— হ্যালো, আমি দুর্লভপুর থেকে বিপ্রতীপ বোস বলছি। আপনি কে বলছেন জানতে পারি?

দুর্লভপুর এক সাদামাটা দোআঁশলা লোকালয়। গ্রাম নয়, কারণ জমিজমা থাকলেও কৃষিজীবি লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন। আর শহর হতে হতেও কোথাও যেন আটকে গেল, কেটে যাওয়া ঘুড়ি যেমন মুক্তির আনন্দে ভাসতে থাকে। আর অনেক নিচে আকাশের দিকে তাকিয়ে লগা, আঁকশি নিয়ে ছুটে চলা প্রার্থীর দল। ঘুড়ির সাধ জাগে, ওদের সঙ্গে জুড়ি বাঁধে। ওপর থেকেই নির্বাচন শুরু করে, যেন স্বয়ম্বর সভা। তখনই ইতিবৃত্তের লম্বা লেজের মতো সুতোটা আটকে যায় কোন এক গাছের ডালে। আকাশ আর মাটির মাঝ বরাবর ঝুলতে থাকে। তার আর জুড়ি বাঁধা হয় না। দুর্লভপুর-এর ঠিক তেমন দশা। শহর হয়ে ওঠার হাতছানি পেয়ে ছুটে চলতে চলতে কোন এক পিছুটানের সুতোয় লটকে আছে।

এমনই সেই জনপদের এক নির্বিবাদী মানুষ বিপ্রতীপ। সকাল বেলায়, নিজের এক চিলতে বারন্দায় বসে খবরের কাগজ সহযোগে চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে ফোন পেল। ফোনের ওপারেও আবার জনৈক ‘বিপ্রতীপ বোস’, যে কিনা আবার কোনও এক দুর্লভপুরেই থাকে। সে কথা বলতে চাইছে। প্রসঙ্গটা বুঝে উঠতেই সময় লাগল। খানিক স্তব্ধতার পর বিপ্রতীপ বললেন,

— আমিই তো দুর্লভপুর থেকে বিপ্রতীপ বলছি। আপনি কে? কাকে চাইছেন?” ওদিকেও জবাবে বিস্ময়ের ভাব ফুটে ওঠে, “আশ্চর্য! তাহলে আমি কে?

— আপনি কে, তা আমি কী করে জানব বলুন?

— সেই জন্যই তো ফোন করছি। আমাকে না জেনে কী করে আমার নাম-ঠিকানা নিয়ে বসে আছেন?

— অদ্ভুত তো! এমন কথা আমি জন্মে শুনিনি। নিজেকে কি নিজে ফোন করা যায়? প্রযুক্তির হাত এখনও অতটা লম্বা হয়নি যে নিজের বিবেক বা আত্মার সঙ্গে নিজেকে কথা বলাবে।

— কিন্তু ফোনটা তো আমিই আপনাকে করলাম।

— সেটাই তো বুঝতে পারছি না। এমন সাত সকালে হঠাৎ আপনি কোথা থেকে ফোনে এসে জুড়ে বসলেন?

— এলাম কি এমনি? নিজের ব্যক্তিপরিচয় অন্যের হাতে চলে যেতে দেখলে কি চুপ করে থাকা যায়? আপনি হলে কী করতেন?

— কী করতাম মানে? আমার তো কোন সমস্যা হয়নি। আগ বাড়িয়ে কাউকে ফোন করার কারণও ঘটেনি।

— চুরি হলে, থানায় কে যায়? চোর না গৃহস্থ?

— সকাল সকাল আমায় চোর বলবেন বলে ফোন করেছেন?

— চোর ডাকাত না হ্যাকার কী বলব বলুন তো?”

— দেখুন, সকালবেলা এই আষাঢ়ে গপ্পো শোনার আমার সময় নেই। আপনি ফোন রাখুন।

— আমি না হয় ফোন রাখব। কিন্তু আপনি আমার নাম পরিচয় কি রাখবেন?

বিপ্রতীপ কথা বাড়ায় না। ফোন কেটে দেয়।

ফোন রেখে থম মেরে বসে থাকে, বোঝার চেষ্টা করে, কী হতে পারে? ছেলে সংসার পেতেছে অন্য দেশে। মাস গেলে টাকা পাঠিয়ে কর্তব্য সারে। যদিও সে টাকা ধরাই থাকে। বিপ্রতীপের নিজের খরচ চালানোর মতো ভালো রোজগার হয়। গাঁয়ের ভেতর পেল্লায় বাড়ি, বারোমাস তালা বন্ধ থাকে। বিপ্রতীপ থাকে ওদের সাবেক আস্তানায়। একচিলতে বারান্দা সহ এক কামরার ঘর নিয়ে এক সময়ে বেশ ভালোই ছিল। স্ত্রী বিপাশা আর পুত্র স্বপ্নদীপকে নিয়ে সংসার দিব্বি এঁটে যেত তখন। রান্নাঘর, কলতলা আর শৌচাগার আলাদা, একটু দূরে। এখন সামনের উঠোন অনেক ছোট হয়ে গেছে। অর্ধেক জুড়ে স্বপ্নদীপের সাধের দোতলাবাড়ি। বানানোর সময় বিপ্রতীপ খুশি হয়েছিল, ছেলে হয়তো দুর্লভপুরে আসবে! তা কোথায় কী? আজ পাঁচ বছর সে বাড়ি তালা বন্ধ। সেই গৃহপ্রবেশ ইস্তক তাদের আর দেখা নেই। আর বিপাশাও হঠাৎ শাঁখা সিঁদূর নিয়ে জীবনের মাঠ থেকে চম্পট দিল। মায়ের জন্য স্বপ্নদীপের যাওবা আসার ইচ্ছে হত, বিপাশার অনুপস্থিতিতে তাও বন্ধ।

ফোন হাতে নিয়ে ছেলেকেই কল করে বিপ্রতীপ। স্বপ্নদীপের রাজ্য অন্য গোলার্ধে। সেখানে এখন দিন শেষ হয়ে সন্ধ্যা নেমেছে। আপিসের কাজ শেষ হয়নি। এমন অসময়ে বাবার ফোন আশা করে না। কোনও দুর্বিপাক? খুব উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করে,

— কী ব্যাপার? কী হয়েছে?

— দ্যাখ না, কে একজন ফোন করে বলছে, সে নাকি আসল বিপ্রতীপ!

— কী?!

— তাই তো বলছি।

স্বপ্নদীপ নিজের কাজের জগতে ডুবে ছিল, সেখান থেকে ভেসে উঠতে একটু সময় নেয়। বয়স হলে হ্যালুসিনেশন-সহ নানা সমস্যা দেখা দেয়। বিপ্রতীপের কি তেমন কিছু?

— তুমি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টগুলো দেখেছ?

— কেন বল তো? তাহলে তো ব্যাঙ্কে যেতে হবে। এখনও কি খুলেছে?

— আচ্ছা, ব্যাঙ্কে যেতে হবে না। চিন্তা কোরও না। আমি এখান থেকে দেখে নিচ্ছি। আমি হাতের কাজ শেষ করে তোমায় আবার ফোন করছি।

ফোন রেখে বিপ্রতীপ একটু নিশ্চিন্ত হয়। সত্যি টাকা পয়সার কথাটা মনে আসনি। ছেলের ওপর ভরসা বেড়ে যায়। কত বড় চাকরি করে! তবেই না এমন সবদিকে লক্ষ্য রাখতে পারে? পেশাগত ভাবে বিপ্রতীপ দুর্লভপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। অবসরের আর খুব বেশিদিন নেই। সেই হিসেবে বিপ্রতীপের বিচার বিবেচনা, পড়ালেখার গণ্ডীর ভেতর সীমাবদ্ধ। তার সঙ্গে বড়জোর নীতিকথার পাঠ। এইসব বৈষয়িক বিষয়ে তার মাথা তেমন খোলে না।

আজ ফোনাফুনি করতে করতে বেলা হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে স্কুলে পৌঁছয়। দিন দু’য়েক পর লোকসভা নির্বাচন। বিপ্রতীপের নির্বাচন কেন্দ্রের ডিউটি পড়েছে। তার আগে বেশ কিছু কাজ আছে। যদিও বয়স আর অসুস্থতার অজুহাতে এড়ানোর চেষ্টা করতে পারত, তবু বিপ্রতীপের ভালো লাগে। যেন সরাসরি দেশসেবায় কিছু করা। আগেরবারও স্বপ্নদীপ বারবার বারণ করেছে। তাও বিপ্রতীপ পিছিয়ে যায়নি। এবারে এই নির্বাচন ডিউটির কথা স্বপ্নদীপকে এখনও বলেনি। আর ছেলেও নিজের ব্যস্ততায় জিজ্ঞেস করেনি। খুব বেশি দূরে নয়, দুর্লভপুরের উত্তর দিকে একটা বুথে ডিউটি পড়েছে। এর মধ্যে সেই ফোনটা আর আসেনি। আর সত্যি বলতে, নির্বাচন সংক্রান্ত তৎপরতায় বিপ্রতীপের মনেও পড়েনি।

দুর্লভপুর সেই ঝুলে থাকা ঘুড়িটার মতো। নিশ্চই চায় সত্যিকারের শহর হতে। এলাকার বেশিরভাগ জোয়ান পুরুষমানুষ মধ্যপ্রাচ্যে। কেউ রাজমিস্ত্রি, কেউ হোটেলে বাসন মাজে, কেউ শৌচালয় পরিষ্কারের কাজ করে। ওদের পাঠানো অর্থে দুর্লভপুরে তৈরি হয় পাকা বাড়ি। তৈরি হয় বিউটি পার্লার, ঘরে ঘরে কেবল টিভি পৌঁছে দেয় আধুনিকতম স্বপ্নের হাতছানি। পড়ে থাকা পরবর্তী প্রজন্ম লগা নিয়ে ছুটতে থাকে। দুর্লভপুর চায় সবচেয়ে বড় লগার সঙ্গে সন্ধি করতে। কিন্তু এক প্রজন্মের ধনী, লক্ষ্মী ধরে রাখার কৌশল জানে না। তাদের দৌড় থমকে থাকে অশিক্ষার ইতিবৃত্তে। মিড ডে মিলের ঘ্রাণেই স্কুল যাওয়া, তার বেশি কিছু নয়।

অবশেষে নির্বাচনের আগের দিন তল্পিতল্পা নিয়ে যখন বুথে পৌঁছয়, তখন সন্ধে নেমেছে। খাতায় কলমে স্পর্শকাতর বুথ না হলেও, কাছাকাছি উত্তেজনার রাজনৈতিক রসদ রয়েছে। এটাও একটা স্কুলবাড়ি, তবে প্রাথমিক স্কুল। তাই মনে হয় নূন্যতম প্রাথমিক ব্যবস্থাও নেই। অত্যন্ত নোংরা হয়ে থাকা টয়লেট। মেঝে ফাটা, দরজা জানালা ঠিক করে বন্ধ হয় না, টেবিল চেয়ার বেঞ্চের অবস্থাও সঙ্গীন। বিপ্রতীপ এসব নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত নয়। এক রাত্তিরের মামলা, চোখকান বুজে পার করে দেবে। স্থানীয় থানা থেকে একজন বয়স্ক প্রহরী আছেন, নাম সনৎ। তিনি বললেন তাঁর একজন জুড়িদার ভোরবেলা চলে আসবেন। প্রহরী ভদ্রলোকের সঙ্গে চারিদিক দেখবার জন্য বড় টর্চটা নিয়ে বের হয়। সামনে কিছুটা উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ। ডানদিক থেকে একটা রাস্তা এসে স্কুলবাড়িকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেছে। পিছনদিকে কচু গাছের ঝোপ পেরিয়ে একটা জীর্ণ পাঁচিল। একপাশে একটা বড় গাছ। বোধহয় কদম। অন্ধকারে বোঝা না গেলেও বিপ্রতীপ আকার দেখে আন্দাজ করে। এই গাছ, ওই কচুবন, ভাঙা পাঁচিল সবকিছুই নির্বাচন প্রক্রিয়ার গোপনীয়তা ভঙ্গ করতে পারে। তবে ভোটের আগের রাতে বিপ্রতীপ ঝুড়ি কোদাল নিয়ে জঙ্গল সাফ করতে বসবে না। মনে মনে স্থির করে, ঘরে গিয়ে ভোটদান কক্ষটি ঠিক মতো সাজাবে।

এই সময় একটা বড় সাদা রঙের গাড়ি এসে থামল। সেখান থেকে ওইরকম সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা আর সাদা স্পোর্টস শু পরে এক নধরকান্তি মানুষ নামলেন। সঙ্গে আরও দু’জন রোগাভোগা চ্যালা গোছের প্রাণি। বিপ্রতীপের কাছে এসে খুব মোলায়েম গলায় বললেন, “নমস্কার স্যার। আমার নাম প্রমথ। আমি এলাকার বাসিন্দা আর সমাজকর্মী।” পাশ থেকে একটি সিড়িঙ্গেপানা লোক বলে, “দাদা এখানকার দেবতা। সবাই খুব মানে।” বিপ্রতীপের লোকসভা বিধানসভা পুরসভা মিলিয়ে প্রায় গোটা দশেক নির্বাচন করা হয়ে গেল। এই সব নমুনা চিনতে তার বাকি নেই। প্রতি নমস্কার জানিয়ে বলে, “আলাপ করে ভালো লাগল প্রমথবাবু।”

— আমার এলাকায় এসেছেন, আপনার কোনও অসুবিধা হবে না। শুধু হুকুম করবেন, আমরা পালন করব।
প্রমথর মুখ ভর্তি পান মশলা। গালে থুতু জমে আছে বলে মুখটা একটু উঁচু করে কথা বলছে। তাও কথার ফাঁকে ঠোঁটের কষ গড়িয়ে লাল রঙ বেয়ে নামছে।

— আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না। আমরা আর কী হুকুম করব? সরকারের হুকুম তামিল করতেই আমাদের এখানে আসা।

— রাতে আমাদের ক্লাবে আজ বিরিয়ানি হয়েছে। আমার ছেলেরা একটু পরে পৌঁছে দিয়ে যাবে।

— না না। আমার দরকার নেই। আমি খাবার নিয়ে এসেছি।

— সেকি? আমাদের অতিথি সৎকারের সুযোগ দেবেন না?

— আসলে, আমি বাইরের খাবার খেতে পারি না। কী করব বলুন? শরীর দেয় না।

লোকটা একটু থেমে বলল, “বেশ। খাবার না খেতে চান, খাবেন না। জলটা দিয়ে যাই। এখানকার জল আবার সুবিধার নয়। আর্সেনিক প্ল্যান্ট বসিয়েছি। তাও আপনারা বিশেষ মানুষ, আপনাদের জন্য কি রিস্ক নেওয়া যায়?” পিচ করে পিক ফেলে প্রমথ। ঘাড় ঘুরিয়ে সঙ্গীদের ইশারা করে। গা ঘিনঘিন করে বিপ্রতীপের। দু’টো লোক গাড়ির পিছন থেকে দু’টো বড় কুড়ি লিটারের জলের জার নামায়। বিপ্রতীপ স্কুলের বারান্দার দিকে আঙুল তুলে বলে, “ওই দেখুন আমাদের জলও এনে রাখা আছে। এত জল তো আমাদের লাগবে না।” এ বারে প্রমথর চোখে বিরক্তির ছাপ। “আচ্ছা, ছেলেরা বয়ে বয়ে নিয়ে এসেছে, এখানে রাখা থাক। আপনার লাগলে, নেবেন। কাল তো কত লোক সমাগম হবে, জলের দরকার নিশ্চই হবে।”

বিপ্রতীপ আর না করে না। এই কথাবার্তার মধ্যে দীপক, ত্রিদিব, মানসরা আসে। এরা সকলেই ভারপ্রাপ্ত পোলিং অফিসার। অল্প বয়স, সম্ভবতঃ প্রথম বা দ্বিতীয়বার ভোট করতে এসেছে। কেউ ব্যাঙ্ক, কেউ ইনকাম ট্যাক্স, কেউ পি-ডাব্লু-ডি তে কাজ করে। তারাও ডিউটি বুঝতে বিপ্রতীপের সামনে এসে দাঁড়ায়। প্রমথর দিকে ফিরে বিপ্রতীপ বলে, “আচ্ছা, নমস্কার। আমাদের বেশ কিছু কাজ গুছিয়ে নিতে হবে। কাল তো সাতটা থেকে শুরু করতে হবে। না হলে পেরে উঠব না।” প্রমথ ইঙ্গিত বুঝতে পারে। সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে গাড়িতে ওঠে। অন্ধকার চিরে সাদা এসইউভি বেরিয়ে যায়।

এই ঝাঁ চকচকে গাড়ি আর তার সওয়ার, ঘুড়ি আর নিচে ছুটতে থাকা প্রার্থীদের মতো। ঘুড়ির ইচ্ছা ষোলোআনা, তার বড় বাড়িতে ঠাঁই হবে। ইতিবৃত্ত নামতে দেয় না। এই নিয়ে তুলকালাম ঝগড়া হয়। আবার সেই ঝগড়া ঢলে পড়ে। নেশার গেলাসে বন্ধুত্ব হয়ে যায়। যেমন বিপ্রতীপের এককালের গোয়াল ঘর কোনওদিন পার্লার হবে। দুর্লভপুরের পোলিং বুথে এমনিই ভোট হয়ে এসেছে। কখনও কখনও কেউ কেউ রুখে দাঁড়ায়। ওপরমহলের নির্দেশ চোখ বুঁজে মেনে নিতে পারে না।

দীপকদের নিয়ে বিপ্রতীপ ঘরটা সরেজমিনে দেখে। মোটামুটি ভাবে ভোট দেওয়ার মতো করে সাজানোই আছে। ইভিএম, ভিভিপ্যাট বসানোর জায়গা, প্রিসাইডিং আফিসার, পোলিং অফিসারদের বসার জায়গা, পার্টির এজেন্টদের বসার জায়গা, সব ঠিক করে বেঞ্চি চেয়ার ঠিক করা। বিপ্রতীপ লক্ষ্য করে, ফাটা মেঝের ওপর পেরেক দিয়ে ইভিএম-এর টেবিল গাঁথা আছে। পিছনদিকে জানালা পুরোটা বন্ধ হয় না। দড়ি দিয়ে গ্রিলের সঙ্গে আটকানো। এর পিছনেই কচুগাছের ঝোপ। সেখানে অনায়াসে কেউ লুকিয়ে থাকতে পারে। বিপ্রতীপ সনৎকে ডাকে।

— একটা কিছু দিয়ে এই টেবিলের পেরেকগুলো খুলে ফেলুন।

— কেন স্যার?

— তেমন কিছু নয়, পজিশনগুলো পাল্টাব।

— সব তো ঠিক করাই আছে, আবার পরিশ্রম করার কি দরকার আছে?

বিপ্রতীপ বিরক্ত হয়।

— আপনাদের আর একজন কখন আসবেন?
বলে নিজেই টেবিল সরাতে হাত লাগায়। বালি ওঠা মেঝে, একটু চাপ দিতেই সবটা উঠে আসে। দীপক, ত্রিদিব, মানস আর বিপ্রতীপ মিলে, টেবিল ঘোরায়, যাতে জানালাটা আড়াল হয়। সনৎ বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকে। বিপ্রতীপ খুব নিরীহ গলায় বলে,
— আপনাদের লগবুকটা নিয়ে আসুন। আমি একটা কমপ্লেন লিখব।
সনতের যেন সম্বিত ফেরে। তাড়াতাড়ি এসে হাত লাগায়। ঠিক সেই সময় কয়েকটি মোটরবাইক এসে স্কুল ঘরের সামনে দাঁড়ায়। সেখানে বসে পাঁচ ছ’জন মেয়ে। এই আধাগ্রাম্য পরিবেশে এমন পোশাক পরা বাইক-আরূঢ় প্রমীলা বাহিনী বিপ্রতীপ আশা করেনি। প্রত্যেকেই পঁচিশের আশেপাশে বয়স। পরনে জিনস আর টপ। সবচেয়ে সপ্রতিভ মেয়েটির বুকের কয়েকটি বোতাম খোলা। উদ্ধত যৌবনের ঝাঁঝ পাওয়া যায়। চোখে মুখে প্রসাধন রয়েছে। এই গ্রামীণ পরিবেশে পার্লার আর কেবল টিভির শহুরে সংস্কৃতির জয়ধ্বজা। মেয়েটি এসে অনায়াসে বিপ্রতীপকে খুঁজে নেয়।

— স্যার, আপনার সঙ্গে একটু প্রাইভেট টক আছে। পাশের ঘরে আসবেন?

বিপ্রতীপ ব্যাঙ্কের এটিএম অথবা নেট পরিষেবা ব্যবহার করতে ভয় পায়। তবে এত বছরের শিক্ষকতায়, মানুষ চেনা আর নীতি নির্ধারণে পারদর্শী। মেয়েদের স্কুল ঘরের ভেতর ঢুকতে না দিয়ে নিজেই বাইরের মাঠে চলে আসে।

— ভেতরে সব অগোছালো হয়ে আছে। আপনি এখানেই বলুন।

— সেকি? অগোছালো কেন? আমরা তো সকালে এসে সব ঠিক করে দিয়েছিলাম।

— তেমন কিছু না। আসলে আমরা বিছানা মশারি খাটাচ্ছি তো।

— তার জন্য চেয়ার টেবিলের পজিশন পাল্টানোর কী দরকার ছিল? আর রাতটা এই ইঁদুর-মশার মধ্যে না কাটিয়ে, যদি চান তো আমাদের বাড়িতেই ব্যবস্থা করে দিতে পারি।

— অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু আমাদের উপায় নেই। তাছাড়া চিন্তা করবেন না। আমাদের কাছে মশা মারার ধূপ আছে।

— বুঝতেই পারছেন, আপনার কোনও অসুবিধা হোক আমরা চাই না।

— কোনও অসুবিধা তো হচ্ছে না।

— এখন হয়তো হচ্ছে না। কাল তো হতেই পারে?

গলায় প্রচ্ছন্ন হুমকি। বিপ্রতীপের বুঝতে অসুবিধে হয় না। গলা যতটা সম্ভব সহজ করে বলে,

— এটা তো একটা ভালো জায়গা। এখানে কি খারাপ কিছু হতে পারে?

— দেখুন একটা কথা খোলাখুলি বলা ভালো। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গোল খেতে তো কেউ চাইবে না, তাই না? আপনি যদি প্রমথর কথায় নাচেন, আমরা ছেড়ে কথা বলব না।

কথা বলতে বলতে বিপ্রতীপ স্কুল মাঠের মাঝখানে এসে গেছে। স্কুল বারান্দা থেকে কিছুটা আলো চুঁইয়ে এসে পড়ছে। কিন্তু ঘিরে থাকা মেয়েদের মাঝখানে যে কী হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে না। তখন স্কুলের ভেতর দীপকরা জিনিসপত্রগুলো গুছিয়ে রাখছে। সনতের ফোনে একটা কল আসে।

— সনৎবাবু, আমি আপনার প্রিসাইডিং অফিসার বিপ্রতীপ বোস বলছি।
সনৎ কতকটা গা-ছাড়া অবস্থায় দাঁড়িয়ে দীপকদের কাজকর্ম দেখছিল। ফোনটা পেয়ে একটু অবাক হল। মেয়েগুলো কি চলে গেছে? বিপ্রতীপ তো ওদের সঙ্গে রয়েছে বলে মনে হল। যদিও স্কুল বারান্দা থেকে মাঠের ওদিকটা তেমন ঠাওর হচ্ছে না। খানিক আমতা আমতা করে উত্তর করে, “হ্যাঁ স্যার বলুন।”

— শুনুন, আমার সঙ্গে ফোনে ডিএসপি আছেন। আমি ফোন কনফারেন্সে কানেক্ট করছি। আপনি একটু ধরে থাকুন।

এবারে সনৎ বেশ ঘাবড়ে যায়। ওদিক থেকে ভারী গলা শোনা যায়।

— আপনি সন্ধে থেকে কী করছেন?

–কেন স্যার, আমি তো, পোস্টেই আছি। কোথাও যাইনি।

— শুধু পোস্টে থাকলে হবে না। সাইলেন্ট জোনে পেট্রলিং করুন।আর পেট্রলিং করতে করতে অবজার্ভেশন নোট করুন। টাইম টু টাইম রিপোর্টিং অফিসারকে জানান।

— কিন্তু স্যার আমি তো এখন একা। পোস্ট ছেড়ে যাব কী করে?

— আপনাকে যা বলছি করুন। আর অ্যাডিশনাল ফোর্স এসে যাবে। ও নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না।

ফোন কেটে যায়। সনৎ নড়েচড়ে বসে। দীপক লক্ষ্য করছিল। জিজ্ঞাসা করে, “কার ফোন দাদা?”

— বুঝলাম না। তবে বলল ডিএসপি।

শুনে ত্রিদিব বলে, “ওরে বাবা! ডিএসপি অবধি পৌঁছে গেছে? ঝামেলা হবে নাকি?”

— ঝামেলা তো হতই না। বিপ্রতীপবাবু একটু মানিয়ে গুছিয়ে নিলেই তো সব ঠিক হয়ে যেত।

— কেন? উনি আবার কী করছেন?

— এই যে, জল, খাবার কিছু নিলেন না। আবার টেবিল চেয়ার বদল করছেন। এসব তো সবাই ভালো চোখে দেখে না।

কথাবার্তার মধ্যে ধীরে ধীরে বিপ্রতীপ এসে ঢোকে। চোখেমুখে খানিক উদ্বেগ আর ক্লান্তির ছাপ।দীপক চেয়ার এগিয়ে দেয়, “বসুন দাদা।” সনৎ নিজে থেকেই বলে,

— রূপশ্রী এখানকার উঠতি নেতা। কাউকে পরোয়া করে না। ওর একটা পার্লার আছে। নাম ‘মডার্ন পার্লার’। অবশ্য নামেই পার্লার। অনেক কিছু চলে।”

বিপ্রতীপ সনৎকে দেখে। মুখে কিছু বলে না। সনৎ বোধহয় প্রত্যুত্তর আশা করছিল। বিশেষ করে ডিএসপি প্রসঙ্গে কিছু। বিপ্রতীপ বসে দেখে সব সুন্দর করে সাজানো হয়ে গেছে। মুখে হাসি এনে বলে,

— তাহলে মক পোলিং সেরে ফেলি।

সবাই মিলে লেগে পড়ে। ইভিএম আর ভিভিপ্যাট মিলিয়ে ভোট যন্ত্রের পরীক্ষামূলক ব্যবহার শুরু হয়। বেশ কয়েকটা ভোট করার পর সে সব যাচাই করা হয়। তারপর মক পোলিংয়ের তথ্য মুছে ফেলে যন্ত্রগুলো সিল করে দেওয়া হয়। সনৎ এই সময় বাইরে একবার টহল দিয়ে আসে। বড়কর্তার হুকুম অনুযায়ী কাজ করে। বুথে থাকা অন্যান্য ভোটকর্মীদের মধ্যে বিপ্রতীপ সবচেয়ে অভিজ্ঞ। রাতের খাবার খাওয়ার আগে সতেরো-এ ফর্ম বার করে সকলের সঙ্গে মত বিনিময় করে নেয়। পরের দিন কে কেমন করে কাজ করবে, তার একটা বিবরণ দিয়ে দেয়। বিপ্রতীপের খেয়ে দেয়ে শুতে শুতে রাত বেড়ে গেল।

বিপ্রতীপের ঘুম আসে না। এত বছরের ভোটের অভিজ্ঞতায় কোথাও যেন সুর কেটে যায়। শাসক কিম্বা বিরোধীর এমন আগ্রাসন, আগে দেখেছে বলে মনে পড়ে না। প্রমথ ও তার সহকারীদের প্রচ্ছন্ন হুমকি বুঝতে অসুবিধা হয়নি। নানা উপঢৌকনের লোভ আগেও দেখানো হয়েছে। বিপ্রতীপ সে সব ফিরিয়ে দেবার মধ্যে একটা মানসিক জোর খুঁজে পায়। কিন্তু ফেরাতে গিয়ে আজ যেন অহংকারীর দর্পে আঘাত করে ফেলে। এইসব বিষাক্ত প্রাণি আহত হলে কী করতে পারে, ভাবলে ভয় হয়। যদিও বিপ্রতীপের জীবনের অধিকাংশ সময় অতিক্রান্ত, কর্তব্য দায়িত্বও সম্পূর্ণ। তার মতো একটি মানুষের পক্ষে মোটামুটি সফলতা ব্যর্থতা মিলিয়ে প্রায়পূর্ণ আয়ুস্কাল। তাই ‘দেশের কাজ’-এ ভয় পাওয়ার পিছুটান কম। কিন্তু দ্বিতীয় দলটির আগমন বিপ্রতীপকে বেশি ভাবায়। এমনভাবে নারীশক্তির ব্যবহার সত্যিই অভিনব।

নেতৃ মেয়েটির শরীরী আচরণ শিহরণ জাগায়। এই পরিণত বয়সে পৌঁছে কোনও অবাঞ্ছিত আরোপে কলুষিত হতে ভয় করে। মেয়েটি প্রথমে আলাদা করে কথা বলতে চেয়েছিল। সরল মনে একলা ঘরে যেতেই পারত। সেই মুহূর্তের তাৎক্ষণিক বিচারে বাইরে না গেলে কী যে হতে পারত, এখন ভেবে অস্থির লাগছে। কথা বলতে গিয়ে বুঝতে পেরেছিল শিকার ফস্কে যাওয়ায় আহত হয়েছে বাঘিনির অহং। রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়াতে অনেকেই আগ্নেয়াস্ত্র সঙ্গে রাখে। প্রমীলাদল সেটি দেখাতেও কসুর করেনি। অপ্রস্তুত বিপ্রতীপ খুব সন্তর্পনে প্রসঙ্গ হাতড়ায়। বুঝতে পারছিল না কী করা উচিত। অথচ এই অন্ধকার বৃত্তটির অদূরে স্কুলবাড়ির বারান্দায় আলো জ্বলছিল, প্রহরী সনৎকে অলসভাবে বসে থাকতে দেখা যাচ্ছিল। সঙ্গী ভোটকর্মীরা ভিতরে। তাদের কাছে অনেকটা পিকনিকের মতো আবহ। ঘটনার গুরুত্ব হয়তো বুঝতেই পারেনি কিম্বা প্রচ্ছন্ন আনুগত্য রয়েছে। মাইক্রো অবজার্ভার, রিটার্নিং অফিসার, পুলিশের ডিএসপি এমন অনেকের ফোন নম্বর রয়েছে। কিন্তু ঘিরে থাকা মেয়েদের মধ্যে থেকে কী ভাবে ফোন করবে? কোনও রকমে পরিত্রাণ পাবার জন্য যতটা সম্ভব হ্যাঁ-তে হ্যাঁ মেলায়। পরদিন সকালের জন্য তাদের নানাবিধ দাবি। কী ভাবে তারা আসবে এবং ভোট দেবে তার পরিকল্পনা বলে চলে। বলা বাহুল্য, বিপ্রতীপকে সে সময় চোখ বন্ধ করে থাকতে হবে। বিপ্রতীপ পুরস্কার গ্রহণ করেনি। তাই বলে তিরস্কার এড়াতে পারবে না। কারণ বাড়ি ফেরার পথ তো সকলের জানা। বিপ্রতীপ ফিরে এসে কাউকে তেমন কিছু বলেনি। নিজের মধ্যেই রেখে দিয়েছে জমানো অসম্মান।

মশারির চারপাশ দিয়ে বেশ কিছু মশা ভনভন করছে। রাত গভীর হতে জানালার ফাঁক ফোকর দিয়ে বাইরের নড়াচড়ার শব্দ যেন আরও স্পষ্ট। ত্রিদিব বা মানস কেউ একজন বেশ জোরে নাক ডাকছে। রাতচরা পাখিদের ডানার ঝাপট, প্রাণিদের দ্রুত দৌড়ে যাওয়া কিম্বা রংচটা ফাটা দেওয়ালে ঝুলন্ত টিকটিকির অবয়ব এই আঁধারেরও অনুভব করে। এপাশ ওপাশ করতে করতে, একটা গাড়ির আওয়াজ ও কোলাহলের শব্দ কানে আসে। তখনও সকাল ফোটেনি। রাত বোধহয় সাড়ে তিনটে হবে। মশারি ডিঙিয়ে বিপ্রতীপ বাইরে আসে। একটা জিপে প্যারামিলিটারি ফোর্সের দু’জন সশস্ত্র জোয়ান এসে বিপ্রতীপের সামনে লম্বা স্যালুট ঠুকে দাঁড়ায়। ওদের দেখে বিপ্রতীপের রাতের নিভে যাওয়া আত্মবিশ্বাস অনেকটা ফিরে আসে। সবার অলক্ষ্যে সনৎ একটু পিছু হটে দাঁড়ায়।        (চলবে)

এক সর্বগ্রাসী হাঁ-করা চোখ নিয়ে, কলকাতা ও সংলগ্ন শহরতলিতে জন্ম ও বেড়ে ওঠা সৌরভের। যা দেখেন, তাই মনে হয় ছুঁয়ে দেখলে ভালো হয়। কিছুটা প্রকৌশল, কিছুটা ছবি আঁকা, ভাষা শিক্ষা, থিয়েটার এমন আরও অনেক কিছু। এভাবেই ভেসে চলা। শৈশবে স্কুল পত্রিকায় হাত পাকিয়ে রেল স্টেশনে দেওয়াল পত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিনের পাতা থেকে প্রাতিষ্ঠানিক বাণিজ্যিক পত্রিকায় পৌঁছনো। জীবিকার তাগিদে কম্পিউটারের সাথে সখ্য। পাশাপাশি কয়েক মাইল ‘কোড’লেখা চলে সমান্তরাল। কর্পোরেটের হাত ধরে পৃথিবীর কয়েক প্রান্ত দেখে ফেলার অভিজ্ঞতা। সবই উঠে আসে লেখায়। আপাততঃ কলকাতা ও ঢাকা মিলিয়ে প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা সাত।

2 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *