সকালের কাগজে একটা খবর খুব নাড়া দিল কৌশিককে।

‘বজবজে গঙ্গার ঘাটে অপরিচিত বৃদ্ধের মৃতদেহ!

এক বৃদ্ধের মৃতদেহ গঙ্গার ঘাটে পড়ে থাকতে দেখে সুবল কর্মকার নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা। মৃতের আনুমানিক বয়স সত্তর। পরনে ছিল মিলের সাদা ধুতি ও আদ্দির পাঞ্জাবি। সুবল বাবুর কথা অনুযায়ী মৃতের পাশে পড়েছিল কাপড়ের একটা ব্যাগ যার মধ্যে ছিল একটা ডায়রি এবং কলম। মৃতদেহের মুখ বিকৃত হবার কারণে পরিচিতি জানা যায়নি। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, মুখটা পুড়িয়ে বিকৃত করে দেওয়া হয়েছে। খবর পেয়ে পুলিশ এসে লাশ নিয়ে যায়। পুলিশ জানিয়েছে লাশ পোস্টমর্টেমের জন্যে পাঠানো হয়েছে, রিপোর্ট এলেই তদন্ত শুরু করা হবে।”

খবরটা পড়া থেকেই কৌশিকের মনটা বড্ড খারাপ হয়ে রয়েছে। কাগজে মৃতের চেহারার আর পোশাকের যা বর্ণনা দিয়েছে তাতে মৃত ভদ্রলোকের একজন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের লোক বলেই মনে হচ্ছে। কী এমন হতে পারে যে একজন আপাত ভদ্র মানুষকে এই ভাবে খুন হ’তে হয়! কিছুই বুঝতে পারছিল না কৌশিক। ঠিক করল একটু বেলায় সন্তুকে ফোন করবে যদি লাশটা একবার দেখা যায় আর বজবজ থানার ওসির সঙ্গে সন্তু যদি একটু যোগাযোগ করিয়ে দেয় তাহলে গিয়ে সরাসরি কথা বলবে।

সন্তু আই পি এস অফিসার, রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে উঁচু পদে চাকরি করে। ভবানী ভবনে অফিস। সন্তুর বন্ধু কৌশিক প্রাইভেট ডিটেক্টিভ। সন্তুর ভাগ্নে পিকু ফিজিক্সে এম এস সি পড়ে । মামার সঙ্গে থেকে থেকে সখের গোয়েন্দাগিরিও করে। কয়েকটা কেস সল্ভ করে আজকাল একটু নামডাকও হ’য়েছে। বেহালার জয়শ্রী পার্কে থাকে। সন্তুকে ফোন করার আগে কৌশিক পিকুকে ফোন করে সবটা বলে, সঙ্গে নিজের উদ্বেগের কথাটাও জানাল। পিকুরও একই মত। ঠিক হল সাড়ে এগারোটা নাগাদ দুজনে ভবানী ভবনে সন্তুর অফিসে দেখা করবে। পিকুর এম এস সির ক্লাস এখনও শুরু হয়নি তাই ওর হাতে সময় আছে।

পিকুকে নিয়ে কৌশিক সময় মতোই সন্তুর অফিসে পৌঁছে গেল।

অফিসের কাজে সন্তু ব্যস্ত থাকলেও ধৈয্য ধরে কৌশিকের কাছে সবটা শুনে বলল লাশ দেখানোর ব্যবস্থা আমি করে দেব, কিন্তু এক্ষেত্রে প্রাইভেট ডিটেকটিভ কতটা কী করতে পারবে বলা খুব মুশকিল। তবুও যা দেখ কী করতে পারিস।” সন্তু নিজের সেক্রেটারিকে বলেও দিল বজবজ থানায় কৌশিকদের ব্যাপারে জানিয়ে দিতে। 

          কৌশিকরা সন্তুর অফিস থেকে বেরিয়ে পাশেই পুলিশ কোর্টের চত্বরে ভানুর হোটেলে একটু পাউরুটি আর চিকেন স্টু খেয়েই রওনা দিল বজবজের উদ্দেশে। মাঝেরহাট থেকে বজবজ লোকাল ধরে বজবজ পৌঁছে স্টেশন থেকে রিকশা নিয়ে থানা। 

ওসি থানায় ছিলেন না, একটু অপেক্ষা করতে হল। কৌশিকরা বসেই ছিল, হঠাৎ শোনে স্যার বলে কে একজন পিছন থেকে ডাকছেন। গলার স্বর, ডাকের ধরন ভীষণ চেনা! মুখ ঘুরিয়ে দ্যাখে ভদ্রেশ্বরের জীবন হালদার।

“আরে আপনারা এখানে?” জীবন বাবু তো ওদের দেখে অবাক। 

“আপনি এখানে?” কৌশিক পাল্টা প্রশ্ন করে।

“কেন শান্তনু স্যার বলেননি, আমি এখন এই থানার ওসি!” জীবন বাবু জানাল। 

কৌশিক যেন হাতে চাঁদ পেল।

অনেকটা একই রকম আছেন জীবন বাবু। যদিও আগের থেকে  একটু মোটা হয়েছেন, কানের চুলগুলো একটু বড় আর ঘন হয়েছে, টাকটাও একটু বিস্তৃত হয়েছে। চোখে নতুন সোনালী ফ্রেমের সানগ্লাস, হাতে সোনালি ব্যান্ডের ঘড়ি আর নাকের তলায় এক সেন্টিমিটারের একটা কুচকুচে কালো গোঁফ। পিকু লক্ষ করল জীবনবাবুর সামনের পাটির ওপরের ঠিক মাঝখানের দাঁতটাও মিসিং। হাসলে এখন একদম জলদস্যুর মতো দেখায়।

আসুন আসুন বলে জীবন বাবু ওদের নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন। 

কুশল বিনিময় শেষে চা আর প্রজাপতি বিস্কুট এল। 

চা খেতে খেতে কৌশিক জীবন বাবুকে সবটা বুঝিয়ে বলতে জীবন বাবু তো বেজায় খুশি। “আপনারা আমার কেসে কাজ করবেন, এ তো আমার পরম সৌভাগ্য! সত্যি বলতে কি আমি তো লাশটাকে বেওয়ারিশ বলে খালাসই করে দিচ্ছিলাম। ঠিক আছে কেসটা তাহলে খোলাই থাক। দেখা যাক যদি কিছু বেরোয়। তবে স্যর, আমার একটা আবদার আছে। আমাকেও কিন্তু আপনাদের সঙ্গে নিতে হবে! বহুদিনের সখ একটা কঠিন রহস্যের সমাধান করি। বৌয়ের কাছে আর মুখ দেখাতে পারছি না।” 

জীবনবাবুর কথা শুনে কৌশিক আর পিকু প্রায় একসঙ্গে বলে উঠল “সে তো আমাদেরও সৌভাগ্য। আপনাকে ছাড়া কি এই ধরনের কেসে এগোনো সম্ভব!”

এসব শুনে জীবন বাবু তো ভীষণ এক্সাইটেড। একটু লাজুক লাজুক মুখ করে বললেন “কি যে বলেন স্যর।!” 

জীবন বাবুকে সঙ্গে নিয়ে ওরা মর্গে গিয়ে লাশটা দেখে এল। নতুন কোনও তথ্য আর তেমন পাওয়া গেল না, শুধু কৌশিকের ধারণাটা আরও মজবুত হলো যে মৃত ভদ্রলোক শিক্ষিত ভদ্র মানুষ ছিলেন। 

থানায় ফিরে পিকু জীবন বাবুর কাছে লাশের সঙ্গে পাওয়া কাপড়ের ব্যাগটা, ডায়রিটা আর কলমটাও দেখতে চাইল।

কলমটা, পার্কারের ফাউন্টেন পেন আর ডায়রিটা ২০১৮ সালের এল আই সি’র ডায়রি। তাতে বাংলায় নানান কিছু লেখা। 

কলমটা কৌশিককে দেখিয়ে পিকু বলল “তোমার সন্দেহ মিলে যাচ্ছে। ভদ্রলোক নির্ঘাত মাষ্টারমশাই ছিলেন। নইলে আজকাল সাধারণত কেউই ফাউন্টেন পেন ব্যবহার করে না।” 

ডায়রি আর কলম ছাড়া আর কোনও জিনিস নেই, যার থেকে কিছু ক্লু পাওয়া যেতে পারে। কে মারল, কেনই বা মারল কিচ্ছু বোঝা যাচ্ছে না। এছাড়া এখনও পর্যন্ত কোনও মিসিং ডায়রি নেই বা কেউ বডিও ক্লেইম করেনি। তাই কোথায় থাকতেন তাও বোঝা যাচ্ছে না। 

পিকু জীবন বাবুকে জিজ্ঞাসা করল ডায়রিটার একটা ফটোকপি পাওয়া যাবে কিনা সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার জন্যে।

জীবন বাবু বললেন “আসলে আইনত তো আমি এটা দিতে পারিনা, তবে আপনি চাইলে  প্রতিটি পাতার ছবি তুলে নিতেই পারেন। যদি বলেন আমি সাহায্য করতে পারি”। 

পিকু মোবাইলে ডায়রির প্রত্যেক পাতার ছবি তুলে নিল। বেশ ভালই পড়া যাচ্ছে। 

এসব করতে করতে প্রায় সাড়ে পাঁচটা বেজে গেল। কৌশিকরা জীবন বাবুকে আবার সময় মতো আসবে বলে বেরিয়ে পড়ল। স্টেশনে যাওয়ার পথে কৌশিকরা একবার গঙ্গার ঘাটের ওই জায়গাটায় গেল যেখানে লাশটা পাওয়া গেছে। ততক্ষণে গঙ্গায় জোয়ার এসে সব ভাসিয়ে দিয়েছে, কোনও চিহ্নই আর নেই। 

আশাহত হয়েই দুজনে বজবজ স্টেশনে ফিরে এল। শিয়ালদার ট্রেনে উঠে বসতে না বসতেই একটু পরে মাঝেরহাটে পিকু নেমে গেল। নামার আগে কৌশিক বলে দিল রাত্রে যদি পোস্টমর্টেম রিপোর্ট জানতে পারে তাহলে ফোন করবে নইলে কাল সকালে কথা হবে। সন্ধে হয়ে এসেছে। একটা বেশ ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে। মাঝেরহাট ব্রিজে উঠে পিকু আর ট্রামে- বাসে না উঠে সোজা বেহালার দিকে হাঁটা লাগাল। খুনের ব্যাপারটা মাথার মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পিকু বুঝতেই পারছিল আস্তে আস্তে ব্যাপারটা মাথায় দানা বাঁধছে। এসব ক্ষেত্রে পিকুর একটা মজার ব্যাপার ঘটে, এইরকম ঘটনা নিয়ে ভাবনা চিন্তা করলে চরিত্রগুলো পিকুর চোখের সামনে ভেসে ওঠে। পিকুর মনে হয় যেন ওদের সঙ্গে কথা বলতে পারছে। এক্ষেত্রেও একটু একটু  তাইই হচ্ছে। এইসব ভাবতে ভাবতেই পিকু বাড়ি পৌঁছে গেল। ঘড়িতে তখন আটটা। হাতমুখ ধুয়ে চেঞ্জ করে সোজা ওপরে নিজের ঘরে চলে গেল। 

কিছুই বুঝতে পারছে না পিকু, কোথার থেকে শুরু করবে। হাতে তো আছে শুধুই ভদ্রলোকের ডায়রির একটা কপি। 

মোবাইল খুলে ডায়রিটা পড়তে শুরু করল পিকু। ভীষণ ছোট ছোট হরফে লেখা। পড়তে শুরু করে মুগ্ধ হয়ে গেল পিকু। কী সুন্দরভাবে জীবন নিয়ে আলোচনা করেছেন ভদ্রলোক। এক জায়গায় বলছেন “জীবনে দেওয়া আর পাওয়ার হিসাবটা বড়ই কঠিন। আমরা সারাক্ষণ শুধু চেয়েই চলেছি ভগবানকেও ছাড়িনা। এত কিছু পাওয়ার পরেও কখনও ভগবানকেও কোনও কৃতজ্ঞতা জানাই না। সব সময় শুধুই দাও দাও না করে মাঝে মধ্যে তো বলতেও পারি একটু নাও! ওঁকে দেওয়ার সময় শুধু বাতাসা আর নিজেরা খাওয়ার সময় রাজভোগ! এ কেমন দ্বিচারিতা! আসলে আমরা বড়ই স্বার্থপর। একটা কথা বুঝতে হবে পাওয়া হল আত্মতুষ্টি আর দেওয়া হল জনতুষ্টি। আমরা সবসময় আত্মতুষ্টিতেই মেতে আছি।”

এইরকম ছোট ছোট কথা কিন্তু ভীষণ গভীর। সবটাই যে গদ্য তা কিন্তু নয়। যেমন পরের পাতাতেই পিকুর চোখে পড়ল, ভদ্রলোক লিখেছেন –

 সামনে ডাঁয়ে ঝড়ের দাপট
বাঁ কোনাতে গাজনপুর,
মিষ্টি বাতাস ছলাৎ ছলাৎ
যমজ শহর দু’মাইল দূর!
পেছন দিকে একটু গেলেই
শ্রেষ্ঠ দেখার বাসা,
তার ভিতরে দশের তিনে
দৈত্য দানব ঠাসা।

পিকু থমকে গেল। হঠাৎ এরকম একটা ছড়া কেন! আগের বা পরের লেখার সঙ্গে কোনওই সাযুজ্য নেই। তাহলে লিখলেনই বা কেন। কী বলতে চাইছেন! অনেকগুলো প্রশ্ন খেলে গেল মাথায়। তবে লাইনগুলো পড়ে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে এতে কোনও একটা জায়গার বর্ণনা আছে।এরমধ্যেই নীচ থেকে মা’র হাঁক, “পিকু খেতে আয়!”

পিকুর মনটা আজ এমনিতেই ভালো নেই। থেকে থেকেই ওই ভদ্রলোকের কথা মনে হচ্ছে। উনি কী এমন করেছিলেন যে তার এই পরিণতি! নানান সব কথা মাথার মধ্যে ঘোরাফেরা করছে।

তার উপরে ডিনারের মেনু দেখে পিকু আরও হতাশ হয়ে পড়ল। ট্যাল ট্যালে মাছের ঝোল, পটল ভাজা আর বন্যাত্রানের মতো ডাল।

পিকু খেতে বসলে সাধারণত ঠাকুমা পাশে এসে দাঁড়ায়। মেনু দেখে পিকুর যত মেজাজ গরম হচ্ছে ঠাকুমা ততই বারে বারে বলছে “রাগ কোইরো না ভাই! আজ খাইয়া লও! কাল বড়া ভাইজ্যা দিমু হানে”! এটা শুনে পিকুর মাথা আরও গরম হতে থাকল। 

দাঁত কিড়মিড় করে বলে উঠল “ডিসগাস্টিং”! 

কোনওরকমে খাওয়া শেষ করে পিকু আবার দোতলায় নিজের ঘরে ফিরে এল। নীচে খেতে গিয়ে সবটা গুলিয়ে গেছে।

ফিরে এসে পিকু আবার ওই ছড়ার লাইনগুলো মন দিয়ে পড়ল। ঝড়ের দাপট আর মিষ্টি বাতাস একসঙ্গে কি করে হয়। তারমানে দুটোর মধ্যে যেকোনও একটা তাৎক্ষনিক। ঝড়ের মধ্যে মিষ্টি বাতাস বইতে পারে না তাই পিকু ধরে নিল এখানে মিষ্টি বাতাসটাই তাৎক্ষনিক। ছলাৎ ছলাৎ মানে জলাশয় বা নদী, যার ডানদিক থেকে ঝড় আসে। যমজ শহর দু’মাইল দূর! 

এই তো মিলে যাচ্ছে। কলকাতা আর হাওড়া তো টুইন সিটি, মানে যমজ শহর। তার মানে গঙ্গার ধার, মাইল দুয়েক দুরে হাওড়া। তাহলে গঙ্গার পারে হাওড়ার দিকে মুখ করে দাঁড়ালে সামনের ডান কোনটা উত্তর পশ্চিম কোণ মানে ঈশান কোণ, যে দিক থেকে কালবৈশাখী আসে! আর গাজন অর্থাৎ শিবের পূজা মানে শিবপুর। অর্থাৎ হেস্টিংসে গঙ্গার পাড়ে দাঁড়িয়ে এই বর্ণনা। 

এইটুকু বার করতে পেরে পিকুর মনটা বেশ হালকা লাগল। কিন্তু সেখানে দাঁড়িয়েই বা এইসব লিখেছেন কেন!

পরের চারটে লাইন ভালো করে পড়ল পিকু। 

‘মহান দেখার বাসা, তার ভিতরে দশের তিন’ এসবের অর্থ কী? এ তো বোঝা অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে। বড্ড মাথায় চাপ পড়ছে, পিকু আর পারছে না; ঘুমিয়েই পড়ল। 

কৌশিকের ফোনে ঘুম ভাঙল। 

“হ্যালো! কৌশিক মামা! বলো!” 

“হ্যাঁ! কাল রাতে আর ফোন করিনি, জীবন বাবু ফোন করেছিল। বলল পোস্টমর্টেম রিপোর্টে বলেছে, মাথার পেছনে আঘাতে মৃত্যু আর মারা যাবার পরে সালফিউরিক অ্যাসিড দিয়ে মুখ পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া সারা শরীরে প্রচুর সিগারেটের ছ্যাঁকার দাগ। তবে আর একটা কথা জানা গেছে যে মারা যাওয়ার আগে ভদ্রলোক বেশ কয়েকদিন কিছু খাননি। তার মানে না খেতে দিয়ে অত্যাচার করে তারপর মেরেছে। 

ওদিকে কোনও ব্রেকথ্রু হলো?” কৌশিক জানতে চাইল।

“না গো ! সেরকম কিছু না। মনে হচ্ছে একটা ক্লু পেয়েছি , কিন্তু খুব একটা জোরালো নয়। দেখি আজ কিছু করতে পারি কিনা। আমি দশটা নাগাদ একটু কলেজ স্ট্রিট যাব, ফিরে এসে আবার বসব। কিছু পেলেই তোমায় জানাব।” পিকু উত্তর দিল। 

সেদিন কলেজ স্ট্রিট যাওয়ার সময় বেহালা চৌরাস্তার মিনিতে উঠে পিকু এসপ্ল্যানেড রওনা দিল। মাঝেরহাটেই ড্রাইভারের ঠিক পিছনে জানালার সিটটা পেয়ে গেল। জানালার পাশে বসে হাওয়া খেতে খেতে ঘুমিয়ে পড়েছিল পিকু, আচমকা ব্রেকে ঘুম ভাঙতেই বাইরে তাকিয়ে দ্যাখে রেস কোর্সের মোড়, ডানহাতে গ্র্যান্ড ভিউ বাড়িটা। বাড়িটা দেখেই পিকুর মাথায় ডায়রির ছড়ার শেষ চারটে লাইন খেলে গেল:

পেছন দিকে একটু গেলেই
শ্রেষ্ঠ দেখার বাসা,
তার ভিতরে দশের তিনে
দৈত্য দানব ঠাসা।

পিকু মোবাইলে ডায়রির প্রত্যেক পাতার ছবি তুলে নিল। বেশ ভালই পড়া যাচ্ছে। এসব করতে করতে প্রায় সাড়ে পাঁচটা বেজে গেল। কৌশিকরা জীবন বাবুকে আবার সময় মতো আসবে বলে বেরিয়ে পড়ল। স্টেশনে যাওয়ার পথে কৌশিকরা একবার গঙ্গার ঘাটের ওই জায়গাটায় গেল যেখানে লাশটা পাওয়া গেছে। ততক্ষণে গঙ্গায় জোয়ার এসে সব ভাসিয়ে দিয়েছে, কোনও চিহ্নই আর নেই। 

পিকু সঙ্গে সঙ্গে কোনওরকমে ঠেলেঠুলে বাস থেকে নেমে গেল। রেস কোর্সের ফুটে একটু দাঁড়িয়ে তারপর রাস্তাটা ক্রস করল। এই তো সেই ‘মহান দেখার বাসা’! একটু ইতস্তত করে পিকু গ্র্যান্ড ভিউ বাড়িটাতে ঢুকে পড়ল। নীচে একজন মধ্যবয়সী লোক বসে, মনে হল সিকিউরিটি, পিকু খুব স্মার্টলি দশতলার তিন নম্বর ফ্ল্যাটে কীভাবে যাবে জিজ্ঞেস করাতে লোকটা লিফট দেখিয়ে দিল। দশতলায় উঠে লিফট থেকে নেমে লবিতে দাঁড়িয়ে আছে পিকু,  হঠাৎ তিন নম্বর ফ্ল্যাট থেকে দুজন ষণ্ডা মার্কা লোক বেরিয়ে দড়জা বন্ধ ক’রে হাত নাড়তে নাড়তে হাসতে হাসতে লিফটে করে নিচে নেমে গেল। 

“একেবারে দৈত্য”, অজান্তেই কথাগুলো পিকুর মুখ থেকে বেরিয়ে পড়ল। বুঝতেই পারল ঠিক জায়গাতেই এসে পৌঁছেছে পিকু। আর অপেক্ষা না করে পিকু সোজা নিচে নেমে এল। ফুটপাথে দাঁড়িয়েই কৌশিককে ফোন করে সব জানাল। সব শুনে কৌশিক পিকুকে জিজ্ঞাসা করল “কেউ সন্দেহ করেনি তো তোকে?” পিকু না বলতে একটু আশ্বস্ত হয়ে কৌশিক জানাল ও সন্তুর অফিসেই আছে, এক্ষুনি পৌঁছাচ্ছে, পিকুকে একটু অপেক্ষা করতে বলল।

দশ মিনিটের মধ্যেই কৌশিক হাজির। গ্র্যান্ড ভিউ পৌঁছেই জীবন বাবুকে ফোন করল কৌশিক “হ্যাঁ আমি কৌশিক বলছি। আপনার একটু ফোর্স নিয়ে রেস কোর্সের পাশে গ্র্যান্ড ভিউ নামের বাড়িটার সামনে আসতে হবে। কতক্ষণ লাগতে পারে?” জীবন বাবু বললেন “আপনারা একটু নজর রাখুন আর চা-টা খান আমরা ঘন্টাখানেকের  মধ্যে পৌঁছে যাব।” 

কৌশিকরা পাশের চায়ের দোকানে চা খেতে খেতে বাড়িটার ওপর নজর রাখতে লাগল। বেশ কিছুক্ষণ পরে সেই ধুমসো লোক দুটো ফিরে এল। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই জীবন বাবু সঙ্গে ফোর্স নিয়ে হাজির। 

সব শুনে জীবন বাবু পিকু আর কৌশিককে সঙ্গে নিয়ে, ফোর্স নিয়ে দশ তলায় চলে এল। তিন নম্বরে বেল বাজাতেই দরজা খুলল একজন! একটু ধস্তাধস্তি হল বটে তবে ওই দৈত্য দুজনকে বাগে আনতে জীবন বাবুদের কোনও অসুবিধাই হলনা। 

কৌশিকরা ভিতরে ঢুকে এল।  ঢুকেই একটা বড় ঘর, ঘরের শেষে একটা বারান্দা কাচের দরজা দিয়ে আটকানো। ঘর থেকে ভিউটা সত্যিই গ্র্যান্ড। সোজা রেস কোর্স, ময়দান, হুগলি ব্রিজ সব দেখা যাচ্ছে। সামনেই ডানদিকে ভিক্টোরিয়া। সব মিলিয়ে দারুণ দৃশ্য ।

ঘরটা ভালো করে দেখল পিকু। ঘরে একটা ফোল্ডিং খাট রাখা আছে, কয়েকটা খালি মদের বোতল আর এ্যাশট্রে ভরা সিগারেটের পোড়া বাট। 

ফ্ল্যাটটাতে আরও দুটো ঘর, দুটো টয়লেট আর কিচেন আছে। দুটো ঘরে মেঝেতে দুটো গদি ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেল না পিকু। এমনকি খাওয়াদাওয়ারও কোনও ব্যবস্থা নেই। অদ্ভুত ব্যাপার।

জীবন বাবু এরমধ্যে সিগারেটের পোড়া বাট সমেত এ্যাস্ট্রে আর মদের বোতলগুলো সাবধানে নিয়ে নিলেন, ফরেনসিক টেস্টের জন্য। 

নীচে এসে জীবন বাবুরা দানব মার্কা দুটোকে নিয়ে চলে গেলে কৌশিক মোটর সাইকেলে পিকুকে নিয়ে বলবন্ত সিংয়ের চায়ের দোকানে এসে একটু চা খেল। পিকুর আর কলেজ স্ট্রিট যাওয়া হল না। চা খেয়ে দুজনে সন্তুর অফিসে এল। কৌশিক তো পিকুর প্রশংসা করার মতো বিশেষণই খুঁজে পাচ্ছিল না। সন্তু চুপ করে সবটা শুনে বলল “সবই তো বুঝলাম, কিন্তু ভদ্রলোকটি কে? কোথায় থাকতেন? এসব কি কিছু জানা গেছে?” পিকু বলল এতটা যখন জানা গেছে তখন মনে হয় বাকিটাও যাবে, তবে সময় লাগবে। ধৈর্য্য ধরতে হবে। এই ভদ্রলোক ভীষণ বুদ্ধিমান। আমি নিশ্চিত উনি কোথাও না কোথাও একটা ক্লু রেখেছেন।”

পিকু একটু তাড়াতাড়িই বেরিয়ে পড়ল।  

সেদিন বাড়ি ফিরে পিকু আর কিছুই করতে পারল না। শুধু মনে পড়ছে কি সাংঘাতিক অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে ভদ্রলোককে! রাত্রে খাও়াদাওয়া হলে পিকু ওপরে বারান্দায় গিয়ে বসল। আকাশটা আজ খুব পরিষ্কার। সপ্তর্ষিমন্ডল আর কালপুরুষও বেশ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। মোবাইলে ডায়রিটা আবার পড়তে শুরু করল পিকু। কি সুন্দর বলেছেন ভদ্রলোক “পাওয়া হল আত্মতুষ্টি আর দেওয়া হল জনতুষ্টি”!  পিকুর ভীষণ ভদ্রলোকটির ব্যাকগ্রাউন্ড জানার কৌতুহল হতে লাগল। ডায়রিতে কিছুই কি এমন পাওয়া যাবে না যার থেকে ভদ্রলোকটির হোয়ারএ্যাবাউটস জানা যাবে! পিকু মোবাইল খুলে ডায়রিতে তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগল যদি কোনও ঠিকানা পাওয়া যায়। কোথাও কোনও ঠিকানার নাম গন্ধ নেই। 

ধীরে ধীরে পরের পাতাগুলো পড়তে শুরু করল। নানান বিষয় নিয়ে ছোট্ট ছোট্ট লেখা। কখনও রবীন্দ্রনাথ, কখনও বিবেকানন্দ আবার কখনও বা ধর্মের আস্ফালন নিয়ে নিজের মত প্রকাশ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের জীবন দর্শনকে উপনিষদের দর্শনের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, রবীন্দ্রনাথের জীবন নিয়ে কথার অধিকাংশটাই উপনিষদের কথা। বলছেন উপনিষদের যে মূল বক্তব্য তাকেই রবীন্দ্রনাথ সমকালীন জীবনের অভিজ্ঞতা আর আধুনিক ভাষার মোড়কে নিজের রচনার মধ্যে দিয়ে আমাদের কাছে তুলে ধরেছেন। সেখান থেকেই বোঝা যায় উপনিষদ কতটা সমকালীন এবং প্রাসঙ্গিক। পিকুর কিন্তু পড়তে বেশ ভালোই লাগছে। আবার মধ্যে মধ্যে ছোট ছোট চার পাঁচ লাইনের ছড়া। কোনওটা অর্থবহ আবার কোনওটার মানেই বোঝা দায়। এরকম আরও একটা পিকুর চোখে পড়ল! 

নারায়ণের পদের নামেই 
পথ, সে যে এক পাড়া,
বাইশ গজের সাতটি ভাগের
সামনে এসে দাঁড়া। 
পাঠশালারই ঈশান কোণে
চারটে বাঁদর সেজে
আইনসভার মহাকাব্যের
জন্ম তারিখ খোঁজে!!

বারে বারে ছড়াটা পড়ল পিকু। যদিও সেরকম কিছুই উদ্ধার করতে পারল না তবু একটাই আশার কথা যে এখানে ভদ্রলোক “পাড়া” শব্দটা ব্যবহার করেছেন। হয়তো একটু চেষ্টা করলে একটা ক্লু বা উত্তর খুঁজে পাওয়া গেলেও যেতে পারে। পিকু আবার প্রথম চারটে লাইন পড়ল। 

নারায়ণের পদ মানে নারায়ণপদ? না সেরকম কোনও রাস্তার নাম তো জানা নেই। এই ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে হলো “হরিপদ” মানেও তো নারায়ণপদই! আবার বলছে পথ হলেও সেটা একটা পাড়া। সব মিলে যাচ্ছে। পিকুর বন্ধু শুভ্র থাকে নবীনা সিনেমার কাছে। ও একবার বলেছিল, ওদের পাশের পাড়াটা একটা গলির নামে। একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চল তার মধ্যে অনেক অলিগলি থাকলেও পুরো অঞ্চলটার ঠিকানাই হরিপদ দত্ত লেন। তাহলে কি এখানে হরিপদ দত্ত লেনের কথাই বলেছেন! হতেই পারে। পরের দুটো লাইন পড়ল পিকু; 

বাইশ গজের সাতটি ভাগের
সামনে এসে দাঁড়া। 

তার মানে বাইশ গজের সাতভাগের একভাগ। ক্রিকেটের বাইশ গজ নিশ্চয়ই বলছেন না। আর ক্রিকেট পিচের বাইশের সাত বলে কিছু হয় না। “এইতো বলেই ফেললাম” বলে উঠল পিকু, বাইশের সাত। অর্থাৎ বাইশের সাত হরিপদ দত্ত লেন। শুভ্রকে ফোন করে ঠিকানাটা কনফার্ম করতে বলবে বলে দেখে রাত সাড়ে এগারোটা বাজে। তবুও ফোন করল। সবটা শুনে শুভ্র বলল সকাল আটটার মধ্যে বলে দেবে ওই নম্বরে কোনও বাড়ি আছে কিনা। আসলে হরিপদ দত্ত লেনে বাড়ির নম্বরের কোনও মাথা মুন্ডু নেই। ভগ্নাংশ ছাড়া নম্বর হয়না। তেরোর পাঁচের পাশের বাড়ি হয়তো তিরাশির চোদ্দো। যাই হোক শুভ্র জেনে দেবে বলল। পিকু এও বলল “যদি সত্যি ওই নম্বরে কোনও বাড়ি থাকে তাহলে এটাও জেনে দিবি যে সেই বাড়ি থেকে কিছুদিনের মধ্যে কোনও বয়স্ক লোক নিখোঁজ হয়েছেন কিনা।” শুভ্রর সঙ্গে কথা সেরে আবার ডায়রিতে মন দিল পিকু। 

পরের চারটে লাইন পড়ে প্রথমেই ধাক্কা খেল পিকু। ঈশান কোণ তো বোঝা গেল কিন্তু পাঠশালা, চারটে বাঁদর, এসবের মানে কী? বাড়িতে বাঁদর আসবে কোথা থেকে! কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। তারপর আইনসভার মহাকাব্য। পার্লামেন্টের বাংলা আইনসভা সেটা পিকু জানে। কিন্তু তার মহাকাব্য! 

“ইন্ডিয়ান কনস্টিটিউশন!” পিকু চেঁচিয়ে বলে উঠল। তার জন্ম তারিখ ছাব্বিশে নভেম্বর উনিশশো উনপঞ্চাশ। 

মানে ২৬-১১-১৯৪৯ । এই সংখ্যাটা আবার কোন কাজে লাগবে? হয়তো লাগবে কোথাও। অকারণে তো আর ভদ্রলোক লিখবেন না! দেখাই যাক না কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়। 

এর পরের পাতাগুলোতে ভদ্রলোক নিজের পরিবারের সম্পর্কে কিছু বলেছেন। ওঁদের আদি বাড়ি ছিল মুর্শিদাবাদে। বাবা স্কুল শিক্ষক ছিলেন। নিজেও সারাজীবন মাস্টারি করেছেন। কৌশিকের অনুমান মিলে যাচ্ছে। স্ত্রী গত হয়েছেন ২০১৬য়। দুই ছেলে, বৌমারা, নাতি নাতনিদের নিয়ে সংসার। 

তবে যত সমস্যার কারণ হল ওঁদের পূর্বপুরুষের রেখে যাওয়া একটি মহামূল্যবান আংটি। আংটিটি নাকি বাংলার শেষ নবাব সিরাউদ্দৌলার তৃতীয় স্ত্রী লুৎফুন্নীসা বেগমের। কোনও ধারণা নেই এখন তার মূল্য কত হতে পারে। 

এইবারে পিকুর কাছে পুরো ব্যাপারটাই পরিষ্কার হয়ে গেল। কিন্তু আংটিটা যে কোথায় রাখা আছে সেসব কিছুই বলা নেই। পুরো ব্যাপারটা বিশ্লেষণ করে পিকু বুঝতে পারল গ্র্যান্ড ভিউ বিল্ডিংএ ওই দুজনকে ধরা ছাড়া এখন পর্যন্ত কোনও জেনুইন ব্রেকথ্রু করতে পারেনি। একটু হতাশই লাগছে। সব কিছুই এখনও কোনও না কোনও ইনফরমেশনের জন্যে আটকে আছে। সেদিন আর কিছু করতে ইচ্ছা করল পিকুর, মনে হচ্ছে কোনও কাজের কাজ না করে ও শুধুই বাংলা ধাঁধা সলভ করছে। বেশ হতাশ হয়েই ঘুমিয়ে পড়ল। রাত্রে ভালো ঘুমও হলো না। উসখুস করতে লাগল। 

সেই ভোর থেকে শুভ্রর ফোনের অপেক্ষায় বসে আছে পিকু। কখন শুভ্র ফোন করবে? নটা অবধি অপেক্ষা করে পিকুই ফোন করল। “কিরে কিছু জানতে পারলি?” 

“হ্যাঁ সবটাই জেনেছি। তোকেই ফোন করতে যাচ্ছিলাম। বাইশের সাত হরিপদ দত্ত লেনে সৌমেন বোস থাকেন। তিনতলা বাড়ি। সঙ্গে দুই ছেলে সুগত আর সুমিত তাদের বউ ছেলে মেয়ে নিয়ে থাকে। সৌমেন বাবু একতলায় থাকেন আর ছেলেরা ওপরে থাকে। কলেজে পড়াতেন সৌমেন বাবু। অঞ্চলে বিদ্যান শিক্ষিত বলে নাম আছে। খুব ভদ্র পরিবার। সৌমেন বাবু চারদিন আগে মুর্শিদাবাদ গেছেন এখনও ফেরেননি, বলে গেছেন দুয়েকদিন দেরি হ’লেও হ’তে পারে।”  শুভ্র এক নিশ্বাসে সবটা বলে গেল। 

“ঠিক আছে! তোর সঙ্গে পরে কথা বলছি!” বলে পিকু ফোনটা ছেড়ে দিল। 

শুভ্রর ফোন রাখতে না রাখতেই কৌশিকের ফোন।

“হ্যাঁ কৌশিক মামা বলো! “

” তুই বল! এগোতে পারছিস?” কৌশিক জিজ্ঞেস করল।

“হ্যাঁ! মনে হচ্ছে কিছুটা এগিয়েছি। তুমি বলো, জীবন বাবুর কাছ থেকে কোন খবর পেলে? যে দুটো লোককে কাল ধরে নিয়ে গেল তারা কারা?” 

“জীবন বাবু ফোন করেছিলেন! বললেন ওই দুজন লোকই বোবা! জিভ নেই। তবে ইশারায় বুঝিয়েছে ওরা কলকাতায় থাকে না, কদিন আগে এসেছে। কিন্তু ওই বাড়িতে  কে এনেছে তা বলেনি। আমি বলেছি বার করতে, যেমন করেই হোক।” কৌশিক বলল।

“কৌশিক মামা তুমি জীবন বাবুকে বলো ওদের জিজ্ঞাসা করতে ওরা মুর্শিদাবাদের লোক কিনা। আর সিগারেটের বাট আর মদের বোতলের ফরেন্সিক রিপোর্ট? আমাকে একটু জানিও প্লিজ ” পিকু বলল।

আধ ঘণ্টার মধ্যে কৌশিক কনফার্ম করল ওই দুটো লোকই মুর্শিদাবাদের। 

পিকু বুঝতে পারছে সবটাই পরিষ্কার হচ্ছে। তার মানে সৌমেন বাবুর মৃত্যুর সঙ্গে ওই দুজন জড়িত। 

পিকু ঠিক করল আজ আর বেরোবে না। সোমবার কলেজ স্ট্রিট যাবে। 

মাকে বলল “আমি স্নান করতে যাচ্ছি, তাড়াতাড়ি খাব, কাজ আছে!” 

“কেন, বেরোবি?” মা জিজ্ঞাসা করল।

“না বাড়িতেই থাকব, কিন্তু কাজ আছে”! 

পিকু স্নান করে খেয়ে ওপরে নিজের ঘরে চলে গেল। আবার মোবাইল খুলে বসল ডায়রির বাকি লেখাটুকু শেষ করতে। 

বাকিটা পড়ল বটে কিন্তু সেরকম ইম্পর্ট্যান্ট আর কিছুই পেলনা। পিকুও দমবার পাত্র নয়। আবার ভালো করে গোটা ডায়রির সবকটা পাতা পড়ল। ডায়রির শেষে অনেকগুলো পাতাই ফাঁকা। কিছুই লেখা নেই। এগোতে এগোতে হঠাৎ একটা পাতায় পেন্সিলে কি একটা লেখা নজরে এল। ভীষণ হাল্কা করে লেখা। ভালোভাবে বোঝাই যাচ্ছে না, ছবিটাও স্পষ্ট নয়। অনেক কষ্টে পিকু যেটা উদ্ধার করল তা মোটামুটি এই রকম: 

লোভাতুর অভিলাষ কথা বলে কম,
সেরাটিং নিবারণ  খায় চমচম
দ্বিতীয়রা মেলে দেখে অপলক চোখে,
ভনভন ষটপদ উড়তেই থাকে॥!

“উরিব্বাস! এটা কী জিনিস! এর তো কোনও মানেই বোঝা যাচ্ছে না!” পিকু নিজেই বলে উঠলো। 

দুটো শব্দে ভীষণ খটকা লাগল পিকুর। ‘সেরাটিং আর ষটপদ ‘। 

ষটপদের ষট ষড় বা ছয়। ষটপদ মানে যার ছটা পা, অর্থাৎ ভ্রমর, যেটা পিকু জানে। কিন্তু সেরাটিং তো কখনও শোনেনি! পিকু ইগনোর করল। তার মানে এখানে একটাই শব্দ ভ্রমর। আর এই ভ্রমর নিশ্চয়ই কারুর নাম। কিন্তু অভিলাষ, নিবারণ এরা কারা? পিকু তিন নম্বর লাইনটা বারে বারে পড়ল। কোন দ্বিতীয়দের কী দেখতে বলছেন সৌমেনববাবু, সেখান থেকে কীই বা পাওয়া যাবে?

প্রত্যেকটা শব্দের দ্বিতীয় অক্ষর গুলো দিয়ে কিছু পাওয়া যায় কিনা বোঝার চেষ্টা করল পিকু। কিছুই পেল না।

ভাবতে ভাবতে প্রত্যেক লাইনের দ্বিতীয় শব্দের প্রথম অক্ষরগুলো পরপর বসাতেই বেরিয়ে পড়ল শব্দটা, “অনিমেষ”! 

অনিমেষ মানে অপলক। তাই বলেছেন অপলক চোখে। হিন্ট কিন্তু দিয়েছেন সৌমেন বাবু! একেবারে জলে ফেলে দেননি। 

কিন্তু ২৬১১১৯৪৯ এই সংখ্যার এখানে অর্থ কী? 

বাইরে তাকিয়ে দ্যাখে অনেকক্ষণ সন্ধে হয়ে গেছে। সাড়ে ছ়টা বাজে।  

কৌশিককে ফোন করল পিকু ফরেন্সিক রিপোর্টের জন্যে। জীবন বাবু তখনও কিছু জানাননি, কৌশিক বলল জীবন বাবুকে ফোন করে জানাচ্ছি। 

 নীচে অনেক লোকের গলার আওয়াজ শুনে পিকু নীচে গিয়ে দেখল ছোটপিসিরা এসেছে। ওদের নাকি আজকে আসার কথাই ছিল।

পিকু বি এস সিতে ভালো রেজাল্ট করেছে বলে ছোটপিসি পিকুর জন্যে সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘দেশে বিদেশে’ বইটা এনেছে। অনেক গল্প হল। মাও বলল, পিকুও বলল ছোটপিসিদের রাত্রে খেয়ে যেতে। ওদের গাড়ি আছে আর পিসেমশাই নিজেই ড্রাইভ করে। পিসেমশাই নিজেই অফিস ফেরৎ নিয়ে যাবে। ফলে কোনও অসুবিধাই নেই। ছোটপিসিও রাজি হয়ে গেল। আরসালান থেকে বাটার নান, গালোটি কাবাব, চিকেন দোপিয়াজা আর ডাল মাখনি আনানো হল। শেষ পাতে ফিরনি। 

ছোটপিসিরা বেরোতে প্রায় সাড়ে দশটা বেজে গেল। 

ওপরে গিয়ে পিকু দ্যাখে কৌশিক মামার তিনটে মিসড কল। সঙ্গে সঙ্গে ফোন করল পিকু। “হ্যাঁ বলো কৌশিক মামা!” 

“তুই ফোন তুলছিস না দেখে আমি তো ঘাবড়েই গেছিলাম! যাই হোক, জীবন বাবু ফোন করে ছিলেন, বললেন ফরেন্সিক রিপোর্ট পেয়েছেন। সিগারেটের বাট গুলো যার অংশ তাই দিয়েই ছ্যাঁকা দেওয়া হয়েছিল ভদ্রলোকটিকে। আর মদের বোতলগুলোর মধ্যে দুটোতে সালফিউরিক অ্যাসিড ছিলো।” 

পিকু শুনে বলল “তাহলে তো ওই বাড়িতেই সব অত্যাচারের ঘটনা ঘটেছে। কাল তো রবিবার, আমরা কি সকাল দশটা নাগাদ নবীনা সিনেমার সামনে মিট করতে পারি? জীবন বাবুও যদি আসেন। আসার সময় যেন ব্যাগ, ডায়রি আর কলমটাও সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। আর যাদবপুর থানায় একটু বলে দিতে হবে যেন বাইশের সাত হরিপদ দত্ত লেনের বাড়িতে একটু খবর দিয়ে দেয় যে  সকাল দশটা নাগাদ সবাই যেন বাড়িতেই থাকে। সাক্ষাতে সব বলব। গুড নাইট।”

পিকু কৌশিককে আর কোনও প্রশ্ন করার সুযোগই দিল না। 

পরদিন সকালে নবীনার সামনে তিনজনে মিট করে সোজা সৌমেন বাবুর বাড়ি পৌঁছে গেল। 

সৌমেন বাবুর ছেলে, ছেলের বউরা তো পুলিশ দেখে একটু ঘাবড়েই গেল। ওপরে নিয়ে গিয়ে বসালো। কৌশিক পুরো ঘটনাটা বলে পিকুকে বলল এক্সপ্লেইন করতে। 

প্রথমে পিকু ব্যাগ, ডায়রি আর কলম দেখিয়ে কনফার্ম করল ওগুলো সৌমেন বাবুরই। সুমিত তো ব্যাপারটা আন্দাজ করে কেঁদেই ফেলল। 

পিকু জিজ্ঞাসা করল সৌমেন বাবু কত ঘনঘন মুর্শিদাবাদ যেতেন। আর কারুর সঙ্গে কোনও শত্রুতা ছিল কিনা। সুগত যা বলল সংক্ষেপে তা হল, ওদের একটা পৈতৃক সম্পত্তির ব্যাপারে সৌমেন বাবুর জ্যাঠতুতো দাদার ছেলেদের সঙ্গে সৌমেন বাবুর একটু বিবাদ চলছিল। সেই নিয়ে ওদের এক ভাই ভ্রমর সৌমেনবাবুকে খুব জ্বালাতন করছিল। ওদের ডিমান্ড ছিল ওই সম্পত্তি বিক্রি করে তা সবার মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হোক। বাবা এর তীব্র বিরোধী ছিলেন। 

পিকু বলে উঠলো “ভ্রমরের আর-এক নাম কি অনিমেষ?” 

“আপনি কি করে জানলেন?” সুমিত প্রশ্ন করল। 

পিকু বলল “সব বলছি! আর পৈতৃক সম্পত্তিটা হল একটা আংটি!  বাংলার শেষ নবাব সিরাউদ্দৌলার তৃতীয় স্ত্রী লুৎফুন্নীসা বেগমের আংটি।” 

সুগত অবাক হ’য়ে পিকুর দিকে তাকিয়ে বলল “ইউ আর হান্ড্রেড পারসেন্ট কারেক্ট।” 

পিকু জিজ্ঞাসা করল আংটিটা কোথায় রাখা আছে সেটা কি আপনারা বলতে পারবেন?” দেখা গেল কেউই জানেনা। 

ওরা সবাই যখন নীচে সৌমেন বাবুর ঘরে যাচ্ছে তার ফাঁকে কৌশিক সুমিতের কাছ থেকে অনিমেষের হোয়ারএ্যাডবাউটস জেনে নিয়ে সন্তুকে ফোন করে অনিমেষের ডিটেল দিয়ে তাকে তক্ষুনি অ্যারেস্ট করতে বলল। 

পিকু সৌমেন বাবুর ঘরে ঢুকেই বুঝল উনি পাঠশালা বলতে কী বুঝিয়েছেন।সারা ঘরে শুধুই বই। ঘরের ঈশান কোণে গিয়ে দাঁড়ালো পিকু। কিছুই বুঝতে পারছে না কী করবে। সামনেই তাকের উপর টুপি পরা নাচের ভঙ্গিমায় চারটে বাঁদর পুতুল রাখা আর তার পেছনে “ইন্ডিয়ান কনস্টিটিউশন” গোটা ভলিউম। পুতুল আর বইগুলো সরাতেই বেরিয়ে পড়ল লকারের কি প্যাড। ডায়রির বর্ণনার সঙ্গে সবকিছু মিলে গেল। পিকু জিজ্ঞাসা করল “এই লকারের কি চার ডিজিট নাকি ছয় ডিজিটের পাসওয়ার্ড!” কেউই কোনও উত্তর দিল না। পিকু ঠিক করল প্রথমে ১৯৪৯ দিয়ে শুরু করবে। কি প্যাডে ১৯৪৯ প্রেস করতে কিছুই হলোনা এরর দিল। এরপর ২৬১১ তে লকারের দরজা খুলে গেল আর বেরিয়ে পড়ল সযত্নে রাখা বাংলার শেষ নবাব সিরাউদ্দৌলার তৃতীয় স্ত্রী লুৎফুন্নীসা বেগমের আংটি। আংটিটি সম্পূর্ণ সোনার, তার উপরে নানান ধরনের দামী দামী সব পাথর বসানো।

জীবন বাবু ফ্যাসফ্যাসে গলায় পিকুর দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে বলে উঠলেন “মগজাস্ত্র”!

এসব দেখে জীবন বাবু, কৌশিক আর বাকিরা সবাই কেমন ফ্যালফ্যাল করে পিকুর দিকে তাকিয়ে রইল। 

জীবনবাবু চলে গেলে কৌশিক আর পিকু ভবানী ভবনে সন্তুর অফিসে এল। সন্তু জানাল অনিমেষকে অ্যারেস্ট করা হ’য়েছে আর ফার্স্ট রাউন্ড ইনটেরোগেশনে মোটামুটি সবটাই স্বীকার করেছে।

সন্তু পিকুর পিঠ চাপড়ে জিজ্ঞাসা করল “বল কী খাবি?” 

একটু মিচকি হেসে পিকু বলে উঠলো “অনেকদিন মোগলাই পরোটা খাই না। সঙ্গে যদি কষা মাংস হয় তাহলে তো কথাই নেই। সুকুমার’দাকে বলোনা মামা! আর সঙ্গে ক্যাফের ক্যারামেল কাস্টার্ডটা আনতে বলো প্লিজ!”

“দাঁড়া দেখছি!” বলে সন্তু সুকুমারকে ডেকে পাঠাল।

Aroop Dasgupta Author

পড়াশোনা করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেডিয়ো ফিজিক্স বিভাগে। পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন তথ্য প্রযুক্তিকে। প্রায় এগারো বছর নানা বহুজাতিক সংস্থার সাথে যুক্ত থাকার পর উনিশশো সাতানব্বইতে তৈরি করেন নিজের তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা। বর্তমানেও যুক্ত রয়েছেন সেই সংস্থার পরিচালনার দায়িত্বে। কাজের জগতের ব্যস্ততার ফাঁকে ভালবাসেন গান-বাজনা শুনতে এবং নানা বিষয়ে পড়াশোনা করতে। সুযোগ পেলেই বেড়াতে বেরিয়ে পড়েন আর সেই অভিজ্ঞতা ধরে রাখেন ক্যামেরায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *