আজকাল অনেকেই আমরা স্বাস্থ্য সচেতন। ফ্যাট, মিষ্টি, ভাত, আলু ছেড়ে ফল, শাকসবজি আর স্যালাড খাই। নিয়মিত মর্নিংওয়াক করি। আবার কেউ কেউ শরীরচর্চার পাশাপাশি হরেক রকমের সাপ্লিমেন্টও নিয়ে থাকি। কিন্তু তাও ফুল বডি মেডিক্যাল চেক আপ করতে গিয়ে ধরা পড়ে উচ্চ রক্তচাপ/ হাইপারগ্লাইসেমিয়া/ ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স/ হাই কোলেস্টেরল/ ইউরিক আ্যসিড…। কেন?? কেউ বলেন এসব বংশানুক্রমিক। অর্থাৎ বংশে কারও থাকলে আপনার হবে। আবার কারও মতে সব দোষই ফাস্ট লাইফস্টাইল আর টেনশনের। কিন্তু সত্যিই কি তাই? উত্তর দিলেন বিশিষ্ট নিউট্রিশনিস্ট তনিমা লাহিড়ি। আলাপচারিতায় শর্মিলা বসুঠাকুর। 

শর্মিলা – আজকাল সত্যিই সুগার, হাইপারটেনশন, কোলেস্টরল, ইউরিক অ্যাসিডের সমস্যা ঘরে ঘরে। এর কারণ কী?

তনিমা – এর উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের বিশদে নিউট্রিজেনোমিকস (nutrigenomics) বিষয়টা বুঝতে হবে।

শর্মিলা – নিউট্রিজেনোমিকস (nutrigenomics)-এর বিষয়বস্তু কী?

তনিমা – নিউট্রিজেনোমিকস গবেষণার মূল উদ্দেশ্য খাবার ও জিনের মধ্যে সম্পর্ক খতিয়ে দেখা। যে কোনও খাদ্য উপাদান, বিশেষ করে মাইক্রো নিউট্রিয়েন্ট, প্রয়োজনের তুলনায় কম বা বেশি খেলে তার থেকে হতে পারে জেনেটিক মিউটেশন। নিউট্রিজেনোমিকসের প্রধান উদ্দেশ্যই হল, আমাদের প্রতিদিনের খাবারে যাতে প্রত্যেকটি উপাদান সঠিক মাত্রায় থাকে, যাতে ডিএনএ ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এবং ভবিষ্যতে বন্ধ্যাত্ব বা ক্যান্সারের মতো রোগ আটকানো যেতে পারে।

Nutrigenamics
কাকে বলে নিউট্রিজেনোমিক্স! ছবি সৌজন্য – তনিমা লাহিড়ির ফেসবুক পেজ থেকে

গবেষণায় জানা গিয়েছে মাইক্রো নিউট্রিয়েন্ট, বিশেষতঃ ফোলেট, ভিটামিন বি-১২, নিয়াসিন, ভিটামিন ই, রেটিনল এবং ক্যালসিয়াম এই ডিএনএ-র ক্ষয় প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। দেখা গিয়েছে, পাশ্চাত্য ডায়েট তথা হাই কার্বোহাইড্রেট/ সুগার/ ফ্যাট ডায়েটই ডায়বেটিস/ ওবেসিটির মতো লাইফস্টাইল ডিজ়িজ়-এর অন্যতম কারণ। যখন বাইরের খাবারের এত প্রচলন হয়নি, তখন এসব রোগের এত আধিক্যও ছিল না। যে কোনও খাদ্য উপাদান হঠাৎ করে খুব বেশি বা খুব কম পরিমাণে নিতে থাকলে তার থেকে শুরু হয় জেনোম ড্যামেজ, যার ফলস্বরূপ ক্রনিক রোগ শরীরে বাসা বাঁধতে থাকে।

Genome Damage

শর্মিলা – তাহলে ক্রনিক রোগের অন্যতম প্রধান কারণ কি লাইফস্টাইল?

তনিমা – হ্যাঁ। ক্রনিক রোগ থেকে মুক্তি পেতেই প্রয়োজন লাইফস্টাইল বদলাবার। কিন্তু লাইফস্টাইল মডিফাই করা মানেই না খেয়ে থাকা অথবা অলিভ অয়েলে রান্না করা নয়! সঠিক সময়ে সঠিক খাদ্যগুণসম্পন্ন খাওয়া দাওয়ার অভ্যাসই মূল কথা।

শর্মিলা – নানা ধরনের ডায়েট সম্পর্কে আপনার কী মতামত?

তনিমা – বাজার চলতি কিটো/ প্যালিও ডায়েট কিম্বা ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং — সবগুলোরই কিছু না কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এভাবে কিছু ওজন হয়তো চটজলদি কমানো সম্ভব। কিন্তু দীর্ঘদিন চালিয়ে যাওয়া আদপেই সম্ভব না। খাওয়া নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গিয়ে নো-কার্ব ডায়েট মেনে ওজন কিছুটা কমলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শরীর নিজেই তা বর্জন করে। অর্থাৎ জেনেটিক ড্যামেজ ঘটে। আবার অচিরেই পুরনো ওজন বা কোনও কোনও ক্ষেত্রে তার চেয়েও বেশি ওজন দেখা যায়। শুধু তাই নয়, ডায়েটের পাশাপাশি দরকার সঠিক সময়ে খাওয়া। বিশেষ করে, রাতের খাবার দেরি করে খেয়ে সঙ্গে সঙ্গে শুয়ে পড়লে মেটাবলিজম চলতেই থাকে। ফলে শরীর আ্যকটিভ স্টেটেই থেকে এবং দেহের সঠিক বিশ্রাম হয় না। স্লিপ ডেপ্রিভেশন তৈরি হয়, যার থেকে শারীরিক এবং মানসিক অসুস্থতা জন্ম নেয়।

শর্মিলা – অর্থাৎ ডিনার সারতে হবে তাড়াতাড়ি?

তনিমা – অবশ্যই। এবং খাওয়ার অন্তত দু’ঘণ্টা পর ঘুমোতে যেতে হবে।

Diet
ডায়েট শুধু রোজের খাদ্যতালিকা নয়, প্রতিটি খাদ্য উপাদানের সঠিক বণ্টন। সেটা প্রত্যেকের জন্য আলাদা। ছবি – তনিমা লাহিড়ির ফেসবুক পেজ থেকে

শর্মিলা – সুস্থতার সঙ্গে যথাযথ খাওয়াদাওয়ার অভ্যাসের গভীর যোগাযোগ কতটা?

তনিমা – নিশ্চয়ই। ডায়েটের সঙ্গে শরীরের তথা রোগের সম্পর্ক খুব সরল। আমরা ছোটবেলা থেকে যে ধরনের খাবারে অভ্যস্ত, তারই প্রতিফলন ঘটে শারীরিক সুস্থতা বা অসুস্থতায়। ডায়েট শুধু প্রতিদিনের খাদ্যতালিকা নয়, প্রত্যেকটা খাদ্য উপাদানের সঠিক বণ্টন এবং তা প্রত্যেকের জন্য আলাদা। এমনকি একই মানুষের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম। একই ডায়েট চার্টও দীর্ঘ সময়ের জন্য কার্যকর নয়। এর থেকেই আসে কাস্টোমাইজ়ড ডায়েটের ধারণা এবং নিউট্রিজেনোমিকস এ ধরনের ডায়েট প্ল্যানের মূল হাতিয়ার। আমাদের প্রত্যেকের শরীরেই ছ’টি খাদ্য উপাদান — কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাট, ভিটামিন, মিনারেল ও জলের চাহিদা বিভিন্ন। নিউট্রিজেনোমিকস বিশেষ করে ব্যক্তিগত প্রয়োজন অনুযায়ী খাদ্য উপাদানগুলির পরিমাণ নির্ধারণে সাহায্য করে।

শর্মিলা – আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে একজন মানুষকে লাইফস্টাইল মডিফিকেশন করতে হলে কী করতে হবে?

তনিমা – ডায়েট প্যাটার্ন পাল্টাতে হবে, কাস্টমাইজ়ড ডায়েট মেনে চলতে হবে।

শর্মিলা – কী ধরনের খাবার খেতে হবে?

তনিমা – আমাদের প্রত্যেকের শরীরের চাহিদা আলাদা। সেই অনুযায়ী ডায়েটটা প্ল্যান করতে হবে। ক্যানড বা প্রসেসড ফুড খাওয়া কমাতে হবে। হোল ফুডসের ওপর জোর দিতে হবে। অরগ্যানিক/ প্রাকৃতিক খাবার বেশি করে খেতে হবে।

Organic Food
অর্গ্যানিক খাবার শরীরের পক্ষে ভালো। দাম কিঞ্চিৎ বেশি হলেও এই খাবার খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা ভালো। ছবি – geneticliteracyproject.com

শর্মিলা – কিন্তু অর্গ্যানিক খাবার তো পাওয়া খুব মুশকিল। তার উপর দামও অনেক বেশি। সাধারণ মানুষ সেক্ষেত্রে কী করবেন?

তনিমা – যাঁরা অর্গ্যানিক খাবার পাচ্ছেন না, তাঁদের বলব, বেশি করে মরশুমি ফল সবজি খান। প্রসেসড খাবার বাদ দেওয়ার চেষ্টা করুন। কোনও অসুখ না থাকলে, সব রকম খাবারই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে খাওয়ার চেষ্টা করুন। তবে দামি হলেও অর্গ্যানিক খাবার খাওয়া একটা মানসিকতার ব্যাপার। এটা ধীরে ধীরে অভ্যাস করতে হয়।



ন’ বছরের ছোট্ট মেয়ে পুনম খুব ভুগত। এখনও পুরো পাঁচ ফুট লম্বা হয়নি পুনম। তাতেই ওজন ৫০ কেজি ছাড়িয়েছে। নিয়মিত পেট ব্যথা, বুকে ব্যথা, বমি ভাব, গলার কাছে খাবার আটকে থাকার মতো অনুভূতি, মুখ টক হয়ে থাকা, গায়ে ব্যথা, হঠাৎ হঠাৎ কাঁপুনি, শীত লাগা, বারবার টয়লেট পাওয়া, শ্বাসের কষ্ট, মাথা ঘোরা, ক্লান্তি, অরুচিতে ভুগত সে। অথচ জ্বর বা অন্য কোনও সিরিয়াস অসুখ তার নেই। মা যোগাযোগ করেছিলেন তনিমা লাহিড়ির সঙ্গে। তিনি জানতে চেয়েছিলেন পুনমের রোজকার খাদ্যতালিকা। পুনম যা যা খেত –

ব্রেকফাস্ট – ডালপুরি বা পুরভরা পরোটা + এক গ্লাস দুধ
স্কুলের টিফিন – ফল + দু’টো রুটি ও সবজি
লাঞ্চ – ভাত, দু’টো রুটি, ডাল, সবজি, রায়তা
স্ন্যাক্স – পাঁচ ছ’টা বিস্কিট/পপকর্ন/চিপস/চকোলেট + এক গেলাস দুধ
ডিনার – দালিয়া/উপমা/খিচুড়ি/পোহা/উত্তপম/ডাল-রুটি

পনেরোদিনে একবার – পিজ্জা/গার্লিক ব্রেড/ফ্রেঞ্চ ফ্রাই/হ্যাশ ব্রাউন
জল – দিনে দেড় থেকে দু’লিটার

তনিমা বুঝতে পারেন পুনমের কেসটি লাইফস্টাইল ডিজ়িজ়ের একটি সার্থক উদাহরণ। ওর হজম ও মেটাবলিজ়মের সমস্যা বুঝতে পেরে তিনি ওর জন্য লাইফস্টাইল মডিফিকেশনের পরামর্শ দেন। একটি ডায়েট চার্টও তৈরি করে দেন। সেটি এখানে দেওয়া হল –

ব্রেকফাস্ট – ৫০ গ্রাম হোলহুইট আটা বা বাজরা দিয়ে বানানো স্টাফড পরোটা। সবজি। সঙ্গে এক গেলাস চিনি ছাড়া লস্যি।
মিডমর্নিং – মিক্সড ফ্রুট স্যালাড – বেদানা/পাকা পেঁপে/তরমুজ/বেরি/অঙ্কুরিত দানাশস্য (সবুজ মুগ/মুশুর ডাল/কাবলি ছোলা)
স্কুলের টিফিন – দালিয়া/খিচুড়ি/পোহা – ৩০ গ্রাম
লাঞ্চ – ৬০ গ্রাম ভাত। সঙ্গে ডাল, সবজি, রায়তা
স্ন্যাক্স – গোটা ফল বা ফলের স্মুদি/বাটারমিল্ক বা ছাঁস/বাদাম – আমন্ড/আখরোট/পেস্তা
ডিনার – ৫০ গ্রাম ভাত। সঙ্গে সবজি ও ৫০ গ্রাম টক দই
ঘুমনোর আগে – ক্লিয়ার স্যুপ বা সবজির ব্রথ

বাদের তালিকায় গেল – চিনি, কেক, প্যাস্ট্রি, হোলমিল্ক এবং তা দিয়ে তৈরি যে কোনও খাবার, সফট ড্রিংক, কাঁচা শাকসবজি বা স্যালাড, গোটা মশলা, ফ্রুট জুস, কুকিজ়, লেবুজাতীয় ফল।

বিশেষ নির্দেশ

এই নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে পুনম এখন সুস্থ। নিশ্চিন্ত তার পরিবার।



শর্মিলা –
ডায়েট করলে বহু মানুষেরই দেখেছি চুল ওঠে, ত্বক খারাপ হয়ে যায়। ঝলমলে মুখ আর ছিপছিপে চেহারা কোন ডায়েটে সম্ভব বলুন তো?

তনিমা – অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে শুধু ওজন কমানোর জন্য ক্যালরি কম নিলে, এই ধরনের সিম্পটম দেখা যায়। কারণ সে ক্ষেত্রে শরীরে মাইক্রো নিউট্রিয়েন্টসের ঘাটতি দেখা যায়। ওজন শুধু কমালেই তো হবে না, সুস্থ থাকতে হবে। আর তার জন্য প্রয়োজনীয় মাইক্রো নিউট্রিয়েন্টস লাগবেই।

শর্মিলা – ইমিউনিটি বাড়ানোর জন্য এখন যা হুজুগ চলছে, আপনার কী মত?

তনিমা – ইমিউনিটি বাড়ানো কোনও মিরাকল নয়। Food is Medicine কথাটার অর্থ সঠিক খাবার খেলেই তা রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা দেবে। আবার ভুল খাবার দিনের পর দিন খেয়ে গেলে, তার থেকে রোগ হতে পারে। তাই প্রধান যে খাবারটা খাচ্ছি, তার মধ্যেই রোগ প্রতিরোধ বাড়ানোর খাবার থাকে। আলাদা করে মিরাকল কিছু নেই এখানে।

Fruit Diet
ফলের রসের তুলনায় গোটা ফল বা ফ্রুট স্যালাড খাওয়া বেশি উপকারি। ছবি- builtlean.com

শর্মিলা – একজন প্রাপ্তবয়স্কের জন্য একটা সহজ, স্বাভাবিক, পুষ্টিকর মিল প্ল্যান কী রকম হতে পারে? ডায়েট চার্টের কথা বলছি না।

তনিমা – সাধারণ মিল প্ল্যান বলে কিছু হয় না। সবার পুষ্টির চাহিদা তো সমান নয়! তবে বিশেষ কোনও রোগ না থাকলে খাবারের মূল ছ’টি উপাদান (কার্ব, প্রোটিন, ফ্যাট, ভিটামিন, মিনারেল আর জল) যেন খাদ্যতালিকায় থাকে সেটা নজরে রাখতে হবে। নিউট্রিয়েন্টগুলির পরিমাণ নির্ভর করবে আপনার লাইফস্টাইলের উপর।

শর্মিলা – ছোটদের খাওয়া দাওয়া কেমন হওয়া উচিত?

তনিমা – ছোটদের ক্ষেত্রে সহজপাচ্য বাড়িতে বানানো খাবার ভালো। ভ্যারাইটি অবশ্যই থাকবে কিন্তু বাচ্চাদের খাবার নিয়ে অতিরিক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা খুব একটা ভালো নয়। ওদের ক্যালোরি বা প্রোটিন নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে অ্যাকটিভিটি লেভেল যাতে ঠিক থাকে, সেদিকে নজর দিন।

 

 

সাংবাদিক, প্রশিক্ষিত নৃত্যশিল্পী ও নৃত্যসমালোচক। দীর্ঘদিন সম্পাদনা করেছেন সানন্দা পত্রিকা। যদিও কর্মজীবনের শুরু হয়েছিল দর্শনের অধ্যাপনা দিয়ে। পরে প্রাণের তাগিদে সাংবাদিকতাকেই পাকাপাকি ভাবে বেছে নেন। অবসর নেওয়ার পরও তুমুল ব্যস্ত। রান্নাবান্না, বেড়ানো, সাজগোজ নিয়ে অবিরাম পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতেই থাকে। ভালোবাসেন বই পড়তে, ভালো সিনেমা দেখতে আর খাওয়াতে। নিবিড় ভাবে বিশ্বাস করেন ভালো থাকায়, জীবনের রোম্যান্টিকতায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *