এক একজনের পাওনাভাগ্য খুব ভা
ল! যেমন আমার! সেই রবিঠাকুরের গান, “না চাহিলে যারে পাওয়া যায়—“! সত্যি, আমার জীবনে এমন বেশ কিছু প্রাপ্তিযোগ আছে! তাই আমার ঝুড়ি কানায় কানায় ভ রা! ছোটবেলায় মা’র (ঠাকুমা’কে মা ব
লে ডাকতাম) কাছে মহাভারতের গল্প শুনে আমি বায়না করেছিলাম “মা আমিও শতপুত্রের মা হব”! মা হেসে বলে ছিল, “তুই আগে এক পুত্রের মা হ’, তা রপর ভাবিস শতপুত্রের মা হবি কি না!” মা আজ নেই তাই দেখাতে পারলাম না, আমি এখন সত্যিই শত পুত্রকন্যার মা! আমি দুই পুত্রের জন্মদাত্রী বটে কিন্তু আরও বহু সন্তানের ধাত্রী মা! তাই আমার ছেলে
রা ঠাট্টা করে বলে , “মা তোমার বকুনির জন্যে দুই ছেলে আর ভালবাসার জন্যে ১০০ জন ছে লেমেয়ে!”
এই ছেলে মেয়েরা আমার জীবনের সঙ্গে ওতঃপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে! আজ
থেকে ১৬ বছর আগে আমি কর্ম জীবনকে (সায়েন্টিফিক রিসার্চ) পাশাপাশি আমার গুরুর অনু মতি নিয়ে একটি গানের স্কুল খুলি! এটা নিছকই বন্ধুদের আবদারে, যা তে তাদের ছেলেমেয়েরা বাঙালির সংস্কৃতির কিছুটা অভাস পায় ! এভাবেই জন্ম হল স্বরলিপি রবীন্দ্রসংগীত মি উজ়িক একাডেমির যার পথ চলা শুরু কিছু বিদেশি বুলবু লিদের নিয়ে! আজ আমি ভিন্ন দেশবাসী
আমার কাজ তোমার মন্ত্র
সুরের ঠাকুর রবিঠাকুরের মন্ত্র-
তুলে দেওয়া কিছু ভিনদেশি বুলবু
লির গলায়! আজ তুমি ছবি হয়ে আছ আমার ঘরে!
আমার ছোট্ট পাখিরা
তোমায় চেনে মালায় ধূপে!
এ বুলবুলিদের ভাষা ভিন্ন
তারা বলে না তোমার ভাষা
পড়তেও জানে না,
কিন্তু তোমায় জানে
জানে তোমার গান!
সেই কলরব -মুখর বুলবুলিরা
বসে তোমার ছবির সামনে
আর সুরে সুরে গেয়ে যায়-
তোমার গান!
ওরা গায় , “আমরা সবাই রাজা
আমাদের এই রাজার রাজত্বে-“
কোন জাদুকর যেন সত্যিই
রাজা করেছে ওদের !
যখন গায় –
“আজি শুভদিনে পিতার ভবনে
অমৃত সদনে চল যাই– “!
মনে হয় ওরা দল বেঁধে চলেছে তোমা
রই কাছে! জোনাকির সুখের পাখা মেলে
ওরা এক সুর থেকে
ভেসে যায় আর এক সুরে !
শুরুতে নেহাতই কিছু কচিকাঁচার ভি
ড়! গান শেখার থেকে, স্বপ্নামাসির আদর আর গানের পরের পপ কর্ন, ললিপপের ওপর তাদের ঝোঁক ছিল বেশি !
সেই শিশুরা আজ কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে প্রবেশ করতে চলেছে! বর্তমানে স্বরলিপির সঙ্গে যুক্ত প্রায় ১৫০-১৬০ জন যাদের মধ্যে শিশু থেকে প্রবীণ সকলেই আছেন! তবে ৫ থেকে ২২ বছরের ছেলেমেয়েই বে
শি! এরা আসে, আমার চোখের সামনে ধীরে ধীরে বড় হয়! আমার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে যায়! তাদের আদর আবদা র আর আমার শাসন সব মিলে মিশে শু ধু মনের টানটাই বাড়ে! পক্ষিমাতা র মতো ডানার আড়াল সরিয়ে এক সময় তা দের মুক্ত আকাশে উড়ে যেতে দিতে বড় কষ্ট হয়! তবে আমার এই সন্তা নরা ফিরে ফিরে আসে আমার কাছে আমা র পাওনা গন্ডার হিসাব পূরণ করতে ! ওদের চোখ দিয়ে আমি যেন নিজেকে নতুন ভাবে দেখি , চিনি, জানি! র বিঠাকুরের কথায় “আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না”! আজ আমার এক ষোড়শী কন্যার গল্প ব
লব! বেশ কয়েক বছর আগে, একবার স্ব রলিপির ক্রিসমাস পার্টি হচ্ছে! বছর ছয়েরএকটি মেয়ে তার মায়ের সঙ্গে এল! মায়ের কোলে তার ভাই, ওরা এখানে কাউকে চেনে না! এত ভিড়ের মধ্যে মেয়েটা বেশ জড়োসড়ো হয়ে মায়ের গা ঘেঁ ষে দাঁড়িয়ে! সে গান শিখবে তাই আ মিই ওদের আসতে বলেছিলাম যাতে সবা র সঙ্গে আলাপ হয়ে যায়! স্বরলিপি পরিবারের সবাই যখন সিঁ
ড়িতে দাঁড়িয়ে গাইছে, আমরা সবাই রাজা আমাদেরই রাজার রাজত্বে ! ত খন দেখি সেও ভয় কাটিয়ে বাকিদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে! হয়তো গানটার দু এক লাইন জানত! সেই তার প্রথম হাতেখড়ি স্বরলিপি আর রবিঠা কুরের সঙ্গে ! পরে ওরা মা-ছেলে-মে য়ে তিনজনেই গান শিখতে শুরু করল! ওর নাম সাফিনা উদ্দীন ! ও যেদিন
প্রথম স্বরবলিপির সরস্বতী পু জোতে এসেছিল সেদিন একটা ব্যাপার হয়েছিল! আমাকে পুরোহিত মশাই জি জ্ঞেস করলেন, কার নাম পুজো উৎসর্গ করা হবে, নাম গোত্র বলুন! আমি ব বললাম আমার সব ছেলেমেয়ের নামে! উনি বললেন তা আবার হয় নাকি? আমি ওঁকে আস্বস্ত করলাম যে সব ছে লেমেয়ের নাম গোত্র দেব আপনি ওদে র নাম একটু জোরে জোরে বলবেন ওরা তাহলে মন দিয়ে আপনার পুজো দে খবে আর ওদের ভালও লাগবে। এক মায়ের ওপর দায়িত্ব পড়ল সবার
নাম গোত্র লেখার! সাফিনাকে যখন জিজ্ঞেস করেছে, ওর তখন আমাকে প্র শ্ন,”স্বপ্নামাসি আমার গোত্র কী?” আমি বললাম “আমি কাশ্যপ গোত্র তা
ই তুইও কাশ্যপ গোত্র ?” তাতে খু ব খুশি যে ও নিজেও স্বপ্নমাসির মতো! সেই থেকে সাফিনা বলতে শুরু করলো, সরস্বতীপূজার দিন আমি হি ন্দু হয়ে যাই, আমার তখন স্বপ্ নমাসির মত কাশ্যপ গোত্র!

এই ছেলেমেয়েদের ৮-৯ বছরের অনুশী
লনের পরে, ওদের শিক্ষার মূল্য বি চার করে ওদের সমাবর্তন করা হয়। প্রায় ২০০-৩০০ মানুষের সামনে, ২ ঘন্টার একক অনুষ্ঠান করতে হয়। বিভিন্ন প র্যায়ের গান, বিভিন্ন রাগের ওপর গান এবং রবীন্দ্রসৃষ্ট বিভিন্ন তালের ওপর গান তারা পরিবেশন করে। এই সমাবর্তনের আগের এক দেড় বছর ধরে চলে এর প্রস্তুতি! আর এই সময়ই ওরা যেন আরও কাছের জন হয়ে যায় আঁকড়ে ধরে! এই সমাবর্তনের কর্ণধার রাহুল (আমার স্বামী)! কোন হলে অনুষ্ঠান হবে, কোন কোন বাজনা সঙ্গতে থাকবে? কোন গানের সঙ্গে কোন স্লাইড যাবে— ইত্যা দি সবকিছু দেখভালের ভার থাকে রাহুলের ওপর! ব্যাপারটা অনেকটা ছোটখাটো একটা বিয়ের মতো! আমার এমনই দুই ছে লে মেয়ে অন্তরা পাল ও প্রমিত সিনহার সমাবর্তন হয়েছে ২০১৬ ও ২০১ ৮ সালে!

গতবছর আগস্ট মাসে সাফিনার সমা
বর্তন করার কথা ছিল! সেই হিসেবে ২০১৯ এর গোড়া থেকেই প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল! ২০২০র স রস্বতীপুজো তে সবাইকে জানানো হল! কিন্তু তা রপর থেকেই আমরা সবাই COVID এর প্রকোপে পড়ে গেলাম! তখন ভেবেছিলাম এটা সাময়িক, সব কে
টে যাবে। হয়তো অগস্টের বদলে নভেম্বরে হবে! সেই উৎসাহ দিয়েই ওকে গানের মধ্যে ধরে রাখার চেষ্টা ক রেছি। আসলে একবার পরীক্ষার জন্য তৈরি হয়ে গেলে, তখন মন সেটা শেষ করার জন্যে প্রস্তুত থাকে! ওর গানের প্রতি উৎসাহ কমতে থা কল। এটা বাঁচিয়ে রাখার জন্য আ মার একটা হারমোনিয়াম ওকে দিলাম। শুরু হল জ়ুম মিটিঙে হারমোনিয়াম শে খানো! ও যেহেতু পিয়ানো বাজায়, স হজেই শিখতে পারল! ওর বাবাকে বলে পাকড়াশীর হারমোনিয়াম আনিয়ে দিলা ম! কিছুদিন সেটা নিয়ে খুশি! তা রপর আবার সেই আগের মতো! গান প্র্যাকটিস করতে বা গানের ক্লাস করতে ভাল লাগেনা! আসলে কথায় আছে বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে! আমার ছা
ত্রছাত্রীদেরও সেই অবস্থা! আমার ওপর, এই বাড়ির ওপর যেন ওদের অধি কার আছে! এ বাড়িতে ওরা সবাই রাজা। সেই অধিকার কি রিমোট দিয়ে পূ রণ করা যায়?

যাইহোক সাফিনার সমাবর্তনের এই অ
নিশ্চয়তা আর ওর এই গান শেখার ব্যপারে নিরুৎসাহ দেখে ওর বাবাকে বললাম যে আমি কিছুদিনের জন্যে বন্ধ করি, ও নিজে থেকে যখন চাইবে তখন আবার শুরু করব। ওকে একটু সময় দেওয়ার প্রয়োজন। গত বুধবার ঈদ ছিল! গত কয়েকবছর ঈ
দের দিন আমার বেশ কিছু ছাত্র ছা ত্রীর বাড়ি আমাদের বিজয়ের শুভেচ্ছা জানানোর মতো ঈদ মুবারক জানাতে গেছি! এবছর তো সেসব কিছু নেই! কাজ থেকে ফিরে বেশ ক্লান্ত, হঠা
ৎ কী খেয়াল হল রাহুলকে বললাম এ কটু ভাল জামাকাপড় পরে নাও, বে রোব! ও অবাক? এখন ? কোথায়? বললাম, ঈদ মুবারক করতে!
ফোন না করেই গেলাম সাফিনাদের বা
ড়ি! দরজায় বেল দিলাম ! সাফিনার বাবা দরজা খুলে দিল! ওরা ঈদের জন্যে সুন্দর পোশাক পরে আছে! দৌ ড়ে এল সাফিনা, “আমি দুটা ভ্যাকসিন নিসি, তুমি আমাকে hug করবা না?” এই আমার গ্রোন আপ ষোড়শী কন্যা! সে আর থামেই না! ” ভাইয়া তুমি পিয়ানো বাজাও, আম্ মু তুমি স্বপ্না মাসিকে ফিরনি দা ও—আজ কেউ আসেনি আমাদের বাড়িতে — তুমি আমার নুতন হার্মোনিয়মটা বাজাবা না?” আমি একটা থালায় কিছু মিষ্টি নি
মকি চকলেট নিয়ে গেছি! সেই দেখে তার মনে পড়ে গেল,” আমি জানতাম তু মি আসবা, তাই আমি তোমার জন্যে এক টা চিঠি লিখসি।” তা পেলাম সেই চিঠি যার গোটাটা ভালবাসা, মনের দ্বন্দ, মান
-অভিমান দিয়ে ভরা।” সেই চিঠি আমি সযত্নে আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছি।

ছবি সৌজন্য: স্বপ্না রায়
আশির দশকে হাওড়ার বর্ধিষ্ণু যৌথ পরিবারের ঘোরাটোপ ছেড়ে বেরিয়ে বিজ্ঞান গবেষণা করতে মার্কিনদেশে চলে এসেছিলেন রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের প্রাক্তনী স্বপ্না রায়। সঙ্গী স্বামী রাহুল রায়। রবীন্দ্রসঙ্গীতের একনিষ্ঠ ভক্ত স্বপ্না তিন দশক আগে আমেরিকার বস্টন শহরে তৈরি করেন রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখার স্কুল স্বরলিপি। আজ তাঁর ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা একশর বেশি। তার মধ্যে ভারতীয়, অভারতীয় উভয়েই আছেন।