দোতলা বাড়িটা যেন বড্ড ফাঁকা। পুরো খাঁ খা করে। বারান্দায় বসে দিনের অনেকটা সময় রাস্তা দেখতে দেখতে হয়তো কেটে যায়। কিন্তু সন্ধেবেলা হলেই মনটা একেবারে উদাস হয়ে যায়। চোখ টিভির পর্দায় থাকলেও, মন পড়ে থাকে অন্য কোথাও। রাতে কোনওদিন স্কাইপ করে সুদূর আমেরিকায় বসে থাকা এক মাত্র মেয়ে। কখনও আবার দিনের পর দিন কথাই হয় না। অথচ কিছু দিন আগে পর্যন্ত এই মেয়েকে নিয়ে হয়তো ব্যতিব্যস্ত থাকতেন আপনারা। তার পড়াশোনা, স্নান, খাওয়াদাওয়ার কথা ভাবতে ভাবতেই কী করে যেন সময় কেটে যেত। খেতে ভাল বাসে বলে রোজই নিত্য নতুন রান্না হত বাড়িতে। আর এখন স্বামী-স্ত্রী কারওর মুখেই যেন রুচি নেই। চারটি ডাল-ভাত খেয়েই চলে যাচ্ছে।

এই ছবিটা আপনাদের সকলের চেনা। চাকরি বা পড়াশোনার সূত্রে শহর বা দেশের বাইরে পাড়ি দিচ্ছে ছেলেমেয়েরা। আর একা থেকে যাচ্ছেন বাবা-মা। কিছুই যেন ভাল লাগছে না। প্রথম দিকের নিয়মিত ফোন, চ্যাট, খোঁজ খবর আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কখনও সময়,কখনও ইচ্ছের অভাবে। অথচ ভাবুন তো যাঁদের হাত ধরেই পথ চলার শুরু, জীবনের শেষ প্রান্তে এসে আমরা কী সহজেই তাঁদের এই হাতটা ছেড়ে দিতে পারি। আমাদের বিবেকবোধ, মূল্যবোধ কি সত্যিই এতটা ঠুনকো হয়ে গেছে? না কি সবটাই কালের নিয়ম, সময়ের সঙ্গে বদলে যাওয়া জীবনযাত্রার পরিণতি। উত্তরটা হয়তো আমরা কেউই সঠিক ভাবে দিতে পারব না।

আমার পরিচিত এক জনের কথা বলি। কালিকাপুরের এক বৃদ্ধাশ্রমে থাকেন। নাম অরুণা মিত্র। স্বামী মারা গেছেন অনেক আগেই। একমাত্র ছেলে বেঙ্গালুরুতে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকে। আসা যাওয়া বড় কম। স্বামী মারা যাওয়ার পর বছরখানেক ছেলের কাছে ঠাঁই পেয়েছিলেন। নাতনির সঙ্গে সময় কাটাতেন। কিন্তু তার পরই ছেলের চাকরির খাতিরে পাড়ি দিতে হল বিদেশে। সেখানে নাকি মাকে নিয়ে যাওয়া যায় না। অতএব কলকাতার বৃদ্ধাশ্রম হল নতুন ঠিকানা।” ছেলের সময় নেই কলকাতায় আসার। বিদেশ থেকে ফিরে বেঙ্গালুরুতেই বাড়ি কিনে নিয়েছে। বছরে এক বার আসে। ফোন করে মাঝাসাঝে। তবে ওখানে যাওয়ার কথা কিছু বলে না। আমিও ঠিক করেছি নিজে থেকে কিছু বলব না। শুধু নাতনির ঠাম্মি ডাকটা খুব মনে পড়ে। ওকে দেখতে খুব ইচ্ছে করে। রাস্তা দিয়ে কোনও ছোট বাচ্চাকে দেখলেই মনে হয় ছুটে গিয়ে আদর করি,” বলতে বলতে গলা ভিজে এল ওঁর।

তবে সবাইকে যে বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হয় তা কিন্তু নয়। অমিতাভ গুপ্ত যেমন স্ত্রীর সঙ্গে ভবানীপুরে নিজের বাড়িতেই থাকেন। এক ছেলে নিউ ইয়র্কে, আর এক ছেলে জাপানে বসে আছে। তাঁরা কেউই এখনও বিয়ে-থা করেনি। বড়দিনের সময় দু’ই ছেলেই শহরে আসে। হইহল্লা করে সময় কাটে সবার। তার পর আবার এক বছরের অপেক্ষা। ”আমার স্ত্রীর হাঁটুর সমস্যা আছে। লম্বা সময় প্লেনে বসতে পারবে না বলে ছেলেদের কাছে যাওয়া হয় না। ওঁরাও খুব ব্যস্ত, ঘন ঘন আসতে আসতে পারে না। তবে ফোনে, স্কাইপে, নিয়মিত কথা বলে। কিন্তু কী বলুন তো, সঙ্গে থাকার একটা আলাদা আনন্দ আছে। তবে আমাদের কোনও আক্ষেপ নেই। আমরাই তো চেয়েছি ওঁরা ভাল চাকরি করুক, স্বাবলম্বী হোক। খালি ওই মাঝে মাঝে কষ্ট হয়। তখন আবার বুড়োবুড়ি মিলে কোথাও কাছেপিঠে বেড়াতে চলে যাই,” জানালেন অমিতাভ বাবু।

অলোক গুপ্ত আবার অন্য রকম ভাবেন। ৮০ বছর বয়স হলে কী হবে, এখনও দারুণ ফিট। এখনও স্ত্রীর পেছনে লাগতে ভালবাসেন। ছেলে সপরিবার সিডনিতে থাকে আর মেয়ে মুম্বইয়ে। তবে সবার সঙ্গে সবার নিবিড় যোগাযোগ। ছেলে-মেয়ে উভয়ই কখনও সপরিবার, কখনও একা বছরে দু-তিন বার কলকাতায় আসেন। বাবা-মা-কেও সঙ্গে নিয়ে যান। ফলে ওঁদের মনে কোনও কষ্ট নেই। “আমার স্ত্রী মাঝে মাঝে একটু ঘ্যানঘ্যান করেন, তবে আমি পাত্তা দিই না। আর আমরা তো ভালই আছি। পুরো জীবনটাই তো ওদের জন্য করেছি, এ বার নিজের মতো থাকি। ইচ্ছে মতো খাই, ঘুরতে যাই, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা দিই। আর তা ছাড়া ছেলেমেয়েরা তো আমাদের অযত্ন করে না। খুব খেয়াল রাখে। অনেক বার আসে, আমরা গিয়ে থাকি। নাতি-নাতনিদের সঙ্গে দারুণ সম্পর্ক। ফলে মোটে খারাপ লাগে না। ভাল থাতে চাইলে ঠিকই থাকা যায়,” হাসতে হাসতে বললেন গুপ্ত বাবু।

আসলে সকলের পরিস্থিতি তো আর এক রকম হয় না। ভাল-মন্দ মিলিয়েই তো জগৎ। একটা সময় ছিল যখন সবাই মিলে একসঙ্গে হইহই করে থাকতেন। একান্নবর্তী পরিবারের ছবিটা তো কবেই খানখান হয়ে গেছে। আর এখন অনু পরিবারও ভাঙতে ভাঙতে এসে দাঁড়িয়েছে শুধুই স্বামী-স্ত্রী ও একটি কী বড়জোড় দু’টি সন্তানে। তাঁরাও আস্তে আস্তে কাজ, পড়াশোনা বা অন্য কোনও কারণে দূরে সরে যাচ্ছেন বাবা-মার থেকে। হঠাৎ করেই একা হয়ে পড়ছেন বয়স্ক বাবা-মা। কেউ কেউ মানিয়ে নিচ্ছেন। কেউ কেউ মনে করছেন সম্পর্ক ভাল রাখতে দূরে থাকাই তো ভাল। আবার কেউ সবচেয়ে কাছের মানুষের থেকে এই দূরে থাকাটা মেনে নিতে পারছেন না। খেই হারিয়ে ফেলছেন নিজেদের জীবনের। যাঁরা আবার একা থাকেন, জীবনসঙ্গীকে হারিয়েছেন, তাঁদের অবস্থা যেন আরও করুণ। ডাক্তার-বদ্যি থেকে দোকান বাজার সবই করতে হচ্ছে একা হাতে। কারওর সঙ্গে মন খুলে কথা বলারও সুযোগ নেই তাঁদের কাছে। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব প্রত্য়েকেই যে নিজের নিজের জগতে ব্যস্ত।

এই একাকিত্ব বড় কঠিন বাস্তব। এর সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই করতে করতে অনেকেই হাঁপিয়ে যাচ্ছেন। মনে আছে মানসিক অবসাদের জেরেই কীভাবে স্ত্রী-কে খুন করে আত্মঘাতী হয়েছিলেন বছর সত্তরের প্রৌঢ়। বলছি না নিজেদের শখ, আহ্লাদ সব বিসর্জন দিয়ে বাড়িতে বাবা-মার কাছে বসে থাকাটাই সন্তানের ধর্ম। তাঁদেরও জীবন আছে, কেরিয়ার আছে, সংসার আছে। কিন্তু তাই বলে, বাবা-মার মনের খোঁজ নেওয়াটাও কি তাঁদের কর্তব্য নয়? শুধুই আর্থিক সহায়তা, ডাক্তার-বদ্যি, মেডিক্যাল ইনশিওরেন্সের ব্য়বস্থা, তাঁদের শরীরের খোঁজখবর নেওয়াই যথেষ্ট নয়। আসলে এই বয়সে এসে মানুষ একটু সঙ্গ চায়, ভালবাসা চায়, যত্ন চায়। এটুকু কি আমরা তাঁদের দিতে পারি না? কেজো কথাবার্তা নয়, অন্তরের প্রসারতা ও সহৃদয়তাই তাঁদের প্রাপ্য। দূরে থেকেও কিন্তু সম্পর্কের উষ্ণতা ধরে রাখা যায়। ইচ্ছেটাই আসল।

বাবা-মাকে ভাল রাখাটা যেমন সন্তানের দায়িত্ব, ঠিক তেমনই বাবা-মার কিন্তু সন্তানের দিকটা বোঝা উচিত। তাঁরা হয়তো সত্যি অপারগ। আক্ষেপ, অনুযোগ করলে তাঁদের মনে অপরাধবোধের সৃষ্টি হতে পারে। আসলে সম্পর্কের সেতু তো দু’জনকেই তৈরি করতে হয় আর ধরেও রাখতে হয়। আপনারাও এই সময়টা শুধু বিগত দিনের রঙিন দিনগুলোর কথা ভেবে মন খারাপ করবেন না। বরং এই সময়টাকে ইতিবাচক ভাবে ব্যবহার করার চেষ্টা করুন। এত দিন তো সন্তানকে আবর্তিত করে বেঁচেছেন, এ বার একটু নিজের কথা ভাবুন। শারীরিক ভাবে সক্ষম হলে নিজের পছন্দের কোনও সামাজিক কাজের সঙ্গে যুক্ত হোন। সিনেমা-থিয়েটার দেখুন। আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ান। সোশ্যাল মিডিয়া এক্সপ্লোর করুন। বেড়াতে যান। নিজের ছন্দে, নিজের আনন্দে জীবনকে উপভোগ করুন। দেখবেন ভাল থাকার রসদ ঠিক খুঁজে পেয়ে যাবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *