রান্না ছাড়াও আরও কত কী যে এই রান্নাঘরে হতো তা বলতেই না দিন কাবার হয়ে যায়! সকালের ঝোঁকে রান্নার ঝকর ঝকর কিছুটা সামলে গেলে, মানে কর্তাদের আপিস, ছোটদের ইস্কুল কলেজ আর বাকিদের জল খাবার পর্ব শেষ হলেই কাজে কিছুটা ঢিলে পড়ত। মানে গিন্নি, বউ, মেয়ে সবাই একটু হাত খালি পেত আর কি! দ্বিতীয় রাউন্ড চা বা একটু মিছরির জল খেয়ে ফুরসৎ মিলত অন্য কিছু ভাববার। রান্নাঘরের লাগোয়া উঠোনে বিশেষত শীতের সকালে চলত, আসন বোনার পাট। এর ওর কাছে প্যাটার্ন তোলার জন্য সে এক বিস্তর সাধাসাধি।সাময়িক হাতা খুন্তি নাড়া ছেড়ে, নক্সা বোনায় ওস্তাদ গিন্নি কোমর ঝাড়া দিয়ে উঠতেন পিঁড়ি থেকে। হলুদ হাতটা কাপড়ে বা গামছায় ‘ পুঁচে ‘ বলতেন, কই দে দিখি চশমা খানা। কত রকমের ফোঁড়ই না শেখাশেখি চলত। আনারস, আতা, লিচু – এ সবের আহা, কত না বাহারি নক্সা! এরই সঙ্গে লতাপাতা, গোলাপ, পদ্ম, চাঁদ, তারা।
আসন আর কার্পেট দুই ই বোনা চলত, যাবতীয় রান্না – বাড়া- বাটনা- কুটনোর ফাঁকে ফাঁকে। কখনও উল, কখনও বা শাড়ির পাড় থেকে সুতো তুলে। আর হতো কাঁথা বোনা।পুরনো ধুতি বা শাড়িতে কাঁথা পেতে নক্সা আঁকা। গেলাস, বাটি, কাঁসার থালার ডাইমিটার কাপড়ে ফেলে সরু পেন্সিল সিসে প্রথমেই আঁকা হতো নানা মাপের গোল। তার ওপর রং মিলিয়ে ছুঁচের ফোঁড়ে ধান ছড়ি , মাছের কাঁটা আর মিহি রান সেলাই। কাঁথা বোনার সুতো ছিল শাড়ির পাড়ের জোট খুলে – এক হালি , দু হালি, তিন হালি। আর বাচ্চার হাগু মুতুর আটপৌরে কাঁথা মানেই দেঁড়ো সেলাই – মোটা ছুঁচে সরু হালিতে চট জলদি। আমাদের সকলের ‘ খুকু পিসি ‘ , রান্নার ফাঁকেই টুক টুক করে শেষ করে ফেলতেন, ছোট ছোট ঢাকা। শাড়ির পাড় জুড়ে, তার ওপর কাঁথার রান সেলাই। বালিশের ওপরে পেতে মাথা রাখলে, ওয়াড়টা আর তেল চিটেনি হতো না। তাঁর এক চিলতে ঘরে থাক থাক রাখা, প্রতিটি টিনের ট্রাঙ্কও এই রকম ঢাকায় সাজানো থাকতো। বাতিল চটের বস্তার ওপরে শাড়ির পাড় বসিয়ে সুন্দর আসনও বানাতেন।
হাত পাখার চারপাশে লাল শালুর যে ঝালর লাগানো, তাও ঝপাঝপ সারা হতো রান্নাঘরের দাওয়ায় বসে। অনেকে আবার এক জোড়া ঝাঁটার কাঠির একটা গোল ফ্রেম বানিয়ে তাতেই আড়াআড়ি রং মিলনতি সুতোর নক্সা তুলে হাতপাখা বানাতেন। সে যে কী হাল্কা আর কত যে সুন্দর বলবার নয়। ঘুমন্ত হাত থেকে আলগোছে পিঠে পড়লেও লাগত না। আর ছিল পাকা কাতলার জাম্বো আঁশ গরম জলে ধুয়ে, চুনের জলে ভিজিয়ে শক্ত করে, তামার সরু সরু তার দিয়ে নক্সায় গেঁথে, একেবারে আঁকা ছবির মতো । আমার দিদিমা ক্ষণপ্রভার করা ওই রকম একটি রঙিন ফুলের ঝাড়, কাচ বাঁধানো কাঠের ফ্রেমে সাজানো থাকত মামার বাড়ির সবচেয়ে বড় ঘরটাতে।
না বললেই নয় কাঁটা ক্রুশ বোনার সেই বিলাসী আড্ডার কথা। কারও হাত চলত ধীরে, কারও বা ঝড়ের মতো। ধপধপে সাদা সুতোয় বোনা লম্বা লম্বা লেস – পেটিকোট বাহার। আর টেপ ফ্রকের দু কাঁধের জন্যে লেসের টেপ। এখানেও শঙ্খ লতা, আতা ফল, সাবু দানা – লং আর চেইন। খুব রেওয়াজ ছিল লেসের ডোয়েলির – গেলাস ঢাকা আর কাটা ফল ও পুজোর ডালা ঢাকার জন্যে বানানো খুঞ্চেপোশ। তার ধারে ধারে মালার মতো পুঁতির কারুকাজ। সাদা, আকাশি বা ফিকে গোলাপি। কেউ কেউ সাদা নেটের ওপর সাদা সুতোয় ফুল তুলে এটা সেটা বানাতো। সব থেকে শক্ত ছিল নোংরা না করে সেলাই – বোনা। তাই একটা ঝুড়িতে ন্যাকড়া মুড়ে আদরে রাখার যে রেওয়াজ , তা প্রায় সবাই মানতো। সে টুকরিতেই থাকত সুতোর লাছি, নানা মাপের ছুঁচ আর টুকরো টুকরো কাগজ আঁকা নক্সার নমুনা। আর ফ্রেমে এঁটে রেশম সুতোর ফোঁড়, সে তো ছিলই। ব্লাউজের গলা ও হাতায় এমব্রয়ডারি ছাড়া কেউ পরতো না। যাদের যত ধৈর্য আর সেলাই এর নেশা, তাদের কাজ যেন জড়োয়া গয়না। এমব্রয়ডারি করা হতো বালিশ ঢাকার চার কোনাতেও। ফুল তোলা রুমাল দিয়ে হাত পাকানোর শুরু। ফ্রেন্চ নটে হাত পাকলেই পদ্মবিভূষণ। কর্তার নামের আদ্যক্ষরটি নক্সা ফোঁড়ে লিখে সে কি লজ্জা আর কান গরম হয়ে যাওয়া – চুপচুপে কথার টিপ্পুনিতে।আর এক রকম ছিল সাদা পেটিকোট জুড়ে সাদা রেশম সুতোয় ফুটো ফুটো চিকনের কাজ। সলমা জরির কাজে জর্জেট, ভেলভেটের শাড়ি ও ব্লাউজ – এসবও ফিরত হাতে হাতে । ঘরোয়া বা শৌখিন – যে যেমন শিখতে পারে বা পছন্দ করে। রান্নার নানান ফোড়নের মতো হাতের কাজেরও বিস্তর আয়োজন আর নতুনত্ব। সাদা সুতোর শায়া বা পাজামায় পরাবার মোটা ফিতে , টুকরো টাকরা কাপড়ের কুচি এসব দিয়েও ফুলতোলা নক্সা হতো। টুকরো টুকরো শুকনো ডালে কাপড় জড়িয়ে বা তুলো দিয়ে কেউ কেউ পুতুল বানিয়ে দিত। কাল রেশম সুতো আঁচড়ে আঁচড়ে চুলের গুছিও, মানে ফলস টাসেল, জ্যান্ত বিনুনিতে জুড়ে মোটা করতে।
মুস্কিল ছিল সোয়েটারের বগল আর গলা ফেলা। শতবার মাপ দিতে দিতে এবং নিতে নিতে দুতরফেরই হাতে হারিকেন। মামার বাড়ির রান্নাঘরে, এই সোয়েটার বোনার আড্ডায় যোগ দিতে আসতেন বড় মামিমার ছোট কাকা টুগাদাদুও। তিনি আবার স্বজন সম্পর্কে মণি মাসির দেওর। একদিকের সম্পর্কে যেমন শ্বশুর মশাই, তেমনই আর এক দিকের সম্পর্কে দেবরটি। এক খিলি পান মুখে দিয়ে, ঝোলা থেকে তাঁর সেই শেষ না হওয়া বোনাখানি বার করে, দিব্যি জমিয়ে বসে যেতেন। আর চারপাশে ঘিরে আসত গল্পের গুজগুজ।
এরই মধ্যে শুরু হয়ে যেত বাকি রান্নার জম্পেশ শেষটুকু, মানে চচ্চড়ি, বড়ার ঝাল, অম্বল আর নারকেলের খাস্তা বিস্কুট – নুন ঠিকরি। স্নান পর্ব শেষে দুটি খেয়ে গড়িয়ে নিতে নিতেই সন্ধ্যে লেগে যেত। তখন শুধুই ঢিস ঢিস – গল্প গাছা, পা মালিশ আর ঝিম ঝিম। তবে আমার মেম সাহেবি ঠাকুমার ফ্রেট মেশিনটি রান্না ঘরের পাশেই থাকত। অপূর্ব ক্রুশ ও ট্যাটিন বুনলেও, ফ্রেট মেশিন চালিয়ে নানা রকম কাঠের জিনিসও বানাতেন যা এখন দুর্মূল্যে পাওয়া যায় ব্র্যান্ডেড দোকানে – লেটার কেস, ট্রে, টেবিল টপ। পরে, এখানেই থাকত মায়ের ঊষা মেশিন – পায়ে প্যাডেল। তখন অবশ্য উনুন বদলে জনতা আর গ্যাস। আর সঙ্গে প্রেশার কুকার। রান্না আর মেশিন আড়াআড়ি চলতো। যতক্ষণ প্রেশারে সিটি বা কড়াতে ঝোল, ততক্ষণ মেশিনও ঝম ঝম।a ফ্রক, টেপ ফ্রক, পেটিকোট ছাড়াও পর্দা, বালিশের ওয়াড়, লেপ তোষকের ওয়াড় আর বাজারের থলে। আর তা তো শুধু নিজের বাড়িরই নয়, আবদারে এবাড়ি ও বাড়িরও। ওই রান্না ঘরের পাশে রাখা মেশিনেই শাড়ির পাড় লম্বায় জুড়ে জুড়ে সুদৃশ্য বেড কভারও রঙ মিলিয়ে বানিয়ে ফেলতেন।
শুধু কি সেলাই! চলত লেখা পড়া। কাজের মেয়ের অক্ষর পরিচয়, স্লেট পেন্সিলে ঋ কার – ঐ কার, নাম সই। ঝর্না কলমে অন্যের পোষ্ট কার্ড লিখে দেওয়া, বা অন্যের লিখে দেওয়া পোস্টকার্ডটির শেষে কুটি কুটি করে লিখে ধরানো – “আ:( আশীর্বদস্বরূপ) ইতি, মা”। ডাকে আসা পোস্ট কার্ড অন্যকে পড়ে দেওয়াও ছিল এক মস্ত কাজ। আর ছিল বই বিনিময়। বিশেষত শরৎ চন্দ্র, নিমাই ভটচাজ আর শঙ্কর। একজনের ভালো লাগলেই তা বাকিদেরও হাতে হাতে ফিরত। তবে পড়ুয়ার সংখ্যা কমই ছিল। আমার ঠাকুরদার দিদিমা কৃষ্ণ কুমারী এবং তাঁর মেয়েরা – হেমলতা, কালীদাসী – সকলেই কবিতা লিখতেন। ছড়া কাটতেন মুখে মুখে। সন্ধ্যেবেলা খাতায় লেখবার আগে রান্নাঘরেই নোট বুক বা রাফ কাগজে মকসো করে রাখতেন, পাছে ভুলে যান। রান্না এবং পদ্য লেখায় নাম ছিল তাঁদের। বাড়িতে বিয়ে মানেই এঁদের লেখা বিয়ের পদ্য। অন্নপ্রাশন উপলক্ষ্যেও এঁদের লেখা ছড়ার নজির আছে। এই রীতিতে একেবারে আধুনিক জিন্স পরা মা – আমার চাকরি করা বন্ধু সুলগ্নাও চলতো। রান্না এবং বেক দুটো করতে করতেই সে তার মেয়ে রিনিকে পড়াত। তার দেখে আমিও। সে সময় আয়ার চলও ছিল না।রান্নার লোকও নয়। সংসারও ছোট হতে হতে প্রায় জনশূন্য। আমার ছোট্ট মেয়ে খুব খুশি হয়ে কড়াইশুঁটি ছাড়াত, আমার লেচি গোল করতো আর দুলে দুলে ছড়া মুখস্থ করতো। কখনও রান্নাঘরের জানলায় বসে পুতুলও খেলত। কী করছো, কেউ জিজ্ঞেস করলেই বলতো , রান্না করছি। টি ভি তে কার্টুন শো বা মোবাইলে গেম খেলতে দিয়ে ভুলিয়ে রাখতে হতো না।
ঠাকুর ঘরে বসে যে পিঁড়ি আঁকা হতো, তারও নক্সা স্কেচ আঁকা হতো রান্না ঘরে পা ছড়িয়ে বসে। গিন্নিরাই বলে দিতেন যে কী কী মঙ্গলিক চিহ্ন হবেই হবে,আঁকতে । আর লেখা হতো লম্বা লম্বা ফালি কাগজে, নানান জিনিসের ফর্দ। মুদির ফর্দ, পুরুতের ফর্দ, বিয়ের ফর্দ, নমস্কারির ফর্দ, পুজোর কাপড়ের ফর্দ, দেওয়া থোয়ার ফর্দ। গিন্নীর মনে পড়ছে, আর বলামাত্র লিখে নিচ্ছে অন্য একজন। অন্যেরাও টুকটাক বলে যাচ্ছে এ পাশ ওপাশ থেকে।এইসব ফর্দের ওপর অনেকটাই নির্ভর করত প্রতিটি সংসারের নিখুঁত চাল এবং চলন।
এরই মধ্যে চলতো খল – নুড়িতে মেড়ে রূপটান আর টোটকা বানানোও। কালমেঘ বড়ি, কাঁচা হলুদের শুকনো গুটি,শিউলি পাতার রস দই – বাতাসা দিয়ে, ক্ষিরুই পাতা বাটা, নিশিন্দে পাতার সঙ্গে ধুনো আর পাকা কলা চটকে টিকের ওপর সাজিয়ে মশা তাড়ানোর দাওয়াই, ব্যথার মালিশে নারকেল তেলে ফেলা ঢেলা ঢেলা কপ্পুর , ঘৃত কুমারীর শাঁস জমিয়ে মাথা ধরার ওষুধ। সব সাপ্লাই হত রান্না ঘরের ফুরসতে। তা ছাড়াও ছোটদের শিখতে হতো চাল বাছা। ধান আর কাঁকর আগের দিন বেছে রাখতেই হতো পালা করে। খেলা বা পড়া কোনো অজুহাত চলবেনা।এ ভাবেই, টুক করে না খেয়ে ফেলে ঠায় বসে মটরশুঁটি ছাড়ানো এবং হরেক রকম শাক বাছাও। এরই সঙ্গে চলত বিস্তর মেরামতি। বাঁশের ঝুড়ি, কুলো, ডালা – এসব ব্যবহার করবার আগেই পাটের সুতলি দিয়ে ধার বাঁধা হতো। ইঁদুরে কাটা চ্যাটাইও মেরামত হতো চটের তাপ্পি দিয়ে। ফুটো থলে, পাড় খুলে যাওয়া বসার আসন – একবার চোখে পড়লে আর রক্ষে নেই। মোটেই। Use and throw, নয় বরং “যাকে রাখ, সেই থাকে” থিওরি। ধনার মা, কেষ্টর মা, পারি মাসি, নিভাননী, এসব কাজ শেষ করে বসত আলু আর পেঁয়াজের বস্তা ঝেড়ে পচাগুলো বাদ করতে। মস্ত ঝুড়ির নিচে বিস্কুটের প্যাকেটের পুলটিশ দিয়ে নতুন করে সাজিয়ে দিত এক হপ্তার আলু, পেঁয়াজ, আদা – সব আলাদা আলাদা ঝুড়িতে। হামান দিস্তায় বা ছোট জাতায় মশলা গুঁড়ো করে দিত। চাল, ডাল, হলুদ, শুকনো লঙ্কা। ঝুড়ি ভরা সুপারি ছাড়াতো, নারকেল ছোবড়া কাটত ধুনো জ্বালানোর জন্য আর ধুঁধুলের ছোবড়া গা ঘষা – পা ঘষায় । আচার করবার চালতা , তেঁতুল, কুল কেটে বেছে ছাড়িয়েও দিত। টাকা কি পেত জানিনা, তবে গিন্নীর প্রসন্নতায় হেঁসেলে সেদিন পাত পেত, আর সঙ্গে কিছু পুরনো শাড়ি, চাদর এইসব। আর পেত আশপাশের বাড়িতে কাজের খোঁজ খবর। গিন্নিরাও এদের কাছে কাজ ছাড়াও এমন আরও অনেক কিছুরই হদিস পেয়ে যেতেন যা তাঁদের সাহায্যে লাগত।
হেঁসেলের খিড়কি দিয়ে ঢুকে পিঁড়ি টেনে জমিয়ে বসত ঘটকি গিন্নি। গিন্নি আর বউদের কানে দিয়ে যেত আইবুড়ো ছেলে আর মেয়েদের বৃত্তান্ত। রান্নার ছোঁকে হুস করে জল ঢাললেই ডুবে যেত তাদের ফিসফাস। ঘটকী বুড়ি আসা মানেই সানাই এর সুর। অনেক সময় চুপি চুপি ভালবেসে ফেলা পাত্র পাত্রীর বিয়েও ঘটক সম্মত করা হত। সু এবং কু দুরকম সংবাদই জানাতো তারা। সেদিনের রান্নার স্বাদ, তার আর পোড়া লাগা দুইয়েরই কারণও হত তারাই। তবে পান, বাতাসা আর জল দিয়ে তাদের আপ্যায়নে ত্রুটি হতো না। আর কিছু টাকার সঙ্গে বাগানের কলাটা, মুলোটাও। ঘোটকী ছাড়াও খবরাখবর চলতো, পাড়ার মেয়ে বউদের হেঁসেল দর্শনে। যেমন পাঁচ ছেলের মা – আবার পোয়াতি, সুতিকায় মৃত্যু, বিধবার মাছ খাওয়া, শহরে রক্ষিতা, অহেতুক ঢলাঢলি, মাথা পাগল , অ্যানিমিয়া, পিত্তি, গ্যাস , অম্বল – কি না আলোচনা হতো! আর ছিল থিয়েটার সিনেমার গপ্পো। কানন দেবী, সায়গল, প্রমথেশ। পরে সুচিত্রা – উত্তম, সাবিত্রী, সন্ধ্যা রায়। মীনা কুমারী, গুরু দত্ত, গীতা বালি, শাম্মী কাপুর।
আর সবচেয়ে জরুরি ছিল রান্নার ফাঁকে ফাঁকে কোলের বাচ্চাটিকে বুকের দুধ খাওয়ানো। উনুন ধারে বসে কখন যে কোলে আঁচল চাপা পড়তো এক দুধের শিশু সে কেউ ধরতে পারতোনা। রান্নাতেও কম বেশি হতো না একটুও। গরম কালে উনুনের তাপে বাচ্চা ছটফট করলে বোঝা যেত যে কোলে কিছু আছে। আর শীতে তো গরম তাপে মায়ের কোলে ডবল আরাম। তাই, কোনও পুরুষ মানুষ হঠাৎ করে হেঁসেল ধারে এসে না পড়লে, বাচ্চাকে ‘দুদু’ খাওয়াতে বুড়ি বা ছুঁড়ি কোনও বয়সের মায়েদেরই আড়ষ্টতা ছিলনা। তবে পুরুষ, মানে নিজের বর এসে পড়লেও বুকের আঁচল টানতে না পারলেও মাথায় ঘোমটা উঠে যেত। নতুন মা দুধ খাওয়ানোয় কিছুটা আনাড়ি হলে অভিজ্ঞ মা, কাকী, মাসিরা সে সব অনায়াসে শিখিয়ে দিতেন। ঠাকুমা দিদিমার বালিশ প্রমাণ দুদুতে ছিল তাবৎ নাতি নাতনিদের অধিকার। মায়ের দুধ ছেড়ে দিলেও ঠাকুমা দিদিমার শুখা বুক চুষিয়েও তাদের কান্না থামানো হতো। মায়েরাও নিশিন্তে রান্না করত।
সেই রাস সুন্দরীর প্রথম পাঠ, সুনয়নী – বিনয়নীর পিঁড়ের ওপর কাপড় বিছিয়ে ওয়াশ পেন্টিং বা হাল আমলে শাকিলার কোলাজ, সকলেরই অন্তর মহল এই রান্না ঘরের স্বাধীনতা। একা অবসর কাটানোর তো জো ছিলনা, তাই ব্যস্ততাকে কাজে লাগিয়ে নিজেরাই নিজেদের শিখিয়ে পড়িয়ে নিয়ে শখ সাধ মেটানো। উনুনের রান্নায় প্রচুর সময় লাগাও এর আরও এক কারণ। আর কারণ, দিনের ঝকঝকে আলো এবং সকালের এনার্জি। আর এ কথাটি তো ধ্রুব সত্য যে একমাত্র রান্নাঘরে থাকলেই দেখেছি যে , বাড়ির মানুষেরা কেউ বিরক্ত তো করেই না উপরন্তু ভীষণ খুশি। আমরা যেমন পড়ার বইয়ের ফাঁকে গল্পের বই রেখে গোগ্রাসে গিলতে ভালবাসতাম, সাবেক গিন্নীর দল তা বেশ ভাল করে বুঝে নিয়ে, সেটাকেই তাদের বোধ বুদ্ধি মনের ওয়ার্কশপ বানিয়ে ছিলেন। তবে পরিশ্রমের দিকটি ছিল অমানুষিক। মোটেই তা এলিয়ে খেলিয়ে, পান খেয়ে আর তাস খেলে কাটানো জীবন ছিলনা। ছিলনা শুধু রাঁধা আর খাওয়া। ছিল অন্তর – যাপন, ছিল বুঝে সমঝে চলা আর বিস্তর মাথা খাটানো। রান্নাঘরে আরও যা যা হতো তা আসলে “রমণী গুণের” যাপন।
আড্ডা আর একা থাকা,দুটোই খুব ভাল লাগে।
লিখতে লিখতে শেখা আর ভাবতে ভাবতেই খেই হারানো।ভালোবাসি পদ্য গান আর পিছুটান।
ও হ্যাঁ আর মনের মতো সাজ,অবশ্যই খোঁপায় একটা সতেজ ফুল।
অনেকদিন পরে কলকাতা বা তার আশেপাশের নগরকেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত যৌথপরিবারের মহিলামহলের ষাট-সত্তর বছর আগেকার আড্ডায় কান পাতলাম । এই আড্ডার ক্ষীয়মান অবশেষ খুব ছোটবেলায় দেখেছি । কল্যাণী দত্তের অসামান্য রম্য লেখাগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। এবং আশাপূর্ণা দেবীর উপন্যাসগুলো ! আপনার আরও লেখা পড়ার প্রতীক্ষায় থাকব ।
আরও লিখেছি। শীগগিরি পড়ে জানান।আপনার মতো পাঠকই তো আমার কলমের ঝণা কালি।
পুরনো দিনের কোলাজ।খুব খুব ভালো লাগলো।বর্তমান যুগে এই সব এখন কল্পনার অতীত
অনেক ধন্যবাদ
দারুন দারুন দারুন।এক নিঃশ্বাসে শেষ করলাম।
ধন্যবাদ
বেশ বেশ। এবার দম নাও।