ছিদাম বাচ্চা ছেলে। বছর তেরো কী চোদ্দ হবে। সীমা আর সায়নের কথাবার্তা অত বোঝে না। তবে এটুকু বুঝতে পারে যে সেদিন সকালে সে একটা ঢোঁড়া সাপের মুখ দেখে ঘর থেকে বেরিয়েছিল। ওদের মাটির ঘরের সংলগ্ন নালাটা জলে টইটুম্বুর থাকে সবসময়। সেখানেই হঠাৎ সাপটা জলের মধ্যে থেকে বেরিয়ে ছিদামকে এক ঝলক দেখা দিয়ে আবার জলের মধ্যেই মিলিয়ে গেছিল। ছিদাম নিমের দাঁতন ঘষছিল মুখের মধ্যে। সেই দেখে আর একটুও দেরি করেনি। চাড্ডি মুড়ি গুড় দিয়ে মেখে খেয়ে একটা মোটামুটি জামা প্যান্ট পরেই গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল মলুটীর মৌলীক্ষা মন্দিরের প্রধান ফটকের বাইরে, সকাল সকাল খদ্দের পাবার আশায়। গাড়ি থেকে সীমা আর সায়ন নামতেই সেদিনের প্রথম বউনি হয়েছিল ছিদামের।
‘তোর কোন ক্লাস রে?’ সায়ন বলে
‘ক্লাস এইট হল।’
‘ওরে বাবা! তুই তো ক্লাস অনুযায়ী বেশ সুন্দর গুছিয়ে বলতে পারিস দেখছি!’— সীমা বলে।
‘ভালো লাগে আমার।’ ছিদাম নিষ্পাপ মুখে বলে।
সে আগে আগে চলে। পেছন পেছন তার সেদিনের ক্লায়েন্ট সায়ন-সীমা।
সায়ন বলে, ‘দেখেছ শহুরে ক্লাস এইটের ছেলেদের মতো পেকে যায়নি ছেলেটা?’
সীমা বলে, ‘পেকে উঠেছে জ্ঞানে, বুদ্ধিতে। কথা শুনলেই বোঝা যায়।’
ওদের কথা ধরতে না পেরে ছিদাম বলে ওঠে, ‘কিছু বললেন বাবু?’
— ‘নাহ, বলছি এত সুন্দর জঙ্গুলে প্রকৃতি। কী গাছ রে সব?’
— ‘এগুলো সব শাল, সোনাঝুরি, সেগুন, আকাশমণি।’

এই জঙ্গলময়তা যেন আবিষ্ট করে রাখে সায়নদের। মাঝেমধ্যে প্রকৃতি রুখুশুখু হলেও এ যেন পড়শি রাজ্যে একটুকরো বাংলায় ইতিহাস আর কিংবদন্তির মিশেলে গড়ে ওঠা পুরনো এক মন্দিরময় গ্রাম। কালের দলিল বলছে ছোট্ট নানকার মলুটী গ্রামের দুটি ঐশ্বর্য হল গ্রামের দু’দিক দিয়ে বয়ে যাওয়া দুই নদী। চুমড়ে আর চন্দননালা। অবিভক্ত বিহারে আগে যা ছিল সাঁওতাল পরগনা, মলুটী গ্রাম হল তারই এক প্রাচীন জনপদ।
সীমা বলে উঠল, ‘এ যেন সেই আমাদের দাদু দিদিমাদের আমলের সেই পশ্চিমের হাওয়াবদল।’
সায়ন বলল, ‘একদম তাই। না এলে মিস করতাম খুব। আমাদেরও চেঞ্জ হচ্ছে দিব্যি।’
এই গ্রামের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে অদ্ভুত অনুভূতি হল সায়নের। গ্রামের বাড়িগুলোর কোনোটি মাটির দোতলা। কোনও বাড়ির পুরো চৌহদ্দি এখনও মাটির পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। বাড়ির মালিকেরাই যে একসময় এইসব মন্দিরের মালিক ছিল তা দেখলেই বোঝা যায়। কখনও চোখের সামনে এসে পড়ে নষ্ট হয়ে যাওয়া রাসমঞ্চ, কখনও আবার ভগ্নপ্রায় নাটমন্দির, দোলমঞ্চ। নামহীন, দেবতার বিগ্রহহীন অজস্র মন্দির। এঁকেবেঁকে গ্রামটার অলিগলি পেরুতেই আবারও একগুচ্ছ মন্দির চোখের সামনে। একেকটা মন্দিরের গঠনশৈলী এক এক রকম।
মলুটীর মন্দিরপাড়া ঘুরে ছবি তুলে তুলে ক্লান্ত হয়ে গেছে ওরা। ছিদাম বলল, ‘এবার চলুন আসল জায়গায়… ওই দেখুন!’ এই বলে বড় রাস্তার পাশেই প্রাচীন মৌলীক্ষা মন্দিরের গেট দেখায় সে।

অনেকদিন আগে সায়ন এখানে এসেছিল বটে। তবে তখন সে এইসব মন্দিরের ধারেকাছে আসেনি। কর্মসূত্রে এলে যা হয় আর কী! তাড়াহুড়োয় এসব হয়ে ওঠে না। আর সায়নের মন্দির টন্দিরের প্রতি তেমন টান ছিল না অল্পবয়সে। এখন নেহাত ছবি তোলা আর বেড়ানোর তাগিদ। আদার ওয়াইজ ধর্ম কর্মে তার মন বসেনি আজও।
সেবার ওর এক কলিগ বলেছিল, ‘যাচ্ছ যখন একবার মলুটীর মায়ের মন্দিরে ঢুঁ মেরে এস। এত জাগ্রত মন্দির! নিজের কেরিয়ার নিয়ে এত চাপ নাও, তাই বলছি।’ তবুও সেখানে যাওয়া হয়নি সায়নের।
তবে তখনই জেনেছিল সায়ন, তন্ত্র সাধক বামাখ্যাপা নাকি তাঁর জীবনের বেশ কিছু বছর কাটিয়েছিলেন মলুটীতে।
ছিদামকে জিজ্ঞেস করে সে— ‘হ্যাঁ রে, এখানে বামাখ্যাপা এসেছিলেন?’
ছিদাম বলে, ‘হ্যাঁ। প্রথম জীবনে তিনি এখানকার জমিদারদের মন্দিরের পূজারী হয়ে আসেন। পুজোর ফুল তোলা আর ভোগঘরের কাজও করতেন। মা মৌলীক্ষার সাধনা করে তাঁকে জাগিয়েছিলেন। তারপর তো তাঁর তারাপীঠে গিয়ে সাধন ভজন করা। এখানে ঢুকতেই পড়ে বামদেবের মন্দির। এই কারণে গ্রামের লোকের বিশ্বাস যে মা মৌলীক্ষা তারা মায়ের বড় বোন।’
সীমা বলে, ‘বাবা! তুই তো অনেক কিছু জানিস দেখছি! তুই গাইড হলে খুব লাভ হবে কিন্তু। এটাকেই কেরিয়ার করে ফেল।’
‘হ্যাঁ, তুই তো সত্যিই এই বয়েসে অনেক কিছু জেনে ফেলেছিস!’ সায়ন স্বীকার না করে পারে না।
— ‘না জেনে উপায় আছে? আমাদের গ্রামের নেপালদাদু সন্ধে হলেই গ্রামের ছেলেপুলেদের নিয়ে নিয়ম করে বসবেন। আর মলুটী, মল্লেশ্বর, গণপুরের গল্প শুনিয়েই ছাড়বেন। আমাদের দাদু খুব ভালো।’
‘নেপাল দাদু আবার কে?’ অবাক হয় সায়ন।
‘নেপালচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। মলুটীর গর্ব। অনেক বই আছে উনার। খুব জ্ঞানীগুণী মানুষ। উনার কাছেই তো সব শিখছি এখনও।’ ছিদাম বলে।
‘তুই এত ভালো কেন রে ছিদাম?’ খানিকটা উচ্ছ্বাসেই ছেলেটার পিঠ চাপড়ে দেয় সায়ন।

ছিদাম বলে, ‘জানেন বাবু, দক্ষিণ দিকের চিলা নদীর দুই পাশে ঝাড়খণ্ড আর পশ্চিমবঙ্গ। শিরালী বলে একটা জায়গা আছে। ওখানে ন্যাচারাল পাথরের একটা বাঁধ তৈরি হয়েছে। ফলে, সেখানে নদীগর্ভেই একটা ছোট জলাশয় হয়েছে আপনাআপনি। সেই জলাশয়ে সারা বছরই জল থাকে। এখানে গ্রামের লোকেরা পৌষ মাসে ছোট ছোট দলে এসে পৌষালী করে বা পিকনিক।’
‘ও মা! কী মজার নাম শিরালী!’ —সীমা বলে।
ছিদাম বলে, ‘শিলি হল সাঁওতালি শব্দ। বাংলায় যার মানে দিশি বালি হাঁস। আমাদের মলুটী গ্রামের পাশে চিলা নদীর সদরঘাট থেকে চিলার উজানে শিরালী পর্যন্ত দেড় কিলোমিটারের মধ্যে তিনটে জায়গায় নদীর মধ্যে থেকে আর আশপাশ থেকেও বেশকিছু পাথরের অস্ত্র ও যন্ত্রপাতি পাওয়া গিয়েছে।’
‘সে কী রে? প্রত্নরাজি?’ সায়ন চমকে ওঠে।
‘হ্যাঁ। আমাদের গ্রামের নেপাল দাদু সব দেখিয়েছেন আমাকে। পাথরের সব কতরকমের সে যুগের যন্ত্রপাতি, ধার দেবার, ঘষার, ফুটো করার সব জিনিস। সব মানুষের কাজের জিনিস। তির-ধনুক বা বর্শার মতো অস্ত্রশস্ত্র নয়।’—ছিদাম বলে।
সায়ন বলল, ‘তার মানে প্রস্তর যুগ বা তার পরের হবে।’
সীমা বলল, ‘হ্যাঁ, প্যালিওলিথিক আর মেসোলিথিক যুগের, ভাইয়ের মুখে শুনে শুনে আমিও শিখেছি অনেকটাই।’
সায়ন বলল, ‘ভালোই তো হল, তোমার ভাইয়ের কাজে আসতে পারে। সে তো আর্কিওলজি নিয়ে পড়ছে। জিজ্ঞেস করে দেখ একবার তাকে।’
‘কোনও ছবি দেখাতে পারিস এসবের?’—সীমা বলে
ছিদাম বলল, ‘ইন্টারনেটে খুঁজলে হয়ত পেয়ে যাবে। নেপাল দাদুর ওপর অনেক কাজ হয়েছে। ইউটিউবেও আছে ভিডিও, মলুটীর ওপরে।’
সায়ন অবাক হয়, ‘তুই তাও জানিস? তা তোকেই তো একমাত্র গাইড দেখলাম এখানে। গ্রামের আর কেউ ট্যুরিস্টদের নিয়ে আসে না? এত গরিব গ্রাম, এখানে চাকরি বাকরিও তো তেমন নেই!’
আরও পড়ুন- গল্প: ছুটির ফাঁদে
ছিদাম হাসে, —’এখন সবাই ইস্মার্ট ফোন নিয়ে বসে থাকে। ঘরে থাকলে কেবিল দেখে, বাইরে ফোন। এসব মন্দির-টন্দির নিয়ে কারোর কোনও ইন্টারেস্ট নেই। দাদু সেই দেখেই তো বলে মাঝেমধ্যে, এর নাম ঘোর কলি। এখনকার ছেলেপুলেরা এসব জানতেও চায় না। আসলে আমার এসব খুব ভালো লাগে।’
সীমা বলে, ‘তুই তার মানে নিশ্চয়ই ইতিহাস নিয়ে পড়বি!’
ছিদাম বলে, ‘একদম না। আমার ইচ্ছে বিজ্ঞান নিয়ে পড়ার। অনেক কষ্ট করছে মা। একটা ভালো চাকরি আমায় পেতেই হবে যেমন করেই হোক। দাদুর থেকে শুনতে, জানতে ভালো লাগে। লিখে রাখি একটু আধটু। এসব বলে দু’চার টাকা ইনকামও হয় আমার।’
সায়ন আর সীমা মুখ চাওয়াচাওয়ি করে।

‘এত দারিদ্র্যের মধ্যে স্মার্ট ফোন সবার হাতে?’ অবাক হয় সায়ন।
ছিদাম বলে, ‘কেন হবে না? দালালির পয়সা তো। ওই যে দেখুন না কেমন লাইন পড়েছে ওখানটায়? অমুক বাবা, তমুক শাস্ত্রীর মতো কত কত তান্ত্রিক, জ্যোতিষ লাল সিল্কের থান পরে, মস্ত সিঁদুরের টিপ পরে রোজ পালা করে বসে এখানে, কাপালিক সেজে। তাদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। গাঁয়ের ছেলেগুলোই তো এজেন্ট। গুচ্ছের ক্লায়েন্ট ধরে আনে আর কমিশন পায়। টিভি চ্যানেলে সেই বাবা আবার লাইভ প্রোগ্রাম করেন। তখন এই ছেলেগুলোই ফোন ঘোরায়।’
সীমা বলে, ‘তুই তো অনেক কিছু জেনেশুনেও নিজেকে বেশ আপডেট রেখেছিস দেখছি। এসব কাটমানি, কমিশনে আবার জড়িয়ে পড়িসনি যেন। মন দিয়ে লেখাপড়াটা চালিয়ে যাস কিন্তু।’
‘মাথাখারাপ হয়েছে আমার?’ ছিদাম বলে— ‘জানেন, আমার খুব ইচ্ছে করে ইঞ্জিনিয়র হতে। আমাদের গ্রামের সবুজ দাদা জয়েন্ট পাস দিয়ে বড় কলেজে পড়েছে। চাকরি করে এত্ত টাকা হয়েছে যে গাড়িবাড়ি করেও বাবা-মা সবার হাতে ইস্মার্ট ফোন কিনে দিয়েছে। আমারও খুব ইচ্ছে করে জানেন সবুজদাদার মতো হতে! সবুজ বরণ রায়ের নাম ছবি দিয়ে খবরের কাগজে বেরিয়েছিল। আপনারা তো ইশকুল মাস্টার, নিশ্চয়ই শুনে থাকবেন। রামপুরহাটের ইশকুলের মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকের টপার।’
সায়ন বলে, ‘বাহ! খুব ভালো কথা।’
সীমা বলে, ‘দেখেছ! গ্রামের ছেলেরা পড়াশুনো করলে খুব ভালো করে প্রতিবারেই।’
সায়ন বলে, ‘আসলে এখানে তো শহরের মতো অত ডাইভারশন নেই। এনিওয়ে, তুই কিন্তু আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখিস ছিদাম।’
‘সে আর বলতে?’ আবারও কথার ঝোঁক পেয়ে বসে ছিদামকে…
— ‘এইসময়েই মলুটীতে একটু ভিড় হয় বেশি। শীতকালেই তো লোকজন ঘুরতে আসে। এছাড়া মৌলীক্ষা দেবীর পুজোয় আর কালীপুজোয় এখানে আপনি ঢুকতেই পারবেন না। এ গ্রামে পুজো, মেলা আর মোচ্ছব লেগেই থাকে।’
‘কেন রে?’ জানতে চায় সীমা।
‘আসলে প্রচুর লোকজন আসে তো। মায়ের পুজোয় মেলা হয়। ভোগ রান্না হয়। কত লোক পুজো দিয়ে মাটিতে বসে খায়। আজকে আরও একটু আগে এলে ভোগ খেতে পেতেন আপনারা। সবাই যে যেমন পারে চাল, ডাল, আলু নিয়ে এসে দেয়। বড় করে খিচুড়ি রান্না হয়। সঙ্গে একটা পাঁচ তরকারি। তাই পড়তে পায় না। বিকেল চারটে অবধি খেয়েই চলে লোক। খুব ভালো রান্নার হাত ঠাকুরটার। খাবেন তো বলুন।’
সায়ন বলে, ‘না থাক। পরে হবে।’
—’বেশ চলুন তবে মন্দির দর্শনে।’
পায়ে পায়ে ওদের মন্দির দর্শন করাতে নিয়ে যায় ছিদাম।
অলংকরণ: শুভ্রনীল ঘোষ
*পরের পর্ব প্রকাশ পাবে ২৯ মার্চ, ২০২৩
রসায়নের ছাত্রী ইন্দিরা আদ্যোপান্ত হোমমেকার। তবে গত এক দশকেরও বেশি সময় যাবৎ সাহিত্যচর্চা করছেন নিয়মিত। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায় এহং প্রথম উপন্যাস সানন্দায় প্রকাশিত হয়। বেশ কিছু বইও প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যেই। সব নামীদামি পত্রিকা এবং ই-ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখেন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, রম্যরচনা ও প্রবন্ধ।
জানতে চাইছি মলুটির এই ইতিহাস কিভাবে বা কোথায় সার্চ করে পেলেন? মল্ল রাজদের সাথে আমাদের বংশের এক প্রাচীন যোগসূত্র ছিল বলে শুনেছি কিন্তু সেইসব কোনো বইয়ে কি ভাবে পাবো জানা নেই । গল্পকার যদি একটু সাহায্য করেন তো ভালো হয়ে।