আজ যাঁর কথা বলব, বা বলার চেষ্টা করব, তিনি আমার বড় কাছের মানুষ, প্রাণের মানুষ, ভালোবাসার মানুষ। সেই মানুষটি সর্বজনপ্রিয়। তাঁর সঠিক রূপ দেওয়া আমার সাধ্য নয়। তবে মহাভারতে একলব্য যেমন অর্চনা করবে বলে তার গুরুর মূর্তি গড়েছিল, আমিও মনের মধ্যে আমার দ্রোণাচার্যের যে রূপ এঁকেছি, তা আজ সবার সামনে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করব।

আমার কোনও লেখা যদি কখনও কারও ভালো লেগে থাকে, তার সব কৃতিত্ব একজনের। তিনিই আমার শিক্ষক, আমার গুরু, আর তাঁর কাছেই আমার লেখার হাতেখড়ি। সেই মানুষটি অনেক বড় মাপের ও বড় মনের। অতি স্নেহে তিনি আমাদের কাছে টেনে নিয়েছিলেন, এ আমার এক বিরাট পাওয়া। আমার অতিঘনিষ্ঠ সর্বজনপ্রিয় মানুষটির নাম শ্রীমতী নবনীতা দেব সেন। আমার দিদি।

কেমন করে শুরু করি, কোথা থেকে শুরু করি, তা জানি না। মনে হয় এ সম্পর্ক চিরদিনের। তাঁর কথা বলা শুরু করি তাঁর সঙ্গে আমার এক বোঝাপড়ার চিঠি দিয়ে।

দিদি, 

আজ তোমারই নাম বলব নানা ছলে। কিন্তু পারছি না বলতে। গলার কাছে দলা পাকানো কী একটা, চোখ ঝাপসা করে দিচ্ছে। পারছি না স্মৃতিচারণ করতে। আজ দু’বছর হল তুমি ঠিকানা বদলেছ, যাবার সময় তাড়াহুড়োতে ঠিকানা দিয়ে যাওনি। যাঁর সঙ্গে প্রায় প্রতিদিনের কথা, যাঁকে সব লেখা আগে পড়াতাম, আর যাঁর কাছ থেকে অনেক আদর ভরা, ভুল শুধরে দেওয়া এক প্রত্যুত্তর তড়িঘড়ি পেয়ে যেতাম, তাঁকে এত সহজে যেতে দেওয়া যায়? কে আমাকে লেখা পড়েই ফোন করে বলবে, “তুই লেখ, আরও লেখ!” আজও প্রতিটা লেখা আমি তোমায় পড়ে শোনাই, অপেক্ষায় থাকি তোমার সম্মতির। কে বলবে দিদি তুমি ছাড়া? তুমি যে আমার দ্রোণাচার্য!

Nabanita dev sen 1
ওঁকে দেখে কিন্তু খুব নরমসরম মানুষ বলে মনে হল না!

দিদির সঙ্গে প্রথম আলাপ অন্তরার মারফত ১৯৮৬-তে বস্টনে, আমাদের ওয়ান বেডরুম অ্যাপার্টমেন্টে। রাহুল ওঁকে আনতে গেল। আমি যথারীতি যে ক’টা রান্না জানি করে ফেললাম। আসলে রান্নার ব্যাপারে তখন আমি নেহাতই অজ্ঞ। তারপর উনি এলেন। ওঁকে দেখে খুব নরমসরম মানুষ বলে কিন্তু মনে হল না! আমি একটু দূরে দূরেই ব্যস্ত হয়ে রইলাম। রাহুলের সঙ্গেই কথা হচ্ছিল। কিন্তু কোথায় যেন ঠিক সুরে লাগছিল না। কানে আসছিল উনি বলছেন “আমি না থেকে চলেও যেতে পারি, হার্ভার্ড ফ্যাকাল্টি লাউঞ্জে বার্গার বা কিছু খেয়ে নেব–“

রাহুলও মুখের ওপর বলে দিল, “আপনি যদি থাকেন তো থাকুন। না হলে আপনাকে আমি পৌঁছে দিয়ে আসছি, যাবার পথে ম্যাকডোনাল্ডে বার্গার খাওয়াতে পারি।” হিতে বিপরীত দেখে তখন আমি মঞ্চে নামতে বাধ্য হলাম।
– আপনি চলে যাবেন? আমি যে আপনার জন্যে রান্না করেছি, না খেলে যে আমার খারাপ লাগবে!
ভাগ্যিস বলেছিলাম! তাইতো স্বনামধন্য নবনীতা দেবসেন আমার দিদি হয়ে গেলেন! এককথায় মানুষটি ঝকঝকে হেসে উত্তর দিলেন
– নিশ্চয়ই খাব, তুমি করেছ আর আমি খাব না?
সেই থেকেই আমাদের বন্ধন।

১৯৯৩ সালে আমেরিকার এক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান দুর্গাপুজোতে দিদিকে আমন্ত্রণ করেছিল। দিদি এলেন আমাদের কেনা ছোট্ট দু’কামরার ফ্ল্যাটে। এ দেশে দুর্গাপুজো মানে অনেক কাজ। আমার ওপর ভার ছিল মিষ্টি তৈরি করার, প্রায় শ’চারেক সন্দেশ। ইতিমধ্যে আবার আমাদের ঘরে নতুন অতিথি এসেছে। আমি মা হয়েছি। তখন আমি Mass General Hospital-এ কাজ করি। ছেলের জ্বর বলে শুক্রবার ছুটি নিয়েছি, নাহলে অত মিষ্টি করব কখন? হঠাৎ বাড়িতে ফোন: “আমাকে এক্ষুনি তুলে নিয়ে যা।”

আমি জানতাম দিদি শনিবার সকালে আসবেন। তার মধ্যে মিষ্টি শেষ করে বাড়ি সাজিয়ে ফেলব। রাহুল বাড়ি নেই, ঠাকুর আনতে গেছে storage থেকে। আবার ফোন,”আমাকে তাড়াতাড়ি নিয়ে যা তোদের কাছে।” বললাম, “ঠিক আছে। আমার এক বন্ধু তোমাকে তুলে নিয়ে আসবে।” বন্ধু খুব খুশি। এমন একজন বড় মাপের মানুষকে ওদের গাড়িতে নিয়ে আসবে! যাইহোক, দিদিকে ওরা কেমব্রিজে থেকে তুলতে গেছে। দিদিকে দেখেই আমার বন্ধু প্রণাম করে বলেছে “মাসিমা আপনি গাড়িতে বসুন। আমি আপনার ব্যাগটা গাড়িতে তুলে দিচ্ছি।” দিদির তৎক্ষণাৎ উত্তর, “আমাকে মাসিমা বলবেন না, আপনার বয়সী আমার কোনও মেয়ে নেই। আমি নবনীতা দেবসেন।” এই হলেন আমার দিদি, অথচ কতবারই আমাকে বলতে শুনেছি, “তুই তো আমার মেয়ের মতো।”

nabanita devsen
সামান্য শাড়ি উপহার পেয়ে কী খুশি যে হলেন!

যাইহোক, দিদি তো এলেন আমাদের বাড়িতে। কাণ্ডকারখানা দেখে অবাক।
– ওমা করেছিস কী? এ তো মিষ্টির কারখানা চলছে রে! আজ তোর ছুটি?
সত্যি কথাই বললাম।
– বাবুর জ্বর বলে ছুটি নিয়েছি।
ব্যাস হয়ে গেল। ফিরে গিয়ে দিদি একটা লেখা লিখলেন, কোন পত্রিকায় বেরিয়েছিল তা আমার মনে নেই। তাতে ছিল নাকি, বিদেশে ছেলের জ্বর বলে ছুটি নিয়ে শত শত মিষ্টি করছে, গান করছে, আল্পনা দিচ্ছে, আবার আমায় কত যত্ন করল রত্না! পড়বি তো পড় আমার বাবা দেখলেন সেই লেখা। তারপরেই ‘ভালোবাসা’ বাড়িতে গিয়ে বাবা রত্নার স্বরূপ উদ্ঘাটন করে এলেন!

যাইহোক, আবার সে বছরের কথায় ফিরে আসি। পুজোর সময় দিদি আসছেন। ক্ষমতা সামান্যই, তবু আমাদের সাধ্যমতো দিদিকে একটা শাড়ি কিনে দিলাম। কী খুশি যে হলেন! বারবার বলতে লাগলেন, “আমি তো তোর জন্যে কিছু আনিনি…।” আসলে দিদির আসাটাই যে আমাদের কাছে পরম পাওয়া, তা যদি জানতেন!

ফিরে যাবার দিন সি অফ করতে গেছি। তখন এয়ারপোর্টে এত কড়াকড়ি ছিল না। যাত্রীদের অনেকদূর পর্যন্ত এগিয়ে দেওয়া যেত। সিকিউরিটি চেক করার আগে দিদি আমাকে বললেন, “তুই একটু কাছে আয়।” গেলাম। বললেন, “তুই এই ক’দিন ধরে আমার জন্যে কত কিছু করলি! শাড়ি দিলি, এত কাজের মধ্যেও রাধাবল্লভী করে খাওয়ালি! আজ আমি তোকে একটা ছোট্ট জিনিস দেব, যাতে তুই অনেকদিন আমাকে মনে রাখিস।” এই বলে ব্যাগ থেকে একটা ছোট্ট বটুয়া বার করে তার থেকে একটা ছোট্ট হিংয়ের কৌটো বের করলেন। বললেন, “তুই যখনই একটু হিং ফোড়ন দিবি, তখনই আমার কথা মনে পড়বে।” হিংয়ের কৌটোর হিং কবেই শেষ হয়ে গেছে কিন্তু তার সেই মায়াবি গন্ধ আর দিদির স্নেহের পরশ এখনও আমাকে জড়িয়ে রয়েছে!

এই প্রসঙ্গে একটা বড় কষ্টের কথাও না বললেই নয়! ২০১৮-তে আমরা দেশে যাবার আগে থেকেই দিদি রাহুলকে বলেছিলেন, আমার অজান্তে আমার কিছু লেখা পাঠাতে বই বার করার জন্যে। নিজে থেকেই বলেছিলেন আমার বইয়ের মুখবন্ধ লিখবেন। তারপর দেশে গিয়ে আমায় অবাক করে বই উদ্বোধন করবেন। আমি জানতে পেরে বাধা দিলাম। আমার বক্তব্য, “আমার আরও অনেক লেখা বাকি।” কিন্তু সে যে আমার জীবনে কত বিরাট ভুল, কত বিশাল ক্ষতি, তা আজ বুঝতে পারি। আজ চাইলেও দিদির লেখা মুখবন্ধ পাব না। তবে যা পেয়েছি তা কিছু কম নয়। সে হল তাঁর অফুরন্ত ভালোবাসা!!

১৯৯৩ সালে আমেরিকার এক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান দুর্গাপুজোতে দিদিকে আমন্ত্রণ করেছিল! দিদি এলেন আমাদের কেনা ছোট্ট দু’কামরার ফ্ল্যাটে! এ দেশে দুর্গাপুজো মানে অনেক কাজ! আমার ওপর ভার ছিল মিষ্টি তৈরি করার, প্রায় ৪০০ সন্দেশ! ইতিমধ্যে  আবার আমাদের ঘরে নতুন অতিথি এসেছে! আমি মা হয়েছি! তখন আমি Mass General Hospital-এ কাজ করি! ছেলের জ্বর বলে শুক্রবার ছুটি নিয়েছি, নাহলে অত মিষ্টি করব কখন? হঠাৎ বাড়িতে ফোন: আমাকে এক্ষুনি তুলে নিয়ে যা!

একবার আমি দেশে গেছি। দিদি আমাকে আর কবিতাদিকে একসঙ্গে এক সন্ধ্যেবেলা যেতে বললেন। বিদেশ থেকে দেশে একা যেতে পারি। কিন্তু দেশে আমার সবসময় একজন বডিগার্ড লাগে চলাফেরা করতে। ঠিক হল, আমার বাপের বাড়ি থেকে কেউ দিদির বাড়িতে পৌঁছে দেবে আর রাতে দিদির বাড়ি থেকে কানাই বা অন্য কেউ যাদবপুরে শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছে দেবে। সন্ধ্যের দিকে দিদির বাড়ি গেলাম, কবিতাদি এসে গেছিলেন। খুব আনন্দে কেটেছিল সন্ধ্যেটা, অনেক গল্প, গান, কবিতা পাঠের মধ্যে দিয়ে। খুব আনন্দ করে রাতের খাবার খেলাম। কবিতাদি বললেন, আমি একটা ট্যাক্সি নিয়ে স্বপ্নাকে নামিয়ে দিয়ে বাড়ি চলে যাব। কিন্তু দিদি কিছুতেই ছাড়বেন না। “আর একটু বসো!”

এদিকে এই করে করে ঘড়িতে তখন রাত দশটা। দিদির হঠাৎ খেয়াল হল, “স্বপ্না, তোরা আমাকে ড্রাইভ করে পৌঁছে দিস, আজ আমি তোদের দু’জনকে পৌঁছে দিয়ে আসব।” কানাইকে বললেন গাড়ি বের করতে। কানাই বলল, গাড়ি বের করার অসুবিধে আছে, সামনে লোকে শুয়ে আছে। দিদির হুকুম, “যেমন করে হোক গাড়ি বের কর, আজ আমি ড্রাইভ করে পৌঁছে দেবই দেব।”

সেই গাড়ি বেরলো প্রায় এগারোটায়! দিদি আমার পাক্কা ড্রাইভার, সে বিষয়ে তো কোনও সন্দেহ নেই। তবে মনে বেশ ভয় ছিল। অনেক রাত তো হল! কবিতাদিকে আগে নামানো হল। ওঁর বাড়ির গেট বন্ধ হয়ে গেছিল, দিদির হাঁকডাকে খুলে দিল। এরপর চললাম যাদবপুর। তখন ঘড়িতে প্রায় রাত বারোটা! আমারা ১১/১ সেন্ট্রাল রোডে গিয়ে পৌঁছলাম।

Nabanita devsen
দিদির খেয়ালখুশির তল পাওয়া ছিল কঠিন

দিদি তড়িঘড়ি আমার হাত ধরে গাড়ি থেকে নামলেন। আমার শ্বশুরবাড়ির সামনে বাগান, বাড়ি থেকে গেটটা বেশ দূরে। চারদিক ঘুমন্ত, নিঃঝুম। দিদি গেটটা ধরে জোরে জোরে নাড়তে লাগলেন। কোনও সাড়া পাওয়া গেল না। আরও জোরে গেট ঝাঁকুনি, তাতেও সাড়া নেই।  এইবার দিদির জোরে জোরে ডাক, “মিস্টার রায়, মিসেস রায়, আপনাদের বৌমাকে গেট থেকে নিয়ে যান, আমি আপনার বৌমাকে পৌঁছে দিলাম—“

তখন মিস্টার রায়, মিসেস রায় কেন, একে একে চতুর্দিকের সব বাড়ি থেকে আলো জ্বলে উঠল। মা বারান্দায় বেরিয়ে এল। আমি যত বলছি “এবার আমি চলে যাই, ওই তো মা দাঁড়িয়ে আছে…” দিদি নাছোড়। না, তোমার শ্বশুরমশায়ের হাতে আমি হ্যান্ড টু হ্যান্ড ডেলিভারি দিতে চাই। বাবা গেটের কাছে এলেন দেখে, গুডনাইট বলে দিদি অবশেষে গাড়িতে ফিরে গেলেন। আর আমি, ধরণী দ্বিধা হও, নতচক্ষু হয়ে সবার চোখের সামনে বাবার পেছন পেছন বাড়িতে গিয়ে ঢুকলাম। 

এই সদাহাস্যময়ী দিদির আবার অন্য এক রূপও দেখেছি। দিদি তখন কেমব্রিজে। এক শনিবার আমাদের ফোন করলেন “কিছু করছিস? একটু আসবি?” গেলাম দিদির কাছে। দেখছি একটু চুপচাপ। বললেন, “কী রকম মেঘলা দিন। মনখারাপ লাগছিল। তাই তোদের ডাকলাম। আমরা একটু চা খাই। তারপর তোরা আমায় গান শোনা।” সেটা তো কোনও ব্যাপারই নয়, বিশেষ করে রাহুলের কাছে। ওকে বললেই ও একের পর এক গান গেয়ে যাবে, আমিই বরং একটু ধানাই পানাই করি। দিদির পাশে একটা কবিতার বই ভাঁজ করা ছিল। তুলে দেখি দিদিরই বই। বললাম, “পড়ছিলে? আমাদের একটু পড়ে শোনাও না!”

বাইরে সন্ধ্যে নামছে। একরাশ চুল খোলা। কপালে বড় টিপ। আধো অন্ধকারে বসে দিদি একের পর এক কবিতা পড়ে যাচ্ছেন। কেমন যেন মনকেমন করা একটা পরিবেশ সবাইকে ছুঁয়ে আছে। ভুলে গেছি বাড়ি ফেরার কথা। সবাই কেমন এক আচ্ছন্নতায় বুঁদ হয়ে ছিলাম। কত সময় কেটে গেল কে জানে? বাইরে সন্ধ্যে নেমেছে। দিদিই নিঃস্তব্ধতা ভাঙলেন বই বন্ধ করে। বললেন, “আজ আর নয়, এবার তোরা বাড়ি চলে যা।” তারপর কী মনে হল আমাকে বললেন, “তুই একটু আমার সঙ্গে ওপরে আয়।” ঘরে নিয়ে গিয়ে দেওয়ালে একটা পেন্টিং দেখালেন। আমি জানি না, তাই জিজ্ঞেস করলাম, “কার আঁকা দিদি? তোমার? বোতলের মধ্যে তিনটে মেয়ের মুখ কেন? বোতলের মুখ তো বন্ধ।” দিদি একটু চুপ করে থেকে বললেন, “আমার জীবনে এমন একটা সময় গেছে, যখন মনে হয়েছিল আমি মুখ বন্ধ বোতলের মধ্যে আছি, দম নিতে খুব কষ্ট হত! ছবিতে সেই কষ্টেরই প্রকাশ।” আমি দিদিকে কিছু বলতে বা সান্ত্বনা দিতে পারিনি সেদিন। কিছুক্ষন নিথর দাঁড়িয়ে থেকে নীচে নেমে এসেছিলাম। দিদি নিজেকে আড়াল করতেই যেন তড়িঘড়ি আমাদের বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। 

Nabanita devsen
দিদির অন্য রকমের রূপও যে কতবার দেখেছি…

আর একবার আমরা দেশে গেছি। প্রতিবারের মতো দিদি আমাদের ফোন করছেন।
– কখন আসবি? আজ জন্মদিন, এক্ষুনি কেক কাটা হবে, আর তোরা দেরি করছিস? এখুনি চলে আয়, একটুও দেরি করিসনি!
আমরা থতমত! আজ দিদির জন্মদিন? জানি না তো? কিছু তো কেনা হয়নি। কোনওমতে পৌঁছে ধড়মড়িয়ে দোতলায় উঠছি। “দিদি” বলে ডেকেছি। তিনতলা থেকে শুনতে পেলাম,
– তোমরা একতলায় চলে যাও। যতক্ষণ না বলব ওপরে এসো না! 
আমরা সুড়সুড় করে একতলায় গিয়ে দাঁড়ালাম! দিদির মুড্ বোঝা ভার। তারপর কী একটা ঘটঘট খটখট আওয়াজ শুরু হল। আর মিনিট কয়েক বাদে আমাদের ওপরে যাবার রথ এসে থামল। সঙ্গে সঙ্গে দিদির অর্ডার: “আমি চেয়ার কার পাঠাচ্ছি। আগে স্বপ্না ওপরে উঠে আসবি। তারপর রাহুল।” অতঃপর দিদি তাঁর নতুন বাহনে করে আমাদের আবাহন করে তিনতলায় তুললেন। কিন্তু কই? জন্মদিনের হুড়োহুড়ি তো কিছুই দেখছি না! দিদি কানাইকে বললেন, “স্বপ্নারা এসে গেছে। এবার কেক নিয়ে এসো, আর বার্থডে বয়কে হ্যাট পরিয়ে নিয়ে এসো। নে, এবার তোরা সবাই হ্যাপি বার্থডে গান কর।”

দিদি আমাকে আর কবিতাদিকে একসঙ্গে এক সন্ধ্যেবেলা যেতে বললেন। বিদেশ থেকে দেশে একা যেতে পারি। কিন্তু দেশে আমার সবসময় একজন বডিগার্ড লাগে চলাফেরা করতে। ঠিক হল, আমার বাপের বাড়ি থেকে কেউ দিদির বাড়িতে পৌঁছে দেবে আর রাতে দিদির বাড়ি থেকে কানাই বা অন্য কেউ যাদবপুরে শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছে দেবে। সন্ধ্যের দিকে দিদির বাড়ি গেলাম, কবিতাদি এসে গেছিলেন। খুব আনন্দে কেটেছিল সন্ধ্যেটা, অনেক গল্প, গান, কবিতা পাঠের মধ্যে দিয়ে। খুব আনন্দ করে রাতের খাবার খেলাম।

অবাক কাণ্ড! বার্থডে বয় কে? কার জন্যে গান করব? দিদির জন্মদিন নয়? দেখি কানাই কেল্টুসকে ধরে, তার মাথায় টুপি পরিয়ে নিয়ে এলো আর ঝর্ণা ট্রেতে করে কেক। আমরাও দিদির সঙ্গে গলা মিলিয়ে “হ্যাপি বার্থডে টু ইউ” গাইলাম। দিদি কেক কাটলেন, কেল্টুস কে আদর করলেন। তারপর বার্থডে বয় সুট করে তার মায়ের পায়ের কাছে খাটের তলায় ঢুকে গেল। আমরা মহানন্দে কেক লুচি তরকারি মিষ্টি পায়েস খেয়ে বাড়ি ফিরলাম!

২০১৯-এর ১২ জানুয়ারি রাত্তিরে ফোন করেছি। কারণ পরেরদিন জন্মদিনে অনেক মানুষ আসবেন, দিদিকে অনেকে ফোন করবেন, আমি কথা বলার সুযোগ পাব না। ফোনে বললাম, “দিদি আমাদের যাওয়া হল না, কিছু পাঠাতেও পারলাম না। মনটা খারাপ।” দিদির উত্তর, “স্বপ্নারানি আর কী পাঠাবে বলো? আমি তোমার দেওয়া ক্রিম মেখে, তোমার দেওয়া কাফতান পরে তোমারই করা ব্ল্যাঙ্কেট গায়ে দিয়ে বসে আছি। আর কী দেবে? চটপট তোরা দুজনে একটা গান শুনিয়ে দে, আমি ঘুমোতে যাব!”

Author with the legend
দিদির সঙ্গে আমরা, ভালোবাসা বাড়িতে। ছবি: লেখকের ব্যক্তিগত অ্যালবাম থেকে

অবশ্য আমার পালটা উপহারও কিছু কম জুটত না! কখনও বই, কখনও কাঁথা কাজের বা বাটিকের স্টোল, কখনো শাড়ি। এর মধ্যে দুটো উপহার খুবই উল্লেখযোগ্য। একবার দিদির লেখা “ভালোবাসা ভালোবাসা” বইটা পাঠালেন! তাতে লেখা: টুমপারানিকে দিলাম, জানি পড়বে না। দু’বছর পরে রাহুল ও স্বপ্নারানিকে দিলাম, জানি পড়বে।” আর একবার দিদি আমাদের এমন এক উপহার পাঠালেন যা আমাদের স্বপ্নেরও অতীত। আমাদের উৎসর্গ করলেন একটা বই– ‘চাকুমচুকুম’। এ তো আমাদের কাছে লটারি পাওয়া! সত্যিই কি আমরা এর যোগ্য?

দিদি, আজ আমার জীবনে এক বড় দুঃখ মেশানো আনন্দের দিন, জানো। হঠাৎ এক প্রাপ্তিযোগে তোমাকে হারানোর ব্যথা আবার নাড়া দিল। কয়েকদিন আগে আমি লেখার জন্যে একটি স্বীকৃতি পেলাম। পুরস্কারটি নর্থ আমেরিকার Gayatri Marsh Memorial Awards For Literary Excellence. লেখার জন্যে স্বীকৃতি পাওয়া আমার জীবনে এই প্রথম। আজই আমার হাতে এটা এসে পৌঁছলো। আমার এই পুরস্কার যাঁকে সবচেয়ে খুশি করত, যাঁর হাতে তুলে দিলে আমি সবচেয়ে খুশি হতাম, তাঁর ঠিকানা আজ আমার অজানা। একলব্যের আর গুরুদক্ষিণা দেওয়ার সুযোগ হল না। আজ তাই আমার ঘরে গুরু ও দক্ষিণা একই ফ্রেমে বেঁধে রাখলাম। 

Email from Nabanita Dev Sen
আমার সবচেয়ে বড় পুরস্কার। ছবি: লেখকের ব্যক্তিগত অ্যালবাম থেকে

সেবার সদ্য তুরস্ক ঘুরে আসার ঘটনা নিয়ে “মধুসূদনদাদা” নামে ছোট একটা রম্যরচনা লিখেছিলাম এক পত্রিকার জন্যে। তো সেই পত্রিকার সম্পাদক বললেন লেখাটা নাকি বেশ ভালো হয়েছে। দিদি না-বলা পর্যন্ত তো আমার শান্তি নেই। তাই মনে বেশ কিন্তু কিন্তু নিয়ে, সঙ্কুচিত হয়েই দিদিকে লেখাটা পাঠালাম ৮ ফেব্রুয়ারি। উত্তরের অপেক্ষায় বসে আছি। কোনও সাড়াশব্দ নেই। মাঝে দুটোদিন অশান্ত মনে কেটে গেল। মনে মনে বললাম, ছিছি, এ লেখা কখনওই পাঠানো উচিত হয়নি। আর তাই উত্তরের আশাও করা উচিত নয়। আর ১০ ফেব্রুয়ারি পেলাম সেই অপ্রত্যাশিত উত্তর, যা আমার চিরজীবনের পাথেয় হয়ে থাকবে। 

 

*বাকি ছবি: নবনীতা দেব সেন ফেসবুক পেজ থেকে। 

আশির দশকে হাওড়ার বর্ধিষ্ণু যৌথ পরিবারের ঘোরাটোপ ছেড়ে বেরিয়ে বিজ্ঞান গবেষণা করতে মার্কিনদেশে চলে এসেছিলেন রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের প্রাক্তনী স্বপ্না রায়। সঙ্গী স্বামী রাহুল রায়। রবীন্দ্রসঙ্গীতের একনিষ্ঠ ভক্ত স্বপ্না তিন দশক আগে আমেরিকার বস্টন শহরে তৈরি করেন রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখার স্কুল স্বরলিপি। আজ তাঁর ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা একশর বেশি। তার মধ্যে ভারতীয়, অভারতীয় উভয়েই আছেন।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *