রসবতীশব্দটির মানে রান্নাঘর, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি উপন্যাসে পড়েছিলাম। বোধহয় তুমি সন্ধ্যার মেঘউপন্যাসটির নাম। বৈষ্ণব পদাবলিতে অবশ্য রসবতীশব্দের অর্থ আলাদা, আক্ষেপানুরাগের পদে রাধা কৃষ্ণের স্পর্শের কথা ভেবে বলছেন, “রসবতী তাক পরশরসে ভাসত, হমারি হৃদয়ে জ্বল আগি।” অর্থাৎ যে ছোঁয়ায় সৌভাগ্যবতী রসবতী নারী পরমসুখে ভাসেন, কৃষ্ণের সেই স্পর্শই রাধার হৃদয়ে কিনা আগুন জ্বালিয়ে দেয়। 

আমার নীহারিকা পিসিমা কিন্তু তাঁর রসবতী অর্থাৎ রান্নাঘরকেই কৃষ্ণ মনে করতেন মনে হয়। ওই ঘরের বাইরে তাঁকে কমই দেখা যেত। নীহারিকা আমার দূর সম্পর্কের পিসিতাঁর বিয়ে হয়েছিল এক বিশাল যৌথ পরিবারে। উত্তর কলকাতার ঘিঞ্জি গলিতে সেই পরিবার একটা ছোট ভাঙাচোরা একতলা বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকত। দূরসম্পর্ক হলেও সে যুগের যেমন প্রথা- আমাদের সঙ্গে ওঁদের যথেষ্ট যাতায়াত ছিল। এমনকী নীহারিকা পিসিমার মেয়ে বীথিকা আমার প্রায় সমবয়সী বলে মাঝে মাঝে গরমের বা পুজোর ছুটিতে ওঁদের বাড়িতে গিয়ে দুচারদিন থেকেওছি আমি ছোটবেলায়।

তখন সকালের জলখাবার খেতে নীহারিকা পিসিমার বড়সড় রান্নাঘরে পিঁড়ি পেতে বাড়ির ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বসে যেতাম। সামনে কাঁসার মাঝারি থালায় মুচমুচে রসালো বেগুনভাজা আর গরম গরম লালচে করে ভাজা পরোটা পরিবেশন করতেন পিসিমা। রান্নাঘরে মেঝেতে বসানো জোড়া মাটির উনুন। তাতে গনগন করছে আঁচদুটি উনুনের মাঝে একটি গোল ফাঁক। তাতে বসালে কেটলিভরা জল এমনিতেই গরম হয়ে যেত আর বাড়ির সকলের হাজারো দরকারে জলভরা কেটলি সর্বদাই বসানো থাকত।

fried brinjal
মুচমুচে রসালো বেগুনভাজা আর গরম গরম লালচে করে ভাজা পরোটা

উনুনের তাপে পিসিমার টকটকে ফর্সা মুখখানা লাল হয়ে যেত। সেদিকে অবশ্য তাঁর কোনও নজর থাকত বলে মনে হয় না। কীরে গোপা, তোকে একটা আলুসেদ্ধ দিই?’ এই বলে আমার মতের অপেক্ষা না করে হাঁড়ির টগবগে ভাতে পেতলের হাতা ডুবিয়ে একটা বাদামি আলু তুলে আনতেন। একটা থালায় রেখে কী কৌশলে চটপট খোসা ছাড়িয়ে নুন ছিটিয়ে সেই ধোঁয়া ওঠা সুস্বাদু আলু আমার পাতে চালান করতেনকথা খুব কম বলতেন আমার এই পিসিটি।

রান্নাঘরের একদিকে পরপর সিমেন্টের তাক করা ছিল। তাতে অগুন্তি বৈয়ম আর কৌটো। শিশিবোতল পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখা। আমাদের জলখাবারের পালা সাঙ্গ হবার আগেই হয়তো পিসিমার কলেজপড়ুয়া দেওররা, ‘বৌদি ভাত দাওবলে ঢুকে পড়ত। আদর করে দেওরদের ভাইবলে ডাকতেন তিনি। এই যে ভাত নামল, দিচ্ছি সেজভাই। অর্থাৎ পিঁড়ি তোলার আর দরকার হত না। কলেজ পড়ুয়ারা মাছের ঝোল-ভাত খেয়ে বেরলেই, কাজের মাসি চটপট রান্নাঘরের এঁটো সরিয়ে সিমেন্টের মেঝে মুছে দিত।

এবার বড় পিঁড়ি পড়বেনীহারিকার স্বামী সতীশচন্দ্র ও তাঁর পরের ভাই সুরেশচন্দ্র অফিসে বেরবার আগে ভাত খেতে বসবেন। পিসিমাকে এইসময় শাড়িটাড়ি একটু গুছিয়ে নিতে দেখা যেত। খুবই সুন্দরী ছিলেন তিনি। ধারাল কাটাকাটা নাক, বড়বড় চোখ, চুলও ছিল কোমর ছাপানোতবে কোন ভোরে অন্ধকার থাকতে উঠে স্নান সেরে তিনি একটি গামছা দিয়ে চুল মুছে সেটি মাথায় খোঁপার মতো করেই বেঁধে রাখতেন। ফলে তাঁর মাথাটা চেককাটা পাগড়ি পরা কোনও শিখ বালকের মতো দেখাত। মোদ্দা কথা, নিজের সৌন্দর্যের দিকে মন দেবার সময় বা ইচ্ছে কোনওটাই তাঁর ছিল বলে মনে হয় না।

 

আরও পড়ুন: মন্দার মুখোপাধ্যায়ের কলাম ‘আইঢাই’: রোগ-বালাই

দুপুরে রান্নাঘরের পাট চুকলে ফের স্নান করে যখন পুজোয় বসতেন, তখন তাঁর পিঠভরা কালো চুলের স্রোত আর ফর্সা কপালে তর্জনীর ডগা দিয়ে পরা গোল সিঁদুরের টিপটি বড় সুন্দর দেখাত। খাওয়া দাওয়ার পর ফের তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়তেন আলসেবিহীন ছাদে রোদে দেওয়া আচারের বৈয়ম আর শিশি নিয়ে। বিকেল সাড়ে চারটেয় ওঁদের ছোকরা চাকর পল্টু আবার সেই জোড়া উনুনে আঁচ দিত।

তখন মধ্যবিত্ত বাঙালি বাড়িতে রেফ্রিজারেটর কেনার কথা কেউ ভাবতেও পারত না। ফলে রান্নাবান্না সব বাড়িতেই দু’বেলা হত। বিকেলের রান্নায় দু’একটা পদ বরং বেশি থাকত। কারণ সকালে স্কুল কলেজ অফিসের তাড়ায় সবাই নাকেমুখে গুঁজে ছোটে। রাতের খাওয়াটা জুতের হওয়া দরকার। পিসিমা রান্নাঘরে পিঁড়িতে বসে কানাউঁচু থালায় বিকেলের জলখাবারের ময়দা মাখছেন, এই দৃশ্যটা খুব মনে পড়ে।

Puja
পিসিমার কপালে তর্জনীর ডগা দিয়ে পরা গোল সিঁদুরের টিপটি বড় সুন্দর দেখাত

সুতরাং নীহারিকা পিসিমার মাথায় তাঁর সংসার আর রকমারি সুস্বাদু রান্নাবান্না ছাড়া আর কিছু ছিল বলে ছোটবেলায় ভাবতে পারিনি। তাই বড় হয়ে মার কাছে যখন শুনলাম, বিয়ের আগে নীহারিকা পিসিমার একটি সাঙ্ঘাতিক সাহসী প্রেম ছিল, খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। ওঁর বাপের বাড়ি ছিল ভয়ঙ্কর রক্ষণশীল, মেয়েদের স্কুলেও পাঠানো হত না।

দোর্দণ্ডপ্রতাপ বাবা ও জ্যাঠারা বাড়ির মেয়েদের রীতিমতো শাসনে রাখতেন। তবু তারই মধ্যে কন্দর্পের দৃষ্টিপাত ও শরক্ষেপ ঘটে গেল, যখন নীহারিকার জ্যাঠতুতো দাদা মৃণালকান্তির অফিসের বন্ধু সত্যব্রত বাড়ির একতলায় একটি ঘরে পেয়িংগেস্ট হয়ে থাকতে এলেন। পেয়িংগেস্টের সঙ্গে বা গৃহশিক্ষকের সঙ্গে বাড়ির মেয়ের প্রেম ব্যাপারটা এক্কেবারে পুরনো বাংলা সিনেমার মতো কিংবা দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পরে বালিশে ভেজা চুল মেলে আগেকার দিনের বৌ-ঝিরা যেসব গল্প উপন্যাস পড়তেন, তার মতো।

শুরুটা তেমন হলেও শেষটা তা হল না। পেয়িংগেস্ট রাখার ব্যাপারটা জ্যাঠা ও বাবার গোড়া থেকেই অপছন্দ ছিল। নেহাত বাড়ির আদুরে বড় ছেলের আবদারে বাধ্য হয়ে রাজি হয়েছিলেনমেয়ে ওই ছোকরার সঙ্গে প্রেম করছে জানার পর আগুনে ঘৃতাহুতি পড়ল। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো সত্যব্রত আবার কুলীন ব্রাহ্মণের ছেলে। তবে শোনা যায় মেয়ের রূপ, শান্তস্বভাব ও ঘরকন্নার কাজে পটুতার কথা শুনে ব্রাহ্মণ পরিবারটি নাকি বিয়েতে আপত্তি করেননি। কিন্তু নীহারিকার বাবা, জ্যাঠারা এই সম্পর্ককে পরিবারের চূড়ান্ত অসম্মান হিসাবে নিলেন। তাঁর বাবা ঘোষণা করলেন, এমন কুলকলঙ্কিনী মেয়েকে কেটে ফেললে কী ক্ষতি? মেয়েকে ঠিকমতো মানুষ করতে পারেননি এই অপরাধবোধে মা, জেঠিরা মাটিতে মিশিয়ে রইলেন। 

আশ্চর্য! নীহারিকা কিন্তু ঘোষণা করলেন, তিনি সাবালিকা। নিজের ইচ্ছেমতো বিয়ে করার অধিকার তাঁর আছে। মারধর চলেছিল কিনা, পারিবারিক চারণরা সে ব্যাপারে নীরব। সত্যব্রত বাড়ি থেকে বিদায় নিয়েছিলেন বটে, কিন্তু কোনও অদৃশ্যপথে যোগাযোগ রেখে যাচ্ছিলেন। সত্যব্রত ভাল চাকরি করেন, শিক্ষিত, তদুপরি অত্যন্ত সুপুরুষ, আপত্তি কেন তবে? আসলে মেয়ে প্রেম করেছে, নিজে বিয়ে ঠিক করেছে- এই স্বাধীনতা সে যুগে ওই ধরনের পরিবারে ছিল অকল্পনীয়।

সোজা পথে মেয়েকে বাঁকাতে না পেরে বাবা জ্যাঠারা এক মোক্ষম চাল দিলেনপরিবারের যিনি গুরুদেব, নীহারিকারও দীক্ষা যাঁর কাছে, তাঁকে দিয়ে পত্র লেখালেন- জীবনে যাই ঘটুক বাবা মার অবাধ্য হওয়া মস্তবড়ো পাপ। পন্থাটি অত্যন্ত অন্যায় এবং ষড়যন্ত্রের নামান্তরকিন্তু যেহেতু গুরুদেবকে নীহারিকা দেবতা জ্ঞান করতেন, পিতা ও পিতৃব্য ষোলোআনা সফল হলেন। 

 

আরও পড়ুন: মণিমেখলা মাইতির কলমে: বাঙালির আচার-বিলাস কি তবে ডাইনোসর হবে?

 

নীহারিকা সংকল্প থেকে সরে এলেন, প্রত্যাখ্যাত হলেন সত্যব্রত। অতঃপর এই বিষাদপ্রতিমা কন্যাকে গোত্রান্তরের পালা, যত তাড়াতাড়ি পারা যায়। চেনামহলে ঢিঢি পড়ে গিয়েছিল। ফলে তেমন যোগ্য পাত্র জুটল না। কালো, ঢ্যাঙা, দাঁত-উঁচু সতীশচন্দ্র বাপমা গত হবার পর একগাদা ভাইবোন নিয়ে নাজেহাল হচ্ছিলেন। নিজে সামান্য চাকরি করতেন কলকাতা ট্রাম কোম্পানিতে কিন্তু পাত্রের বংশ নামকরা, যাকে বলে কংসরাজের বংশধর। বিয়ের দিন ফোটা পদ্মফুলের মতো সুন্দরী নীহারিকার পাশে সতীশচন্দ্রকে নাকি মর্কটের মতো দেখাচ্ছিল। বিয়ের পর থেকেই নীহারিকাকে হেঁসেল ও ছোট ছোট দেওর ও ননদের দায়িত্ব নিতে হল। কালেদিনে তাঁর তিনটি সন্তান হল, সতীলক্ষী সুগৃহিনী রূপে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল, প্রায় লক্ষীর পাঁচালীর ধরনে।

এই গল্পটি শোনার পর নীহারিকা পিসিমাকে আমি অন্য দৃষ্টিতে দেখতে থাকি। সেই কাঁচা বয়সে আমার মনে হত, রান্নাঘরটি কি তাঁর গোপন আশ্রয়? তিনি কি এখনও চণ্ডীদাসের রাধার মতো সেই জোড়া উনুনে কয়লা গুল আর ঘুঁটের আঁচ উঠলে ধুঁয়ার ছলনা করিকাঁদেন? খিটখিটে কুদর্শন সতীশ পিসেমশাইকে তিনি রূপবান সত্যব্রতর জায়গায় বসাতে পেরেছেন কি আদৌ? এইসব প্রশ্নের কোনও উত্তর ছিল না।

bengali-bride
বিষাদপ্রতিমা কন্যাকে গোত্রান্তরের পালা, যত তাড়াতাড়ি পারা যায়

তবে ওঁদের একটি পারিবারিক ভোজসভার কথা মনে পড়ছে, যেখানে নীহারিকা পিসিমার বাবা কারুকার্য করা আসনে বসে মস্ত একটা মাছের পেটিকে কায়দা করতে ব্যস্ত ছিলেনসতীশচন্দ্রের দিদি তাঁর অবস্থা দেখে ঠাট্টা করে বললেন, ‘তালুইমশাই, মেয়ে কেমন মাছ খাওয়াচ্ছে বলুন?’ একগাল হেসে আমার সেই জ্ঞাতিঠাকুর্দা বললেন, ‘আমার মেয়ে তো, সেরা পিসখানা বাবার পাতে না দিলে ওর চলবে কেন?’ 

আমি ওই ঘরেই বসে খাচ্ছিলামসঙ্গে সঙ্গে চোখ গেল পিসিমার দিকে। মাছের মস্ত বড় গামলাটা হাতে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন। এখনও মনে আছে লালপেড়ে একখানা চাঁপারঙের শাড়ি তাঁর সুগৌর গাত্রবর্ণে মিশে গিয়েছিল। মাথায় ঘোমটা ছিল না। তাই তাঁর বড় বড় কালো চোখ দু’খানার দৃষ্টি যে তাঁর বাবার দিকে নিবদ্ধ, তা দেখতে পেলাম। চোখ দিয়ে যে ঘৃণা ঝরে পড়ে, সেই প্রথম অনুভব করেছিলাম। ভাগ্যিস ‘অনার কিলিংশব্দটা তখন চালু ছিল না!

 

*ছবি সৌজন্য: Pinterest, chotpot.com, dailyhunt

চাকরিজীবনের শুরুতে লেডি ব্রাবোর্ন কলেজের অধ্যাপিকা ছিলেন এবং পরবর্তীকালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান হয়ে অবসরগ্রহণ করেন। গৌড় বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্বও সামলেছেন। গল্প ও প্রবন্ধ লিখছেন কয়েক দশক। নারী ও সমাজ বিষয়ে ওঁর প্রবন্ধের সংকলন প্রকাশিত হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *