ব্রহ্ম এক এবং অদ্বিতীয়। একথা যেমন শ্বাশত সত্য, তেমনই ভারতীয় ধর্ম-সংস্কৃতি-সভ্যতা সেই এক অদ্বিতীয় ব্রহ্মকে বহুধা রূপে আরাধনা করে এসেছে বহু প্রাচীনকাল থেকেই, সেটিও সত্য। বেদে যেমন অদ্বিতীয় ব্রহ্মের কথা আমরা পাই, আবার সেই ঋগ্বেদেরই ছত্রে অগ্নি, ইন্দ্র, সূর্য, বরুণ-সহ রুদ্র, বিষ্ণুর উল্লেখও পাই। প্রাচীনকালের সত্যদ্রষ্টা ঋষিরা যে জগৎপালনকারী শক্তিকে দ্যুলোক, ভূলোক, অন্তরীক্ষে অনুভব করেছিলেন, পুরাণ, মহাকাব্য, শাস্ত্র, পঞ্জিকা থেকে আপামর সাধারণ মানুষের হৃদয়ের কোনও এক মণিকোঠায় তা সুপ্ত হয়ে রয়েই গেছে। কোথাও কখনও তা প্রকাশ পেয়েছে উচ্ছল নদীর স্রোতের মতো, কখনও বা তিরতির করে বয়ে চলেছে অন্তঃসলিলা ফল্গুধারার মতো। আর এইসব কিছু মিলিয়ে মিশিয়ে তৈরি হয়েছে বহু বিশিষ্ট সভ্যতার বিচরণ ক্ষেত্র।
ঋগ্বেদের ঋষি যেভাবে ত্রিবিক্রম বা উরুগায় অর্থাৎ বিস্তৃতভাবে বিচরণশীল এক পুরুষের উল্লেখ করেছেন, সেখানে বিষ্ণুর সঙ্গে সূর্যকে অভিন্ন মনে করা হয়েছে। শতপথ ব্রাহ্মণ, তৈত্তিরীয় আরণ্যকে আর এক দেবতা পরিচিত ‘নারায়ণ’ নামে, যেখানে তিনি যজ্ঞপুরুষরূপে বিদ্যমান। শতপথ ব্রাহ্মণ এই যজ্ঞপুরুষ নারায়ণ এবং আদিত্যকে একইসঙ্গে আরাধনা করেছে। “স যঃ স বিষ্ণুর্যজ্ঞঃ স । স যঃ স যজৌ সৌ স আদিত্য ।।” (১৪.১.১৬)
মহাভারতে বিষ্ণু, নারায়ণ দুই নামই আছে। বৃষ্ণি বা বৃষ্ণি সাত্বত জনগোষ্ঠীর জনপ্রিয়তম মানুষটি বসুদেবপুত্র শ্রীকৃষ্ণ রূপে জন্মগ্রহণ করে আদিত্য, বিষ্ণু, নারায়ণের সঙ্গে ভারতীয় সভ্যতায় একীভূত হয়ে গিয়েছেন। একইসঙ্গে অদ্বিতীয় এককসত্তার এমনভাবে তিন দেবসত্তার সমন্বিত রূপে প্রকাশ হওয়ার মহান রূপটি ‘বিষ্ণু’কে কেন্দ্র করেই সর্বত্র বিরাজমান। বিষ্ণুগায়ত্রী মন্ত্রে উচ্চারিত হয়েছে — “ওঁ নারায়ণায় বিদ্মহে, বাসুদেবায় ধীমাহি, তন্নোবিষ্ণু প্রচোদয়াৎ।” ভারতবর্ষের এই দেবতারূপে ঈশ্বরীয় চিন্তা ও সাধনা বহু বহু প্রাচীন। আজ যে ভারতবর্ষের মানচিত্র আমরা দেখতে পাই, পূর্বে সেই ভারতের পরিসর ছিল বহুদূর বিস্তৃত। শ্রীকৃষ্ণ ভগবদগীতায় যে বাণী উচ্চারণ করেছিলেন— “যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাং স্তথৈব ভজাম্যহম্। মম বর্ত্মানুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্ব্বশঃ” তা যেন সত্যই দেশকালের গণ্ডি অতিক্রম করে এক বৃহত্তর ভারতের আঙিনায় অবলীলাক্রমে ছড়িয়ে পড়েছে।

বঙ্গদেশের অতিনিকট প্রতিবেশী শ্যামদেশ, অধুনা থাইল্যান্ড। এই শ্যামদেশ ইন্দোচিন ভৌগোলিক রাজ্যের সীমারেখার মধ্যে সুপ্রতিষ্ঠিত। প্রাচীন মালয় উপদ্বীপ ও ইন্দোচিনকে ভারতবাসী ‘সুবর্ণভূমি’ নামে আখ্যা দিয়েছিল। সঠিক দিন-সালের হিসাব জানা নেই, তবে এই উপদ্বীপটির সঙ্গে সুপ্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার আদান-প্রদান বহুকালের। অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গের মানুষরা সমুদ্রযাত্রায় যেমন বিশেষ দক্ষ ছিলেন, তেমনি ব্যবসায়িক সূত্রে, রাজনৈতিক আদানপ্রদান তথা শিল্পী-ভাস্করদের সৃষ্টিদক্ষতায়, অতি উন্নতমানের গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে পারদর্শিতা-সহ ব্রাহ্মণ্যকুলের বিভিন্ন রাজপরিবারে সম্মানপ্রাপ্তির যোগ্যতার নিরিখে রাজপদ অধিকারে ‘ভারতবর্ষ’ স্বমহিমায় বিরাজ করে গেছে বর্হিভারতের এই প্রতিবেশী দেশগুলিতে। আর এই সবকিছুর মধ্যে দিয়েই, ঐতিহাসিক দিন-কালের হিসাব অতিক্রম করে ভারতীয় দেবদেবীরাও সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে আজও প্রাসঙ্গিক রয়ে গেছে এই বৃহৎ ভারতের প্রাঙ্গণে।
গুপ্ত সাম্রাজ্যের সাংস্কৃতিক গৌরব যেমন প্রচ্ছন্ন ছাপ ফেলেছিল বর্হিভারতের কৃষ্টিতে, তেমনি শ্রীবিজয়া, চোল, পল্লব, ও বাংলার পাল রাজাদের কিছু বৈশিষ্ট্যের প্রভাব পড়েছিল এই প্রতিবেশী দেশগুলিতে। বিগত কয়েক বছর থাইল্যান্ডে বসবাস করার সৌজন্যে এবং ন্যাশনাল মিউজিয়াম, ব্যাঙ্ককের সংস্পর্শে এসে এই প্রভাব অতি বিশদে চোখে পড়েছে। আর সত্যিই আপ্লুত হয়েছি একটি ঘোষিত বৌদ্ধধর্মাবলম্বী দেশের বিষ্ণুকে আরাধনা, সম্মান প্রদর্শন দেখে। থাইল্যান্ডের আপামর মানুষের কাছে বিষ্ণু পরিচিত ‘ফ্রা বিষিণু’, ‘ফ্রা নারাই’, ‘ফ্রা রামা’, অথবা ‘ফ্রা কিষিণা’ রূপে।
‘ফ্রা’ কথাটির অর্থ হল সম্মাননীয় দেবতা, বা গুরু। যে বিষ্ণুরূপী নারায়ণকে বেদ-পুরাণ গায়ত্রী মন্ত্রে ভারতবর্ষ আরাধনা করেছে, এ যেন তারই প্রতিধ্বনি। থাইল্যান্ডের বিষ্ণু আরাধনার ইতিহাস বা প্রত্নতাত্ত্বিকদের প্রদর্শিত তথ্য থেকে সংগ্রহ করেছি কিছু কথা, আর কিছুক্ষেত্রে দৈনন্দিন জীবনযাত্রার সঙ্গে সেই ফ্রা বিষ্ণু বা ফ্রা নারাই-এর নিগুঢ় যোগাযোগ থেকে। এ লেখা কোনও ঐতিহাসিক বা প্রত্নতত্ত্ববিদের লেখা ইতিহাসের কথা নয়, এক ভারতীয় নারীর নিজের দেশের সনাতন সভ্যতার চরণচিহ্ন খুঁজে পাওয়ার উল্লাসের আখ্যান, দেশের গণ্ডির বাইরে। এক শিল্পীর চোখে দেখা কিছু ভাস্কর্য, সৃষ্টিশীলতাকে দর্শন করার রচনা, এক অনুসন্ধিৎসু মানবীর চোখে দেখা রাজকীয় ঐতিহ্যমণ্ডিত কিছু অনুষ্ঠানের রূপরেখা— আর এই সবকিছুর সঙ্গেই সংপৃক্ত হয়ে আছে একটি নাম, তিনি শ্রীবিষ্ণু।
থাইল্যান্ডের প্রাচীন ইতিহাসের পাতায় বিষ্ণু আরাধনা প্রায় ষষ্ঠ, সপ্তম শতাব্দী থেকেই প্রচলিত। হয়তো তারও আগেও আরো কিছু ছিল। কিন্তু সর্বপ্রাচীন যে বিরাট পাথরের মূর্তিটি পাওয়া যায়, সেটি শ্রীবিজয়া সাম্রাজ্যের শাসনকালে, খুব সম্ভবত সপ্তম শতাব্দীর মধ্যভাগে ‘টাকুয়া পা’ নামক শহর থেকে প্রাপ্ত। তামিলনাড়ুর সঙ্গে এই শহরের বৈদেশিক বাণিজ্য তথা শাসনব্যবস্থারও যোগাযোগ ছিল। ‘টাকুয়া পা’ থাইল্যান্ডের দক্ষিণপ্রান্তে অবস্থিত। এই শহরটি আন্দামান সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলের অধীনে। হিন্দু রাজাদের সংস্পর্শে থাকার জন্য এই প্রদেশে অনেক বিষ্ণুমূর্তি, শিবলিঙ্গ-বা অন্যান্য ভারতীয় দেবদেবীর চিহ্ন পাওয়া গেছে।
‘টাকুয়া পা’ থেকে প্রাপ্ত বিষ্ণুমূর্তিটি পাথরের, উচ্চতায় প্রায় ২ মিটার ৩৫ সেন্টিমিটার। মুখটি খুব বেশিমাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত, কিন্তু অপূর্ব দেহসৌষ্ঠব। চারটি হাতও ক্ষতিগ্রস্ত। বর্তমানে ব্যাঙ্ককের জাতীয় জাদুঘরে প্রতিষ্ঠিত। ‘টাকুয়া পা’-র একটি প্রাচীন হিন্দু মন্দিরের ধ্বংসস্তূপ থেকে প্রাপ্ত এই মূর্তিটি। মন্দিরটি একটি ছোট পাহাড়ের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল, যার নাম ফ্রা নয়হিল। কথিত আছে, এই মন্দির সংলগ্ন বৃহৎ জলাশয়টি খনন করিয়েছিলেন তখনকার বিখ্যাত বাণিজ্য সম্প্রদায় ‘কোদুম্বালুর মণিরঙ্গম’। সেখান থেকে পাওয়া একটি শিলালেখে প্রাচীন তামিলে উল্লেখ করা আছে এটির নাম— ‘অবনী নারানাম’ বা ‘অবনী নারায়ণ’ রূপে।

‘টাকুয়া পা’ ছাড়াও ছিল আরো অনেক জায়গা। সমগ্র শ্যামদেশে ভারতীয় বিষ্ণুর প্রভাব প্রবল। ‘ছাইয়া’ নামক একটি জায়গা, যেটি ‘দ্বারাবতী’ শাসনকালের বলে মনে করা হয়, সেখানের বিষ্ণুমূর্তি পরিচিত ‘ফ্রা নারাই’ নামে। এই ‘নারাই’ শব্দটি ভারতীয় ‘নারায়ণ’ শব্দের থাই অপভ্রংশ। ‘সুরতমানী’ নামক প্রদেশে ফুম ডুয়াং নামক নদীর ৪০০ মিটার দূরের পর্বতমালায় এই বিরাট বিষ্ণুমূর্তির সন্ধান পাওয়া যায়। সেটি ‘খাও সি উইচাই’ নামেও পরিচিত। অনেকে মনে করেন এটি ‘নাখোন সি থাম্মারাত’-এর বিষ্ণু। এখানে কতকগুলি শব্দ খুব অপরিচিত মনে হচ্ছে। ‘সি’ অর্থে ‘শ্রী’ অর্থাৎ আমরা যেমন বলি শ্রীবিষ্ণু, এদের উচ্চারণে এটি তাই। ‘নাখোন’ কথাটি সংস্কৃত ‘নগর’ অর্থাৎ ‘শহর’ শব্দের প্রতিরূপ। আবার ‘থানী বা থানি’ মানে ‘স্থান’। তেমন ‘থাম্মারাত’ অর্থে ‘ধম্মরাজ’ বা ‘ধর্মরাজ’।
ব্যাঙ্কক মিউজিয়ামের গাইড হিসেবে গত কয়েক বছরে অনেক কিছু দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। অতি সুভদ্র সজ্জন ব্যবহারের থাইজাতির ইতিহাসে অনেক রাজবংশ, অনেক রাজার শাসনকাহিনি রয়েছে। রাজাদের প্রাসাদ বা ‘প্রাসাত’ (থাইভাষায়) নির্মাণে যেমন রামায়ণ, মহাভারতের ছাপ পড়েছে, তেমনি আজও বর্তমান গ্র্যান্ডপ্যালেস বা ব্যাঙ্ককের রাজপ্রাসাদের অলিন্দে বিষ্ণুরূপী ‘সি রামা’ বা ‘ফ্রা লামা’র কাহিনি উজ্জ্বলভাবে প্রতীয়মান। থাইল্যান্ডের প্রতিটি মানুষের কাছে রাজা = বিষ্ণু। এর অন্যথা আমি এখনও দেখিনি। প্রতিটি রাজপরিবারের সদস্যকে এঁরা বিষ্ণুরূপী স্বর্গের প্রতিভূ হিসেবে মান্যতা দেন। শ্রীরামচন্দ্রকে ভারতবর্ষ বিষ্ণুর সপ্তম অবতার বলে নির্দিষ্ট করেছে তার আধ্যাত্মিক, শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যায়। শ্যাম, কম্বোজ-সহ এশিয়ার বহুদেশ তাদের রাজাকে ঠিক এই বিষ্ণুরূপী রামচন্দ্ররূপেই পুজো করে থাকেন, এই ২০১৮ সালেও যা অত্যন্ত বাস্তব ঘটনা।

শিল্পের নেশায়, ভারততত্ত্বের ছাত্রী হিসেবে, ভালোবাসার টানে গুটিগুটি করে অনেকগুলি স্টাডি ট্রিপ বা সভ্যতা-সংস্কৃতি বিষয়ক ভ্রমণদলের সঙ্গী হয়েছি। আর এভাবেই পৌঁছে গিয়েছিলাম থাইল্যান্ডের উত্তর-পূর্ব প্রান্তের ‘নাখোন রাচাসীমা’র (নগর রাজাসীমা) ‘ফিমাই’-তে। কী আশ্চর্য ব্যাপার, দেখে হতবাক হয়ে গেলাম। ‘প্রাসাত হিন ফিমাই’ বলে চোখের সামনে যে অপূর্ব রাজপ্রাসাদ দেখছি, তা কথিত ভীমাপুরা বা ভীমের শহর নামে। ভামায়াপুরা→ ভীমায়া→ ফিমাই– এভাবেও ব্যাখ্যা করেন প্রাচীন থাইরা। আমরা হরপ্পা-মহেঞ্জোদারো সভ্যতায় সুন্দর রাস্তা নির্মাণের কথা পড়েছি, মেক্সিকোর মায়া সভ্যতার শহরগুলি বা প্রাচীন মিশরের শহরগুলির গঠনেও যে সুন্দর রাস্তা বা যাত্রাপথ ছিল জানি; এই ‘ফিমাই’ কেন্দ্রটি ছিল আঙ্কোরভাটের হিন্দু কম্বোজ রাজাদের এক সুদীর্ঘ হাইওয়ে বা অতিদীর্ঘ রাজপথের প্রান্তসীমার শহর। বিরাট জায়গা নিয়ে প্রায় আঙ্কোরভাটের আকৃতিতে তৈরি হয় ‘ফিমাই।’ ১০২০ × ৫৪০ মিটার জায়গা নিয়ে তৈরি এই মন্দির নগরী ছিলো দশম-দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে নির্মিত।
কম্বোজের ‘খমের’ রাজাদের অন্যতম বিশাল রাজপ্রাসাদটিতে অসংখ্য বিষ্ণু, শিবের মন্দির পাওয়া গেছে। অবাক হয়ে দেখেছি মন্দিরের লিনটেলগুলিতে শ্রীকৃষ্ণের জীবনী যেমন উৎকীর্ণ রয়েছে, তেমনই মহাভারতের অশ্বমেধ যজ্ঞের অপূর্ব পাথরের ভাস্কর্যও উপস্থিত। কৃষ্ণের কালীয়দমন যেমন উত্কীর্ণ তেমনি এই পাথরের কবিতায় মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গাকে দেখে চমকে উঠেছি। ফিমাই প্রাসাদ, ফিমাই ন্যাশনাল মিউজিয়াম, দুটোই অসাধারণ। লোপবুড়ি, সুকোথাই রাজত্বকালেও বহু অপূর্ব বিষ্ণুমূর্তি, কৃষ্ণকথার ভাস্কর্য তৈরি করেছে থাইল্যান্ড। বিষ্ণুর অনন্তশয়নের এক নয়নাভিরাম পাথরের মূর্তি আছে ব্যাঙ্কক মিউজিয়ামে। আর আছে ব্রোঞ্জের এক অসাধারণ বিষ্ণু। প্রায় সাতফুট দৈর্ঘ্যের এই মূর্তিটি ‘সুখোথাই’ সাম্রাজ্যের এক অসামান্য শিল্পকর্ম।

পাথুরে মূর্তির হিসেবনিকেশ থেকে মন সরিয়ে নিলে দেখি আজও বিষ্ণু স্মরণ করে সমস্ত রাজারা উপাধি গ্রহণ করছেন ‘রামা’। থাইল্যান্ডের এক প্রখ্যাত রাজবংশ ‘নারাই’ বংশ। রাজা নারাই (১৬৩৩–১৬৮৮ খ্রিঃ) বিখ্যাত ছিলেন ‘রামা হি বোদি’ নামেও। বিষ্ণুর বাহন ‘গড়ুর’ এখনও থাইল্যান্ডের জাতীয় প্রতীক যেমন আমাদের ‘অশোকচক্র’। ‘গড়ুর’ পরিচিত ‘ফ্রা ক্রু’ নামে। অর্থাৎ মহান গুরু। বহু লোকালয়ের মধ্যে, এমনকী অফিসে বা পার্কে ‘নারাই’ অর্থাৎ নারায়ণরূপী বিষ্ণু এবং তাঁর বাহনের মূর্তির উপস্থিতি অত্যন্ত প্রবল। ‘নারায়া’ নামে একটি বিখ্যাত ব্র্যান্ড আছে ব্যাগের। এয়ারপোর্ট থেকে যে কোনও বাণিজ্যকেন্দ্রে এর বিশেষ প্রভাব রয়েছে। এমনকী বেশ কিছু বড় আবাসিক প্রকল্প ‘নারাই’ বা ‘নারায়া’ নামে নামাঙ্কিত। থাইল্যান্ডের বর্তমান রাজবংশ বিখ্যাত ‘চক্রী’ রাজবংশ নামে, যা এসেছে শ্রীবিষ্ণুর আয়ুধ ‘চক্র’ থেকে। রাজপরিবারের নিজস্ব যে প্রতীক তাতেও দেখা যায় চক্রের উপস্থিতি। বার্ষিক হলকর্ষণ উৎসবে বিষ্ণু, নারায়ণ, লক্ষ্মীর উপস্থিতি এবং যথাযোগ্য মর্যাদায় পূজার অনুষ্ঠান দেখবার সৌভাগ্যও হয়েছে।

থাইল্যান্ডের বিভিন্ন প্রাদেশিক রাজপ্রাসাদগুলির ইতিহাসে বিষ্ণুর উপস্থিতি বহুল। কম্বোজ এবং ভারতের যুগ্মপ্রভাবে ভিনদেশের মাটিতে শ্রীকৃষ্ণের অভিনব উপস্থাপন তাই খুব উজ্জ্বল। কত যে স্থাপত্যে, ভাস্কর্যে, কালীয়দমনের উল্লেখ রয়েছে, তা বিস্ময়কর। অনেকে মনে করেন, এগুলি বোধকরি শুধুমাত্রই কাহিনি, কল্পনার খেলা। ভাবতে অবাক লাগে সেই কাহিনিকারদের লেখনী দক্ষতাকে, সম্মান করি সেই কল্পনার স্রষ্টাদের যাদের হাত ধরে ভারতবর্ষ এমনভাবে আপন হয়ে গেছে বর্হিভারতের অঙ্গনে। প্রাসাত ফিমাই, প্রাসাত শিখরাফুম, প্রাসাত ফানোমরুং যেমন আশ্চর্যজনকভাবে ‘বিষ্ণুকথা’র পাথুরে ভাষ্যকার, তেমনি অপূর্ব থাই মানুষদের দৈনন্দিন জীবনের অনুষ্ঠান— ‘কতা বুচা ফ্রা নারাই’ অর্থাৎ সত্যনারায়ণ পূজার থাই সংস্করণ। কতা — কথা, বুচা বা বুছা — পূজা, ফ্রা-নারাই অর্থাৎ শ্রী নারায়ণ। সত্যনারায়ণ পূজায় যেভাবে কথাপাঠ হয় এখানেও ‘কতা ফ্রা নারাই সংস্কৃত’ অর্থাৎ নারায়ণকথা সুর করে পাঠ করা হয়। ‘বিষিনু গায়ত্রী’ এবং ‘নারাই গায়ত্রী’ মন্ত্রপাঠ অত্যন্ত আবশ্যিক এই অনুষ্ঠানে।
এ প্রসঙ্গে একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার উল্লেখ করি। আমাদের পরিবারে প্রতিবছর একটি ‘সত্যনারায়ণ’ পূজার আয়োজন করা হয়, দেশে ও দেশের বাইরে যেখানেই থাকি। ব্যাঙ্ককে প্রথম বছর যখন অনুষ্ঠান করি, আমাদের পারিবারিক থাইভাষার শিক্ষিকাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। মনে মনে চিন্তায় ছিলাম থাই শিক্ষিকা হয়তো একটু অপ্রস্তুত বোধ করবেন পূজায় এসে। ভাষা আলাদা, আচার-আচরণও তাই। কিন্তু খুব অবাক হয়ে লক্ষ করেছিলাম, অত্যন্ত গভীর মনোযোগ দিয়ে তিনি পুরো অনুষ্ঠানটি দেখলেন। শুধু তাই নয়, ভক্তিভরে প্রণাম করে জানিয়ে গিয়েছিলেন যে তাঁরাও এইভাবে বিষ্ণুর আরাধনা করেন। তাঁর একটুও মনে হয়নি কোনও ভিনদেশির পুজো দেখছেন। আজ যখন এ বিষয়ে লিখতে বসেছি, তখন মনে পড়ছে সেই কথাগুলি। সত্যিই তো অনেক অমিলের মধ্যে বহু মিলও রয়েছে দু’দেশের ‘নারায়ণ’ আরাধনায়।
শিল্পের নেশায়, ভারততত্ত্বের ছাত্রী হিসেবে, ভালোবাসার টানে গুটিগুটি করে অনেকগুলি স্টাডি ট্রিপ বা সভ্যতা-সংস্কৃতি বিষয়ক ভ্রমণদলের সঙ্গী হয়েছি। আর এভাবেই পৌঁছে গিয়েছিলাম থাইল্যান্ডের উত্তর-পূর্ব প্রান্তের ‘নাখোন রাচাসীমা’র (নগর রাজাসীমা) ‘ফিমাই’-তে। কী আশ্চর্য ব্যাপার, দেখে হতবাক হয়ে গেলাম। ‘প্রাসাত হিন ফিমাই’ বলে চোখের সামনে যে অপূর্ব রাজপ্রাসাদ দেখছি, তা কথিত ভীমাপুরা বা ভীমের শহর নামে।
নারাই পূজার সামগ্রী ও আচার সঙ্গতভাবেই থাইজাতির নিজস্ব প্রভাবে প্রভাবিত। এদেশে কলাপাতা দিয়ে এক অপূর্ব শিল্পকর্ম করা হয় যাকে ‘ক্র্যাথোং’ বলে। সেই কলাপাতার ‘ক্রাথোং’-এ কী কী থাকে জানলে অবাক হতে হয়। একধরনের রঙবেরঙের মুড়ির চাক (অনেকটা আমাদের বাদামচাকের মতো), তিনরকম সবজি, পাঁচরকম মিষ্টি জাতীয় খাবার, তিনটি ফল, মূলতঃ কলা, নারকেল এবং আখ, দুধ, ঘি বা মাখন, ক্যাপরাও বা থাই তুলসিপাতা, সাদা এবং সবুজ শস্যবীজ, লাল বিন, নারকেলের দুধে তৈরি, সুগন্ধী জল (অগুরুর মতো) সাতটি ছোট ছোট সবুজ পতাকা, তিনটি রঙিন কাপড়ের টুকরো সবুজ, লাল, হলুদ রংয়ের। একটি ছোট পাথর, বা সিমেন্ট, কখনও কাঠের কারুকার্য করা একটি খণ্ড, এবং তারই সঙ্গে আমাদের ঝুলনের মতো কিছু গরু, বাছুর, হাতি ঘোড়ার ছোট ছোট মূর্তি! ধূপ, মোমবাতি, ফুল তো অবশ্যই আছে। এর সঙ্গে থাকে এক গ্লাস জল।

আরো চমৎকার ব্যাপার, ওই পাথরের বা কাঠের খণ্ডটিকে স্নান করানোর জন্য সুগন্ধী জল রেখে দেওয়া হয় শাঁখের ভিতর। পূজার আয়োজন সমাপ্ত হলে ‘নারাই কতা’ অর্থাৎ বিষ্ণুকথা পাঠ হয়। তারপর আমাদের যে রকম বাহুতে বা কবজিতে লাল বা সাদা মন্ত্রপূতঃ সুতো বাঁধা হয়, এখানে তেমনি অ্যামুলেট অর্থাৎ ধাতব মাদুলি পরার চল রয়েছে। মাদুলিটি তিনবার মন্ত্রোচ্চারণ করে ধারণ করা হয়। প্রথমবার বলার পর নারায়ণের আসনে রাখা হয়। একে বলা হয় ‘পিতি বুয়াং সুআং’। স্থানীয় মানুষ বিশ্বাস করেন, এই মাদুলিতে রোজ অন্ততঃ একবার করে ফুঁ দিতে হয়, যা তোমার নিঃশ্বাসকে এই মাদুলিতে ধরে রাখে। এদের বিশ্বাস এই মাদুলি ভক্তকে দীর্ঘজীবন দান করবে। শুধু তাই নয়, শ্রী নারাই-এর দৈবশক্তি ও আশীর্বাদে ভক্তের জীবন ধন্য হবে। নিজস্ব দেশীয় ভঙ্গীতে উচ্চারিত হয় বিষ্ণু গায়ত্রী মন্ত্র, নারায়ণী গায়ত্রী মন্ত্র, তারপর নারায়ণের কাছে আশীর্বাদ প্রার্থনা করা, যাকে ‘বাতা খোর পোন’ বলা হয়।
ভাবতে আশ্চর্য লাগে, কোন সুদূরকালের কোনও বণিক বা ব্রাহ্মণদের সঙ্গে যে আচার-অনুষ্ঠান এসে পৌঁছেছিল এদেশে, আজও তা পালিত হচ্ছে। মনে পড়ে আমাদের ব্রতকথায় বণিকদের কাহিনি। কী জানি হয়তো কোনও নদীর পারে চোখে পড়েছিল ভিনদেশি মানুষেরা পুজো করছেন। এদেশের মানুষ জানতে চান এ কীসের পুজো, কী ফল পাবে, উত্তরে শোনেন প্রভুশ্রী নারায়ণের জয়। দেশ-কাল-পাত্রভেদে প্রবহমান বিশ্বাস, ভালোবাসা, ভক্তি, শ্রদ্ধার এক জীবন্ত চলমানতা। ‘শ্রীবিষ্ণু’ তাই কখনও ‘কিষিণা’ হন, কখনও বা ‘নারাই’, কিন্তু তাঁর রূপ বদল হলেও মূল বিশ্বাস থাকে একই।
*লেখাটির ইংরিজি সংস্করণ পড়তে হলে ক্লিক করুন Vishnu Katha লিংকে।
তথ্যসৌজন্য:
(১) দেবদেবী ও তাঁদের বাহন — স্বামী নির্মলানন্দ, অষ্টম সংস্করণ, প্রকাশক — ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ। ১৪১৮।
(২) প্রতিমা শিল্পে হিন্দু দেবদেবী — কল্যাণ কুমার দাশগুপ্ত। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা অ্যাকাদেমী। ২০০০, মে।
(৩) শিল্পে ভারত ও বর্হিভারত — মণীন্দ্রভূষণ গুপ্ত। আনন্দ পাবলিশার্স। তৃতীয় মুদ্রণ, মে ২০১১।
(৪) Brahmanism in South East Asia — Dawee Daweewarn, Sterling Publishers Private Limited.
(৫) Siamese State Ceremonies — Their History and function — H.G. Quaritech Wales., Bernard Quaritech Ltd. London, 1931.
(৬) Hindu Gods of Peninsular Siam — Stanley J. O’Connor. Yr. Arti bus Asiae. Switzerland, 1971.
(৭) Ancient Khmer Sites in North Eastern Thailand. (Khorat, Buriram and the Angkor-Phimai Route). by — Asger Mollerup, White Lotus Publication-2018.
(৮) A History of Indian Shipping and Maritime Activity — by — Radha Kumud Mookerjee, Longmans, Green And Co. 1912.
ছবি সৌজন্য:
লেখক, ebay, Wikipedia, Swatantramag
লেখক ও গবেষক অনিতা বসু দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াতে ভারতীয় হিন্দু সংস্কৃতির প্রভাব নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করছেন। এর পাশাপাশি পটচিত্র ও বয়নশিল্প নিয়েও তাঁর গভীর আগ্রহ ও চর্চা। থাইল্যান্ডে থাকাকালীন ব্যাংকক ন্যাশনাল মিউজিয়ামে তিনি একমাত্র ভারতীয় ট্যুর গাইড হিসেবে নজির গড়েছেন।