আগের পর্বের লিংক: [] [ ২] [] [] [] [] [] [] [ ৯] [১০] [১১] [১২] [১৩][১৪][১৫] [১৬] [১৭] [১৮] [১৯] [২০] [২১] [২২]  [২৩]

হ্যাঁ ইতিমধ্যে আমি জুড়ানকে বেশ কয়েকবার কিছু কিছু করে দিয়েছি, কেন দিয়েছি, না শ্যামাশ্রী ভাল থাকবে। জুড়ান বলল, “দাও অনুতোষ, আয় কি শুধু নিজের জন্য করে মানুষ, ভাইয়ের মেয়েকে তাহলে মানুষ করলাম কেন?”    

সত্যিই তো তাই। সারাজীবন আমি নিজের জন্য ভেবেছি। কয়েকবার বন্যাত্রাণে চাঁদা দেওয়া ব্যতীত আমার প্রতিদান কি পৃথিবীর মানুষের উদ্দেশে। পৃথিবী আমাকে সুখ দিয়েছে, শ্যামাশ্রীর স্মৃতি দিয়েছে, আমিও তো কিছু দেব। চঞ্চলচন্দ্রর কথা মনে পড়ল আমার। হুঁ, আমি দিচ্ছি  শ্যামাশ্রীর মঙ্গল কামনায়।  জুড়ান ভাবছে তাকে দিচ্ছি, আসলে দিচ্ছি শ্যামাশ্রীর জন্য। কিন্তু এই কথাটি কেউ জানে না। যদি বলার হয় বলব চঞ্চলচন্দ্রকে। ইতিমধ্যে সুমিতাভ মৈত্র চঞ্চলচন্দ্রকে নিয়ে গল্প লিখেছেন। আমারটা আমি লিখব। লিখে চঞ্চলচন্দ্রর কাছে তাঁর রানি রোডের নতুন ফ্ল্যাটে দিয়ে আসব।  

চঞ্চলচন্দ্রকে নিয়ে যে গল্প লিখেছেন লেখক সুমিতাভ, তা শোনার আগে চঞ্চলের নিজের কথা শোনা যাক। তিনি ফরেন সার্ভিস করতেন, অনেক দেশ ঘুরেছেন, আফগানিস্তান ছিলেন এক সময়, কত মানুষের মৃত্যু দেখেছেন, নিজেও মরতে মরতে বেঁচে গেছেন কতবার, সবই যেন ঈশ্বরের অভিপ্রায় ছিল। ঈশ্বর তাঁকে আয়ুষ্মান করেছেন। তিনি অনেক টাকা পেয়েছেন অবসরের পর, বিয়ে করেননি, টাকা নিয়ে করবেন কী, তাই ঋণ শোধ করছেন মঞ্জরীর কথায়। এই বয়সে এসে তিনি মঞ্জরীকে খুঁজে পেয়েছেন। সেও তো কোনও এক ঈশ্বরের অভিপ্রায়ে।   

কে মঞ্জরী? আমি চমকে উঠলাম কেন জানি না। মঞ্জরী যে কেউ হতে পারে। আমি ওই নামে কাউকে চিনি না। শ্যামাশ্রী  মনে হল আমার। শ্যামাশ্রী কি মঞ্জরী হয়ে গেছে চঞ্চলের কাছে গিয়ে? তার তো অনেক নাম।     

চঞ্চলচন্দ্র অথবা লেখক সুমিতাভ বলেছিলেন, মঞ্জরী চৌধুরী, মঞ্জরী ছিল কুড়ি তখন, চঞ্চল ছাব্বিশ, এক  ছোট শহরের চেনা, এক পরিচয়, এক বছরের বেশি টেকেনি তা। চঞ্চলচন্দ্র বলেছিলেন, মঞ্জরী তাঁকে ভয়ানক ভাবে  প্রত্যাখ্যান করেন, এখন তাঁর মনে হয় তাঁদের ভিতরে কোনও সম্পর্কই তৈরি হয়নি, এক তরফা ছিল সব, সে ছিল এক চৈত্র দুপুর, তাঁদের শেষ দেখা হয়েছিল এক মফস্বলী রেল স্টেশনে।

মঞ্জরীরা শহরে নতুন এসেছিল। মঞ্জরীর বাবা সরকারি চাকরি করতেন। সেটেলমেন্ট  ডিপার্টমেন্টের  কানুনগো থেকে  প্রমোশনে  সার্কেল  অফিসার। তাঁর  অধীনেই চাকরি করত শুভানন। শুভানন কিংবা শুভময় বা শুভঙ্কর। চঞ্চলের মনে আছে শুভ নামটি। কলকাতার বাঘাযতীন কলোনি থেকে সে  চাকরিসূত্রে সেই শহরে এসেছিল। বাবা যে ফ্যাকটরিতে চাকরি করতেন, তা ধুঁকতে ধুঁকতে  চলছিল। কয়েক বছর বাদে তা বন্ধও হয়ে গেল। তার বাবাকে রাজস্থান বদলি করেছিল। যাওয়া সম্ভব ছিল না। এসব জানতেন না চঞ্চল। পরে  জেনেছেন। শুভাননের সঙ্গে মঞ্জরীর সম্পর্ক  হয়েছিল। শুভানন কবিতা লিখত। মঞ্জরী সেই কবিতা পড়ত। চঞ্চলচন্দ্র  এই সময়ে  মঞ্জরীর সন্ধান পান তাঁর  পুরোন  কলেজে  গিয়ে। কী কাজে গিয়েছিলেন মনে নেই, কিন্তু গিয়েছিলেন। মঞ্জরীর প্রেমে পড়েন  তিনি। মৃদু স্বরে কথা বলত মঞ্জরী। দর্শনে অনার্স পড়ত। তারপর কী হয়েছিল। চঞ্চলচন্দ্র যে ফরেন সার্ভিস পেয়েছেন, তা  ছোট শহরে রটে গিয়েছিল। শালবনের ভিতরে সেই শহর, অপূর্ব।  চঞ্চলচন্দ্ররা ছিল শহরের অভিজাত পরিবার। প্রাচীন পরিবার। শিক্ষিত বলে সুনাম ছিল তাঁদের। চঞ্চলের ভিতরে ভয়ানক ক্রোধ জেগেছিল প্রত্যাখ্যানে। সেই ক্রোধের আগুনের সঙ্গে  নরকের আগুনের তুলনা হতে পারে। তিনি মঞ্জরীকে চিঠি  দিয়েছিলেন। মঞ্জরী জবাব দেয়নি। তিনি তখন মুসৌরিতে ট্রেনিঙে  যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। তাঁর  মনে হয়েছিল  ওকে চাই, তিনিই  শ্রেষ্ঠ, ফরেন সার্ভিস পরীক্ষার  ইন্টারভিউ পেয়েছি, রিটেন এগজামিনেশনে দশ জনের ভিতরে আছি, চাকরি হবেই, সুতরাং মঞ্জরী তাঁর। সেটেলমেন্ট অফিসের এক  সামান্য কানুনগো যার সারা মাসের মাইনে তাঁর একদিনের বেতন হবে, তা ছাড়া গাড়ি, বাংলো, আর্দালি… সে তাঁকে হারিয়ে দেবে?            

চঞ্চলচন্দ্রকে নিয়ে যে গল্প লিখেছেন লেখক সুমিতাভ, তা শোনার আগে চঞ্চলের নিজের কথা শোনা যাক। তিনি ফরেন সার্ভিস করতেন, অনেক দেশ ঘুরেছেন, আফগানিস্তান ছিলেন এক সময়, কত মানুষের মৃত্যু দেখেছেন, নিজেও মরতে মরতে বেঁচে গেছেন কতবার, সবই যেন ঈশ্বরের অভিপ্রায় ছিল। ঈশ্বর তাঁকে আয়ুষ্মান করেছেন।

মঞ্জরী তৃতীয় চিঠির উত্তরে বলেছিল, যতবড়  চাকরি পান, যতই আপনার কৌলীন্য থাকুক মশায়, আপনার  ইচ্ছে পূরণ হবে না। আমি যাকে ভালবাসি, তার থেকে সরে আসব না লোভে পড়ে, ভালবাসার মানেই জানেন না আপনি, বোঝেনই না ভালবাসা কী, তাই সব জেনেও বারবার বিব্রত করছেন আমাকে,  অহমিকায় ভালবাসা পরিমাপ করা যায় না।

একদিন শুভানন এল চঞ্চলের কাছে। চঞ্চলের বাড়ি  থেকে বিবাহর প্রস্তাব  গেছে মঞ্জরীর  বাবা মায়ের  কাছে। শুভাননকে ডেকেছিলেন  চঞ্চলই।   এক রেস্তরাঁয়  কথা হয়েছিল।  শুভাননকে বলেছিলেন, কলকাতায়  বদলির  ব্যবস্থা করে দেবেন তিনি, গ্রামে ঘুরতে হবে না, হেড অফিস সার্ভে  বিল্ডিঙে   বসবে শুভানন। চঞ্চলের সেই ক্ষমতা আছে। আছে মানে হয়েছে। তাদের পরিবারের  হাত বহুদূর। তা ব্যতীত সে  ফোরেন সার্ভিস পেয়েছে, সেইটা বড় কথা। তার ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রদূত। ভারতের অ্যাম্বাস্যডর হবে সে একদিন। শুভানন কিছুই না। শুভানন বলেছিল, না সে কিছুই না। অতিকষ্টে প্রচুর পড়ে এই চাকরি অবধি পৌঁছতে পেরেছে সে। কিন্তু চঞ্চলবাবু কেন ডেকেছে তাকে সে জানে না।

চঞ্চল বলেছিল, বদলির অর্ডার এসে যাবে, কলকাতায় চলে যাক শুভানন, মঞ্জরীর সঙ্গে যেন যোগাযোগ  না রাখে।

শুভানন চুপ করে বসেছিল। চঞ্চল বলেছিল, মঞ্জরীকে নিয়ে সে মুসৌরির ট্রেনিং ইন্সটিটিউট চলে যাবে,  সুতরাং সে যা চায় তাইই পাবে।

সে যা চায় মানে শুভানন যা চায় তা চঞ্চল দেবে তাকে। শুভানন বলেছিল, সে মঞ্জরীকেই  চায়। সে বলেছিল, চঞ্চলচন্দ্রের সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। চঞ্চলের তুলনায় সে কিছুই না। নগন্য এক মানুষ।  কিন্তু সে মঞ্জরীকে ভালবাসে। মঞ্জরীও তাকে ভালবাসে। সে এসেছে এই অনুরোধ জানাতে যে চঞ্চলের বাড়ি  থেকে যেন আর অনুরোধ না করা হয়। মঞ্জরী চায় না যে চঞ্চলচন্দ্র তাকে আর কোনও প্রস্তাব পাঠান।  শুভানন এক শীর্ণকায় যুবক। চায় কবি হতে। কবিতা তার গ্রাসাচ্ছাদনের উপায় হবে না বলেই চাকরি নেওয়া। মঞ্জরী বলেছে সে একটা চাকরি পেলে শুভাননকে আর চাকরি করতে দেবে না। শুভানন কবিতা লিখবে, গল্প লিখবে। শুনতে শুনতে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন চঞ্চল। বলেছিলেন, হাজার কুড়ি টাকা  দেবেন। যুক্ত করে প্রত্যাখ্যান  করেছিল শুভানন। তারপর উঠে চলে গিয়েছিল। ৪৫০ টাকা বেতনের   কর্মচারীর  সাহস কত। কুড়ি হাজারের তখন অনেক দাম। কয়েক লাখের সমান। চঞ্চল সহ্য করতে পারেনি ওই সামান্য যুবকের অহঙ্কার। সে তখন শুভাননকেই বিব্রত করতে আরম্ভ করে। জেলা অধিকর্তাকে দিয়ে শুভাননকে  বদলি করিয়ে দেয় অন্য জেলায়। সেই জেলা কলকাতা  থেকে আরও দূরে। কিন্তু সে সম্পর্ক রেখে চলেছিল মঞ্জরীর সঙ্গে। পোস্টে চিঠি আসত, কবিতা আসত। সেই চিঠি  তিনিই পেতেন। শহরে তাঁর অসীম ক্ষমতা। তিনি ছিলেন এক আগ্রাসী যুবক। তাঁদের পরিবারের একজন ছিলেন মন্ত্রী। যেভাবেই হোক শুভাননকে  সেই দূরের জেলায়  ঘুষের  মামলায় ফেলে  দু’দিনের হাজতবাস করিয়েছিলেন চঞ্চল।  

Amar Mitra

অমর মিত্রের জন্ম ১৯৫১ সালে বসিরহাটে। তবে বহুদিনযাবৎ কলকাতাবাসী। ১৯৭৪ সালে 'মেলার দিকে ঘর' গল্প দিয়ে সাহিত্যিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ। প্রথম উপন্যাস 'নদীর মানুষ' ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হয় অমৃত পত্রিকায়। প্রথম গল্পের বই 'মাঠ ভাঙে কালপুরুষ'-ও ১৯৭৮ সালেই। রাজ্য সরকারি চাকরি করেও আজীবন সাহিত্যসাধনায় ব্রতী। ২০০৬ সালে 'ধ্রুবপুত্র' উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার। ২০০১ সালে বঙ্কিম পুরস্কার পেয়েছেন 'অশ্বচরিত' উপন্যাসের জন্য। এছাড়াও ২০০৪ সালে শরৎ পুরস্কার ও ২০১০ সালে গজেন্দ্রকুমার মিত্র সম্মান পেয়েছেন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *