আগের পর্ব পড়তে: []  []

চৈত্রের দিনে পুকুরের জল শুকিয়ে এসেছে এ গাঁয়ে। ছেলেপিলেরা কাদায় হাঁটু ডুবিয়ে পাঁকাল মাছ ধরছে, চ্যাং, ল্যাটা ধরছে। একটা নুয়ে পড়া পাতাবাদাম গাছের নীচে বসে বসে সেসব দেখছি। পশ্চিমের গাঁয়ে আসরের আজান দিচ্ছে। মীনা তো সেসব টের পায় না, ও তাই পড়ে থাকা মাঠের ওপারে কাস্তে হাতে ঘাস কাটছে। কেটেই যাচ্ছে। ওর মুখ গরমের তাপে লালচে হয়ে উঠেছে। উঠবেই তো। ওকে দেখতে দেখতে আমার শেরিং-এর কথা মনে পড়ছে হঠাৎই।

শেরিংকে আমি খুব কাছ থেকে দেখিনি কখনও। দেখবই বা কেমন করে! সেই কোন লাদাখের পার্বত্য উপত্যকায় বরফের রাজ্যে ওর বাস। ও মেষপালিকা। বছরভর ভেড়া চড়ায়, ছাগল চড়ায়। আসলে যতটা সহজে এ কথা বলছি ততটা সহজ তো নয় সেসব! একা একা একজন সাতান্ন বছরের মহিলা প্রায় তিনশো ছাগল আর ভেড়াকে নিয়ে পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন ঘাসের খোঁজে। কত কত হিমবাহ, কত না খরস্রোতা নদী পেরিয়ে, কোন সে পাহাড়চূড়া ডিঙিয়ে ঘাস খুঁজে বেড়ায় ও। ভেড়া আর ছাগলদের পথ দেখিয়ে বেড়ায়, তাও সেই তেরো বছর বয়স থেকে। সেই যে যখন ওর বাবা মরে গেল! আর বাড়ির সক্কলের দায় এসে পড়ল ওর ঘাড়ে। বাপের কাছে সে মেয়ে মেষপালন শিখেছে। সে কি হেরে যাবে বলে! কক্ষনো না। ওই অতটুকু মেয়ে, অথচ ওই বয়সেই বরফ ডিঙোতে শিখেছে অক্লেশে। ওর কাছে ওই ভেড়ার পাল, ছাগলের দল জীবনের চেয়েও বেশি কিছু।

Ladakh Sheeps

গত প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে কখনও গ্রীষ্মে, কখনও শীতে উপত্যকায় ঘুরে ঘুরে কেবল ঘাসের মূল খুঁজেছে ও। যখন বরফের চাদরে পাহাড় ঢেকে গেছে, ঝোড়ো হাওয়ায় গায়ে গা লাগিয়ে পশুদের দল ওম খুঁজেছে কেবল, শেরিং তখন ওর সামান্য তাঁবুতে কুপি জ্বালিয়ে বসে থেকেছে একা। নিজের গাঁ ছেড়ে কখনও কুড়ি, কখনও চল্লিশ কিলোমিটার পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়েছে ও, ঘাসের খোঁজে। সন্ধের অন্ধকারে একা একা একটা মেয়ে শীতের উপত্যকায় প্রায় ৪৭০০ মিটার উচ্চতায় বসে রেডিও শুনেছে, আর মনে মনে ভেবেছে ছাগলগুলো আবার ভোরের আলো দেখুক, আবার নরম আলোয় ঘাসটুকু ছিঁড়ে খাক। কে বলে ওর লোভ কেবল পশমিনা উল বিক্রিতে! কেউ বলে না। কেউ বলতে পারে না।

সেই কোন প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রাম গ্যা-মিরুর মানুষেরা জানে ওই ছাগল আর ভেড়ারাই ওর জীবন। অনেক উঁচুতে, যেখানে মানুষের স্বর পৌঁছোয় না প্রায়, সেখানে একা একা কেমন করে থাকে শেরিং? অনেক খুঁজেপেতে খাওয়ার জলটুকু জোগাড় করতে হয় ওকে, কখনও বা বরফ গলিয়ে জল বানায়। দুধ গরম করে চা খায়। চা খেতে খেতে কুপির আলোয় বসে বসে রেডিও শোনে ও। মানুষের গলা শোনে ও আসলে। উর্দু খবর থেকে বঙ্কিমের বন্দেমাতরমের হদিশ দেয় ওই রেডিও ওকে। কেবল কি মানুষের স্বর শোনে ও! স্নো-লেপার্ডের ভয়েও রেডিওর আওয়াজ বাড়িয়ে দেয় না বুঝি! একা একা একটা মেয়ে এমন করে আরও একা হয়ে যেতেই পারত তো! কিন্ত ও একা হয়নি। ও একা হতে শেখেনি। ও তো কেবল ছাগল ভেড়াদের পালিকা নয়, ও ওদের ধাত্রী, বন্ধু, অভিভাবক। শীতের দিয়ে সদ্যোজাত শিশুদের ও পিঠে করে বয়ে বেড়ায় বন্ধুর পথে। যখন ঘাস জোটে না মোটে, ও তখন নিজের রসদ থেকে খাবার বানিয়ে খাওয়ায় ওদের। সারা পৃথিবীর মানুষ এসব তো জানতেই পারত না, যদি না শেরিং-এর ভাই ২০১৬ সালে ওর উপরেই একটি প্রামাণ্য তথ্যচিত্র বানিয়ে ফেলত! সে ছবির নাম– ‘Shepherdess of The Glaciers’। সে ছবি পৃথিবীর মানুষ দেখে তাজ্জব বনে গেছে, স্টানজিন দোরজাই-কে পুরস্কৃত করেছে। দোরজাই-এর ছবি আসলে শেরিং-এর জীবনের গল্পই তো বলেনি কেবল! বলেনি একজন একা মেয়ের গল্প। ওঁর ছবি দেখিয়েছে, পৃথিবীর ছাদের উপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একজন মানুষ, একজন মেয়ে কেমন করে পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তনের সাক্ষী থাকছে প্রতিদিন। বদলে যাচ্ছে বৃষ্টি, বদলে যাচ্ছে ঘাসের জোগান, কমে যাচ্ছে ভেড়ার দল, ছাগলের পাল। ওদের লোম, ওদের বর্জ্য, ওদের দুধ থেকে দই মাখন, আর যা যা কিছু মিলেমিশে আছে এই চারণ-ইতিহাসের সঙ্গে সেসব বদলে যাওয়া দেখতে কেমন লাগে শেরিং-এর? ওর মনখারাপ মিলেমিশে যায় ছবির ভাষার। মৃত ছাগশিশুদের দাফন করার ব্যথা ছড়িয়ে যায় ওর মুখে। সেসব ব্যথার পর্দা সরিয়ে ও আবার ঘাস খুঁজতে বেরোয়, জল খুঁজতে বেরোয়।

Village Girl

আসলে মীনাকে দেখতে দেখতে আমার শেরিং-এর কথা মনে হয়। মীনা তো কথা বলতে পারে না, শ্রুতিও ওর দুর্বল। ওর তাই কোনও বন্ধু নেই তেমন। জীবন জুড়ে আছে কেবল ছাগলের দল। এমন চৈত্রের দিনে আর কেউ না জানুক, মীনা কিন্তু জানে কোথায় কোথায় সবচেয়ে নরম, সবচেয়ে সবুজ ঘাসের গালচে পাতা আছে। কাস্তে হাতে রোদে রোদে ঘুরে সারা দিন ধরে ওর ছাগলদের জন্য ঘাস খুঁজে বেড়ায় কেবল। ওর রোজা রাখা দিনের ক্লান্তিও ওকে থামিয়ে দিতে পারে না। খরার ধান তো এ অঞ্চলে সবাই করে না, খুঁজে খুঁজে ধানক্ষেতের আলে আলে ভিজে মাটির ধারে নরম ঘাস কেটে কেটে ও বস্তায় জড়ো করে। সেসব সাইকেলে বেঁধে ও যখন ঘরে ফেরে, ওকেই তখন আর দেখা যায় না প্রায়। চোখাচোখি হলে হাসে কেবল, ঘাস খুঁজে পাওয়ার খুশিতে ওর মুখখানা চকচক করে। ও বা শেরিং কেউ কাউকে চেনে না। চিনবেও না। অনেক দিন পরে গাঁয়ে ফেরা শেরিং সান্ধ্য আড্ডায় ওর বাড়ির বাচ্চাদের বই উলটে-পালটে দেখছিল। সে বইয়ে কত কত কর্মজীবী মানুষের ছবি! শেরিং ওদের জিজ্ঞেস করেছিল, আমাদের কথাও কি বইয়ে লেখা আছে? 

ছাগল-চড়ানির কথা ইস্কুলের বইয়ে লেখা থাকে না। ঘাস খুঁজে নেওয়ার মানচিত্রও না। এই মাঠ, এই আলপথ যদি আর নাই থাকে একদিন, এমন চৈতি দিনে মীনা ঘাস খুঁজবে কোথায়! পৃথিবীর সে উত্তর খোঁজায় আগ্রহ নেই। শেরিং, একা একটা মেয়ে, লাদাখি উপত্যকায় শেষ ভেড়াচরানি মেয়ে তাই দেখে, কেবলই দেখে। একা একা। ভেড়াদের মরে যাওয়া… ঘাসেদের মরে যাওয়া…

 

 

ছবি সৌজন্য: লেখক, Pxfuel

Amrita Bhattacharya

অমৃতা ভট্টাচার্য (জ.১৯৮৪-) শান্তিনিকেতনের জল হাওয়ায় বড়ো হয়েছেন। পাঠভবনে তাঁর পড়াশোনা। পরে বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগ থেকে বাংলা উপন্যাসে বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে গবেষণা করেছেন। পড়িয়েছেন জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউশনে এবং পরে চারুচন্দ্র কলেজে। বর্তমানে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের দেশজ রান্না নিয়ে কাজ করছেন। স্বপ্ন দেখেন পুঁজির প্রতাপের বাইরে অন্যরকম জীবনের, খানিকটা যাপনও করেন তা। যে হাতে শব্দ বোনেন সেই হাতেই বোনেন ধান, ফলান সব্‌জি। দেশ-বিদেশের নানা-মানুষের অন্যরকম জীবন দেখতে ভালোবাসেন। তাঁর লেখা স্মৃতিগ্রন্থ ‘বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ ’ এবং 'রেখেছি পত্রপুটে' পাঠকের সুসমাদর পেয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *