গরম কালের ঠা ঠা দুপুর। নাইতেখেতেবসতেশুতে কোনও শান্তি নেই। রোদ্দুরের বহর দেখে খোদ সূর্যও লজ্জা পাবে। যে দিক ফিরে শোয়া, সে দিকটাই ঘামে ভিজে। একটা টানা রিকশার ঠুনঠুন কিংবা ধুনুরির ড্যাং ড্যাং শব্দ বই আর কিছু শোনা যায় না। পরাণটাকে কেউ মনে হচ্চে হিঁচড়ে হিঁচড়ে বের করে নিতে চাইছে—ঠিক এমন সময়ই হঠাৎ ছাতার মতো একটা কালো আস্তরণ টাঙিয়ে দেয় একটা স্বস্তির শামিয়ানা। হ্যাঁ, তিনি আসেন। ভৈরব রূপে। হুহু গরম হাওয়ার মধ্যে একটা ঠাণ্ডা হাওয়ার শিহরণ। এবং হইহই করে ট্রামলাইন ধরে উড়তে থাকে ধুলো, ঘুরতে থাকে ধুলো। যুদ্ধ থেকে প্রেমিক ফিরলে অন্তস্বত্ত্বা প্রেমিকার যে আনন্দ হয়, চাঁদিফাটা গরমের দুপুরে কালবৈশাখী এলে ঠিক সেই আনন্দই হয়। মনে হয়, এত আনন্দও আমার প্রাপ্য ছিল ঠাকুর!!! আমি কি এতই ভাগ্যবতীইইইই!!! কালবৈশাখী যে একটা কালেকটিভ পাওয়া, সে কথা তখন মনেই থাকে না। এমন কাঙ্ক্ষিত প্রলয়ে অন্য কাউকে ভাগ দিতে মোটে মন চায় না।

তবে যতই কাঙ্ক্ষিত হোক না কেন, চাইলেই যে দেখা মেলে না, এ সব্বার জানা। আসলে কালবৈশাখীর মধ্যে যেটা আছে, তা হল আচম্বিত। চেয়ে হেদিয়ে গেলেও পাওয়া যাবে না, আর যখন ন্যূনতম আশা থাকবে না, তখন হরে মুরারে বেশে রই রই আছড়ে পড়বে। সে কেউ চাক বা না চাক। অতএব, তার উপস্থিতিতে প্রাণ জুড়তে পারে কিন্তু ভযঙ্করতাকে সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে। কেবল কালবোশেখির আমেজ আর আত্মা জুড়িয়ে যাওয়া আরামটুকু নেব কিন্তু তার প্রলয় ভাবটিকে সরিয়ে রাখব তা হবে না। পিক অ্যান্ড চুজ করলে হবে না। গ্রহণ করলে সবটাই করতে হবে। মুশকিল হল, বর্জন যে করবে তার উপায় নেই। কারণ কালবোশেখির আসাযাওয়া আমাদের ইচ্ছের ওপর নির্ভর করে না। তার ইচ্ছের ওপর করে। খানিকটা জীবনের মত। যখন প্রলয় চাই না, তখন তা অতর্কিতে কোন ফাঁকফোকর দিয়ে ঢুকে যে ছিন্নভিন্ন করে নিত্যকার ছন্দে পতন ঘটিয়ে চলে যায়, বুঝে ওঠা মুশকিল। আমাদের জীবনে গ্রহণ-বর্জনের হিসেবও সব সময় আমাদের হাতে থাকে না। যেমন অনিচ্ছায় অনেক কিছু গ্রহণ করতে হয়, তার ফলে ঘটে প্রলয়। আবার প্রলয় হবে জেনেও কিন্তু অনেক সময়ই অনেক কিছু বর্জন করা যায় না। তাকে কালবোশেখির তীব্রতায় সহ্য করতে হয়। তবে জীবনের সঙ্গে কালবোশেখির প্রলয়ের একটাই তফাত, মোটামুটি সব কালবোশেখির পর একটা শান্তির বারিধারা নেমে আসে, স্বস্তি দেয়। কিন্তু নিত্য জীবনে সে গ্যারান্টি কই! বারিধারা নামলেও, তা স্বস্তির হয় কি?

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায় হাসিখুশি, এমনকী যখন সেই মোড-এ থাকেন না, নিজেকে ঠেলে হিঁচড়ে হিহিহোহো’তেই ল্যান্ড করানোর চেষ্টা করেন। জাপটে ভালবাসেন আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, সিরিয়াল, গান, রাস্তায় নেড়িবাচ্চার লটরপটর কান। পড়াশোনার সময় ফিল্ড করেছেন, হাতুড়ি দিয়ে পাথর ভেঙেছেন, গ্রামবাসীদের তাড়া খেয়েছেন, এক বার পাহাড় থেকে অনেকটা হড়কে পড়ে মুচ্ছো গেছিলেন, উঠে দেখেন, কবর! এক বার ম্যানেজমেন্ট কোর্সের অঙ্গ হিসেবে চিন গেছিলেন, রাত্তির দুটোয় সাংহাইয়ের রাস্তায় হারিয়ে গিয়েও কাঁদেননি। ফিউজ সারাতে পারেন, পাখার কার্বন বদলাতে পারেন, কাগজের চোঙ পাকিয়ে গাড়িতে পেট্রল ঢালতে পারেন, চিনেবাদাম ছুড়ে দিয়ে মুখে নিপুণ লুফতে পারেন। ব্যাডমিন্টন খেলার ইচ্ছে খুব, কিন্তু জায়গা ও র‌্যাকেট নেই। অরোরা বোরিয়ালিস যারা দেখেছে, তাদের একাগ্র ভাবে হিংসে করেন। দেশের বাড়িটা উনি বড় হওয়ার পর ছোট হয়ে গেছে বলে, আর আমির খান এক বার কার্টুন এঁকে দিয়েছিলেন— সে কাগজ হারিয়ে গেছে বলে, জেনুইন কষ্ট পান। এক বার ঈগলের রাজকীয় উড়ান আগাগোড়া খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *