*আগের পর্বের লিংক: [] [] [] []

ক্লাবটার নাম বর্ষা স্মৃতি সংঘ। বৈশাখী স্মৃতি সংঘ হয়, হৈমন্তী সংঘও দেখা যায়। শর স্মৃতি, ফাল্গুনী ক্লাব তো জলভাত– বোধহয় পাড়ায়-পাড়ায় একটা করে আছে। দেখা যেত না বর্ষা আর শীত। বর্ষা স্মৃতি তো পাওয়া গেল। কলকাতার জলবায়ুর যা অবস্থা, খুব তাড়াতাড়ি শীত স্মৃতি সংঘও দেখতে পাওয়া যাবে।

ছিটের বেড়া কিংবা দরমার নয় একেবারে ইঁট, কাঠ, সিমেন্টের ক্লাব। স্থাপিত ১৯৪৮। সদ্য চুনের প্রলেপ লেগেছে। ভেতরের হলঘরের ছবিটা এইরকম– পশ্চিম দেওয়ালে এলইডি টিভি সাঁটান। এই মুহূর্তে ইন্ডিয়া-অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট ম্যাচ চলছে। দু’ফুট ওপরে ঘড়ি। উত্তরের দেওয়াল ঘেঁষে স্টিলের আলমারি। পাশের শোকেসে এক ঝাঁক ফলক, যাকে ছেলেরা মেমেন্টো বলে থাকে। পূর্ব দিকে ক্লাবে ঢোকার দরজা। দক্ষিণদিকে লাগোয়া আর একটা ঘর আছে। যার পাশেই ‘টয়লেট’। আশপাশে যে হারে একতলা দু’তলা ভাঙা পড়ে আকাশছোঁয়া উঠছে, অচিরেই এই পুকুরপাড়ের ক্লাবের দম আটকে যাবে। তবু, তা মেনে নিয়েও, পাড়ার কোনও ডাকাবুকো ছেলে হয়তো প্রোমোটরকে ধরে-করে ক্লাবের চেহারার বদল ঘটিয়েছে। অবশ্য পাড়ার এই জাতীয় ক্লাব এখন সরকারের থেকে খোরপোশ পায়।

 

আরও পড়ুন: অপূর্ব দাশগুপ্তের কলমে: চা বাগিচার কড়চা

 

হলঘরের ঠিক মাঝখানে লাল প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে সুহাসিনী হালদার। তাঁকে ঘিরে বসে পাঁচজন উঠতি ছেলে। তিনজনের ছেঁড়া জিনস, দু’জনের কালো ট্রাউজার্স। আর লাল শাড়ি কালো পাড় শ্যামলা যুবতী। ওর মুখ তেল চকচকে। অবশ্য তেল না হয়ে ক্রিম চকচকে বলাটাই নিরাপদ। কারণ, তেল হলে আরও বেশি চকচক করত। এদের পেছনে দাঁড়িয়ে লছমন। বিরাট কোহলি ব্যাট চালাতেই পাঁচটি ছেলে তিড়িং করে লাফিয়ে উঠে চিকার করল, ‘ছক্কা….!’ লছমনের দিকে ফিরে একজন বলল, ‘এই লাফা…।’ লছমনও গুনে-গুনে পাঁচবার লাফ মারল। লালশাড়ি চিকার করল,
– ওই দ্যাখ অনুষ্কার মুখে কি হাসি… 

সুহাসিনীও হাততালি দিলেন–
– হাসবেই তো, বিয়ে করবার পর বরের তেজ বেড়ে গেছে। হাসবে না?
এরপরেই বিজ্ঞাপন বিরতি। সেই ফাঁকে একজন জিনস বলল,
– মাসিমা, আপনি শুধু আজকের রাত নয়, এখন যে ক’দিন খেলা চলবে, এখানেই থেকে যান…। আপনি থাকলেই বিরাট ছক্কা মারছে…

সুহাসিনীর শরীর নড়ল। চোখ বড়-বড়। পাতলা ঠোঁটের কোণে হালকা হাসির ছোঁয়া। রাজি কিনা বোঝা গেল না। নিশ্চিত করবার জন্য কালো ট্রাউজার্স মাথা নাড়ল,
– হ্যাঁ মাসিমা, থাকতেই হবে…। কোনও প্রবলেম নেই, থাকবার ঘরও আছে…
দক্ষিণের ঘরটি দেখাল কালো ট্রাউজার্স।
– ইন্ডিয়াকে জেতাতে হবে তো… ! তাছাড়া, পরের সপ্তাহেই ময়দানে আমাদের মিটিং। হুইল চেয়ারে বসিয়ে আপনাকে নিয়ে যাব। সব ক’টা টিভি চ্যানেলে আপনার ছবি দেখাবে… পুরো জমে ক্ষীর…
– কী যে সব হাতিঘোড়া বলিস! আমার মতো বুড়িকে দেখাবে! ধ্যা
মুখে এমন বললেও, বেশ বোঝা যা‌য় মনে-মনে খুশি হয়েছেন ভদ্রমহিলা।
কালো ট্রাউজার্স সেটা লক্ষ করল।
– আরে মাসিমা, পাকা চুল তো কী হয়েছে? আজকাল কত ইয়ং মেয়েদের পাকাচুল থাকে… সব সেলুনে গিয়ে রঙ করায়…
সুহাসিনী মাথা নাড়লেন।
– ওইসব বুঝি না, আমার কথা হল, যার নাম চালভাজা তার নাম মুড়ি, যার মাথায় পাকা চুল তারই নাম বুড়ি…
আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। তার আগেই যে ঢুকল, তাকে দেখে সবাই উঠে দাঁড়াল–
– এই তো চিকুদা… 

উত্তরের দেওয়াল ঘেঁষে স্টিলের আলমারি। পাশের শোকেসে এক ঝাঁক ফলক, যাকে ছেলেরা মেমেন্টো বলে থাকে। পূর্ব দিকে ক্লাবে ঢোকার দরজা। দক্ষিণদিকে লাগোয়া আর একটা ঘর আছে। যার পাশেই ‘টয়লেট’। আশপাশে যে হারে একতলা দু’তলা ভাঙা পড়ে আকাশছোঁয়া উঠছে, অচিরেই এই পুকুরপাড়ের ক্লাবের দম আটকে যাবে।

পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি। মাথায় পুরো টাক। কিন্তু বয়স বেশি নয়। পঞ্চাশে হেলান দিয়ে থাকা চল্লিশ হবে। অথবা পঞ্চাশ ছুঁয়ে ফেললেও অনায়াসে একে আটচল্লিশ বলে চালানো যায়। মুখে চর্বি লেগেছে। এইজন্যই ছোট চোখ আরও কুতকুতে দেখায়। নেতার মতো চেহারা নয়, কিন্তু তবু সবাই একে কেন চিকুদা-চিকুদা করে দাঁড়িয়ে উঠল, প্রথম ধাক্কায় বোঝা গেল না। চিকুদা হেসে দু’হাত তুললেন। যেন বরাভয় দিচ্ছেন।
– তারপর… চিয়ার্স বন্ধুগণ… কী হচ্ছে?
গলার আওয়াজ ইচ্ছে করেই খাদে নামানো। নেতাদের এমন করতে হয়। এখনও লোকে গভীর-গম্ভীর কণ্ঠস্বরকে মান্য করে। চোখের ইঙ্গিতে সুহাসিনীকে দেখালেন ভদ্রলোক। করপোরেশনের পাইপ ফেটে জল বেরোবার মতো গলগল করে লাল শাড়ি কালো পাড় বলতে শুরু করল,
– মাসিমাকে ওর ছেলে রাস্তায় বসিয়ে কেটে পড়েছে…
– গুড…
চিকুদা পকেট থেকে মোবাইল বের করলেন।
– মাসিমা আপনি বলতে থাকুন কেসটা কী? আমার দিকে তাকিয়ে বলুন… অনিমা তুই এই মোবাইলের ভিডিও ক্যামেরায় সব রেকর্ড কর… কলকাতা সারাদিনকে দেব, ওরা দেখাবে। ভাবতে পারছিস এক ঝটকায় আমাদের বর্ষা সংঘ পুরো হিরো…
– চলুন একবার ট্রায়াল দিয়ে দেখা যাক। অনিমা রেডি? আমি আর মাসিমা দু’জনেই যেন ক্যামেরায়…
চিকুদার কথা শেষ হতে না হতেই ক্রিম-চকচকে মুখ বলল,
– ওকে… নিন এইবার শুরু করুন…

ক্যামেরা চালু হতেই সুহাসিনী কাঁদতে শুরু করলেন।
– আমাকে… আমাকে আমার ছেলে পথে বসিয়ে পালিয়েছে। একটার জায়গায় দুটো ট্যাংরা মাছ খেয়ে ফেলেছি, সেইজন্য। বউয়ের ভাগেরটা। কী টেনশন, কী টেনশন… ভাবতেই পারছি না কী করব। ট্যাংরা মাছ যে ভালোবাসি… ডিম ভরা ট্যাংরা…
– বাহ্‌ হেভি হচ্ছে… ব্যাপক…!!
চিকুদা খুব খুশি।
– দেখিস দেখাবার পর কী হয়। টেলিকাস্ট হওয়া অবধি মাসিমাকে এখানেই রাখ–
অনিমা নামের মেয়েটি দু’দিকে মাথা নাড়াল।
– একেবারে জমে ভ্যানিলা আইসক্রিম…
চিকুদাকে দেখে ক্রিম-চকচকে মেয়েটি হঠা যেন সপ্রতিভ হয়ে উঠেছে!

এতক্ষণ সব কিছু চুপচাপ দেখে যাচ্ছিল রঞ্জন। আর পারল না–
– তা কী করে হবে? এখন যদি ওর ছেলে বাসস্ট্যান্ডে খুঁজতে আসে?
চিকুদা ঘাড় বেঁকিয়ে রঞ্জনকে একবার দেখে সামনের কালো ট্রাউজার্সের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকালেন। নিশ্চয় জিজ্ঞাসার ভঙ্গি ছিল চোখে। কালো ট্রাউজার্স সাত তাড়াতাড়ি বলল,
– ও আর এই লছমনই তো মাসিমাকে নিয়ে এসেছে…
এবার নেতার গলা বেরিয়ে এল।
– ছেলেকে ফুটিয়ে দেবেন। আগে সারাদিন খবর করবে, তারপর মা ফের পাবে ছেলে–
– তার আগে আপনাকে ফুটিয়ে দেব… 

 

আরও পড়ুন: দীপংকর চক্রবর্তীর কলাম: স্টোরির নেপথ্যে গল্প

 

রঞ্জনের মুখ দিয়ে এমন বাক্য বের হলেও সে মোটেই এমন বলতে চায়নি। যেমন দাপট নিয়ে শব্দ ক’টি ছুটে গেল, তেমন ওজন তো তার গলায় সচরাচর থাকে না! অনিমা ছুটে এল,
– কেন ঝামেলি পাকাচ্ছেন?…যান না…
– আপনি ভাগুন তো, আপনার মুখের থার্ড ক্লাস ক্রিমের গন্ধ আমার মোটেই পছন্দ নয়…
এই কথাটাও রঞ্জন বলতে চায়নি, কিন্তু বেরিয়ে গেল! অনিমা তো বটেই চিকুদারও মুখ ঝুলে গেছে। তবু সহজে দান ছাড়বার পাত্র নয়।
– কী বললেন! জানেন আমি কে? আমি জন্মভূমি পার্টির–
– সে আপনি যে পার্টিরই হোন, আমিও খবর কলকাতা পত্রিকার সম্পাদক… লিখে দেব জন্মভূমি পার্টির সহ-সম্পাদক জোর করে এক অসহায় মহিলাকে আটকে রেখেছেন তার সম্পত্তির লোভে…’
পকেট থেকে টুইটার মোবাইলের আই-কার্ড বের দেখাল রঞ্জন। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ম্যাজিশিয়ানের ভঙ্গিতে আবার পকেটে পুরে নিল। চিকুদার এখন যা খিচুড়ি দশা, রঞ্জনের পরিচয়পত্রটি খতিয়ে দেখবার মতো মন নেই। সহ-সম্পাদক এই কথাটা শুনতে যতটা ভালো লাগছে, কাগজে কেচ্ছা বেরোবার খবরে নেতা ততটাই ত্রস্ত।

জিনস পরা ছেলেটি রঞ্জনের দিকে ফিরল।
– না…মানে আপনিই তো…
ক্রিমের অপমানে অনিমা রেগেই ছিল। জিনসের দিকে ফিরে বলল,
– অত নরম করে বলার কী আছে? আমরা যা ভালো বুঝেছি তাই করেছি।
কথা শেষ করেই সমর্থনের আশায় চিকুদার দিকে তাকাল। ‘তাই না চিকুদা?’ হঠা সুহাসিনী উঠে দাঁড়ালেন।
– আমি এখানেই থাকব। এখানেই ভালো। আর বাড়ি যাব না।
এমনভাবে বললেন যেন খুঁজেপেতে জায়গাটা উনিই জোগাড় করেছেন।
জিনস বলল,
– দেখছেন তো… আপনি আর লছমন আনলেও উনি এখানেই থাকতে চাইছেন।
কালো ট্রাউজার্স বলল,
– অত সহজ নয় ব্যাপারটা। তার মানে উনি স্বেচ্ছায় এখানে থাকতে চাইছেন। ছেলে রাস্তায় বসিয়ে গেছে তাতে ওঁর কোনও দুঃখ নেই। পেপারে বেরিয়ে গেলে প্রচুর বাওয়াল হবে। থানাপুলিশ… তাই না চিকুদা?
সতেরো বছর রাজনীতি ঘষটানো চিকুদা এমন জটিল গিঁট দেখেননি। এগোলেও বিপদ, পেছোলেও। এদিকে সবাই তাঁর সমর্থনের আশায় ‘তাই না চিকুদা, তাই না চিকুদা’ করে যাচ্ছে।

পকেট থেকে টুইটার মোবাইলের আই-কার্ড বের দেখাল রঞ্জন। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ম্যাজিশিয়ানের ভঙ্গিতে আবার পকেটে পুরে নিল। চিকুদার এখন যা খিচুড়ি দশা, রঞ্জনের পরিচয়পত্রটি খতিয়ে দেখবার মতো মন নেই। সহ-সম্পাদক এই কথাটা শুনতে যতটা ভালো লাগছে, কাগজে কেচ্ছা বেরোবার খবরে নেতা ততটাই ত্রস্ত।

পরিস্থিতি আরও ঘোরালো। চিকার শুনে আশপাশ থেকে আরও অনেকে জুটে গেছে। সবাই কোনও না কোনও পক্ষে। সবাই তেতে উঠেছে। এইবার মনে হয় চেয়ার ছোঁড়াছুঁড়ি হতে যাচ্ছে। কাঠের চেয়ার হলে আহতের সংখ্যা বাড়ত, প্লাস্টিকের চেয়ারে মনে হয় অতটা হবে না।
– স্যার…আভি তুরন্ত চলিয়ে…
রঞ্জন চমকে ফিরে তাকাল। লছমন হাসল,
– চলিয়ে, শু পালিশ করনা বাকি হ্যায়…
‘বাঃ–’ রঞ্জন মনে-মনে তারিফ করল। এর হবে। চারপাশে যতই হট্টগোল থাকুক, এই লোকটা নিজের লক্ষ্যে স্থির। সেলস পার্সনদের এরকমই হওয়া উচিত। টার্গেট ভুললে চলবে না। লছমন তার হাত ধরে টানল।
– চলিয়ে স্যার…
– দাঁড়াও, প্রথম চেয়ারটা ছোঁড়া হোক, তারপর…

 

*ছবি সৌজন্য: gallerykolkata

প্রাবন্ধিক ঔপন্যাসিক অশোককুমার মুখোপাধ্যায়ের ঝোঁক বিভিন্ন বিষয়ের প্রতি। তাঁর তিনটি তথ্য-উপন্যাস-- অগ্নিপুরুষ, আটটা-ন’টার সূর্য এবং অবিরাম জ্বরের রূপকথা--তিনটি বিভিন্ন সময় নিয়ে। প্রবন্ধের জন্য দু’বার পেয়েছেন আনন্দ-স্নোসেম পুরস্কার। শেষোক্ত উপন্যাসটি ইংরেজিতে অনূদিত হয়ে নামী পুরস্কারের বিচার তালিকায় স্থান পেয়েছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *