‘আফগানদের সামনে দুটো রাস্তা আছে- হয় নিজেদের মধ্যে শান্তিতে বিবাদ মেটাতে হবে, না হলে ন্যাটো ফৌজ চলে গেলেই দেশে ফের গৃহযুদ্ধ বাঁধবে।’
আবু বকর সিদ্দিকী (দ্য পাশতুন’স) 

– কোথায় যাবেন এবার?

উমিদ আবদুল্লায়েভ কেমন যেন অসহায়ভাবে তাকিয়ে রইলেন কথাটা শুনে। এই উজবেকের কপালের বলিরেখার স্তর তাঁর ফেলে আসা আশিটা বসন্তের জানান দিচ্ছে। কোনওদিনও কুন্দুজের বাইরের পৃথিবীটা তাঁর দেখা হয়নি। আর আজ, দেশজুড়ে এমনই আগুন জ্বলেছে, যে চোদ্দোপুরুষের ভিটে ছেড়ে এক কাপড়ে তিনশো কিলোমিটার পাহাড়ি পথ উজিয়ে, ছ’বছরের নাতনি আসমার হাত ধরে তিনি এসে দাঁড়িয়েছেন কাবুলের এক পার্কে। কুন্দুজের সম্পন্ন ব্যবসায়ী উমিদের কাবুলে এখন একটাই পরিচয়- তিনি শরণার্থী। নিজভূমে পরবাসী।

নিজের জানের মায়া করেন না উমিদ। আল্লার দয়ায় অনেক ক’টা বছর তিনি হিন্দুকুশের কোলে জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু আসমা? সে তো ছ’বছরের শিশু। তার তো সারাজীবন পড়ে আছে! অথচ কী গ্রহের ফের! যে আতঙ্কের হাত থেকে বাঁচতে তিনি উত্তর আফগানিস্তানে তাঁর সাত পুরুষের শহর ছাড়লেন, সেই আতঙ্ক তো কাবুলেও চলে এসেছে। এবার কী হবে? নাতনিকে নিয়ে যাবেন কোথায়? ১৫ অগস্ট কাবুলের রাজপথে যখন তালিবানদের হামভির কনভয় ঢুকছে, তখনই এই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে বৃ্দ্ধ উজবেকের মাথায়।

কোথায় যাব এ বার?

কুন্দুজ থেকে কাবুল

আদতে উত্তরটা আব্দুর জানেন না, জানার কথাও নয়। আসলে উত্তরটা তো জানা ছিল না কুন্দুজে থাকতেও। উত্তরের এই কুন্দুজ রাজ্য তাজ়িকিস্থান আর উজ়বেকিস্থান লাগোয়া। তাই সীমান্ত পেরিয়ে এই শহরে যুগে যুগে তাজ়িক, উজবেকরা এসেছে, বংশ পরম্পরায় রয়ে গিয়েছে। এককালে এই শহর ছিল মধ্য এশিয়ার সবচেয়ে বড় বাজারগুলোর মধ্যে একটা। সমরখন্দ, বুখারার সঙ্গে একত্রে নাম নিত লোকে। হাজার দেড়েক বছর আগে বৌদ্ধ আমলেও এটা ছিল মধ্য এশিয়ার অন্যতম বাণিজ্যকেন্দ্র। পরবর্তীকালে শাসক বদল হলেও কুন্দুজ তার গুরুত্ব ঠিকই বজায় রেখেছিল।

মধ্য এশিয়ার প্রবেশদ্বার বলে খ্যাত এই শহরে বারবার তালিবানি হামলাও হয়েছে। সত্যি বলতে, মুজাহিদিনদের তাড়িয়ে ১৯৯৭ সালে যখন প্রথম শহরে তালিবানিরা এল, স্বাদ বদলের মতো মনে হল লোকজনের। কানাঘুষোয় এদের ধর্মান্ধতার কথা শুনেছিলেন কমবেশি। কিন্তু শোনা এক আর নিজে জানা আর এক। তাই প্রথমে তেমন আমল দেননি উমিদের মতো অনেকেই। দেখাই যাক না, শাসক যেই হোক, কুন্দুজের ব্যবসা বাণিজ্যে তো কোনওদিনও কেউ নাক গলায়নি।

অবশ্য সে ভুল ভাঙতে সময় লাগল না। দেখা গেল দক্ষিণে কান্দাহার থেকে আসা এইসব তথাকথিত পড়ুয়ারা (তালিব শব্দের অর্থ পড়ুয়া) ধর্মের ব্যাপার সত্যিই চরমপন্থী। সামান্য পোষাকের গন্ডগোলের জন্য বাজারের সবচেয়ে বড় দোকানের উজবেক মালকিন জামিরা মান্নোনোভা-কে সবার সামনে চাবুকপেটা করল। আর এক তাজিক দোকানদার বেহরুজ়কে প্রকাশ্য দিবালোকে খুন করল। শত শত বছর পাশাপাশি থেকে যা কু্ন্দুজের মানুষ ভাবেনি, এই দুটি ঘটনা তাদের চোখে আঙুল দিয়ে তা দেখিয়ে দিল। উমিদরা সেদিন বুঝতে পারলেন, দেশের সাড়ে তিন কোটি জনসংখ্যার ৪২ ভাগ নিয়ে থাকা পাশতুনদের পায়ের তলায় থাকতে হবে দেশের জনসংখ্যার ২৭ ভাগ নিয়ে থাকা তাজিক, ৯ ভাগ নিয়ে থাকা হাজারা আর তাদের মতো উজবেকদের। আসলে সেদিন থেকেই বোধহয় পাশতুনদের সঙ্গে নতুন করে অন্য আফগান জনগোষ্ঠীগুলোর সংঘাতের সূচনা হল। যা এতদিন ছিল রাশিয়ার মতো বহির্শত্রুর সঙ্গে লড়াই, তা ভিন্নরূপে গৃহযুদ্ধের দিকে ঘুরতে শুরু করল।

পরের বছর চারেক কুন্দুজে তালিবান নিপীড়ন চলার গল্প। উমিদের মতো পুরুষানুক্রমে থাকা উজবেকরা কোনওমতে মাথা গুঁজে দিন গুজরান করছেন। তারপর ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর পৃথিবী উথালপাথাল হয়ে গেল। নিউইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের দুটো টাওয়ারই ভেঙে পড়ল আল-কায়দা জঙ্গীদের আত্মঘাতী জোড়া বিমান হামলায়। পরিণামে মার্কিন সেনা নামল কাবুলের বাগরাম বিমান বন্দরে (যা বর্তমানে একবিংশ শতকে প্রথম নির্বাচিত আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের নামাঙ্কিত)। আকাশে উড়ে এল মার্কিন বি-৫২ স্ট্র্যাটোফোর্টেস বোমারু বিমান। লাগাতার আক্রমনে নাজেহাল হয়ে তালিবান পিছু হঠল। কুন্দুজ রাহুমুক্ত হল। লোকজন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।

তারপর দীর্ঘ দেড় দশক শান্তি। ফের ২০১৫ সালে অতর্কিত হানায় দিন কয়েকের জন্য কুন্দুজ দখল করল তালিবান। মার্কিন সেনার পাল্টা আঘাতে তারা তখনকার মতো পালাল ঠিকই, কিন্তু পরের বছরই আবার তালিবান কুন্দুজ দখল করল। এবারও শেষমেশ মার্কিন সেনার পাল্টা আক্রমনের জেরে শহর ছাড়তে বাধ্য হয় তারা। কিন্তু পরপর দু’বছর তালিবান হামলার পর উমিদের মতো শহরের অনেকেরই কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলল। মার্কিন ফৌজ আছে, তাতেও তালিবানকে ঠেকিয়ে রাখা দায় হয়ে উঠেছে। যদি না থাকে তখন কী হবে?

Neighbouring countries
প্রতিবেশী রাষ্ট্রের অসহায় মানুষদের জন্য খুলতেই হল সীমান্ত

এইসব ভাবনাচিন্তা করতে করতেই ২০২১ এসে গেল। ততদিনে দোহা-তে মার্কিন দূত জালমে খালিজ়াদ দীর্ঘ দু’বছর ধরে তালিবান নেতা মোল্লা আব্দুল ঘনি বারাদারের সঙ্গে বৈঠক করে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন ফৌজ যাওয়া নিয়ে চুক্তি করে ফেলেছেন। সেই চুক্তি আদতে শান্তি চুক্তি না তালিবানের কাছে আত্মসমর্পণ চুক্তি, এইসব প্রশ্ন ওঠার আগেই নয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ওভাল অফিসে বসেই ফরমান জারি করলেন, চলতি বছরের ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে মার্কিন ফৌজ আফগান ভূমি ছাড়বে। উমিদ সুদূর উত্তরে বসেও বেশ বুঝতে পারছিলেন তালিবানরা আবার পূ্র্ণোদ্যমে ধেয়ে আসবে। কিন্তু পূর্বপুরুষের শহর ছেড়ে যাবেনই বা কোথায়? 

এপ্রিল মাস থেকে সেটা গোটা শহর জুড়েই ছিল গনগনে গুজব। আসছে আসছে, একের পর এক রাজ্য গ্রাস করতে করতে তালিবান বাহিনী এগিয়ে আসছে। এরপর জুলাই মাসের প্রথম সকালে উঠে সেই খবরটাই পেলেন যার জন্য এতদিন ভয়ে শিঁটিয়ে ছিলেন। আগের রাতে কাবুলের অনতিদূরে বাগরাম বিমানঘাঁটি ছেড়ে রাতের আঁধারে মার্কিন ফৌজ চলে গিয়েছে। এমনই অবস্থা যে আফগান সেনাও জানত না এই চলে যাওয়ার খবরটা। ভোররাতে স্থানীয় লোকজন ঢুকে ফাঁকা বিমানঘাঁটি থেকে কম্পিউটার, এসি, ফ্রিজ, চেয়ার, টেবিল মাথায় করে নিয়ে যাচ্ছে খবর পেয়ে তাঁরা আসে। 

 

আরও পড়ুন: দেবর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায়ের কলমে: বাংলা গানে সময়ের থাবা

 

সেদিনই উমিদ বুঝে গিয়েছিলেন এ বার আর কুন্দুজের রক্ষা নেই। হলও তাই। তাসের ঘরের মতো একের পর এক রাজ্য তালিবানদের হাতে চলে যেতে থাকল। একটাই শেষ আশা- কাবুল। তালিবান আর যাই করুক, কাবুল দখল করতে পারবে না। দেশশুদ্ধ লোক তখন ঘটিবাটি বেচে চলেছে কাবুল পানে। মনে আশা, বাঁচালে একমাত্র কাবুলই বাঁচাবে। মহল্লার লোকজন যখন একটা ট্রাক ভাড়া করে কাবুল যাওয়ার তোড়জোড় শুরু করল, তখন উমিদ আর দেরি করা সমীচীন মনে করলেন না। যে গতিতে তালিবান এগোচ্ছে, কুন্দুজ থেকে কাবুল যাওয়ার রাস্তা কতদিন মুক্ত থাকবে, তা নিয়ে রীতিমতো সন্দেহ রয়েছে। তাই আর দেরি না করে নাতনির হাত ধরে এই প্রথম কুন্দুজের বাইরে পা রাখলেন উজবেক বৃ্দ্ধ। 

কাবুলে পৌঁছে দেখেন, সেখানে হাজার হাজার লোক। রাস্তায়, পার্কে তারা ছড়িয়ে রয়েছে। তালিবানের ভয়ে কার্যত একবস্ত্রে এরা পালিয়ে এসেছে কাবুলে। এইসব সহায় সম্বলহীন মানুষগুলোর সারা বিশ্বে একটাই ঠিকানা হয়- খোলা আকাশ। উমিদ ভিড়ে গেলেন এই জনারণ্যে। ঠাঁই হল এক পার্কে। একটা হলুদ তাঁবু হল বাসস্থান। কিন্তু ১৫ অগস্ট দুপুরে উমিদের শেষ আশাও নিভে গেল। তালিবানের হামভির কনভয় দেখা দিল কাবুলের রাজপথে। আদতে এই তালিবান কিন্তু দীর্ঘ রক্তাক্ত আফগান ইতিহাসের নবতম পরিচ্ছেদ মাত্র। আমরা বরং দেড়শো বছর আগের মধ্য এশিয়ার ‘গ্রেট গেম’ থেকে দেখতে শুরু করি।

‘গ্রেট গেম’-এর ছায়ায় ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধ  

সময়টা উনবিংশ শতকের তৃতীয় দশক। ইউরোপের পরে মধ্য এশিয়ার দিকে নজর পড়েছে রুশ জার সাম্রাজ্যের। ঝড়ের গতিতে মধ্য এশিয়ায় এগিয়ে আসছে জারের বাহিনী। একের পর এক অধুনা কাজ়াখস্থান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, কিরঘিজ়স্থান, তাজ়িকিস্থান তাদের করতলগত হচ্ছে। আর এতেই টনক নড়ে গিয়েছে ইংরেজদের। মতলবটা কী সেন্ট পিটাসবার্গের? ভারতের দিকে হাত বাড়াবে না তো? 

হিমালয় থাকার জন্য সোজাসুজি না এসে ঘুরপথে আসবে না তো? ঘুরপথে মানে তো আফগানিস্তান দিয়ে। তৎকালীন ব্রিটিশ বিদেশমন্ত্রী লর্ড পামারস্টোন (যিনি পরবর্তী কালে দু’দুবার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন) আর ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণকারী বোর্ড অফ কন্ট্রোলের প্রেসিডেন্ট স্যর জন হবহাউস- দু’জনেরই ঘুম ছুটে গেল। দুজনেরই দৃঢ় সন্দেহ হল মধ্য এশিয়ায় হঠাৎ এই রুশ আগ্রহ আদতে ইংরেজের সাধের ‘জুয়েল ইন দ্য ক্রাউন’ ভারত হস্তগত করা। আর কে না জানে রাশিয়া ভারত মহাসাগরের দিকের রাস্তাও খুলতে চায়। 

এখানে বলে রাখা ভাল ইতিহাস কিন্তু ইংল্যান্ডের এই রুশ আতঙ্কের পক্ষে মোটেই সায় দেয় না। অনেক ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, একমাত্র রুশ জার প্রথম পলই ১৮০০ সালে কসাক সেনাদল পাঠিয়ে ভারত আক্রমণের পরিকল্পনা করেন, যা পলের ভারত অভিযান বলে পরিচিত। কিন্তু সেটাও বানচাল হয়ে যায় ১৮০১ সালের ২৩ মার্চ রাতে সেন্ট পিটার্সবার্গে নবনির্মীত সেন্ট মাইকেল কাসেলে তাঁকে খুন করায়। ইতিহাসে তৎকালীন বিশ্বের দুই পরাশক্তির এই ছায়াযুদ্ধকে ‘দ্য গ্রেট গেম’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। রুডইয়ার্ড কিপলিংয়ের অমর সৃষ্টি ‘কিম’-এ এই ‘গ্রেট গেম’ চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে।

neighbour
সময় জানে আফগানিস্তানের রক্তঝরা ইতিহাস

এই রকম যখন টালমাটাল অবস্থা তখন, ১৮৩৭ সালের ডিসেম্বরে তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড অকল্যান্ড (যার আসল নাম জর্জ ইডেন। ১৮৪১ সালে এঁর নামে তৎকালীন নিউজিল্যান্ডের রাজধানীর নাম অকল্যান্ড রাখা হয়। এঁরই লেখিকা বোন, এমিলি ইডেনের নামে ইডেন গার্ডেন্স নামকরণ করা হয়) খবর পেলেন, বছর তিরিশেকের বহু ভাষাবিদ রুশ দূত কাউন্ট জান প্রস্পার উইটকিউইজ় কাবুলে আফগান আমীর দোস্ত মহম্মদ বরাকজাইয়ের সঙ্গে দেখা হাজির হয়েছেন। ক্রু্ধ লর্ড অকল্যান্ড ১৮৩৮ সালের ২০ জানুয়ারি রুশ দূতকে কাবুল থেকে বিদায় করতে বলে দোস্ত মহম্মদকে চিঠি লিখলেন। কিন্তু তাতে পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হল। এপ্রিল মাসে ব্রিটিশ দূতকেই কাবুল থেকে বার দেওয়া হল। 

এই অপমানের শোধ নিতে লর্ড অকল্যান্ড অন্য চাল চাললেন। ১৮০৯ সালে কাবুলের তখত থেকে বিতাড়িত শাহ সুজা ১৮১৮ থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আশ্রয়ে ভারতে ছিলেন। (ইতিহাস বলে এই শাহসুজার কাছ থেকেই পঞ্জাব রাজ রঞ্জিত সিং কোহিনূর হস্তগত করেন।) এ ইংরেজের আজ্ঞাবহ হবে ভেবে, সুজাকেই কাবুলের বৈধ আমীর ঘোষণা করে বসলেন অকল্যান্ড। আদতে নিষ্ঠুরতা আর শয়তানির জন্য আফগানরা দুচক্ষে দেখতে পারতেন না শাহ সুজাকে। কিন্তু পাকে চক্রে এই সুজাই হয়ে উঠল আফগানিস্তানে ইংরেজদের পোস্টার বয়।

ফলে যা হওয়ার তাই হল। ব্যারন জন কেনের নেতৃ্ত্বে ২১ হাজারি ব্রিটিশ ভারতীয় ফৌজ ১৮৩৮ সালের ডিসেম্বর মাসে পঞ্জাব থেকে রওয়ানা দিল। ব্রিটিশ ঐতিহাসিকরা যে ফৌজের গালভরা নামও দিয়েছিলেন-‘গ্র্যান্ড আর্মি অফ দ্য ইন্দাস’। ১৮৩৯ সালের ২৩ জুলাই গজনি দূর্গ জয় দিয়ে শুরু হল প্রথম ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধ। সুশিক্ষিত ইংরেজবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ সমরে আফগানরা পেরে উঠল না। বিপদ বুঝে দোস্ত মহম্মদ সন্ধি করতে চাইলেন। বললেন শাহ সুজাকে তখতে বসিয়ে তিনি সুজার উজির বা প্রধানমন্ত্রী হতেও রাজি। 

কিন্তু সদ্য গজনি জেতা ব্যারন কেন সেই প্রস্তাব ফুৎকারে উড়িয়ে দিলেন? মাস চারেক পরে সেই ইংরেজ ফৌজ ফেরার সময় যখন গিরিপথে কচুকাটা হল, তখন কি ইংরেজদের একবারের জন্যও মনে হয়েছিল দোস্ত মহম্মদের দোস্তির প্রস্তাবটা মেনে নিলে হয়ত প্রাণটা বেঘোরে যেত না! তার চেয়েও বড় কথা সন্মান ভুলুন্ঠিত করে পরে দোস্ত মহম্মদকেই আবার মসনদে বসাতে হত না। অবশ্য ইতিহাস তো ‘যদি’ ‘কিন্তু’তে ভরা।

ইতিহাস কিন্তু ইংল্যান্ডের এই রুশ আতঙ্কের পক্ষে মোটেই সায় দেয় না। অনেক ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, একমাত্র রুশ জার প্রথম পলই ১৮০০ সালে কসাক সেনাদল পাঠিয়ে ভারত আক্রমণের পরিকল্পনা করেন, যা পলের ভারত অভিযান বলে পরিচিত। কিন্তু সেটাও বানচাল হয়ে যায় ১৮০১ সালের ২৩ মার্চ রাতে সেন্ট পিটার্সবার্গে নবনির্মীত সেন্ট মাইকেল কাসেলে তাঁকে খুন করায়। ইতিহাসে তৎকালীন বিশ্বের দুই পরাশক্তির এই ছায়াযুদ্ধকে ‘দ্য গ্রেট গেম’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে।

যাই হোক, ৭ অগস্ট ইংরেজ সেনা গিয়ে দোস্ত মহম্মদকে ক্ষমতাচ্যুত করে শাহ সুজাকে তিন দশক বাদে ফের তখতে বসায়। দোস্ত মহম্মদ পালালেন। পরে তাঁকে ধরে মুসৌরিতে নির্বাসনে পাঠানো হয়।  কিন্তু রাজ্যশাসন করার বদলে সুজা প্রতিহিংসা মেটাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। এদিকে ইংরেজ সেনা অফিসাররা তাঁদের পরিবার নিয়ে গেলেন কাবুলে। স্বাধীনচেতা আফগানরা বুঝল ইংরেজরা দীর্ঘদিন থাকার মতলবে এসেছে। একে সুজার লাগামছাড়া অত্যাচার অন্যদিকে ইংরেজদের এই হুকুমত আফগানদের মধ্যে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দিল। ১৮৪১ সালের ২৩ ডিসেম্বর কাবুলে মুখ্য ব্রিটিশ রাজনৈতিক প্রতিনিধি স্যার উইলিয়াম হে ম্যাকনাগটেন (যিনি গভর্নর জেনারেলের প্রাক্তন মুখ্য উপদেষ্টাও ছিলেন) দোস্ত মহম্মদের ছেলে আকবর খানের হাতে খুন হলেন। এই ঘটনার মাস দেড়েক আগে ২রা নভেম্বর রাতে ম্যাকনাগটেনের সহকারি স্যর আলেকজান্দার বার্নেস কাবুলে নিজের বাড়িতে ভাই চার্লস আর মেজর উইলিয়াম ব্রাডফুট সহ উত্তেজিত জনতার হাতে খুন। পরদিন কাবুল বাজারে তিনজনের কাটা মুণ্ড দেখানো হয়। 

বস্তুত এই দুই রাজনৈতিক প্রতিনিধির হত্যার পর ব্রিটিশ সেনাবাহিনী আর কাবুলে থাকতে ভরসা পায়নি। ১৮৪২-এর ৫ জানুয়ারি ৯০ মাইল দূরের জালালাবাদের ঘাঁটির দিকে রওনা দেয় সাড়ে চার হাজার ইংরেজ সেনা আর তাদের হাজার বারো সহযোগী। কিন্তু বরফ ঢাকা গিরিপথে আফগান বাহিনীর মুহুর্মূহু হামলায় গোটা সেনাদল নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। নারী আর শিশুদের বন্দি করে কাবুলে নিয়ে যাওয়া হয়। কেবলমাত্র মারাত্মক আহত অবস্থায় সেনাবাহিনীর বেঙ্গল রেজিমেন্টের ডাক্তার উইলিয়াম ব্রাইডন কোনওমতে জালালাবাদ পৌছান। 

ব্রিটিশ সাহায্য ছাড়া শাহ সুজাও টিঁকতে পারলেন না। মাস তিনেক বাদেই ৫ই এপ্রিল কাবুলের দক্ষিণে বালা হিসার কেল্লার বাইরে  তাকে খুন করা হল। যে দোস্ত মহম্মদ খানকে তখত থেকে সরাতে এত কাণ্ড ব্রিটিশ করল, তাকেই ১৮৪৩ সালে আমীর হিসাবে মেনে নিতে হল। ফলে প্রথম ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধে সবদিক থেকেই ইংরেজদের মুখ পুড়ল।

ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি: ব্রিটেনের মতো মার্কিনিদেরও ‘মুখ পোড়ানো’র গল্প

আর ইতিহাস বলছে এই মুখ পোড়ার কাহিনি গত ১৮০ বছর ধরেই চলে আসছে। ব্রিটেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র- সব পরাশক্তিরই একই হাল হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আশ্চর্যজনকভাবে প্রতিবারই এক কাহিনি। শুধু কুশীলবরা বদলে যাচ্ছে। প্রথমে বিদেশি শক্তি তাদের উন্নত প্রযুক্তি ও যুদ্ধবিদ্যার সাহায্যে জিতে কাবুল, কান্দাহার, হিরাট, মাজার-ই-শরিফের মতো বড় শহরগুলো দখল করছে, বিদ্রোহীরা পার্বত্য অঞ্চলে আশ্রয় নিচ্ছে। কিন্তু ধীরে ধীরে পাল্লা ভারী হচ্ছে বিদ্রোহীদের। চোরাগোপ্তা হানা ক্রমশ বদলে যাচ্ছে বড় হামলায়। 

বহিরাগত শক্তি দীর্ঘ রক্তক্ষরণে বাধ্য হয়ে ধীরে রণাঙ্গণ থেকে সরে যাচ্ছে। খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে মস্কো আর ওয়াশিংটন ঠিক পরিস্থিতির কারনেই সরতে বাধ্য হয়েছে। এ এক অন্তহীন লড়াই। সাংবাদিক আবু বকর সিদ্দিকি তাঁর ‘দ্য পাশতুনস’ বইতে লিখেছেন, ২০১০ সালে প্রাক্তন আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই স্বখেদে বলছেন,”সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য ন্যাটো বাহিনি এখানে এসেছে। কিন্তু সেই লড়াই চলছে বছর দশেক হয়ে গেল। কোনও ফল তো আজও মিলল না।”

Love thy neighbour
গৃহযুদ্ধের খাদের ধারে দাঁড়িয়ে এই নিষ্পাপ মুখগুলি

তবে মিল অনেক আছে। ১৮০ বছর আগে যে বারাকজাই রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা দোস্ত মহম্মদকে তখত থেকে সরানোর জন্য ইংরেজ এত কাণ্ড করল, মায় প্রথম ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধই বাধিয়ে দিল ১৮৩৯ সালে, পরে যাকে মুসৌরিতে নির্বাসিত করল, শাহ সুজার হত্যাকাণ্ডের পর ১৮৪৫ সেই তাঁকেই কাবুলের গদ্দী ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হল। উল্লেখ্য, কয়েক বছরের বিরতি বাদে ১৮২৩ থেকে ১৯৭৩-এই পরবর্তী দেড়শ বছর বারাকজাই বংশ রাজত্ব করে। দোস্ত মহম্মদও বহাল তবিয়তে আমৃত্যু ১৮৬৩ পর্যন্ত আফগান আমীরই ছিলেন। 

ওয়াশিংটনের দশাও কিছু ভিন্ন হল না। প্রায় ১ লক্ষ ৩০ হাজারের মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনি ২০০১ সালে কাবুল থেকে তালিবানকে তাড়ায়। তারপর ২০ বছর ধরে লড়ে, ২৮০০ মার্কিন সেনাকে হারিয়ে, মার্কিন করদাতাদের লাখ তিনেক কোটি ডলার কাবুল নদীতে ভাসিয়ে কী হল অন্তিম ফল? না তালিবান কমাণ্ডারকে সপার্ষদ আফগান প্রেসিডেন্টের ঘরে খোসগল্প করার ছবি বিশ্ব দেখল। বিশ্ব দেখল যে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে পেন্টাগন যুদ্ধ করতে নেমেছিল, তারা পালাতে এতই ব্যস্ত যে সাড়ে ৮ হাজার কোটি ডলারের অত্যাধুনিক অস্ত্রসম্ভার সেই তালিবানের হাতেই তুলে দিয়ে এল। বিশ্ব দেখল যে সন্ত্রাসবাদকে সমূলে উৎপাঠিত করার জন্য বুশ লম্বা চওড়া ভাষন দিয়েছিলেন, তাঁরই উত্তরসূরী বাইডেন এশিয়া তথা বিশ্বকে আরও বড় বিপদের মুখে ঠেলে দিলেন।

অশনিসঙ্কেত কিন্তু রয়েছে তালিবানেরও

বিশেষজ্ঞরা বলছেন,যতই বিদ্যুৎগতিতে কাবুল দখল করুক তালিবান, দেশ শাসন করা তাদের পক্ষে দুঃসাধ্য। কারণ হিসাবে তারা মূলত আফগান জনগোষ্ঠীর উপজাতির বিভাজনের দিকে দৃষ্টি আকর্ষন করছেন। তাঁদের মতে, আফগান সমাজ এমনিতেই উপজাতি দীর্ণ। কাবুলের তোয়াক্কা কোনও কালেই হিরাটের হাজারা বা কুন্দুজ, মাজার-ই-শরিফের তাজিক উজবেকরা করে ন। দেশের পূর্ব আর দক্ষিন ভাগে যেমন পাশতুনরা রাজ করে, তেমনি দেশের পশ্চিমভাগে হাজারা আর উত্তর ভাগে তাজিক আর উজবেক জনগোষ্ঠীর বাস। দেশের সিংহভাগ ক্ষমতা আর কাবুলের মসনদ পাশতুনরা দখলে রাখলেও দেশের প্রান্তিক অঞ্চলগুলিতে বিশেষ করে উত্তর আর পশ্চিমভাগে তাদের প্রকৃত ক্ষমতা কত, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। মনে রাখতে হবে, বিংশ শতকের শেষে ও একবিংশ শতকের শুরুতে যে বছর পাঁচেক আফগানিস্তানে তালিবানি শাসন চলেছিল, উত্তরের বিশাল ভূখণ্ডে পাল্টা স্বাধীন সরকার চালিয়েছে আহমেদ শাহ মাসুদের নেতৃত্বাধীন নর্দার্ন অ্যালায়েন্স।

 

আরও পড়ুন: কৌশিক মজুমদারের কলমে: মেগাস্থিনিসের ভারত

 

কাবুল দখলের পরও যে তালিবান নেতৃত্বের প্রায় একমাস লেগে গেল মন্ত্রিসভা গড়তে, তার মূলেও তীব্র আভ্যন্তরীন দ্বন্দ্ব রয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। পাকিস্তানী মদতপুষ্ট জালালউদ্দিন হাক্কানি আর তার শাকরেদদের মন্ত্রীসভায় জায়গা দিতে হিমসিম খাচ্ছে বরাদররা। অন্যদিকে পঞ্জশিরে মাসুদ পুত্র আহমেদ আর বিগত আসরাফ গনি সরকারের ভাইস প্রেসিডেন্ট আমরুল্লাহ সালের নেতৃ্ত্বে ন্যাশানাল রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্টের অধীন হাজার দশেকের এক বাহিনী লড়ছে।  

নয়া তালিবানের উপর অত্যধিক পাকিস্তানী চাপ বুমেরাংও হতে পারে ইসলামাবাদের জন্য। ভুলে গেলে চলবে না, পাক পাশতুন জঙ্গি গোষ্ঠী তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তানে যথেষ্ট সক্রিয়। ইতিমধ্যেই আফগানিস্তানে পাকিস্থানি রুপি চালানোর চেষ্টা তালিবান বাতিল করে দিয়েছে। তবে কাবুলের উপর নানা ভাবে চাপ ইসলামাবাদ রেখে যাবেই বলে ধারনা করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে এটাই কাবুল-ইসলামাবাদ বিবাদের কারন হতে পারে।

শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত জানা যাচ্ছে, উমিদ ফের নাতনিকে নিয়ে উত্তরে ফিরে গিয়েছেন। না,কুন্দুজ বাজারে দোকানে আর তিনি বসেননি। বরং গিয়ে সালের দলে নাম লিখিয়েছেন। বন্দুক তুলে নিয়েছেন হাতে।মরার আগে শতবার আর মরতে চান না তিনি।  আসমার ভবিষ্যৎ তিনি কাউকে ছিনিয়ে নিতে দেবেন না।

এ বার উমিদ জানেন তাঁকে কোথায় যেতে হবে।

*মতামত, সত্যতা ও বক্তব্যের দায় লেখকের। 
*ছবিগুলি প্রতীকী। সৌজন্যে: saatchiart, hyperallergic.com

কিংশুক বন্দ্যোপাধ্যায় সাংবাদিকতা করছেন দীর্ঘ আড়াই দশক যাবত। মূলত অর্থনীতি ও প্রযুক্তি নির্ভর সংবাদের নিয়েই তাঁর কাজ। সময় পেলে ক্যামেরা নিয়ে ঘুরতে বেড়িয়ে পড়া, কফি সহযোগে বইয়ের পাতা উল্টানো কিংবা চলচ্চিত্রের স্বাদ নেওয়া, তাঁর প্রিয় অবসরযাপন।

One Response

  1. ভালো প্রতিবেদন। তালিবানের দাপটে ১৫ অগস্ট, ২০২১ কাবুলের পতন হয়নি। ২০২০-র ২৯শে ফেব্রুয়ারি কাতার-এর রাজধানী দোহায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তালিবানের মধ্যে একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সেই চুক্তি অনুযায়ী পরবর্তী ১৪ মাসের অর্থাৎ ৩০শে এপ্রিল ২০২১-এর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের কথা ছিল। করোনা সংক্রমণ জনিত কারণে দু’ পক্ষ আলোচনা করে চূড়ান্ত দিন স্থির হয় ৩১শে অগস্ট, ২০২১। কাজেই কোনো পক্ষের জয় বা পরাজয় হয়নি। হয়েছে চুক্তি মোতাবেক শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *