শীত ফুরিয়ে আসছে। এখন রাতের আকাশে তাকালে অগণন তারার ভিড়ে কালপুরুষকে দেখতে পাই। ডান হাতে উদ্যত খড়্গ, বাঁয়ে ধনুর্বাণ। এক আদিমপুরুষ শিকারে বের হয়েছে, চিরযোদ্ধা সে।
জ্যোতির্বিজ্ঞান বলে কালপুরুষের জন্মক্ষণ নাকি প্রায় মানুষের আবির্ভাবের সমসাময়িক। তাকে ঘিরে কল্পনার শেষ নেই মানুষের। যেহেতু মহাকাশের বিষুবীয় অঞ্চলে এই তারকামণ্ডলীর অবস্থান, তাই পৃথিবীর সব স্থান থেকেই দৃশ্যমান হয় কালপুরুষ (Orion) এবং প্রায় সব সভ্যতাই একে ঘিরে গেঁথেছে নানা কিংবদন্তীগাথা।
গ্রিক পুরাণে আছে অরণ্য, প্রান্তর ও চন্দ্রালোকের দেবী আর্টেমিস ছিলেন অপরূপ সুন্দরী। কোনও পুরুষ-দেবতা কিংবা মানুষ তাঁর কাছে ঘেঁষার সুযোগ পায়নি কোনওদিন, এমনই ছিল তাঁর দাপট। কেবল আর্টেমিসের শিকার-সহচর এক মনুষ্য যুবা- ওরাইয়ন খুব কাছাকাছি এসেছিল দেবীর। কে জানে, এর আড়ালেও কোনও চিত্রাঙ্গদার গল্প লুকিয়ে আছে কিনা… রূপ যেখানে তুচ্ছ হয়ে যায়। পরস্পরের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে সহজাত এক আকর্ষণ, এখানে বা চিত্রাঙ্গদায় যা কিনা যুদ্ধবিদ্যা।
আর্টেমিসের যমজ ভাই অ্যাপোলো কিছুতেই মেনে নিতে পারলেন না তাঁর বোনের এক নশ্বর মানুষের প্রতি এই আসক্তি। ফলে ওরাইয়নকে হত্যা করতে তিনি পাঠালেন এক অতিকায়, বিষাক্ত বৃশ্চিক। যুদ্ধ বাধল দু’জনের। ওরাইয়ন তার সব তির ও তলোয়ার দিয়েও পরাস্ত করতে পারল না সেই বৃশ্চিককে। শেষে নিধনে অসমর্থ হয়ে সমুদ্রে সাঁতরে পড়ল প্রাণভয়ে। এমন সময় আর্টেমিস এলেন ওরাইয়নের সাহায্যার্থে।

কিন্তু অ্যাপোলো তাঁকে বিভ্রান্ত করার জন্য বললেন যে আর্টেমিস যেহেতু কুমারীত্ব রক্ষারও দেবী, তাই ওরাইয়নকে বাঁচানোর আগে তাঁর আশু কর্তব্য হল দূরে সমুদ্রে ওই যে বুদ্বুদ দেখা যাচ্ছে, কিশোরীর কুমারীত্ব হরণ করে পলায়নকারী ওই দস্যুকে বধ করা। কিছু বিবেচনা করার আগেই আর্টেমিসের বাণ ছিন্ন করল দূরের সেই অস্পষ্ট লক্ষ্যবস্তুর মাথা। সমুদ্রের ওপর ভেসে উঠল তাঁরই প্রাণহীন প্রেমিকের দেহ।
আর্টেমিস বুঝতে পারলেন তিনি না বুঝে নিজহাতে হত্যা করেছেন ওরাইয়নকে। বুঝতে পারলেন অ্যাপোলো নীচ এক ছলনা করেছেন তাঁর সঙ্গে। অ্যাপোলোর সেই নীচতা আর ছলনার ইতিহাসকে এবং নিজের একমাত্র প্রেমকে মৃত্যুহীন করে রাখতে আর্টেমিস আকাশের তারকামণ্ডলীতে স্থান করে দিলেন ওরাইয়নকে। অন্যপ্রান্তের আকাশ ছেয়ে রয়ে গেল সেই ভয়াল বৃশ্চিক। তাদের যুদ্ধ আর থামলই না কখনও! আর কাঙ্ক্ষিত মিলনের পথ চেয়ে রাতের পর রাত একা একাই ক্ষয় ও পূর্ণতার ভেতর জেগে রইলেন নিঝুম বনজ্যোৎস্নার চিরকুমারী দেবী।
***
হিন্দু পুরাণমতে সৃষ্টিকার্যের সময় প্রজাপতি ব্রহ্মা নাকি কন্যা ঊষাকে জন্ম দেবার পর তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে মিলন প্রার্থনা করে বসেন। ঊষা বলেন, ‘আপনি আমার পিতা, আপনার এ প্রস্তাব অন্যায় ও পাপ।‘ কিন্তু ব্রহ্মাকে কিছুতেই তাঁর কামেচ্ছা থেকে নিরস্ত করা গেল না। ঊষা পলায়ন করে মহাদেবের শরণ নিলেন। পলায়নকালে বারবার রূপ বদলে নিতে থাকলেন ঊষা। পিছনে ধাবমান কামার্ত ব্রহ্মা প্রতিবারই ঊষার নেওয়া রূপের সঙ্গে মিলিয়ে তার পুরুষরূপটি ধারণ করতে থাকলেন। এবং মহাদেব রুদ্ররূপে বাণ নিক্ষেপ করে ব্রহ্মাকে শাস্তি প্রদান করলেন এই গর্হিত অপরাধের জন্য।
কালপুরুষের মাথার দিকে যে নক্ষত্র Meissa রয়েছে, বাংলাতে তার নাম মৃগশিরা। সে-ই হল ব্রহ্মার মৃগরূপ মস্তক। কালপুরুষের কোমরবন্ধের কাছে তিনটি তারা যথাক্রমে ঊষা (Alnitak), অনিরুদ্ধ (Alnilam) এবং চিত্রলেখা (Mintaka)। ডান কাঁধে আদ্রা তারা (Rigel) হল বাণরাজা। বাঁ কাঁধের তারাটি কার্তিকেয় (Bellatrix)।
ডান হাঁটুর কাছের তারাটি কার্তবীর্জ (Saiph) এবং বাম হাঁটুর তারাটিও বাণরাজা নামে পরিচিত। কালপুরুষের হাতের ধনুকটি হলেন রুদ্র, যাঁর নিক্ষিপ্ত বাণ ঊষাকে রক্ষা করে ধাবিত হচ্ছে ব্রহ্মার দিকে। ডান হাতে কালদণ্ডের ন্যায় উদ্যত খড়্গ যা কিনা সৃষ্টিকর্তাকেও তাঁর অপরাধের জন্য নির্ধারিত শাস্তি থেকে পালাতে দেয় না।
কথিত আছে, পুরাকালে অঘ্রাণের আকাশে মৃগশিরা নক্ষত্র দেখে বছর শুরু হত এ দেশে। সে মাসের নাম ছিল মার্গশীর্ষ। জানি না, প্রজনন, আকাঙ্ক্ষা, সংযম, নিরপেক্ষ বিচার ও বিনাশের মধ্যেকার সমতা রক্ষার শিক্ষাই বছরভর স্মরণীয় করে রাখার কথা ভেবে এই নক্ষত্রমণ্ডলীর দিকে তাকিয়ে আমার পূর্বসূরীগন বর্ষারম্ভের মন্ত্রোচ্চারণ করতেন কিনা! হে রুদ্র, আপনার প্রসন্ন মুখের দ্বারা আমাদের সর্বদা রক্ষা করুন।
***
কিন্তু সন্ধ্যাকাশে কালপুরুষ দেখলে আমার এসব কিছুই মনে পড়ে না। আমি ভাবি এক বালকের কথা। সদ্য উপনয়নের পর সে পিতার সঙ্গে চলেছে হিমালয়ে। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে; বোলপুরের বিস্তীর্ণ খোয়াই-প্রান্তর, অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির মধ্যে গুরুগ্রন্থসাহিবের সম্মোহক সুর, নানা বনস্পতি, মহাপ্রাণ গাছ, খরতোয়া ঝর্ণা ও গিরিখাত পার হয়ে ডালহৌসি এসে পৌঁছেছেন তাঁরা। বক্রটার সবচেয়ে উঁচু পাহাড়-চূড়ায় তাঁদের বাসা।
সন্ধে নেমে এলে বারান্দায় বসেন দুজন। চারদিকের বিপুল অন্ধকার রহস্যময় করে তোলে সুপ্রাচীন পাহাড়তলি। কেলুবন ঘিরে ঝিঁঝিঁদের ডাক শোনা যায় অবিরত। আর তার মাথার ওপর বিছিয়ে থাকে গ্রহতারকার প্রদীপ নিয়ে নিস্তব্ধ নভোতল। বালক পুত্রকে তারা চিনতে শেখান মহর্ষি পিতা। বলেন, ‘গান গাও এবার, আজ আর কথা নয় কোনও‘। সেই বালকের সুরেলা কণ্ঠ অনুরণন তোলে আকাশে, শীতার্ত হাওয়ায়। সে গেয়ে চলে একের পর এক ব্রহ্মগান। গভীর প্রার্থনায় ভেসে যায় বিস্তীর্ণ গিরিউপত্যকা, বন, পিতা ও পুত্রের হৃদয়।
প্রজনন, আকাঙ্ক্ষা, সংযম, নিরপেক্ষ বিচার ও বিনাশের মধ্যেকার সমতা রক্ষার শিক্ষাই বছরভর স্মরণীয় করে রাখার কথা ভেবে এই নক্ষত্রমণ্ডলীর দিকে তাকিয়ে আমার পূর্বসূরীগন বর্ষারম্ভের মন্ত্রোচ্চারণ করতেন কিনা! হে রুদ্র, আপনার প্রসন্ন মুখের দ্বারা আমাদের সর্বদা রক্ষা করুন।
কালপুরুষ নিয়ে জ্যোতিষশাস্ত্রে কুসংস্কার আছে বলে শুনেছি। কালপুরুষের প্রভাবে মানুষ নাকি গৃহত্যাগী হয়। কে জানে সেই কারনেই সারা জীবন পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ালেন কিনা দেবেন্দ্রনাথ! সে কারণেই কোথাও একটানা বেশিদিন থিতু হতে পারলেন না কিনা তাঁর কবিপুত্র! সারা জীবনটাই তাঁর আশ্চর্য-ভ্রমণ হয়ে গেল, যার কাছে গিয়ে দাঁড়ালে বোঝা যায়, জীবনে গন্তব্য নয় যাত্রাটাই আসল।
শীত ফুরিয়ে বসন্ত এসেছে চোখের নিমেষে আমার বাংলায়। পালিয়ে যাবার সেই সনাতন লোভটা তীব্র হয়ে বুকের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকবে এবার সমস্ত সময়। মনকেমনের হাওয়া বলবে হু হু স্বরে- হেথা নয়, হেথা নয় অন্য কোথা অন্য কোনওখানে। আকাশ থেকে কালপুরুষ মিলিয়ে যাবে ধীরে। তার প্রভাবে এ জন্মে আর আমার সব নাগাল ছাড়িয়ে যাওয়া হবে, কি হবে না, জানি না। কেবল জানি শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, বসন্তে চিরজাগ্রত থাকবে সেই অপাপবিদ্ধ বালকের রূপ আর তার অপরাজিত গান। আমার সমস্ত সঙ্গোপন ও হারিয়ে যাওয়ার একমাত্র আকাশ- চিরসখা রবীন্দ্রনাথ।
ঋভু চৌধুরী হুগলি জেলার হরিপালের বাসিন্দা। জন্ম ১৯৯১-এর ভরা বসন্তে। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর। বর্তমানে পেশা ব্যবসা। নেশা লেখালিখি, বই পড়া, ছবি আঁকা, গান শোনা, সিনেমার দুনিয়ায় ডুব, আর পথে-প্রান্তরে ঘুরে বেড়ানোর অবকাশ খুঁজে নেওয়া।