রাত দশটা। নন্দিনী কফিশপে একা বসেছিল। আনমনে কফির চিনিটা গোলাচ্ছিল। আজ বহু বছর এই সময়টা এখানেই কাটায় সে— যতক্ষণ না কাফেটা বন্ধ হচ্ছে। কিন্তু আজকের মতন এতটা অন্যমনস্ক সে কখনও থাকে না। আসলে একটু আগে যা ঘটে গেছে তা সম্পূর্ণভাবে তার কাছে অপ্রত্যাশিত।

এ তল্লাটে সবাই নন্দিনীকে চেনে, জানে তার মেডিক্যাল কন্ডিশনের কথা। নন্দিনীর এক অদ্ভুত অসুখ আছে। খুবই বিরল। জেরোডার্মা পিগমেন্টোসাম। সোজা বাংলায় বলতে গেলে সূর্যের আলোতে তার অ্যালার্জি। সেই ছোটবেলায় ধরা পড়ে এই অদ্ভুত অসুখ। বহু রকম চিকিৎসায় কোনও সুরাহা হয়নি। ছোট থেকে নন্দিনীর মা তাকে আগলে আগলে রেখেছিল, সে দিনে বেরোতো না। হোম-স্কুলিং হয়েছিল। নন্দিনীর রুটিনটাই অন্যদের থেকে আলাদা ছিল। তার কাজকর্মের জগৎ ছিল রাতের বেলা। সারা রাত জেগে কাজ করত, আর দিনে পর্দা টেনে, ঘর অন্ধকার করে ঘুমোতো। সূর্যের সাথে আড়ি করে, চাঁদের সঙ্গেই সই পাতিয়ে নিয়েছিল সে। আক্ষরিক অর্থেই সে ছিল নিশাচর।

আরও পড়ুন- গল্প: শিবার প্রতিশোধ

মা গত হওয়ার পর থেকেই ভীষণ একা হয়ে পড়েছিল নন্দিনী। বাবাকে তো কোন ছোটবেলায় হারিয়েছে, মনেই পড়ে না। সেভাবে কোনও বিশেষ বন্ধু কোনোদিনই হয়নি তার। তবে তার দৈনন্দিন ব্যবহারিক জীবনের সব কিছুরই ব্যবস্থা তার মা করে গেছিলেন। পাড়ার সবজি-বিক্রেতা থেকে মাছওয়ালা— সবাই নন্দিনীকে চেনে। পাড়ায় সবাই তাকে দিদি বলে ডাকে। বাড়িতেই সবজি, ফল, দুধ, মাছ ইত্যাদি পৌঁছে দেয়। সন্ধেবেলায় অবশ্য নন্দিনী বেরোয়, যতক্ষণ দোকান-বাজার খোলা থাকে, সে ঘুরে বেড়ায়।  আর শেষে এই কফি শপে এসে বসে, যতক্ষণ না কাফের ঝাঁপ বন্ধ হয়। কতরকমের লোকজন আসে— জোড়ায়-জোড়ায়, গ্রুপে… সে দূর থেকে তাদের দেখে। ভেসে আসা কথা শোনে। ভালো লাগে তার।

Window and Moon
সূর্যের সাথে আড়ি করে, চাঁদের সঙ্গেই সই পাতিয়ে নিয়েছিল সে

গত এক মাস থেকে একটি ছেলেও নিয়মিত আসছিল কফি শপে। তার মত সেও একাই একটা টেবিলে বসত। চোখে পড়ার মতন সুদর্শন, সম্ভবত বেশ অবস্থাপন্নও। অথচ সোবার। কিন্তু ঠিক সন্ধে আটটার সময় উঠে যেত। নন্দিনী লক্ষ্য করে দেখেছে যে ঠিক ঐ সময় একটা লাল রঙের বি এম ডব্লু গাড়ি এসে কফি শপ্‌টার সামনে হ্যাজার্ড লাইট অন করে দাঁড়াত। গাড়ির স্টার্টও বন্ধ হত না। আর অমনি ছেলেটিও কফিশপ্‌ ছেড়ে গাড়িতে উঠে বসত। 

বয়সের যা নিয়ম… বহুবার নন্দিনীর মনে হয়েছে ছেলেটার সঙ্গে গিয়ে একটু কথা বলে, ভাব জমায়। কিন্তু নিজের আড়ষ্টতা কাটাতে পারেনি। ছেলেটাও তার দিকে মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে বলে এক দু-একবার মনে হয়েছিল তার। পরে মনের ভুল ভেবে উড়িয়ে দেয়। বা, এমনও হতে পারে, সবাই যেমন নন্দিনীর ব্যাপারটা জানে, ছেলেটাও সেটা জেনেছে। আর তাই তাকে কৌতূহলবশত একটা ‘দেখার জিনিস’-এর মতোই আড়চোখে দেখছিল । 

দু সপ্তাহ আগে ছেলেটিই হঠাৎ এগিয়ে এসে প্রথম আলাপ করল— নমস্কার, আমি হন্সরাজ বসরা। হোপ্‌ দ্য সিট্‌ ইজ নট টেকেন ইয়েট,…মে আই…

নন্দিনী সপাটে উত্তর দেয়— ইট্‌ ওয়াজেন্ট টেকেন আন্টিল নাও, ইফ্‌ ইউ হ্যাভেন্ট নোটিশ্‌ড সিন্‌স লাস্ট ফিউ উইক্‌স… তারপর একটু হেসে বলল, বসুন।

— থ্যাঙ্ক ইয়ু। আপনি তো নন্দিনী!

— হ্যাঁ, আর আমি শিওর আমার ঠিকুজি কুষ্ঠি আপনার জানা হয়ে গেছে এতদিনে। সো প্লিজ আমার লাইফ্‌ হিস্ট্রি নিয়ে আপনি নিশ্চয়ই নতুন করে ইন্টারভিউ নিয়ে বোর করবেন না ।

— আপনি কি সব সময়ই এমন সিনিক্যাল, নাকি সন্ধে ছটার পর আপনার ব্যাড হেয়ার ডে, থুড়ি, ব্যাড হেয়ার নাইট্‌ শুরু হয়?

Girl in coffeeshop

দুজনেই অল্প হেসে ওঠে প্রথম আলাপে। নন্দিনী বলে— আপনার নাম শুনে তো বাঙালি বলে মনে হয় না, অথচ ‘থুড়ি’ বলছেন এবং উচ্চারণ শুনে অন্য রাজ্যের বলেও মনে হচ্ছে না।

— হংসরাজ বললে বোধহয় ষোলোয়ানা বাঙালি হওয়া যেত! মুচকি হাসে ছেলেটি। —ঠিকই বুঝেছেন, আমি জন্মসূত্রে পাঞ্জাবি। তবে সেই আড়াই মাস বয়েস থেকেই কলকাতাতে আছি, সুতরাং…

অল্প সময়ের মধ্যেই তাদের আলাপ জমে ওঠে। দুজনেরই সেন্স অফ্‌ হিউমারটা একই ধাঁচের। কিছুক্ষণ আড্ডার পরেই আরও কিছু একই রকম ভালোলাগা বেরিয়ে পড়ে— সাহিত্য, সিনেমা, এল্ভিস প্রেসলির গান ইত্যাদি। এর পর থেকে রোজই সন্ধের এই দু-ঘণ্টার একটা নিয়মিত আড্ডা শুরু হয় দুজনের মধ্যে। নন্দিনী জানতে পারে হন্সরাজও তারই মতন ফ্রিল্যান্সিং-এর কাজ করে। সব থেকে ভালো লাগে হন্সরাজ কখনও তার মেডিক্যাল কন্ডিশন নিয়ে অকারণ বেশি কৌতূহল দেখায় না। তবে নন্দিনী লক্ষ্য করেছে হন্সরাজের কথা বলার সময় কোথাও যেন অল্প অসুবিধে আছে। প্রথমে মনে হয়েছিল, বাংলায় অনভ্যস্ত উচ্চারণ করার জন্য তা হচ্ছে। পরে খেয়াল করল ইংরাজি বা হিন্দি কথা বলাতেও কেমন অল্প শ্বাসের কষ্ট আছে। হয়ত বা কোনও স্পিচ-ইস্যু আছে বলে ধরে নিয়েছিল নন্দিনী, আলাদা করে কিছু জিজ্ঞেস করেনি।

man woman chat
দুজনেই অল্প হেসে ওঠে প্রথম আলাপে

এইভাবে বেশ চলছিল। এর পর হঠাৎ দু’দিন হন্সরাজের কোনও পাত্তা নেই। আজ নন্দিনীর কাফেতে ঢুকতে ঘণ্টাখানেক দেরি হয়েছিল। হন্সরাজের অনুপস্থিতিটা কেমন যেন কাফের আকর্ষণটাই হঠাৎ কমিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আজ কাফেতে ঢুকেই দেখে হন্সরাজ আগে থেকে বসে আছে। মুখটা কেমন বিষণ্ণ, চেহারাতেও ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট।

— অল ওকে? — স্বভাবতই উদ্বিগ্ন নন্দিনী ।

— বস। কিছু কথা বলার আছে তোমাকে— চাপা স্বরে বলে হন্সরাজ। গত কয়েকদিন হল তারা আপনি থেকে তুমি সম্বোধনে উপনিত হয়েছে।

নন্দিনী বসে। ওয়েটার তাদের নিয়মিত অর্ডার, দুটো ক্যাফে মোকা টেবিলে দিয়ে যায় । 

হন্সরাজ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শুরু করে— কী বলি তোমায়! কোথা থেকে যে শুরু করি!… তারপর স্মিত হেসে বলে, বরং একটা রূপকথার গল্প দিয়ে শুরু করি।

— কাম্‌ ডিরেক্টলি টু দ্য পয়ন্ট, হন্স, তুমি আমাকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছ। 

— শান্ত হও, নন্দিনী… এই গল্পের অবতারণার দরকার আছে জটিল বিষয়টা সহজ করে বোঝাতে। 

অগত্যা চুপ করে থাকে নন্দিনী।  

— এটা একটা অনেক পুরনো ইউরোপিয়ন রূপকথা। হান্স বলে এক নাইটের প্রেমিকা ছিল এক জলপরি, যার নাম ছিল আন্ডিনি।

— ভেরি ফানি, নন্দিনী ফুট কাটে — নামের মিল রেখে গল্প ফাঁদছ?

— না, না। সিরিয়াস্‌লি এটার বিভিন্ন রকমফেরে নানারকমের লোকগাথা আছে। কোথাও নাইটের নাম হুল্ডব্র্যান্ড আর পরির নাম উন্ডাইন, আবার কোথাও নাইটের নাম হান্স আর পরির নাম ওন্ডিন। কিন্তু মোদ্দা গল্পটা এক। 

— বেশ শুনি।

— এই হান্স আর আন্ডিনির এক চুক্তি হয়েছিল যে কখনও যদি হান্স আন্ডিনিকে ধোঁকা দেয়, তাহলে তার প্রাণনাশ হবে।

— তো, ধোঁকা আর প্রাণনাশ হল?

— হল। হান্স রাজকন্যা বার্থার প্রেমে পড়ল। জলপরি আন্ডিনি পালিয়ে যাওয়ারও চেষ্টা করেছিল, যাতে তার জন্য হান্সের চুক্তির শর্ত মেনে অভিশাপ না লাগে। কিন্তু একটা জেলে মাছ ধরতে গিয়ে আন্ডিনিকে ধরে ফিরিয়ে দিল, আর অমনি সেই অভিশাপে হান্স শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল।

mermaid-Myth
জলপরি আন্ডিনি পালিয়ে যাওয়ারও চেষ্টা করেছিল

— হুঁম্‌, আই ডোন্ট লাইক ট্র্যাজেডিস্‌। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল নন্দিনী। 

কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা

তারপর ধরা গলায় হন্সরাজ বলল— লাইফ ইজ্‌ আ কমেডি অন দ্য কন্ট্রারি। একটু থেমে হঠাৎ নন্দিনীর হাতটা ধরে বলল— আমরাই পারি এটাকে কমেডি করতে। তোমার সাথ লাগবে আমার বন্ধু।

ঘটনার আকস্মিকতায় নন্দিনী একটু হক্‌চকিয়ে গেছিল। কিছু বলার আগেই, হন্স আবার বলল— তুমি আজ বড্ড দেরি করে এসেছ… আমাকে এবার যেতে হবে। কিন্তু তুমি প্লিজ কাল আমার বাড়ি একবার এস। এই গল্পের অবতারণার কারণ তোমাকে বলতেই হবে। কিন্তু এখন যে আমাকে যেতেই হবে। কাল ঠিক এই সময় কাফেতে আমার গাড়িটা তোমার জন্য ওয়েট করবে। ড্রাইভার তোমাকে আমার বাড়ি নিয়ে যাবে। আমি আর এখানে কাল আসব না।

নন্দিনী দেখল বাইরে সেই বি এম ডব্লু গাড়িটা এসে হ্যাজার্ড লাইট অন করে দাঁড়িয়ে আছে। হন্স উঠে দাঁড়িয়ে, ক্লান্ত পায়ে গাড়ির দিকে এগোল।

নন্দিনী সেই থেকে এরকম থম্‌ মেরে বসেছিল। হন্স কী বলতে চাইল? কী চুক্তি বা অভিশাপের ইঙ্গিত দিল? হন্সকে এত ক্লান্তই বা লাগছে কেন? গত দু’দিন সে আসেনি কেন? তার কী সাহায্য লাগবে? সাত-পাঁচ কিছুই ভেবে পাচ্ছিল না নন্দিনী।

Red Bmw
নন্দিনী দেখল বাইরে সেই বি এম ডব্লু গাড়িটা এসে হ্যাজার্ড লাইট অন করে দাঁড়িয়ে আছে

সারা রাত আর কোনও কাজেই তার মন বসল না। দিনের বেলাতেও ভালো ঘুম হল না। ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখল, হন্স ঠিক করে নিঃশ্বাস নিতে পারছে না, আর হাত বাড়িয়ে তার কাছে সাহায্য চাইছে। সে নিজে পরির মতন বসে আছে। কিন্তু তার একটা ডানা কাটা হয়ে পড়ে আছে, তাই সাহায্য করতে পারছে না। 

ঘুম ভেঙে গেছিল। নন্দিনীর রুমটা সাউন্ড-প্রুফ। তাই কর্মব্যস্ত দিনের শব্দ-আওয়াজ ঘরে ঢোকে না। পর্দা দেওয়া জানলা দিয়ে দিনের আলোও ঢোকে না। কিন্তু এই প্রথম তার খুব আফশোস হল এই বিপরীত জীবনের নিয়মে। খুব ইচ্ছে করছিল কীভাবে হন্সকে সাহায্য করা যায়… কিন্তু স্বাভাবিক নয় যে তার জীবন। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগল সন্ধ্যার, যখন হন্সের ড্রাইভার তাকে নিয়ে যাবে হন্সের বাড়িতে। 

সময়মতোই গাড়ি পৌঁছে গেল নন্দিনীকে পিক্‌ আপ করতে। সল্টলেকে বেশ বড় বাড়ি বসরাদের। তবে লোক বেশি নেই বলেই মনে হল। পরিচারক দরজা খুলে দিয়ে নন্দিনীকে ভেতরে বসতে বলল। বাড়ি-গাড়ি দেখেই বোঝা যায় বেশ পয়সাওয়ালা লোক ওরা। পুরো বাড়িটায় আভিজাত্যের ছাপ স্পষ্ট। পরিমিত রুচিশীল সজ্জায় সাজানো— মেঝেতে পার্সিয়ান কার্পেট, চারিদিকে দামি সেগুন কাঠের কারুকার্য করা আসবাব, এমনকি জানলা দরজার পর্দাগুলোও দামি পলি-রেসিন ডবল-স্টিচ করা। শুধু একটা ঘরের পর্দা কেমন হাসপাতালের মতো একরঙা সবুজ। সেই ঘরের ভিতর থেকেই হালকা গান ভেসে আসছে। এল্ভিস্‌ প্রেসলির– 

ওয়াইজ্‌ মেন সে,
ওনলি ফুল্‌স রাশ ইন,
বাট আই কান্ট হেল্প ফলিং ইন লাভ্‌ উইথ্‌ ইয়ু…

একটু পর পরিচারক এসে বলল— ম্যাডাম, ছোটেবাবু আপনাকে ঘরে নিয়ে যেতে বললেন। নন্দিনী তাকে ফলো করে সেই সবুজ পর্দা দেওয়া ঘরে ঢুকেই চমকে উঠল। একি! এ যেন একটা ছোটোখাটো হাসপাতালের রুম। বিভিন্ন রকমের মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি, অক্সিজেন সিলিন্ডার, বেডটাও দুদিকে রেলিং দেওয়া। সেখানে শুয়ে আছে হন্স।

woman sleeping
দিনের বেলাতেও ভালো ঘুম হল না

— কী হয়েছে তোমার হন্স? দৌড়ে যায় নন্দিনী।

ক্লান্ত হাসি অধরে আটকে হন্স বলে, কিছুই না বন্ধু, শুধু ঘুমোবার প্রস্তুতি। এত বিচলিত হয়ো না। তোমাকে সবটা বলব বলেই এখানে ডাকা। বসো। 

নন্দিনী কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মতন আজ্ঞাবহ হয়ে বসে পড়ে। 

হন্স শুরু করে— তোমার মতন আমারও একটি বিচিত্র অসুখ আছে। এটা স্লিপ-অ্যাপনিয়ার একটা এক্সট্রিম কন্ডিশন। মেডিক্যাল ভাষায়, সেন্ট্রাল হাইপোভেন্টিলেশন সিনড্রোম। সেই রূপকথার গল্পের থেকে ধার করা এর একটা সহজ নাম আছে— ওন্ডিন্‌স কার্স। আমি স্বেচ্ছায় নিঃশ্বাস নিতে পারি শুধু দিনে, কিন্তু রাতে নয়। একবার ঘুমিয়ে পড়লে আমার স্বাভাবিক নিঃশ্বাস প্রক্রিয়া আর কাজ করবে না। তাই কৃত্রিমভাবে একটা মাস্ক্‌ পরিয়ে, একটা ভেন্টিলেটর মেশিনের সাহায্যে আমার শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঘুমোনোর সময় আমার ব্লাড প্রেশার, হার্ট রেট সব কিছু মনিটর্ড থাকে। নার্স থাকে। হঠাৎ যদি ঘুমের ঘোরে সিজার হয়, কখন বুঝি চিরতরে ঘুমিয়ে পড়ি— হন্স ম্রিয়মাণ হাসে।

কিছুক্ষণ সবাই চুপ। নন্দিনী ঘটনার আকস্মিকতায় স্বাভাবিকভাবেই বিহ্বল। হন্স আবার শুরু করে— আমার জন্মানোর পরে ডাক্তারেরা বলেছিল বড় জোর ছ’সপ্তাহ বাঁচব। কিন্তু আমার মা’র অক্লান্ত উদ্যোগে আর বাবার টাকাপয়সার জোরে আমি এখনও বেঁচে। মা অবিশ্যি গত হয়েছেন আজ পাঁচ মাস হল। তাই এখন আমি মূলত রাতের ১০ ঘণ্টা নার্সের করুণায় এখনও শ্বাস নিচ্ছি । 

sickbed
কখন বুঝি চিরতরে ঘুমিয়ে পড়ি!

হন্স আবার একটু থামে। তার গলা ভারি হয়ে এসেছে। তারপর রুমে থাকা নার্সকে বলে নন্দিনীর জন্য একটু চা করে আনতে। নন্দিনী আপত্তি জানায়, কিন্তু হন্স ইশারায় বোঝায় সে এই সুযোগে একা কিছু বলতে চায় নন্দিনীকে। আজকাল তারা নিজেদের ইশারাও খুব ভালো বুঝতে শিখেছে। নার্স বেরিয়ে গেলে, হন্স একটু বসার চেষ্টা করে। নন্দিনী এগিয়ে যায় সাহায্য করতে। নন্দিনীর হাতটা মুঠোর মধ্যে ধরে ভারী গলায় হন্স বলে— তুমি আমার রাতের বন্ধু হবে? আমরা একে-অন্যের পরিপূরক হতে পারি। এই নার্সদের হেফাজতে থাকতে আমার ভরসা বা ভালো কোনোটাই লাগে না। ক’দিন আগেই একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে গেল। আমি আরও বাঁচতে চাই নন্দিনী। জীবন বড় সুন্দর। তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর আরও সুন্দর লাগছে। তাই তুমি রাতে আমার সাথে থেকো, আর দিনে আমি তোমার জন্য থাকব। তোমার দিনের কাজ আমি সব করে দেব। পারবে? পারবে এই হন্সের ওন্ডিনি হয়ে উঠতে? 

— পারব, আমি পারব, হন্স। চোখের কোনা থেকে জল গড়িয়ে পড়ে নন্দিনীর। হন্সের কপালে হাত বুলিয়ে দেয়।
— আজ রাত থেকেই আমি রয়ে যাচ্ছি। কয়েকটা রাত তো লাগবে নার্সদের কাছে সব কিছু শিখে নিতে। 

হঠাৎ করেই সব কিছু ঠিক হয়ে যায় যেন। একটু পরে পরম নিশ্চিন্তে হন্স ঘুমিয়ে পড়ে। নন্দিনী এক পলকে চেয়ে থাকে হন্সের দিকে। হন্স যেন এক নিষ্পাপ শিশু। ঘুমোলে সবাইকেই কি এতটা পবিত্র দেখায়? মনে মনে ভাবে সে। ওদিকে এল্ভিস প্রেসলির পরের গান তখন শুরু হয়েছে—

মাই হার্টস্‌ অ্যাট ইওর কম্যান্ড ডিয়ার
টু কিপ্‌, লাভ এন্ড টু হোল্ড
ম্যেকিং ইউ হ্যাপি, ইজ মাই ডিজায়ার
কিপিং ইউ ইজ মাই গোল।।

 

 

*ছবি সৌজন্য: Wallpaper flare, pexels, Needpix, Freepic

Kuhoki alias Souvik Maiti

‘কুহকী’ তাঁর ছদ্মনাম। এ নামেই প্রকাশিত হয়েছে “একলব্য অতঃপর ও অন্যান্য গল্প" বইটি, যা পাঠকের ভালোবাসা পেয়েছে। কুহকীর জন্ম ১৯৭৫-এ কলকাতায়। আইআইটি থেকে ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার, বর্তমানে একটি বহুজাতিক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় কর্মরত। বিজনেস ম্যানেজমেন্ট পেশা হলেও দেশবিদেশের সিনেমার বিশেষ অনুরাগী। নেশা, সাহিত্যচর্চা ও ছবি আঁকা।

2 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *