বাঙালি পরিবারের বাবা’রা যেমন হয়, ঠিক তেমনই ছিলেন আমার বাবা। তিনি যে তখনকার কালে বেশ অন্য রকম পেশার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার খাতিরে সেলেব্রিটিদের সঙ্গে মেশামিশি করতেন, এ কথা বুঝতে পারিনি। আমার বাবা যে ফোটোগ্রাফার সে কথা বুঝলাম গুপী গাইন বাঘা বাইন সিনেমা দেখতে গিয়ে। প্রথম দিন বিজলী সিনেমায় আমরা সবাই ভাই বোনেরা গুপীবাঘা দেখতে গেলাম। তখন বুঝলাম বাবা ফোটোগ্রাফি করেন। এবং ওঁকে নিয়েও একটু-আধটু মাতামাতি চোখে যে পড়েনি তা নয়। কিন্তু এই টুকুতেই সীমাবদ্ধ। তিনি যে পরিচালকের ছবি তুলে নজর কেড়েছেন, এ সব আমাদের ধারণার মধ্যেই ছিল না। তবে বাবা সত্যিকারের নাম করেছিলেন বা বলা যেতে পারে বিশ্বের দরবারে নিজের স্থান করেছিলেন যখন লন্ডন থেকে প্রকাশিত বিখ্যাত ফিল্ম পত্রিকার “সাইট অ্যান্ড সাউন্ড”-এ ওঁর ছবি প্রকাশ পায় ও ওই পত্রিকা তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করে।
মানিক জেঠু, আমার বাবার সঙ্গে যাঁর নাম একসঙ্গে উচ্চারিত হয়, তাঁকে আমি প্রথম দেখি ৬ই মার্চ ১৯৭১, আমার কাকার বউভাতের দিন। খুবই লম্বা এক জন মানুষ, একটি সাধারণ কাঠের চেয়ারে বসে রয়েছেন। হাতে সিগারেট এবং সেই সিগারেট ২/৩ ভাগ পুড়ে সিগারেটের মুখেই সেই লম্বা ছাইটা আটকে রয়েছে। উনি ফেলেননি। আমিও চোখের পাতা ফেলিনি। ফ্রেম করছিলাম বোধ হয়। আসলে আমাদের বাড়িতে তখন যাঁরা আসতেন, তাঁরা আমাদের কাছে বিশেষ সেলেব্রিটি বলে আসতেন না। পারিবারিক সম্পর্কেই আসতেন। আত্মীয়তা গড়ে উঠেছিল। আমাদের বাড়ির সরু গলিতে কোনওদিন গাড়ি ঢোকে না। সেই গলি দিয়ে পায়ে হেঁটে মানিকজ্যেঠু আসতেন ভবানীপুরের এই বাড়িতে। তখন আমি ফোটোগ্রাফি পুরো দস্তুর শুরু করেছি, একবার দেখি অভিনেতা অনিল কাপুর আমাদের রকে বসে আড্ডা মারছেন (“কাঁহা কাঁহা সে গুজার গায়া” ছবির শুটিং-এর জন্য এসেছিলেন কলকাতায়, তখন বাবার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন)। আমার নিজের চোখে দেখা, একদিন ভোর বেলায় অমিতাভ বচ্চন আর জয়া ভাদুড়ি গাড়ি নিয়ে এসেছিলেন বাবাকে পিক আপ করতে। সঙ্গে রবি ঘোষ, আমার রবি জেঠু। সবাই এক সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গিয়েছিলেন। তাই আমাদের বাড়ির আবহে এঁরা আর পাঁচ জন মানুষের মতোই যাতায়াত করতেন। এবং তাই বোধ হয় আমার বাবা সেলেব্রিটি এবং তাঁর চারপাশে যাঁরা ঘোরাফেরা করেন, তাঁরা আলোয় মোড়া, এ ভাবনা কোনও দিন স্থান পায়নি। কারণ বাবা জীবনটাকে খুব আটপৌরে রাখতে চেয়েছিলেন। আর শিল্পটাকে রাখতে চেয়েছিলেন সেলেব্রিটি করে।
আমার ফোটোগ্রাফির শখ খুব ছোট্ট বেলা থেকেই, কিন্তু বাবার কড়া নির্দেশ ছিল, গ্র্যাজুয়েট না হওয়া পর্যন্ত ফোটোগ্রাফির পেছনে দৌড়নো চলবে না। অথচ আমি দেখেছি বাবা দাদার হাতে দু-একবার ক্যামেরা দিয়েছেন, কিন্তু আমার হাতে দেননি। কারণ আমার সব কিছুর স্ক্রু খুলে ফেলার বিশেষ প্রবণতা ছিল। আমার বেশ মনে আছে, যে দিন গ্র্যাজুয়েশন পরীক্ষা শেষ হল, সব বন্ধুরা মজা করতে, সিনেমা দেখতে ব্যাকুল। আমি ঠায় বাড়ির গলির মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছি কখন বাবা আসবেন, আর আমাকে অফিশিয়ালি জ্যোতিষ জেঠুর হাতে তুলে দেবেন। আগে আমি জ্যোতিষ জেঠু মানে বিখ্যাত ফোটোগ্রাফার জ্যোতিষ চক্রবর্তীর স্টুডিয়োতে গিয়েছি, কিন্তু বাবা পছন্দ করতেন না। আমাকে ওখানে দেখলে বাড়ি এসে বকতেন। সেই অমোঘ চেতাবনি—গ্র্যাজুয়েশন।
এর পর যখন আমি ফোটোগ্রাফিকেই নেশা ও পেশা করলাম, তখনও যে বাবা আলাদা করে হাতে ধরে কিছু শিখিয়েছেন, তেমনটা নয়। কিন্তু ওঁর সঙ্গে ছায়ার মতো লেগে থাকতে থাকতেই সব কিছু শিখেছি। প্রফেশনাল ষ্টুডিও হওয়ার পর আমার নিয়মিত একটি কাজ ছিল, বাবার সমস্ত ফিল্ম প্রসেস করে প্রতি দিন রাত্রে বাবার ঘরে রেখে আসা। বাবা হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছেন। কিন্তু আমি ঘরে প্যাকেট হাতে ঢুকলে ঠিক উঠে পড়ে পুরো রোলটা এক্সপোজ হয়েছে কিনা সেটা দেখে রেখে দিতেন। হয়তো খুঁটিয়ে তখনই দেখতেন না, কিন্তু যাচিয়ে নিতেন। কেন? কারণ ছবির ব্যাপারে উনি অতি সাবধানী ছিলেন। প্রতিটি ফিল্ম রোলই তার কাছে সন্তান সমান। যদি কোনও দিন ষ্টুডিওতে আগুন ধরে যায় বা কোনও দুর্ঘটনা ঘটে, সেই আতঙ্কে কখনও ফিল্ম প্রসেস হওয়ার পর স্টুডিয়োতে রাখতেন না। এই প্রসেস করতে করতে আমার কত কিছু পাওনা হয়েছে বলে শেষ করা যাবে না। সিটি অব জয়, সিনেমার ভারতের অংশের জন্য আমি ফিল্ম প্রসেসার হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলাম। রীতিমতো যোগ্যতার পরীক্ষা দিয়ে তবে সেই কাজ পাওয়া গিয়েছিল। সেই সব সময় শিখেছি অনেক। এমন হয়েছে, বাবার হয়ে আমি এক বার আলো করে দিয়েছি, সব ব্যবস্থা হয়ে যাওয়ার পর বাবা ছবি তুলেছেন। ছবি তোলার আগে পোলারয়েড-এ তুলে দেখে নিয়েছি যে আলো কেমন উঠল। সেখানে উপস্থিত ছিলেন ভারতবর্ষের এক জন বিখ্যাত সিনেমাটোগ্রাফার, অশোক মেহতা। পিঠ চাপড়ে আমায় বলেছিলেন, বাহ! বেটা বহুত আচ্ছা লাইট কিয়া। আবার আমার অ্যাসাইনমেন্ট। ক্লায়েন্ট জিজ্ঞেস করেছে, “শুটিং-এ নিমাই ঘোষ থাকবেন তো?” জবাবে বলেছি, “আপনি চাইলে বাবাকে রাখতে পারি। কিন্তু শাটারটা আমিই টিপব।” এতে আমি অনেক ক্লায়েন্ট হারিয়েছি। কিন্তু আমাদের মিউচুয়াল একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং ছিল।
অনেক সময় বাবার সঙ্গে মন কষাকষি হত। আমি কী কী ধরনের ছবি তুলছি, সেই সব নিয়ে বাবার সঙ্গে আলোচনাও হত আর মতান্তরও। কিন্তু ফের আবার কাজ শেখার জন্য, কাজের সমালোচনার জন্য আমি আর বাবা সাধারণ ভাবেই আলোচনা করতাম। ছবি তোলা নিয়ে একটা ঘটনার কথা বলি। আমার বাবা পছন্দ করতেন না যে আমি বিয়েবাড়ির ছবি ফ্ল্যাশগান ব্যবহার করে তুলি। একদিন, আমি জানি বাবা বাড়িতে নেই, আউটডোর শুটিং-এ গেছেন। তাই বিয়েবাড়ির একটা অ্যাসাইনমেন্ট নিয়েছি বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে। আমাদের বাড়ির নিচের ঘরে আমার ছোটকাকা শুতেন। রাত্রে দরজার কড়া নাড়ার শব্দ শুনে ছোটকাকা ভেবেছেন আমি এসেছি। বাড়িতে আমার ডাকনাম দিলু, তাই আমার নাম ধরে ডেকেছেন।
বাইরে থেকে সাড়া এল, “না, আমি নিমাই।”
দরজা খুলতেই বাবা বাড়ির ভেতরে ঢুকে জিজ্ঞেস করলেন “দিলু এখনও বাড়ির বাইরে ?”
ছোটকাকা বললেন, “ও ছবি তুলতে গেছে। ”
– “নিশ্চই তাহলে বিয়েবাড়ির ছবি তুলতে গেছে, নইলে এতো রাত্তির হয় ?”
সকলেই বুঝতে পারলো যে বাবা রেগে গেছেন। আমার বোন ওপরে ঘরে গিয়ে বাবাকে সামলাচ্ছে। এবার বোন জেগে রয়েছে যে দাদা কখন বাড়ি ফেরে। এদিকে খাওয়া দাওয়া সেরে বাবা শুতে গেছেন। আমি জানতাম, যখন আমি বাড়ি ফিরব, তখন অনেক রাত হয়ে যাবে আর বাবা তখন নাক ডেকে ঘুমোচ্ছেন। তখন রাত দুটো বাজে। তাই বাড়ির গেটের সামনে এসে এমন ভাবে দরজার কড়া নাড়লাম যাতে বাবার নাক ডাকার শব্দের চেয়েও কম আওয়াজ হয়। কড়া নাড়ার শব্দে যেন বাবার ঘুম না ভেঙে যায় আর আমি না ধরা পরে যাই। আমার বোন আস্তে আস্তে পা টিপে এসে দরজাটা খুলে দিয়ে বলল যে বাবা রেগে ফায়ার। প্রচন্ড বকাবকি করেছেন।
পরদিন সকাল। সাড়ে ন’টার সময় বাবা নিচের ঘরে বসে আছেন। রোজকার মতন যথারীতি এসেছি বাবার সঙ্গে দেখা করতে। আমি কিন্তু সাধারণ কথাবার্তাই বলতে লাগলাম, গত রাত্রের সেই বিয়ে বাড়ির প্রসঙ্গে একটি কথাও তুললাম না। এটাও আমাকে শিখতে হয়েছে কি করে বাবার মতো একজন রাগী মানুষকে আমি ফেস করবো ?
ফটোগ্রাফি – ডিজিটাল না অ্যানালগ এই নিয়ে বাবা আজীবন ওঁর মত পোষণ করে গেছেন। উনি কিন্তু সব সময় অ্যানালগ ক্যামেরা নিয়েই কাজ করে গেছেন। নিজের মত থেকে সরে আসেন নি। জীবনের শেষ কয়েক মাস ছাড়া তিনি আজীবন, ঘরে ও বাইরে ফোটোগ্রাফারই ছিলেন। গত সেপ্টেম্বর মাসে আমি যখন এলাম, তখন ওঁর ক্যামেরাগুলো আমায় দিয়ে দিচ্ছিলেন। হঠাৎ বললেন, “একটা ক্যামেরা আর দুটো লেন্স রেখে যাও। আমি ছবি তুলব।” আমি বেশ জোরের সঙ্গেই প্রশ্ন করলাম, তুমি এখনও ছবি তুলবে ? বলল – “হ্যাঁ।” আমি তার উত্তরে কিছু বলিনি। কিন্তু গত ডিসেম্বরে অপারেশন হওয়ার পর বললেন, “ক্যামেরা, লেন্স—সব নিয়ে যাও। আর ছবি তুলতে পারব না।” শুনে আমার ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠেছিল। হাওয়া-বাতাস ছাড়া কি মানুষ বাঁচে?
বাবার জীবনে একটাই আক্ষেপ থেকে গেছিল। তাঁর ছবিগুলো ইন্টারনেটে ছেয়ে গিয়ে বড় বাজারি হয়ে গিয়েছে। তাঁর যে এক্সক্লুসিভিটি, সেটা চলে গিয়েছে। উনি যে ভাবে ক্রনিকল করেছিলেন, সেটা সত্যই কুর্নিশযোগ্য। বাবার মত ছাড়া তো এক সংস্থা মানে বড় ইনস্টিটিউশন, নামী কলেজ একটা ক্যালেন্ডার ছাপিয়ে দিল। এ সব কি উচিত কাজ? প্রশ্ন করা হলে গণ্যমান্য ব্যক্তি আড়াল করলেন কয়েক জনকে। তিনি আবার প্রিন্সিপাল। বাচ্চাদের তা হলে উনি কী শিক্ষা দিলেন? শিল্পের আর শিল্পীর অমর্যাদা করতে?
শেষে একটা কথা বলি, বাবা তো বহু বিখ্যাত অভিনেতা, অভিনেত্রী, মডেল—সবার দুর্দান্ত সব ছবি তুলেছেন। কিন্তু বাবার প্রিয় মডেল কে জানেন? মানিক জেঠু। না, মানিক জেঠু বিখ্যাত পরিচালক কিংবা বাবার ঘনিষ্ঠ বলে নয়, মানিক জেঠুর মতো ফিচার, তাঁর অমন লম্বা গলা, তাঁর ভঙ্গিমা—বাবার ভাষায়, রেয়ারেস্ট কম্বিনেশন। বাবা মডেল সত্যজিৎ রায়ের ছবি তুলে সবচেয়ে বেশি তৃপ্ত হয়েছেন।
পেশায় ফোটোগ্রাফার। ছক বেঁধে শেখেননি কারও কাছে। তবে বিখ্যাত ফোটোগ্রাফার জ্যোতিষ চক্রবর্তীকে গুরু মানেন। বাবা নিমাই ঘোষ-এর ছত্রচ্ছায়ায় শিখেছেন অনেক কিছু। পেশায় বিজ্ঞাপনের ছবি তুললেও বালবাসের মানুষের ছবি তুলতে আর সেই ছবি দিয়ে মাুষের গল্প বলতে। জগদ্বিখ্যাত ফোটোগ্রাফার অঁরি কার্তিয়ে ব্রেসোঁ-র কাছ থেকে প্রশংসা আদায় করেছেন। পেয়েছেন স্পাইডার ও পিএক্স-৩'এর মতো নামকরা সব পুরস্কার।
Khub bhalo laglo lekha ta porre. Tomader Bhabanipurer barite anekbar gechhi. Nicher oi bosar ghore Satyaji Ray er oi look through kora chhobi ta rakha chilo , tomar babar tola.
অপেক্ষায় ছিলাম। ধন্যবাদ।
আরও অনেক বিস্তারিত বড়ো লেখার আশায় রইলাম।
Aro janar ichcha roilo..
Sesh hoi ao hoilo Naa sesh.
খুব ভালো লাগল ।
Khub bhalo lekha. Chhue gelo. Nimai babur oi ektalar ghare amio giechhi. Takhan ami sabe chhobi tulte shuru korechhi. Unar hate tola amar didi r chhobi roechhe amader album e. Amrao thaktam bhowanipur e, shyamanada road e. Amar baba r bandhu circle e chhilen uni.
Beautiful piece of writing that sheds light on some totally unknown aspects of Nemai Babu’s personality. I knew him quite well but never knew this side of his character. Not many celebrities are as grounded as he was.
কি সুন্দর নিরপেক্ষ একটা লেখা। লেখাটার সবচেয়ে বড় গুণ আটপৌরে গদ্য। সহজ সরল স্বচ্ছ। আসল নিমাইদাকে বুঝতে পারা।
নিমাইদার সঙ্গে অনেক বছরের আলাপ, কিন্তু নিকটজনদের কখনও তাঁর বিশালত্বটা বুঝতে দিতেন না।
সাত্যকি, এই লেখাটাকে একটা গ্রন্থের রূপ দেওয়া যায় না ??
অজানা কিছু কথা জানলাম,
SIR..anek kothai mone pore…aj jekhane achi ta apnar jannoi…je confident professonally amar kaj ta kori ta apnar kach thekei sikhechi ba peachi..Nemai Sir,ke prothom dekhi apnar focus studio te..apni amake parichoy koriea dieachilen je apnar kache kaj sikhte eseche..Nemai Sir bolechilen BAHLOBESE karo jai korbe…ekhono amar mone a oi kothata ..
Sir.. Bhalobasar sathe sathe eta amar professionn o duna te tike thakar jannyo …. Anek bar Nemai sir er stahe amar kotha hoeche kintu sahos kore onar je chobi tulbo seta hoy ni karon Nemai sir ke dekhlei amar khub bhoy hoto karon onar personality ebong sound chilo Paharproman…amar sathe kotha bolten amar sikhha kemon hochhe…anek kichu mone pore…Nemai Sir ke last dekhi Ekbalpur Nursing Home e….ami gehilam amar Ma ke niea Doctor ke dekhate..Ekhono mone ache sedin kar kotha aro anek kotha..