একটা সময় ছিল যখন এই কলকাতা শহরটার এখান থেকে ওখানে যেতে হলে গেরস্ত বাঙালির বাস বা ট্রাম ছাড়া গতি ছিল না। ট্যাক্সি চড়াটা তাদের কাছে ছিল বিলাসিতা এবং প্রয়োজনের খাতিরে।

এ শহরে অটো আর মেট্রোরেলের শুরু আটের দশকের প্রথম দিকে। কিন্তু এগুলোয় চড়ে তো সব রুটে যাওয়া যেত না। এদের গতিবিধি ছিল সীমিত। তবে যানবাহন যা-ই হোক না কেন, তাদের চালায় কিন্তু ড্রাইভার। ড্রাইভারকে সব দিক থেকে গাইড করার জন্যে এবং যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া আদায়ের জন্যে আমরা এক বিশেষ শ্রেণির মানুষকে বাস এবং ট্রামে দেখতে পেতাম, যাদের বলা হত কনডাক্টর। ট্যাক্সিতে যখন ম্যাক্সিমাম চারজন যাত্রি তোলবার নিয়মটি লাগু হয়নি, তখন তাতে কখনো কখনো একজন হেল্পারের দেখা পাওয়া যেত। সে কিন্তু ড্রাইভারকে গাইড করত না। ড্রাইভার ক্লান্ত হয়ে পড়লে সে-ই তখন গাড়িটা চালাত। কনডাক্টরের দেখা আমরা পেতাম শুধুমাত্র বাসে এবং ট্রামে। এর মধ্যে প্রাইভেট বাস–  মানে, যার গা রুপোলি পাত দিয়ে মোড়া– তার দুই গেটে কনডাক্টর থাকলেও, প্রথম গেটে অফিস-টাইমে তার সঙ্গে একজন হেল্পারও থাকত । মিনিবাসে গেটের সংখ্যা একটি। তাই কনডাক্টর একজন, হেল্পারও একজন। আগে সরকারি বাস ছিল দু’রকমের। সাধারণ লাল বাস আর কমলা রঙের স্পেশাল বাস। লাল বাসের ছিল দুটি দরজা। স্পেশাল বাসে দরজা একটিই কিন্তু তাতে আবার পাল্লা ফিট করা থাকত। সরকারি বাসে হেল্পারের কোনো প্রশ্নই ছিল না। আর দু’কামরার একটি ট্রামে ফার্স্টক্লাসে একজন এবং সেকেন্ড ক্লাসে একজন– মোট দু’জন কনডাক্টরকে দেখতে পাওয়া যেত।  

বাস এবং ট্রামের কনডাক্টরদের মধ্যে চেহারা, পোশাক-আশাক এবং হাবভাবের বেশ কিছুটা তফাত ছিল। তফাত ছিল সরকারি এবং প্রাইভেট বাসের কনডাক্টরদের মধ্যেও।

ট্রামের কনডাক্টররা সম্ভ্রান্ত। এদের গায়ে খাকি জামা-প্যান্ট। পায়ে কালো  বুটজুতো। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, মুখে পান। এরা ট্রামের মাথায় লাগানো জালে-ঘেরা সিলিং পাখার নিচে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে কথা বলত। একজন যাত্রির সঙ্গে কথা শেষ না-করে, অন্যজনকে উত্তর দিত না। ট্রামের চাকা লাইন থেকে পিছলে সরে গিয়ে রাস্তায় নেমে এলেও তাদের মুখের রেখাচিত্রের খুব একটা পরিবর্তন হত না। কমলা স্পেশাল বাসের কনডাক্টরদেরও ছিল এই একই পোশাক। ব্যবহারেও মোটের ওপর একটা ভারিক্কি চাল ধরা থাকত। লালরঙা সরকারি বাসের কনডাক্টররা কেউ কেউ খাকি প্যান্টের ওপর রঙিন শার্ট পরে ডিউটি করত। আবার কেউ করত আগাগোড়া প্লেন ড্রেসে।

প্রাইভেট এবং মিনিবাসের কনডাক্টরদের কখনোই কোনো ইউনিফর্ম পরতে দেখিনি। এদের চেহারা হত রোগাটে। জামা-প্যান্ট সামান্য ময়লা, কুঁচকোনো এবং কাঁধের ওপর বা প্যান্টের পকেটের কাছটা ছোটো খাটো রিফু করা। আর এই এইসব দেখেই হয়তো লেখা হয়েছিল সুমনের সেই অমোঘ গানের লাইন, ‘রোগারোগা চেহারার কনডাক্টর সব আমাদের জন্য!’ মুখে বিড়ি বা সস্তার সিগারেট, পায়ে হাওয়াই, ডান হাতের কোনো একটি আঙুল আধখানা অদৃশ্য–  এমনটাও তো হামেশাই চোখে পড়ত। ওরা চিৎকার করত বেশি, গোলমেলে যাত্রীদের সঙ্গে ঝুটঝামেলায় জড়িয়ে পড়তও বেশি। তবে এ কথা স্বীকার না-করে উপায় নেই– আমাদের ছোটোবেলায় দেখা বাস কনডাক্টররা এখনকার তুলনায় অনেক বেশি ধৈর্যশীল এবং সংযত ছিল। এখনকার কনডাক্টরদের মতো আলগা গালাগাল কিন্তু ওদের মুখে শুনতে পাওয়া যেত না। পরিচিত কোনো যাত্রীকে বাস ধরার জন্য পিছন থেকে ছুটে আসতে দেখলে, স্টপেজ ছেড়ে যেতে যেতেও ওরা টিং করে বেল মারত। অমনি ড্রাইভারও ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষে দিত। আর এটাও বলার যে, সেইসময় অধিকাংশ কনডাক্টরই ছিল বাঙালি। এখন বিহার বা উত্তরপ্রদেশ থেকে আসা পানমশলার কষ গড়ানো যেসমস্ত কনডাক্টারকে আমরা মহাদর্পে বাসের দরজা সামলাতে দেখি, নয়ের দশকের প্রথমদিক পর্যন্ত কলকাতার বুকে তাদের বড়ো একটা দেখতে পাওয়া যেত না। 

এখন বাস বা ট্রাম যে গাড়িরই কনডাক্টর হোক না কেন, দুটো ব্যাপারে ওদের মধ্যে মিল সাংঘাতিক। প্রথমত, এদের সব্বার হাতে থাকে টিকিটের গোছা। মনে আছে ছোটোবেলায় এমনই একগোছা আনকোরা টিকিট এক কনডাক্টরদাদার কাছ থেকে উপহার পেয়েছিলাম–  যা দিয়ে মামারবাড়িতে তুতো ভাইবোনেদের সঙ্গে টিকিট-টিকিট খেলা ভারি জমে উঠেছিল। আর দ্বিতীয়ত, কনডাক্টরদের কাঁধে থাকে খয়েরিটে চামড়া দিয়ে বানানো এক বিশেষ ধরনের ছোট মাপের ব্যাগ। ওই ব্যাগ কাঁধে নেওয়ার বেল্টটি সুতির তৈরি এবং একধরনের হলদেরঙা ঠাসবুনোট ফিতে দিয়ে বানানো। ছোটোবেলায়  বাসে করে উত্তর কলকাতায় যাওয়ার সময় বিধান সরণির ঠিক ক্রসিং-এ পরপর দু’তিনটি দোকানের সামনের হুকে এমন নতুন নতুন কনডাক্টরদের ব্যাগ ঝুলে থাকতে দেখে কী যে লোভ হত বলে বোঝাতে পারব না! তবে ওই ব্যাগটি যদি বাসে হওয়া কোনো ঝামেলার সময় পয়সা-ভর্তি অবস্থায় একবার মাটির দিকে মুখ করে উপুড় হয়ে যেত–  তাহলেই ঝামেলার একশেষ। 

নানা ধরনের কনডাক্টরদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি করে প্রাইভেট বাস কনডাক্টরদের বিশেষ কিছু কার্যকলাপ হয়তো অনেকের মতো আমার মনের মধ্যে স্মৃতি হয়ে রয়ে গিয়েছে। যেমন, তারা ভিড় বাসের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীদের ক্রমাগত ‘ঢুকে দাঁড়ান!  ঢুকে দাঁড়ান!’ বলে চলত। আর যাত্রীরা বিরক্ত হয়ে বলত, ‘আর কোথায় ঢুকব বাপু? ভেতরে কেমন গড়েরমাঠ রয়েছে একবার নিজে ঢুকেই বরং দেখে এসো না !’ হ্যাঁ যেত। সব কনডাক্টররাই বাসের মধ্যে ভিড় ঠেলা অনেকদূর ঢুকে যেত টিকিট কাটার জন্যে। পৌঁছে যেত সেইসব যাত্রীদের কাছে, যারা বাসের এই গেট দিয়ে উঠে ওই গেট দিয়ে নেমে যাওয়ার সময়, ওপারের কনডাক্টরকে টিকিট না-কেটেই মিষ্টি হেসে বলত, ‘ভাই, হয়ে গেছে।’ কনডাক্টর তাদের কাছে গিয়ে বলত, ‘টিকিটটা এবার কেটে ফেলুন কাকা, আর দিচ্ছি-দিচ্ছি করবেন না!’ কোনো যাত্রী অল্প দূরত্বের টিকিট কেটে বেশি দূর অবধি গেলে, বাস থেকে নামবার সময় কনডাক্টর তাকে খপাৎ করে ধরত। অল্প পয়সা হাতে ধরিয়ে দিয়ে, ‘আরে রাখো না, টিকিট লাগবে না …’ বলে কিছু যাত্রী পয়সা বাঁচাবার চেষ্টা করত চিরকাল। এরা কখনও সফল হত, কখনও হত না। আবার কেউ টিকিট না-কেটে নেমে পড়লে সে-ও তার সঙ্গে রাস্তায় নেমে পড়ে, বাসের গায়ে চাপড় মেরে বাসটাকে থামিয়ে দিয়ে, তার টিকিট কাটত। অনেক কনডাক্টর আবার পয়সাটা গাপ করে দেওয়ার জন্যে যাত্রীকে টিকিটটা না দেওয়ার চেষ্টাও করত। আবার কোনো যাত্রী ঠেকায় পড়ে টিকিট কেটে, নাক ফুলিয়ে টিকিট না-নিয়ে চলে গেলে, ওরা সেটা হাওয়ায় উড়িয়েও দিত। মাঝ রাস্তায় বাস খারাপ হয়ে গেলে, বাস থেকে নেমে যাওয়া যাত্রীদের টিকিটের টাকা ফেরত দিয়ে দিত এই কনডাক্টররাই।

একই রুটের দুটো বাসের রেশারেশির মূল নায়ক কিন্তু ড্রাইভার নয়–  কনডাক্টর। এজন্যে কত বিচ্ছিরি বিচ্ছিরি অ্যাক্সিডেন্ট ঘটেছে বলার নয়। বাসে যাত্রী কম থাকলে, রাস্তায় গুড়গুড় করে এগোনো বা ইচ্ছে করে সিগনাল খাওয়াটাও তো এদের ইচ্ছেতেই। বাস যাত্রীদের ছুড়ে দেওয়া, ‘চাকায় কি হাওয়া নেই?’, ‘কারো জন্যে অপেক্ষা করছ নাকি ভাই?’ বা ‘ সাইড করে দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়!’ —  এমন মন্তব্যে তাদের কোনো হেলদোলই হত না। ড্রাইভারের হাতে স্টিয়ারিং থাকলেও সে এখানে ‘রক্তকরবী’র সেই প্রাসাদের মধ্যে থাকা রাজার মতো। মানে, বাসের সামনের গ্রিল-ঘেরা জায়গাটুকুর মধ্যেই তার ডেরা। যেখানে কেউ তাকে পরিষ্কার দেখতে পায় না– গলার আওয়াজটুকুই মাঝে মাঝে শুনতে পায়। মাত্র। 

কনডাক্টররা উঠতি ছেলেছোকরাদের ফুটবোর্ডে ঝুলতে বারণ করত। পকেটমার উঠলে যাত্রীদের ইশারায় সতর্ক করে দিত। রাত্তিরে কোনও মোদো মাতাল আচমকা বাসে উঠে পড়লে, ওরাই বাস থামিয়ে তাদের ঘাড় ধরে নামিয়ে দিত। এরা হয়তো গরিব, হয়তো মাথাগরম, হয়তো অশিক্ষিত … হয়তো এরা গলা ফাটিয়ে মিন্টু পার্ক, পার্কইস্টিট বলে চেঁচায়। তবু এদেরই দেখা যায় বাইরের রড ধরে ঝুলে পড়া মাঝবয়সি কোনো মাহিলাকে নড়া ধরে বাসের ভেতরে তুলে নিতে, তারপর তাঁকে ‘মাসিমা’ না-বলে ‘দিদিমা’ বলে ফেলায়, ‘কেন রে পোড়ারমুখো, চোখের মাথা কি খেয়েছিস নাকি রে!’–  গোছের ভর্ৎসনা হজম করতে। বাচ্চা-কোলে কোনো মা বাসে উঠলে তাকে ইশারায় বলে দিতে, কোন জায়গার সিট তাড়াতাড়ি খালি হবে। তারা বাচ্চা নিয়ে বাস থেকে নেমে যাওয়ার সময় কনডাক্টরের মুখেই শুনতে পাওয়া যেত সেই ইতিহাস হয়ে যাওয়া ডায়লগটি, ‘আস্তে লেডিস, কোলে বাচ্চা!’ আর এসব ছবি তো কোনোদিনই মুছে যাওয়ার নয়।

রজতেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের জন্ম কলকাতায়, পড়াশুনো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে, লেখালেখির শুরু নয়ের দশকে। বিভিন্ন বাণিজ্যিক পত্রপত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিনে ছোটগল্প, কবিতা এবং নানা বিষয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন। কবিতার বইয়ের সংখ্যা দশ। প্রচ্ছদ এঁকেছেন তিরিশেরও বেশি বইয়ের। পেশায় চাকরিজীবী।

4 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *