একটা প্রশ্ন আমাদের মনে বারংবার ঘুরেফিরে আসতে চায়। তা হল, শিল্পী বা লেখক তাঁর সময়কালে যতটা অভিনন্দিত হন, গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেন– পরবর্তীকালের দর্শক-পাঠক কি তাঁদের সেভাবে মনে রাখেন? অবশ্য দ্রুত এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ পরিপ্রেক্ষিতটুকু বুঝে নেওয়া জরুরি। 

শিল্প ও সাহিত্যের একটা চলমান স্রোত আছে– যা সেই সময়কে ছুঁয়ে থাকে। অর্থাৎ, প্রবহমান ঢেউ তথা কনটেম্পোরারি ট্রেন্ডকে সে অনুসরণ করে চলে। তবে এক ধরনের গতানুগতিক আবহে বয়ে চলা শিল্পী বা লেখক তাঁদের সময়ে জনপ্রিয়তা পেলেও কালের বিচারে তিনি টিঁকে থাকবেন কিনা, বলা মুশকিল। অবশ্য কেউ বলতেই পারেন, তাতে কী এসে যায়? বর্তমান হল শ্রেষ্ঠ সময়। সেখানে যদি তাঁদের অবস্থান নিশ্চিত হয়, সেইটেই তো যথেষ্ট। লেখক বা শিল্পীর অবর্তমানে ভবিষ্যৎ তাঁদের পক্ষে কী রায় দেবে, সে ভাবনায় কাজ কী?

কথাটা আপাতদৃষ্টিতে গ্রহণীয় মনে হতে পারে। কিন্তু ভেবে দেখলে, শিল্প হোক বা সাহিত্য, বর্তমানের সীমানা পেরিয়ে যদি সে ভবিষ্যতের দিকে একধাপ এগিয়ে না-থাকে, তাহলে ইতিহাস তাকে স্বীকার করে না। এখানেই এসে পড়ে শিল্পের বিচার। প্রশ্ন এখানেও, শিল্পসাহিত্যকে বিচার করবার অধিকার কার হাতে? সেই বিচারের মানদণ্ড কি আমজনতার করায়ত্ত? নিশ্চয়ই নয়, কারণ তার জন্য নিজেদের শিক্ষিত করে তোলার প্রয়োজন আছে। আর আমাদের দেশের সাধারণের মধ্যে শিক্ষার সেই পাঠগ্রহণের কাজ এখনও সম্পূর্ণ হয়নি। 

Abanindranath_Tagore
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর

এই মুহূর্তে কথাগুলো বলছি আমাদের এক মহান শিল্পীর জীবন ও কাজের দিকে তাকিয়ে। তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আজ আমরা তাঁর জন্মের সার্ধশতবর্ষের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি। দেড়শো বছরের জন্মদিনে যাঁকে বিশেষভাবে স্মরণ করতে হয়, এমন শিল্পীর কাজের দিকে নিশ্চিতভাবে এবার ফিরে তাকাতে হয়। আবার এখানেও প্রশ্ন, নতুন করে কেন চেয়ে দেখা প্রয়োজন তাঁর কাজ, তাঁর শিল্পভাবনার দিকে? সে কথা বলার আগে একঝলক তাঁর বিষয়ে জেনে নেওয়া যাক। 

প্রথম পর্বে তিনি রীতিমতো সাহেব শিল্পীর কাছে প্রথাগত পাশ্চাত্য শিল্পের পাঠ নিয়েছিলেন। তারপর স্বদেশী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে প্রাচ্য তথা ভারতীয় শৈলীর অনুসন্ধানে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর আবিষ্কার করলেন এক নতুন চিত্র-আঙ্গিক– যা ‘ওয়াশ’ পদ্ধতি হিসেবে পরিচিত। সেই পদ্ধতি মূলত মোগল মিনিয়েচার টেকনিকের সঙ্গে জাপানি আঙ্গিকের মিশ্রণ। তবে সেখানে মিশে রইল ইউরোপীয় জলরঙের স্বচ্ছতা– যার সঙ্গে অবনীন্দ্রনাথের পরিচয় তাঁর চিত্রচর্চার প্রথম লগ্নে।

ওই সুক্ষ্ম সুতোটুকু ছাড়া তিনি যখন ইউরোপীয় পদ্ধতিকে একপাশে সরিয়ে তাঁর ছবিতে অন্য ধরনের শিল্পশৈলীর অবতারণা করলেন– সকলে তা গ্রহণ করতে পারলেন না। কারণ, আমাদের দেশের বিভিন্ন আর্টস্কুলে তখন বিলেতের রয়েল কলেজ অফ আর্টের ধারায় শিল্পশিক্ষার প্রচলন। সেইসব স্কুলে মূলত বিলেতের একাডেমিক পদ্ধতিতে শিল্পশিক্ষা দেওয়া চলেছে। অবনীন্দ্রনাথ তাঁর চিত্রে বিলেতের সেই ন্যাচারালিস্টিক অ্যাপ্রোচ থেকে সরে আসতে চাইছিলেন। এই ভাবনায় পিছনে ছিলেন তার প্রিয় ‘রবিকা’। 

Sindbad the sailor by Abanindranath Tagore
অবন ঠাকুরের তুলিতে সিন্দবাদ নাবিক

এদিকে সেই পর্বে রবি বর্মার ছবি বিপুল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তাঁর ছবির বিষয়ও ভারতীয় পুরাণ আশ্রিত কাহিনি অবলম্বনে অঙ্কিত। তবে রবি বর্মা ভারতীয় পৌরাণিক বিষয় নিয়ে আঁকলেও তাঁর চিত্রপদ্ধতি ছিল পুরোপুরি ইউরোপীয়। তাঁর সেই রিয়েলিস্টিক আদলে আঁকা ছবির পাশে সেই সময়ের দর্শক অবনীন্দ্রনাথের নতুন শৈলীকে তেমন গ্রহণ করতে পারছিলেন না। পত্রপত্রিকায় অবনীন্দ্রনাথের নতুন আদর্শে অঙ্কিত ছবি প্রকাশিত হলে তার বিরুদ্ধে বিদ্রুপের ঢল নামতে দেখা যায়। যদিও ‘প্রবাসী’ পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের মতো ব্যক্তি সর্বদা অবনীন্দ্রনাথের এই নতুন আঙ্গিককে স্বাগত জানিয়েছেন। তা সত্ত্বেও সে বিদ্রুপ যে কোন মাত্রায় পৌঁছেছিল, তার দু’একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। 

প্রবাসী পত্রিকার ১৩১২ সালের চৈত্র সংখ্যায় অবনীন্দ্রের ‘পুষ্পরাধা’ শিরোনামে একটি ছবি প্রকাশিত হলে ‘সাহিত্য’ পত্রিকায় সুরেশ সমাজপতি লিখলেন–

‘পুষ্প-রাধা শ্রীঅবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অঙ্কিত চিত্রের প্রতিলিপি। প্রবাসীতে কেবল কালীর স্তুপ দেখিতেছি। ঘোর অন্ধকারে উপবিষ্ট শ্রীকৃষ্ণের যে আভাস দেখিতেছি তাহা পুরুষোত্তমের ভূত হইতে পারে, পুরুষোত্তম নহে।’

‘ভারতী’ পত্রিকায় অবনীন্দ্রনাথের ‘কাজরী’ ছবিটির প্রতিলিপি মুদ্রিত হলে সুরেশ সমাজপতি আরা সুতীব্র বিদ্রুপে লিখলেন-

‘শ্রীঅবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কাজরী’ তাঁহার আবিষ্কৃত ভারতীয় চিত্রকলা পদ্ধতির বিজয়বৈজয়ন্তী। আবার পরিত্যক্ত চিত্ররীতির পুনরাবর্তন। অবনীন্দ্রনাথ যেন পাকাঘুঁটি কাঁচাইয়া খেলাটি মাটি করিতেছেন। কেমন করিয়া বলিবকেমন সেই ছবিখানি। কোন ভাষায় বর্ণিব সেই তিন রূপসীর তিন রূপ। কেমন করিয়া বুঝাইব তাহাদের ঢেউখেলানো দেহষ্টির সেই আঁকাবাঁকা ভাব, প্যাকাটিবিনিন্দিত হাতের সেই ত্রিভঙ্গিম ভঙ্গী, শুকনো, পাকানো, লতানে, সেই উৎক্ষেপ, বিক্ষেপ, প্রক্ষেপ! কোন ছন্দে বাখানিব এই তিন সুন্দরীর সৌন্দর্য!– অবনীন্দ্রনাথ সেকালের দোহাই দিয়ে ছবিখানি আঁকিয়াছেন বটে, কিন্তু ইহার মডেল আদর্শ তত পুরাতন নহে। বাঙ্গালীর দুভাগ্যক্রমে এখনও কলিকাতার রাজপথে বিবাহের শোভাযাত্রায় ময়ূরপঙ্খীর উপর নির্লজ্জ নাচের যে জঘন্য ক্যারিকেচারললিতলাস্যের যে অপমান দেখিয়া মরমে মরিয়া যাইতে হয়, সুবেশা, সালস্কৃতা সুন্দরীর অপভ্রংশে ভারতীয় চিত্রকলার রাফেল সেই কদর্য, নির্লভ ভঙ্গীর আরোপ করিয়াছেন।’ 

nasim-bagh_Abanindranath Tagore
ছবির নাম ‘নাসিমবাগ’

এই বিরূদ্ধ ও কদর্য সমালোচনার কাছে কিন্তু অবনীন্দ্রনাথ তিনি মাথা নিচু করেননি। বরং পরবর্তীকালে দেখি, অবনীন্দ্রনাথের শিল্পভাবনা, তাঁর সেই চিত্র-আঙ্গিক, ভারতীয় শিল্প-ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। নতুন চোখে দেখতে শিখিয়েছে ছবি, চিনিয়েছে নিজেদের শিল্পের ঐতিহ্য। এই পর্বে তিনি কেবল একলা-চলা পথিক নন, তৈরি করেছেন তাঁর শিষ্যদল– যাঁরা সেই প্রবাহকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। তবে তিনিই আলোকবর্তিকা হাতে সর্বদা অগ্রপথিকের ভুমিকায়। 

ঐতিহাসিকেরা অবনীন্দ্র প্রবর্তিত বিশেষ ধারাকে বেঙ্গল-স্কুল নামে অভিহিত করেছেন। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন নন্দলাল বসু, ভেঙ্কটাপ্পা, সুরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, যামিনী রায়, ক্ষিতীন্দ্রনাথ মজুমদারের মতো একঝাঁক শিল্পী। যদিও সকলে যে বাংলা-কলমের শিল্পধারায় আজীবন চিত্রচর্চা করেছেন তা নয়, রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে নন্দলাল যোগ দিয়েছেন কলাভবনে। সেখানে গিয়ে তাঁর চিত্রকলার পরিবর্তন ঘটেছে। অন্যদিকে সরে গিয়েছেন যামিনী রায়, তিনি গ্রামীন পটচিত্র, কালীঘাটের পট ইত্যাদি লোকায়ত চিত্রকলার অনুপ্রেরণায় নতুন শৈলীতে ছবি আঁকা শুরু করেছেন।

কিন্তু স্বীকার করতেই হবে, পাশ্চাত্যের খোলস ছাড়িয়ে ভারতীয় শিল্পের আধুনিকতার দিকে এগিয়ে যাওয়ার পক্ষে সেটাই ছিল প্রথম ধাপ… যার উত্থান হয়েছে অবন ঠাকুরের হাত ধরে। তবে কি এটাই আজ তাঁকে মনে রাখার একমাত্র কারণ? তিনি এক নতুন যুগের সূচনা করেছেন– ভারতীয় শিল্পে এই কি তাঁর অবদান? নাকি সবার আগে স্মরণীয় ‘গুরু’ অবনীন্দ্রনাথ, তাঁর শিক্ষকের ভূমিকাকেই কি মনে রাখব তাঁর সার্ধশতবর্ষের মহালগ্নে? তবে কি অবনীন্দ্রনাথের নিজস্ব চিত্রীসত্তা পড়ে রইল সবার পিছনে? 

Abanindranath_Tagore_Journeys_End
ছবির নাম: যাত্রাপথের শেষ

তা কখনও হতে পারে না। তাঁর শিল্পীসত্তার সিংহাসন সবার আগে। ‘আঁকিয়ে’ আর ‘লিখিয়ে’ অবনীন্দ্রনাথের মধ্যে কে কার আগে পরে, এই নিয়ে হয়তো অনেক বিতর্ক আছে, থাকবেও। তা সত্ত্বেও বলব ছবি লিখিয়ে অবিন ঠাকুরকেই সবার আগে রাখতে হবে আমাদের। দেখতে পাই, বিশ্বশিল্পের ইতিহাস যাঁদের মনে রেখেছে, তাঁরা কেউ স্থবির ছিলেন না, নিজেদের কাজ নিয়ে প্রতিনিয়ত পরীক্ষা নিরীক্ষায় মগ্ন থেকেছেন। একটা বিশেষ স্টাইল বা ভঙ্গিতে নিজেদের আটকে রাখেননি। এই ভাঙাগড়ার মধ্যে দিয়ে প্রতি মুহূর্তে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে চলাই সত্যকার শিল্পীর লক্ষণ। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় যাকে বলতে পারি সে নিজের ভাঁড়ার থেকে ক্রমাগত নিজেরই চুরি করা নয়। তাঁর মতে শিল্পীকে হতে হয় ‘আত্মবিদ্রোহী’, যে কিনা ‘আপন তুলির অভ্যাসকে ক্ষণে ক্ষণে ভাঙতে থাকে’– সেই রকম শিল্পীকেই সত্যিকার শিল্পী বলেছেন রবীন্দ্রনাথ।

অবনীন্দ্রনাথের কাজ প্রতি মুহূর্তে সেই উজ্জ্বল ভাঙাগড়ার দুর্জয় সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। তাঁর চিত্রজগতের প্রধান বাঁকগুলোর দিকে একবার তাকানো যাক। নতুন শৈলীর কাজে ‘কৃষ্ণলীলা’ থেকে ‘ভারতমাতা’ দিয়ে যার সূচনা, তার মধ্যে আছে ‘দি পাসিং অফ শাজাহান’- এর মতো ছবি, ‘ওমর খৈয়াম’ সিরিজ, ‘ফাল্গুনীর ছবি’, ‘গণেশজননী’ ‘উমা’ ‘সাজাদপুর’ চিত্রমালা, ‘অ্যারেবিয়ান নাইটস’ ‘মুখোশ’, রবীন্দ্রনাটক ও সাহিত্যের চরিত্রগুচ্ছ। আবার ‘কবিকঙ্কণ চন্ডী’, ‘কৃষ্ণমঙ্গল সিরিজ’ ইত্যাদি কাজও রয়েছে। এ ছাড়া সারাজীবনে অজস্র প্রতিকৃতি এঁকেছেন, যেগুলি তাঁর প্রথম জীবনে চিত্রশিক্ষার পশ্চিমী ধারাকে অবলম্বন করলেও একেবারে নিজের মতো করে গড়েপিঠে নেওয়া ছবি। 

Death of Shah Jahan_Abanindranath Tagore
ছবির নাম: শাজাহানের মৃত্যু

সব ছাপিয়ে জীবনের প্রান্তে এসে হেলাফেলার উপকরণ দিয়ে তাঁর বানানো ‘কুটুম-কাটাম’ যেন শিল্পী হিসেবে তাকে অন্য দিগন্তে পৌঁছে দিয়েছে। প্রথম জীবনের জটিল পদ্ধতির ‘ওয়াশ-টেকনিক’ থেকে শেষ বেলাকার সাধারণ উপকরণে তৈরি এই ভাস্কর্য যেন দিনান্তবেলায় নিজেকে শিশুর সরলতার দিকে নিয়ে যাওয়া। অবনীন্দ্রনাথের শিল্পীজীবন বলতে আমরা আলাদা করে কিছু ভাবতে পারি না। সমগ্র জীবনই তাঁর শিল্পের মধ্যে দিয়ে চলা, সে এক সহজিয়া সাধকের মতো। সার্ধশতবর্ষে দাঁড়িয়ে এমন শিল্পীর কাজের দিকে আমাদের আরও একবার চোখ মেলে তাকাতেই হবে।

sushobhan adhikary

বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী সুশোভন অধিকারী একইসঙ্গে শিল্প-ঐতিহাসিক এবং সংরক্ষক। একদা কলাভবনের ছাত্র হিসেবে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন। পরে সেখানেই তত্ত্বাবধায়ক পদে কর্মরত ছিলেন দীর্ঘকাল। বর্তমানের রবীন্দ্র-গবেষকদের মধ্যে তাঁর নাম অগ্রগণ্য। রবীন্দ্র চিত্রকলা নিয়ে রয়েছে বিশেষ অধ্যয়ন ও চর্চা। মাস্টারমশাই নন্দলাল নামে তাঁর লেখা বই পাঠকমহলে বহুল সমাদর পেয়েছে।

One Response

  1. অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিল্পের মূল্যায়ন করা সোজা নয়, তাঁর সারা জীবনের শিল্প চর্চা কে আমরা হয়তো শুধুই প্রণাম জানাতে পারি। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিল্পের মূল্যায়ন করা সোজা নয়, তাঁর সারা জীবনের শিল্প চর্চা কে আমরা হয়তো শুধুই প্রণাম জানাতে পারি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *