে চায়, তা হলে আর আগের পাথরগুলোকে পাওয়া যাবে না৷ বিস্ফোরণের চোটে সেগুলো সব কয়েকশো গজ দূরে ছিটকে পড়ে উধাও হয়েছে৷ দেখে মনে হচ্ছে এখানে যেন কখনও হাওয়া-কল বলে কোনও বস্তু ছিলই না।
একসময় নেপোলিয়নের দেহরক্ষী সেই ন’টা কুকুর তার নির্দেশমতো ঝোপের আড়ালে গা-ঢাকা দিয়ে ঘুরপথে পৌঁছে গেল মানুষদের কাছাকাছি। তারপর রক্ত জল করা গর্জন করতে করতে বেরিয়ে এল ঝোপ থেকে৷ এবার মানুষেরা ভয় পেয়ে গেল৷ তারা দিব্যি বুঝতে পারল বিপদ তাদের ঘিরে ধরছে একটু একটু করে৷ ফ্রেডরিক চিৎকার করে সকলকে সময় থাকতে থাকতে কেটে পড়তে বলল। পরমুহূর্তেই দেখা গেল শত্রুপক্ষ ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’ বলে কাপুরুষের মতো দৌড় দিয়েছে।
জন্তুরা খামারের দিকে এগোতেই স্কুইলারকে দেখা গেল৷ যুদ্ধের সময় কেন কে জানে তার পাত্তা পাওয়া যায়নি। এখন সে লাফাতে লাফাতে এগিয়ে এল। তার মুখ আনন্দে ঝলমল করছে, লেজটাও নড়ছে এ-পাশ ও-পাশ৷ জন্তরা শুনতে পেল খামারবাড়ির দিক থেকে বন্দুকের গম্ভীর গর্জন ভেসে আসছে৷
বক্সার বলল, “বন্দুক ছোড়া হচ্ছে কেন?”
স্কুইলার বলল, “আমাদের এই বিজয় উদ্যাপনের জন্য।”
“কীসের জয়?” বক্সার জিজ্ঞেস করল৷ তার হাঁটু থেকে রক্ত বেরোচ্ছে। একটা নাল খুলে গেছে, একটা খুরও ভেঙে গেছে। আর পেছনের পায়ে গেঁথে রয়েছে এক ডজন গুলি৷
“কীসের জয়? এ আবার কেমন কথা কমরেড? আমরা কি শত্রুদের ভাগিয়ে দিইনি? আমরা কি খামারের পবিত্র ভূমি ফের নিজেদের কব্জায় নিয়ে আসিনি?”
“কিন্তু ওরা তো আমাদের হাওয়া-কলটাকে পুরোপুরি গুঁড়িয়ে দিয়ে গেছে৷ আমাদের দু-দুটো বছরের হাড়ভাঙা খাটনি ছিল ওর পিছনে।”
“আরে, তাতে কী হয়েছে? আমরা আবার একটা হাওয়া কল বানাব৷ শুধু একটা কেন, দরকার পড়লে আমরা ছ’-ছ’টা হাওয়া কল বানাব। তুমি বুঝতে পারছ না, কমরেড, আমরা কী বিশাল একটা কাজ করে ফেলেছি! আমরা যে মাটিতে দাঁড়িয়ে রয়েছি সেটা কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত শত্রুপক্ষের কব্জায় ছিল। আর এখন দেখ, কমরেড নেপোলিয়নের দুরন্ত নেতৃত্বে আমরা খামারের প্রতিটি ইঞ্চি আবার নিজেদের দখলে এনেছি।”
বক্সার বলল, “তার মানে, আগে আমাদের যা কিছু ছিল তার সবই আমরা ফের জয় করে নিয়েছি?”
“একেবারে ঠিক, এটাই আমাদের জয়।” বলল স্কুইলার৷
ওরা খোঁড়াতে খোঁড়াতে উঠোনে গিয়ে ঢুকল৷ বক্সারের চামড়ার নীচে ঢুকে থাকা গুলিগুলো জন্য অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। বক্সার বুঝতে পারছে আগামী দিনে কী সাংঘাতিক রকমের পরিশ্রম করে তাকে সেই হাওয়া-কল আবার ভিত থেকে গড়ে তুলতে হবে৷ মনে মনে সে যেন এখন থেকেই লেগে পড়েছে সেই কাজে। কিন্তু জীবনে এই প্রথমবারের জন্য সে অনুভব করল যে, তার এগারো বছর বয়স হয়ে গেছে৷ তার শরীরের সেই দুর্দান্ত পেশীগুলোও যেন আর আগের মতো শক্তপোক্ত নেই। (চলবে)
ছবি সৌজন্য: Flickr, Max Pixel, Movie Nation,
অর্ক পৈতণ্ডীর জন্ম ১৯৮৫-তে বীরভূমের সিউড়িতে। পড়াশোনা, বেড়ে ওঠা বোলপুর, শান্তিনিকেতনে। বিজ্ঞানের স্নাতক। পেশাদার শিল্পী। 'মায়াকানন' পত্রিকা ও প্রকাশনার প্রতিষ্ঠাতা ও কর্ণধার। অবসরে লেখালিখি করেন। অলঙ্করণ শুরু ষোলো বছর বয়সে শুকতারা পত্রিকায়। পরবর্তীকালে আনন্দমেলা, সন্দেশ, এবেলা, এই সময়, উনিশ-কুড়ির মতো একাধিক পত্রপত্রিকার জন্য ছবি এঁকেছেন। কমিক্স আঁকার জন্য ২০১৪ সালে নারায়ণ দেবনাথ পুরস্কার পেয়েছেন।