আগের পর্বের লিংক: [পর্ব ১] [পর্ব ২] [পর্ব ৩] [পর্ব ৪] [পর্ব ৫] [পর্ব ৬] [পর্ব ৭] [পর্ব ৮] [পর্ব ৯] [পর্ব ১০]

ঠাকুরের জন্মোৎসবে এবার কেন ধুমধাম? না এদেশে আসার পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হচ্ছে তাদের। বলল প্রতিপক্ষ জুড়ান রায়। কিন্তু ধুমধাম করেও পার পাবে না। জুড়ান দেখে নেবে। সে কোনওদিন নেমন্তন্ন পায় না, পেলেও যাবে না। গেলে হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেবে। আমরা প্রত্যেকবার নেমন্তন্ন পাই। সুমিতাভ যান না। নীলমাধব বলল, চঞ্চলচন্দ্রকে ডেকেছি, দেখি আসে কিনা। চঞ্চলচন্দ্রকে নিয়ে তার খুব মাথাব্যথা। 

আসলে এই একটি লোক তার গায়ে গায়ে থেকেও তাকে অগ্রাহ্য করছে। এই প্রত্যাখ্যান সে সহ্য করতে পারছে না। কিন্তু সে হেরে যাওয়ার মানুষ নয়। চঞ্চলচন্দ্রের উঁচু মাথা সে নিচু করবেই যে করে হোক। নীলাম্বর আবাসন তাদের জমিতে। সেখানে থেকে তাকে অগ্রাহ্য করলে হবে? শুনে জুড়ান রায় বলল, ওই নীল না লালমাধবের সাহস নেই যে তাকে যেতে বলে। কে বিরাম ঠাকুর? তাঁর শিষ্য ওরা কী করে হয়?  বিরাম ঠাকুর চাটগাঁর বাসিন্দা ছিলেন। তাঁর শিষ্য সকলেই চাটগাঁর। এমন কি বার্মাতেও আছে, ত্রিপুরাতেও আছে। ফরিদপুরে তিনি জন্মাননি। পদ্মা পার হয়ে এদিকে আসেননি। এই নিয়ে তর্ক করা চলে না।

জুড়ান রায় যা বলবে, তাইই কি সত্যি হবে? জুড়ান বলল, হবে। কেন না সে ইন্টারনেট সার্চ করতে পারে। 
– গুগুল সার্চ করে দ্যাখো বিরাম ঠাকুরের জন্ম কোথায়। বারাসতের দিকে যে বার্মা কলোনি আছে, সেখানে গেলেই বিরাম ঠাকুরের কথা জানতে পারবে। তাঁর জন্ম অঘ্রাণ সংক্রান্তিতে। জৈষ্ঠ্যপূর্ণিমায় নয়। আসলে বিরাম ঠাকুর ধরেছে ওরা কলকাতায় আসার পর। নীলমাধব মোল্লা আবার হিন্দু হল, তা নিয়ে ভয় ছিল তো। তাই বিরাম ঠাকুরের মোচ্ছব চালু করল।
উঁহু। এসব কথা বলা ঠিক নয়। আলাদা কেউ হবেন ইনি। আমি নীলমাধবের সমর্থনে বললাম।    
– কেউ না। মধুতলায় কোনও যুগপুরুষ জন্মাননি। ওদের বাড়ি বলে রাধাকৃষ্ণ ছিল, তার মোচ্ছব হত? সব মিথ্যে। ওদের যা রমরমা এপারে লুটের টাকা নিয়ে এসে।

আমার শুনতে ভয় করে। জুড়ান অতি বিপজ্জনক ব্যক্তি। ভয়ডর বলতে কিছু নেই। এতবছর ধরে বলে যাচ্ছে, বাংলাদেশ জন্মের পঞ্চাশ বছর হয়ে গেল, তবুও বলে যাচ্ছে। প্রমাণ করতে পারল না কিছুই। বাংলাদেশ পুলিশ তো এল না নীলমাধবের মণিমালিকা আবাসনে! তবু জুড়ান বলল:
– নেট খুঁজে দ্যাখো অনুতোষ, বিরাম ঠাকুর চট্টগ্রামের। ফরিদপুরের নন। আমি এইবার ফাটাব, ঠিক ফাটাব। জুড়ান তার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে।  

না। চঞ্চলচন্দ্র আসেননি। সুমিতাভও না। হ্যাঁ, যে কথা বলা হয়নি, সুমিতাভ মাঝে-মধ্যে নাকি চঞ্চলচন্দ্রের  ফ্ল্যাটে যান। তাঁর সঙ্গে চঞ্চলের ভাব-তরঙ্গ মেলে। সুমিতাভ যেহেতু চঞ্চলের ফ্ল্যাটে ঢুকতে পারেন, নীলমাধব বিরক্ত। কিন্তু স্পষ্ট করে কিছু বলতেও পারে না। মুখে তুচ্ছ করলেও জানে সুমিতাভ এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। শুধু একদিন বলল:
– যাবেন না। লোকটা সন্দেহজনক। একা থাকে কেন? ঘরে কাউকে ঢুকতে দেয় না কেন?
সে এক একজন এক এক রকম হয়। সকলের সঙ্গে সকলের মেলে না। সুমিতাভ বললেন।
– যাবেন না। অভদ্র লোক। আমি থানায় রিপোর্ট করব। লোকটা কে জানতে হবে।
হুঁ! আধার কার্ড, ভোটার কার্ড, প্যান কার্ড সব আছে কিনা দেখতে হবে। গুণেন সরকার বলল বিদ্রূপের সুরে।  

 

আরও পড়ুন: আনন্দ সেনের গল্প: জানালা (প্রথম পর্ব)

     

আবার ইঁদুর বিড়াল খেলা আরম্ভ হলো যেন। নীলমাধব বলল:
– ওসব পয়সা দিলেই তৈরি করা যায়।
– হুঁ! মুজিব হত্যাকারী যে লুকিয়ে ছিল পার্ক স্ট্রিটে মাস্টার হয়ে, সেও ওসব তৈরি করে ফেলেছিল। গুণেন বলল। 
চমকে উঠল নীলমাধব!
– তার মানে?
– জানেন না? মুজিবর রহমানের হত্যাকারী একজন পার্ক স্ট্রিটে…।
– ও! আমি ভাবলাম…। কথাটা থামিয়ে দিল নীলমাধব। কী ভেবেছে নীলমাধব তা বুঝতে পারা গেল না। জুড়ান রায় থাকলে হয়তো বুঝতে পারত। কিন্তু ব্যাখ্যাটি মাধব নিজেই দিল। বলল, সে ভেবেছে ওই সিসিসি মুজিব হত্যাকারী নাকি।
কী যে বলেন! তখন তো আপনিও ফেঁসে যাবেন। আমি বললাম।
– কেন? আমি ফাঁসব কেন? আমার কী? আমরা মুক্তিযুদ্ধের আগেই ইন্ডিয়ায় চলে এসেছিলাম।

নীলমাধব একটি জলজ্যান্ত মিথ্যে কথা বলল। আমার স্পষ্ট মনে আছে তারা এসেছিল ১৯৭১ সালের নভেম্বরে। ২৩ নম্বর বাড়িতে ভাড়ায় ছিল দু’মাস, তারপরই কাকলি গানের বাড়ি কিনে সেখানে গিয়ে উঠল ১৯৭২-এর জানুয়ারির শেষে, মাঘ মাসে। অবাকই হয়েছিলাম। এ পাড়ায় ভাড়া থেকে এ পাড়ায় বাড়ি কিনে নেওয়ায় দম লাগে। সকলেই তো পাড়া ছেড়ে মধ্যমগ্রাম, বিরাটি, বাগুইআটির দিকে চলে যায়।  

গুণেন বলল:
– আর একজন হোমিওপ্যাথ ডাক্তার ছিল হাবড়ায়…।
– আমি তো বলেইছি, লোকটা সন্দেহজনক। যেন আত্মগোপন করে আছে আমাদের আবাসনে। আমি ধরতে পারছি তো, ওই জন্যই আমার সঙ্গে মেশে না। ফ্ল্যাটে কাউকে অ্যালাউ করে না। আমি দিল্লিতে ফোন করেছিলাম ফ্ল্যাটের মালিক অহীন চৌধুরীকে। তার কথা বলার সময় নেই। বলল, দেখেশুনেই দিয়েছে, থানা বুঝবে। 
– একটা লোক একা থাকতেই পারে। তার মানে তাকে সন্দেহ করতে হবে কেন? আমি না পেরে বললাম।
একা থাকা মানে ফ্ল্যাটে কাউকে অ্যালাউ করব না? নীলমাধব ক্রুদ্ধস্বরে বলল।          
– না করতেই পারেন। সকলের ফ্ল্যাটে সকলের ঢোকার অধিকার আছে নাকি? আমি বললাম।        
নীলমাধব আমার কথা পছন্দ করল না। বলল:
– আমি আবাসনের সেক্রেটারি। আমার সম্মান নেই?
তা অবশ্য ঠিক। কিন্তু ওই চঞ্চলচন্দ্র তো ভাড়ায় আছেন। তিনি তো আবাসনের সমবায় সমিতির কেউ নন। আজ আছেন কাল নেই। 
– হুঁহ! নীলমাধব বলল: চাল নেই চুলো নেই।  

 

আরও পড়ুন: আনন্দ সেনের গল্প: জানালা (শেষ পর্ব)

 

কথাটা কেউ সিরিয়াসলি নিল না। আবাসনের নাকের ডগায় থানা। থানার কাছে আশ্রয় নিয়ে নিজেকে সন্দেহজনক করে তুলবে কেন চঞ্চলচন্দ্র চন্দ্র? এই রকম নামও দেখা যায় না বড় একটা। আর এলাকায় ভাড়ায় এলে থানায় সব তথ্য জমা করতে হয়, তাও করেছেন উনি। নীলমাধব কথাটা বলল বটে, কিন্তু বলা ঠিক হয়নি। সুমিতাভ বললেন:
– চঞ্চলচন্দ্র চন্দ্র একজন প্রকৃত সাধক মানুষ। অন্তরে অতি শুদ্ধ। তাঁর সঙ্গে নীলমাধব পালের মিলবে না বলেই তিনি নীলমাধবের বন্ধুতার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন।
– নীলমাধব, লালমাধব, সব মাধবের খবর হবে। খবর তো ৫০ বছর ধরে হচ্ছে। জুড়ান বলে।
– জুড়ান জানে অনেক, কিন্তু সব জানে না। কিন্তু সবটা জানেই বা কে? গুণেন প্রশ্ন করে।   

লিংক কী তা আমি জানি না। জুড়ানচন্দ্র জানে। মাধ্যমিক পাশ নয়, তবু অনেক কিছু জানে ‘নিরীহ মানুষ জগদীশ।’ জুড়ান আমাকে বোঝাতে লাগল, লিংক হলো সূত্র, সবুত। লিংকে ক্লিক করেই সব তথ্য জানা যায়। পৃথিবীতে প্রতিদিন কত তথ্য জন্মায়। আকাশের তারার মতো অগণন।  কিন্তু আমার ফেসবুক নেই, টুইটার নেই, লিংক খুলবে না। তবে খুলতেও পারে। মোবাইল ডেটা আছে তো। জুড়ান বলল:
– ফেসবুক না থাকলে, ফেসবুক লিংক খুলবে না। নেট আছে তো? ফ্রি কল আর ডেইলি এক জিবি?
– তা আছে। কিন্তু তা দিয়ে হোয়াটস্যাপ কল হয় মেয়ের সঙ্গে।
– তোমার হোয়াটস্যাপে ছবি দিতে পারি।
কী ছবি? খারাপ ছবি হলে দিও না।
আমি একটু ভয়ই পেলাম।
– আর ওইসব হত্যাকারীর ছবিও দিও না। আমি ভয় পাই। শুনেছি আমাদের দেওয়া নেওয়া সব মেসেজ, ছবি সরকারের নজরে থাকে। সরকার সব নিজের কাছে রেখে দেয়। দরকারে ব্যবহার করবে যে কোনওদিন। আমি তখন কী জবাব দেব? 

Amar Mitra

অমর মিত্রের জন্ম ১৯৫১ সালে বসিরহাটে। তবে বহুদিনযাবৎ কলকাতাবাসী। ১৯৭৪ সালে 'মেলার দিকে ঘর' গল্প দিয়ে সাহিত্যিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ। প্রথম উপন্যাস 'নদীর মানুষ' ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হয় অমৃত পত্রিকায়। প্রথম গল্পের বই 'মাঠ ভাঙে কালপুরুষ'-ও ১৯৭৮ সালেই। রাজ্য সরকারি চাকরি করেও আজীবন সাহিত্যসাধনায় ব্রতী। ২০০৬ সালে 'ধ্রুবপুত্র' উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার। ২০০১ সালে বঙ্কিম পুরস্কার পেয়েছেন 'অশ্বচরিত' উপন্যাসের জন্য। এছাড়াও ২০০৪ সালে শরৎ পুরস্কার ও ২০১০ সালে গজেন্দ্রকুমার মিত্র সম্মান পেয়েছেন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *