আগের পর্ব পড়তে: [

সে বছর পলাশে পলাশে আগুন লেগেছিল। সে আগুন নেভার আগেই সিলভিয়ার সঙ্গে আমার আলাপ। আলাপ থেকে বন্ধুত্বে গড়িয়ে সে সম্পর্ক ক্রমে আত্মীয়তায় মিলেমিশে গেছে। মানুষের সঙ্গে মানুষের তো কেবল রক্তের সম্পর্কই থাকে না! সম্পর্কের কত না নদীজল সাগর আর মোহনায় এসে মেশে তার হিসেব রাখে না জীবন। রাখতে চায়ও না। সে কেবল আশ্চর্য হয়ে শোনে মানুষের গল্প। সে গল্পে মিশে থাকে সিলভিয়ার জীবন, ওর শৈশব, ওর দিদি। রোসেলার গল্পে খানিক পরে আসব। তার চেয়ে বরং জেনে নিই বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইতালি ছেড়ে কেমন করে ওদের বাবা ল্যাতিন আমেরিকায় পাড়ি দিয়েছিল। সে গল্পে মিশে আছে অভিপ্রয়াণের কত না-মানুষী ইতিহাস। কেবল তো আর মানুষ নয়, ভেনিজুয়েলার গাছগাছালি, সমুদ্দুর সব নিয়ে ওদের ভাইবোনেদের বেড়ে ওঠাও ভারী আশ্চর্যের। সেই গাছগাছালির গন্ধ মাখতে মাখতে ওরা বারবার ভুলে যেতে চেয়েছে ইতালির নিভু চুলিতে নরম নরম রুটি সেঁকার গন্ধ, ওরা বলেছে আমরা ভেনিজুয়েলান। গাছেদের ভালবেসেছে ওরা প্রাণ ভরে। এমন বসন্ত দিনে গাছ ভরে ভরে যখন ট্যাবাবুইয়া ফুটেছে, ওরা তখন এই আলো আর আকাশকে ভালোবেসে কৃষ্ণচূড়ার জন্য অপেক্ষা করেছে। মিশনারিদের সঙ্গে ওরা পাড়ি দিয়েছে আমাজনের গভীর অরণ্যে। গাছেদের ভালবেসে, মানুষকে ভালবেসে। সেসব গল্প ওদের মুখেই শুনেছি কতবার। তবু, গল্পেরও তো শেষ আছে! মানুষের সংসারে গল্পের লাটাই গড়াতে গড়াতে কোথায় যায় তার কোনও ঠিক নেই! ভাইবোনেরা কাজের আবর্তে কোথায় কখন ছিটকে পড়েছে তার ঠিক নেই। কেবল সিলভিয়ার দিদি রোসেলা রয়ে গেছে কারাকাসের বাড়িটুকু আগলে। রয়ে গেছে ওদের বৃদ্ধা মা। ওদের গাছপালারা। এমন দিনে কারাকাসে গাছ ভরে ট্যাবাবুইয়া ফোটেই তো!

এমন একটা খনিজ সম্পদে মোড়া দেশে গৃহযুদ্ধের আগুন কেমন করে ছড়িয়ে যায় তার খবর কি গাছেদের কানে পৌঁছয়! সে দেশে বাজারদর আগুন, সে দেশে মানুষের জীবনের দাম দিতে রাজি নয় কেউ। নেই কোনও পরিশ্রুত পানীয় জল। সেসব নিয়ে ইউনিসেফ ছবি বানায়। ক্ষমতাবান মানুষদের এসবে খুব কিছু যায় আসে না বটে। তবু, মায়ের কথা ভেবে ওদের চিন্তা হয়। বহু কষ্টে মা-কে ওরা ফিরিয়ে আনে ভেরোনার বাড়িতে। দেশান্তরী হওয়া কারাকাসের ভিটেয় রয়ে যায় কেবল রোসেলা। মানুষ তো ভালো থাকতেই চায়। খাদ্য, স্বাস্থ্য, পানীয় জল এসবের অধিকার নিয়েই তো বাঁচতে চায় মানুষ। রোসেলার কি ইচ্ছে করে না সেসব চাইতে! ওর মা, ভাই-বোনেরা কেউ নেই আর কারাকাসে। ওর নিরাপত্তাও নেই। রোসেলা, কী চাও তুমি?

Family photograph of Rosella
রোসেলার পরিবার, পুরনো অ্যালবাম

রোসেলা খানিকটা আমার মতোই ভাঙা ভাঙা ইংরেজি বলে। একেকদিন সিলভিয়া ফোনের প্রান্তখানা ধরিয়ে দেয় আমার হাতে, বলে— রোসেলাকে বল ইন্ডিয়ায় আসতে! তোমাদের মাঠের পাশে যে পলাশের গাছখানা আলো হয়ে আছে তার ছবি পাঠাও ওকে! সেসব আমন্ত্রণের ওপারে দাঁড়িয়ে থাকে রোসেলা। ও কেমন করে আসবে বল! ওর গাছেদের ছেড়ে! ওর ফুলেদের ছেড়ে! কারাকাস ছুঁয়ে সমস্ত ভেনিজুয়েলার গাছ ফুল লতাপাতা ওর আপনজন। তাদের ছেড়েও কি ওর আসা সম্ভব! যেদিন যেদিন একেবারেই ওর ভাঁড়ারঘর খালি হয়ে যায়, কোনও খাবারই আর থাকে না, সেদিন এক টুকরো মাংস জোগাড় করে ও বড়শি দিয়ে মাছ ধরতে যায় নদীতে। ছিপ ফেলে পিরানহা ধরে। সে মাছ খেতে যে ও খুব ভালবাসে এমন ভাববেন না যেন! সে মাছ ওর মুখে রোচে না। কিন্তু কী করবে বলুন রোসেলা, ওর গাছেদের ছেড়ে ও কেমন করে আসবে! ওর বাড়ি জুড়ে কত কত গাছের বীজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সে যেন আস্ত একখানা সিড লাইব্রেরি। সেসব ছেড়ে কেউ কখনও বেকুবের মতো পালায়! তার চেয়ে আধপেটা খেয়ে হলেও রোসেলা বরং গ্রীষ্মের দিনে লাল টুকটুকে কৃষ্ণচূড়া ফোটা দেখবে। ওর কথা ভেবে ভেবে ওর মা, ওর বোনেরা দুশ্চিন্তা করবে খুব। তা বলে কি পালিয়ে আসবে? পালিয়ে আসা যায় কখনও! ওর বড় হয়ে ওঠার দেশ, তার গাছপালারা ওকে দু-হাতে জড়িয়ে ধরতে চাইছে। ওর সিড লাইব্রেরি প্রতিদিন আরও অগোছালো হয়ে উঠছে নিত্যনতুন বীজের আহ্বানে। ও কি আসলেই তবে ভিতরে ভিতরে ভেঙে পড়ছে? মহামারী পূর্ব কোও এক শরতে সিলভিয়ার মেসেজ ভেসে এল… ‘ Hi  little sis! I am trying to convince Rossella to come to India for Durga Puja.We have to sort out many things but I am hopeful that she can make it. It would be so great! You will finally meet!!!…’ (april 10, 2017).

Rosella

গাছেদের ছেড়ে খুব স্বাভাবিক নিয়মেই রোসেলা আসেনি। আসবেই বা কেন! ও তো সবার মতো করে ভাবতে চায়নি কখনও! ওর রূপোলি চুলের রেখায় সময়ের ছাপ পড়েছে যত বেশি, ততই ও ভালবেসেছে এই মারীর পৃথিবীকে। প্রথম বিশ্বের যা কিছু সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, আরাম— সমস্তের বিনিময়ে ও বেছে নিয়েছে গাছেদের। ও কেবল বারবার বলেছে, ও চলে এলে ওর বাড়িভর্তি বীজ সব এলোমেলো হয়ে যাবে। সেসব বীজ বর্ষায় বর্ষায় ও কতক ছড়িয়ে দেয়, চারা বানায়, সে গাছে ফল হলে ফুল হলে ওর মনখানা ভরে ওঠে খুশিতে। কারাকাসের গাছেদের ছেড়ে ও থাকতে পারবে না। পারবেই না। ওকে দেখতে দেখতে আমার মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের গান— ‘পাগল যে তুই কণ্ঠ ভরে জানিয়ে দে তাই সাহস করে…’। সে সাহস ওর আছে জানি। জানি বলেই এমন বসন্ত দিনে ফুলের জলসায় ঘুরে ফিরে কেবল রোসেলার মুখখানা মনে পড়ে আমার। ওর সঙ্গে আর বোধহয় কখনও দেখাই হবে না! এত দূর থেকে আমি কেবল মনে মনে ভেবে নিতে পারি, নোয়ার নৌকার মতো একখানা মস্ত জাহাজের মাস্তুলে পিঠ রেখে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের রোসেলা। নৌকা চলেছে পাল তুলে। গৃহযুদ্ধ, অ-পরিশ্রুত জল, হারানো শৈশব— এই সমস্তকে পিছনে ফেলে বীজকোষখানা বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরে ও কন্যে কোথায় চলেছিস তুই? তুই কি আরেকখানা নতুন পৃথিবীর ঠিকানা জানিস? তোর ইতালির বাড়ি, নরম রুটির গন্ধ, চিলগুজা দিয়ে পেস্তো বানানোর সকাল, সমস্ত পড়ে রইল ওই। এমন বোকামিও মানুষ করে! ছিন্নমূল মানুষ তো তুই! তবু তোর শিকড়ের টান! 

 

 

আগামী পর্ব: এপ্রিল ২০২৩

ছবি সৌজন্য: লেখক

Amrita Bhattacharya

অমৃতা ভট্টাচার্য (জ.১৯৮৪-) শান্তিনিকেতনের জল হাওয়ায় বড়ো হয়েছেন। পাঠভবনে তাঁর পড়াশোনা। পরে বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগ থেকে বাংলা উপন্যাসে বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে গবেষণা করেছেন। পড়িয়েছেন জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউশনে এবং পরে চারুচন্দ্র কলেজে। বর্তমানে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের দেশজ রান্না নিয়ে কাজ করছেন। স্বপ্ন দেখেন পুঁজির প্রতাপের বাইরে অন্যরকম জীবনের, খানিকটা যাপনও করেন তা। যে হাতে শব্দ বোনেন সেই হাতেই বোনেন ধান, ফলান সব্‌জি। দেশ-বিদেশের নানা-মানুষের অন্যরকম জীবন দেখতে ভালোবাসেন। তাঁর লেখা স্মৃতিগ্রন্থ ‘বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ ’ এবং 'রেখেছি পত্রপুটে' পাঠকের সুসমাদর পেয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *