পুজোয় কোথাও একটা বেড়াতে যাবে আগে থেকেই ঠিক ছিল। শেষে সবাই মিলে ঠিক করা হল জয়সলমির যাওয়া হবে। পিকু, সাত্যকি আর মেঘনা যাবেই, তবে আর একজন মেয়ে দরকার নইলে মেঘনার বাড়ি থেকে হয়তো ছাড়বে না। পিকুদের কলেজ যাতায়াতের বন্ধু অন্বেষা কিছুতেই যেতে রাজি হল না। শেষে মেঘনা ওর আর এক বন্ধু ঋতজাকে রাজি করাল। ঋতজা বিশ্বভারতীতে ইতিহাসে এম এ পড়ে। মেঘনা বলে “একদম বোর হবি না কারণ ঋতজা ভালো গান গায়। “

লক্ষ্মীপুজোর দুদিন আগে কলকাতা থেকে যোধপুর এক্সপ্রেস ধরে লক্ষ্মীপুজোর দিন সকালে যোধপুর পৌঁছবে। সারাদিন যোধপুর দেখে রাতের ট্রেন ধরে ভোরবেলা জয়সলমির। কপাল ভালো থাকলে কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে ট্রেনে শুয়ে শুয়েই চাঁদের আলোয় থর মরুভূমি দেখা যাবে।

ঋতজার মেসো রেলে কাজ করেন, তার সহযোগিতায় স্টুডেন্ট কনসেশনে টিকিট হয়ে যাবে। আর পিকুর আইপিএস মামা সন্তুর বন্ধু জয়সলমিরের এসপি ডঃ কিরণ কঙ্গ আরটিডিসির টুরিস্ট লজে থাকার ব্যবস্থা করে দেবেন। পিকু শখের গোয়েন্দাগিরি করে শুনে এস পি অফার দিলেন পিকুরা যেন ওই কদিন ওঁর গেস্ট হয়েই থাকে, অতএব থাকা খাওয়া ফ্রি। এস পি পিকুদের ঘোরার জন্যে একটা গাড়িও দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু সন্তুই সটান না করে দিয়েছে।

থাকা খাওয়া ফ্রি আর যাতায়াতের ব্যবস্থা সস্তায় হওয়াতে সবাই দারুণ খুশি। যেহেতু খানিকটা টাকা বেঁচে যাবে, ট্রেনে এসি টু টায়ারেই টিকিট কাটা হল। ঋতজা যেহেতু ইতিহাসের ছাত্রী তাই ওর ওপর দায়িত্ব বর্তালো জয়সলমির সম্বন্ধে ইনফরমেশন কালেক্ট করে হোয়াটস্যাপ গ্রুপে শেয়ার করার। মেঘনা মোটামুটি একটা ডে ওয়াইজ প্ল্যানও তৈরি করে ফেলল।

বেড়াতে যাওয়া আছে তাই পুজোর কদিন বেশি ঘোরাঘুরি না করে পিকুরা একদিন ম্যাডক্স স্কোয়ারে দেখা করল। পিকুর ছোটমামি নবমীর দিন দুপুরে পিকু আর মেঘনাকে বাড়িতে খেতে বলেছিল।

দিদা ম্যাঘনা ম্যাঘনা করে আদিখ্যেতা করতে লাগল। আর ছোটমামি তো মেঘনাতে ফিদা। মেঘনা সবাইকে তুমি টুমি বলে, দিদাকে একটু জড়িয়ে ধরে, অনবরত কথা বলে সবাইকে বেশ কাছে টেনে নিল। এমন ভাব করতে লাগল যেন মামাবাড়িটা মেঘনারই। পিকুকে কেউ আর পাত্তাই দিচ্ছে না। ক্যাবলার মতো বসে বসে পিকু একা একাই টিভি দেখল। এদিকে সন্তু আর মেঘনার মধ্যে আবার একটা অন্যরকম সম্পর্ক। হ্যান্ডসাম আইপিএস মামা আর গোয়েন্দা ভাগ্নের গার্লফ্রেন্ড। দুপুরে খাওয়াদাওয়া করে বিকেল হতে না হতেই পিকু আর মেঘনা বেরিয়ে পড়ল। মেঘনাকে নামিয়ে পিকু সোজা বাড়ি।

জয়সলমির রওনা হওয়ার দিন সন্ধ্যা সাড়ে নটা নাগাদ সবাই হাওড়া স্টেশনে বড় ঘড়ির তলায় মিট করল। রাত এগারোটা পঁচিশে ট্রেন। ট্রেনে উঠে সবাই যে যার জায়গায় সেটল করে গেল। একটা কুপে চারজন একসঙ্গে। মেঘনা আর ঋতজা নীচের বার্থে, পিকু আর সাত্যকি উপরে। রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ বর্ধমান ক্রস করলে আলো নিভিয়ে সবাই মোটামুটি কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষন পরেই বাধ সাধল সাত্যকির নাক ডাকা। যতবার পিকু সাত্যকিকে ধাক্কা দিয়ে তোলে একবার সরি বলে আবার নাক ডাকতে শুরু করে দেয়। যাইহোক মাঝরাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়ল আর সাত্যকিও মনের আনন্দে নাক ডেকেই গেল।

সকালে লোকজন, ফেরিওয়ালার আওয়াজে ঘুম ভাঙলে জানালার পর্দা সরিয়ে দেখা গেল ট্রেন গয়া স্টেশনে দাঁড়িয়ে। পিকু আর সাত্যকি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সকলের জন্য চা নিয়ে এল। ঋতজা ব্যাগ থেকে বিস্কুট বার করল। ঋতজা মেয়েটা মেঘনার থেকে কম কথা বলে আর ভীষণ বুঝদার। চা খেয়ে একে একে সবাই ফ্রেশ হয়ে আসতেই প্যান্ট্রি থেকে ব্রেকফাস্টে সেই চিরাচরিত স্ট্যান্ডার্ড মেনু সার্ভ করে গেল। টোস্ট, অমলেট, কলা আর চা। ঋতজার ব্যাগে প্রচুর টুকটাক খাবারের স্টক। গল্প করে আর তাস খেলে সকালটা কেটে গেল। দুপুরে এলাহাবাদে লাঞ্চ দিল, চিকেন মিল। দুপুরটা গল্প করে আর ঘুমিয়ে কাটিয়ে  বিকেলে কানপুর ক্রস করলে একটু চা খেয়ে সবাই আবার আড্ডা মারতে বসল। প্যান্ট্রি থেকে বলে গেল ডিনারে এগ মিল। “আচ্ছা আমরা যে এই জয়সলমির যাচ্ছি ওখানকার ইতিহাস সম্বন্ধে কারুর কোনও ধারনা আছে? তুই তো নিশ্চই জানিস ঋতজা!” পিকু জিজ্ঞাসা করল। ঋতজা বলল “জানি, তবে খুব একটা ডিটেইলে নয়।” “তুই তো নিশ্চই পড়ে এসেছিস পিকু বল না।” মেঘনা বলে উঠল। পিকু বলল “বলতে পারি যদি ডিনারে তোর থেকে একটা ডিম দিস!”

“আচ্ছা দেব”। 

“প্রমিস?”

“হ্যাঁ প্রমিস।” 

পিকু শুরু করল।

জয়সলমিরের রাজারা হল রাজপুত শাসক জয়তসিংহর বংশধর। নবম শতাব্দীতে ভাটি রাজপুতদের রাজপুত্র দেওরাজ প্রথম রাওয়াল উপাধি পান। রাওয়াল শব্দের অর্থ আক্ষরিক ভাবে না হলেও মোটামুটি রয়্যাল বলা যেতে পারে। রাজপুতরা এমনিতেই ভীষণ আত্মসম্মান সচেতন। ওদের মধ্যে অনার কিলিংটা সেখান থেকেই হয়তো এসেছে। একটা ঘটনার থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় তখনকার দিনে অনার কিলিং কী রকম ছিল!

একবার দেওরাজ তার প্রতিবেশী এক প্রধানের মেয়েকে বিয়ে করেছিল বলে দেওরাজের বাবা তার শ’চারেক অনুগামিকে নিয়ে বিয়ের দিন এক হত্যালীলা চালায়। এই আক্রমণের সময় দেওরাজ এক ব্রাহ্মণ যোগীর সঙ্গে কোনওরকমে পালিয়ে প্রাণে বাঁচে। কিন্তু প্রতিবেশী সেই প্রধানের লোকজন যখন দেওরাজকে ধরে ফেলে তখন ওই ব্রাহ্মণ যোগী দেওরাজের সাঙ্গে এক থালায় ভাত খেয়ে আক্রমণকারীদের বুঝিয়ে দেন যে দেওরাজ তারই মতো ব্রাহ্মণ আর উঁচু জাতের। “কি ডেনজারাস ক্যারেকটার রে ভাই।” সাত্যকি বলে উঠল।

পিকু বলতে থাকল।

fort at jaisalmer
জয়সলমিরের রাজারা হল রাজপুত শাসক জয়তসিংহর বংশধর।

দেওরাজ আর তার বেচেঁ থাকা সঙ্গী সাথীদের নিয়ে দেরওয়ার দখল করে আর তার কিছুদিনের মধ্যেই জয়সলমিরের দক্ষিণ পূর্বে লৌদ্রভা দুর্গও দখল করে আরেক রাজপুত রাজার কাছ থেকে।

একটা ব্যাপার মনে রাখা দরকার যে ব্যবসা বাণিজ্যের দিক থেকে জয়সলমিরের একটা সাংঘাতিক লোকেশনাল ইম্পর্ট্যান্স ছিল। উত্তর ভারত, মধ্য ভারত বা গুজরাট থেকে আরবদেশ, মিশর বা পারস্যে যাওয়ার পথ ছিল জয়সলমির হ’য়েই। ফলে জয়সলমির-এর ওপর দিয়েই সবাই আরবদেশ, পারস্য, বা মিশরের সঙ্গে বাণিজ্য করতে যেত। 

আর দেওরাজ জয়সলমিরের লোকেশনাল ইম্পর্ট্যান্স বুঝতে পেরে জয়সলমির হ’য়ে যাওয়া সব পণ্যবাহী যানবাহন থেকে ট্যাক্স আদায় করতে শুরু করল। তাই নিয়ে মাঝেমধ্যেই নানা রকম ঝামেলাও হত। 

বারোশো শতাব্দীতে রাওয়াল দেওরাজের বড় ছেলে রাওয়াল জয়সাল লৌদ্রভার অধিকার পায়। সেই সময় একবার জয়সাল ত্রিকুটাতে বিস্তীর্ণ মরুভূমির মাঝে ৭৫ মিটার উঁচু একটা ত্রিভুজাকৃতি পাথরের সন্ধান পায়। মরুভুমির মধ্যিখানে ওই পাথর দেখে রাওয়াল বেশ বিস্মিতও হয়। রাওয়ালের মনে হয় চারপাশে মরুভূমি থাকায় জায়গাটা খুব নিরাপদ হবে এবং সেই জন্যেই সে ঠিক করে তার রাজধানী লৌদ্রভার থেকে ওইখানে সরিয়ে নিয়ে আসবে। যদুবংশীয় রাওয়ালের এই ডিসিশন আরও জোরদার হয় যখন এক সাধুর কাছে জানতে পারে যে শ্রীকৃষ্ণ নাকি ভীমকে এই জায়গাটা দেখিয়ে বলেছিল কোনও এক যদুবংশীই এইখানে তার রাজত্ব বিস্তার করবে। সেইসব শুনে রাওয়াল আরও উৎসাহিত হয়ে পড়ে। ১১৫৬ খ্রিস্টাব্দে সেইমতো জয়সাল ত্রিকুটা পাহাড়ের ওপরে একটা দুর্গ বানায়। নিজের নামের সঙ্গে মিলিয়ে জায়গাটার নাম দেয় জয়সলমির। এই হল জয়সলমিরের ইতিহাস। 

“তুই হিস্টরি নিয়ে পড়াশোনা করলি না কেন রে পিকু?” ঋতজা আর না বলে পারল না। পিকু বলল “একটা জায়গায় যাচ্ছি আর তার সম্পর্কে কিছু জানব না সে কী করে হয়। তাই টডের বইটা একটু পড়ে এসেছি।”

পিকু আবার বলতে শুরু করল- 

জয়সলমিরের দুর্গ থর মরুভূমির ত্রিকুটা পাহাড়ের গায়ে গড়ে ওঠা এক বিস্ময়। সকালের সূর্যের আলোয় দুর্গের স্যান্ড স্টোনের, কেউ কেউ যাকে লাইম স্টোনও বলে, দেওয়ালগুলো একেবারে সিংহের গায়ের রঙের মতো দেখায়। আবার সূর্যাস্তের সময় মধু ঢালা সোনালি রঙের রূপ নিয়ে বিস্তীর্ণ মরুভূমির সঙ্গে একাকার হয়ে যায়। এ নাকি এক অপরূপ দৃশ্য। 

১২৯৪ সাল। সব ঠিকঠাকই চলছিল। একবার দিল্লির তখনকার বাদশা আলাউদ্দিন খিলজির সৈন্যরা প্রায় হাজার তিনেক ঘোড়ার একটা কনভয়ে লুঠ করা সোনাদানা, মণিমাণিক্য নিয়ে জয়সলমিরের ওপর দিয়ে দিল্লির পথে যাচ্ছিল। খবর পেয়ে তৎকালীন রাওয়াল রাজা জেঠশির সৈন্যরা খিলজির কনভয়ে আক্রমণ করে। আচমকা আক্রমণে প্রথমে একটু কোনঠাসা হয়ে পড়লেও খিলজি মশাই ছাড়ার পাত্র নন। সঙ্গে সঙ্গে আরও সৈন্য নিয়ে খিলজি দ্বিগুণ উদ্যমে আক্রমণ ক’রে দুর্গ ঘিরে ফেলে। প্রায় আট বছর পুরো দুর্গ ঘিরে রাখে খিলজির সৈন্যরা। তখনও যুদ্ধ শুরু হয়নি, শুধু দুর্গের ভিতরে কেউ যেতেও পারছে না আর দুর্গ থেকে কেউ বেরোতেও পারছে না। এমনি ক’রে অনেকদিন কেটে যাওয়ার পর আস্তে আস্তে যখন দুর্গের ভেতরের রসদ ফুরিয়ে আসতে থাকল তখন উপায় না দেখে রাওলরা সরাসরি খিলজির সৈন্যদের আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়, যুদ্ধ শুরু হয়। সেই যুদ্ধে জেঠশির মৃত্যু হলে তার দ্বিতীয় ছেলে মূলরাজ দুর্গের দায়িত্ব পায়। যুদ্ধ চলাকালীন যদিও ভাটিরা কোনওভাবে শিশু, বৃদ্ধ আর অসুস্থদের দুর্গের বাইরে একটা সেফ জায়গায় পাঠাতে পেরেছিল কিন্তু খিলজি আস্তে আস্তে দুর্গের পুরো সাপ্লাই লাইন বন্ধ করে দেওয়ায় ভাটিরা বুঝতে পারে যে জেতার বা পালানোর আর কোনও সম্ভবনাই নেই। তখন তারা খিলজির সৈন্যদের হাত থেকে বাঁচাতে দুর্গের মহিলাদের জন্যে জওহরের বন্দোবস্ত করে। আনুমানিক হাজার দুয়েক মহিলা জওহরের আগুনে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যু বরণ করলেও সবাই জওহরে প্রাণ দিতে পারেনি। বাকি মহিলাদের পুরুষদের তরোয়ালের কোপে প্রাণ দিতে হয়। তখন পুরুষরা যে মেয়েদের ভোগবিলাসের জিনিস মনে করত জওহর প্রথাই তার প্রমাণ। অর্থাৎ আমার মৃত্যুর পর আমার বিলাসের জিনিস যেন অন্য কেউ ভোগ করতে না পারে। তাই ব্রতের নামে কথায় কথায় মেয়েদের আগুনে পুড়িয়ে মারা হত। ঠিক যেমন আমাদের সতীদাহ প্রথা ছিল। বা আজও অনেক সমাজে যেমন স্বামীর মৃত্যুর পর মহিলাদের বিয়ে করার চল নেই।  

এরপরেই দুর্গের দরজা খুলে দিয়ে প্রায় চার হাজার ভাটি সৈন্য সরাসরি মুখোমুখি যুদ্ধে নেমে পড়ে আর আত্মত্যাগ করে। পুরুষদের এই সুইসাইডাল অ্যাটাকে মৃত্যুকে বলা হত সাকো। 

“অত মহিলা আগুনে ঝাঁপ দিয়ে মারা যায়? কী ভয়ঙ্কর রে! আনবিলিভেবল।” মেঘনা প্রায় আঁতকে উঠল। পিকু বলে চলল—

এরপর বেশ অনেক বছর দুর্গ পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে থাকার পর জয়সলমিরের ভাটিরা আবার দুর্গে ফিরে এসে নির্বিঘ্নে থাকতে শুরু করে। 

কিন্তু শান্তি বেশিদিন স্থায়ী হয়না। 

ভাটিরা বুঝতে পারে যে জেতার বা পালানোর আর কোনও সম্ভবনাই নেই। তখন তারা খিলজির সৈন্যদের হাত থেকে বাঁচাতে দুর্গের মহিলাদের জন্যে জওহরের বন্দোবস্ত করে। আনুমানিক হাজার দুয়েক মহিলা জওহরের আগুনে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যু বরণ করলেও সবাই জওহরে প্রাণ দিতে পারেনি। বাকি মহিলাদের পুরুষদের তরোয়ালের কোপে প্রাণ দিতে হয়।

চোদ্দ শতকের শেষের দিকে দিল্লির তুর্কি শাসক ফিরোজ শাহ তুঘলক আবার জয়সলমির আক্রমণ করে। তবে এর কারণ অবশ্য অন্য ছিল। জয়সলমিরের এক রাজপুত্র আজমেরের কাছে আনা সাগর লেকে তুঘলকের সৈন্যদের শিবিরে আক্রমণ করার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যে তুঘলকের সৈন্যরা পাল্টা আক্রমণ করে দুর্গ এমনভাবে ঘিরে রাখে যে দুর্গের ভিতরে আবার জওহরে প্রাণ দেওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়। সেইবারেও বেশ কয়েক শো মহিলা জওহর ব্রতে প্রাণ দেন। যুদ্ধে তখনকার রাজা রাওয়াল দুদু আর তার ছেলে তিলাস্কির সঙ্গে প্রায় হাজার দুয়েক ভাটি সৈন্যেরও মৃত্যু হয়। 

এরপরে পনেরোশো শতকের গোড়ার দিকে ভাটিরা আবার দুর্গে ফিরে আসে আর মোটামুটি স্বাধীনভাবে বাস করতে থাকে। 

১৫৩০ থেকে ১৫৫১ সালের মাঝে, যখন রাওয়াল লুনাকরন জয়সলমিরে রাজত্ব চালাচ্ছে তখন আমির আলি নামে একজন আফগান কর্মকর্তা লুনাকরনের কাছ থেকে অনুমতি চায় যদি তার স্ত্রীদের জয়সলমিরের রানিদের সঙ্গে একবার দেখা করতে দেওয়া হয়। অনুমতি পাওয়ার পর যখন আমির আলি দুর্গে ঢোকে তখন লুনাকরনের সৈন্যরা বুঝতে পারে পালকিতে আমির আলীর স্ত্রীদের বদলে ফুললি আর্মড সৈন্যরা বসে। এই ঘটনাটা এতটাই আনএক্সপেকটেড ছিল যে প্রায় বিনা বাধায় আমির আলির সৈন্যরা দুর্গের গার্ডদের মেরে নিজেরা দুর্গের দখল নিয়ে নেয়। রাওয়াল হার বুঝতে পেরে জওহরের ব্যবস্থা করার সময় না পাওয়ায় নিজেই নিজের স্ত্রীদের কুপিয়ে মারে। যাকে হাফ জওহর বলা হয়। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই লুনাকরনের আশপাশের বন্ধু রাজাদের কাছ থেকে আরও সৈন্য এসে হাজির হয় আর রাওয়ালরা নিজের ক্ষমতা ফিরে পায়। এই যুদ্ধের শেষে আমির আলিকে কামানের গোলার সঙ্গে বেঁধে উড়িয়ে দেয় রাওয়ালরা।

“ইস্ কি নিষ্ঠুর!” ঋতজা বলে উঠল। সাত্যকি সঙ্গে সঙ্গে রিয়্যাক্ট করল 

“কেন রে ওদের জন্যে যে ওতগুলো নিস্পাপ মানুষের প্রাণ গেল তার বেলা!”পিকু বলতে থাকল। 

যাইহোক, এরপর ১৫৪১ সালে আবার মোঘল সম্রাট হুমায়ুন আজমের যাওয়ার পথে দুর্গ আক্রমণ করে। লুনাকরন তখনও জয়সলমিরের রাজা। আবার যুদ্ধ শুরু হয়। পরে নিজেকে বাঁচানোর জন্যে হুমায়ুন পুত্র আকবরের সঙ্গে নিজের মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব দেয় লুনাকরন। কিন্তু তাতে কোনও লাভ হয়না। হুমায়ুন দুর্গের দখল নেয়। 

অবশ্য ১৭৬২ সালে মহারাওয়াল মুলরাজ আবার ক্ষমতায় ফিরে আসে আর সেই থেকে রাওয়ালরাই দুর্গ দখলে রাখে। 

১৮১৮ সালে মুলরাজ ব্রিটিশদের সঙ্গে চুক্তি করে ওখানেই নির্ভয়ে বসবাস করতে থাকে। ১৮২০ সালে মুলরাজের মৃত্যুর পর তার নাতি গজ সিং জয়সলমিরের সিংহাসনে বসে। তারপর তো দেশ স্বাধীন হয়, রাজারা রাজত্ব হারায় আর সত্যজিৎ রায়ের হাত ধরে জয়সলমিরের দুর্গ সোনার কেল্লা নামে বিখ্যাত হয়।

তাহলে ভেবে দ্যাখ জটায়ু যদি সোনারকেল্লার ইতিহাস জানত তাহলে কী হোত।

পিকু শেষ করার পর সবাই বলে উঠল “সত্যিই এসব জানার দরকার ছিল”।

ততক্ষণে ট্রেন আগ্রা ফোর্ট পেরিয়ে গেছে।

আধ ঘণ্টার মধ্যেই ডিনার এল। ডিম কষা, রুটি, আচার আর দুটো কালাকান্দ। কথামত মেঘনা যেই একটা ডিম পিকুকে দিতে যাবে ওমনি সাত্যকি ঝাঁপিয়ে পড়ে চিলের মতো ছোঁ মেরে সেটা তুলে নিল। পিকু প্রচণ্ড রেগে বলল “এটা ঠিক নয়।” শেষে হাফ হাফ ডিমে সেটলমেন্ট হল। 

ভোরবেলা আটটা নাগাদ ট্রেন যোধপুর পৌঁছল। নামার আগেই সবাই ফ্রেশ হয়ে নিয়েছিল, তাই ট্রেন থেকে নেমে সোজা রেলওয়ে ক্যান্টিনে ঢুকে পড়লো ব্রেকফাস্ট করতে। আজ আর টোস্ট না খেয়ে ওরা সবাই পুরি ভাজি, সবজি, গোলাপ জামুন আর চা খাবে ঠিক করল। ধীরেসুস্থে খাওয়া সেরে আরও দু কাপ চা খেতে দশটা বেজে গেল। 

স্টেশনেই ট্রাভেল এজেন্সির কাউন্টার থেকে একটা গাড়ি ভাড়া করা হল। ১২০০ টাকায় মেহেরনগড় ফোর্ট আর উমেদ ভবন দেখিয়ে লাঞ্চ করিয়ে স্টেশনে ছেড়ে দিয়ে যাবে। যাই করুক সব মিলিয়ে ছ’ঘণ্টার মধ্যে শেষ করতে হবে। তার মানে পাঁচটার পর আর গাড়ি থাকবে না। 

জিনিসপত্র ক্লোক রুমে রেখে ওরা গাড়িতে উঠে বসল। ড্রাইভার কাকুর বছর ষাটেক বয়েস হবে। কানে দুল আর মাথায় একটা নোংরা কিন্তু রঙচঙে পাগড়ি বাঁধা। তবে গোঁফখানা জব্বর। পিকু বলল “গোঁফই রাজস্থানিদের পৌরুষের প্রতীক। কেউ কেউ এক মিটার লম্বা গোঁফও রাখে। জয়সলমিরে নাকি দেখা যাবে। “ড্রাইভার কাকুর নাম গজেন্দ্র জিঙ্গার।

মেহেরনগড় পৌঁছতেই প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট লেগে গেল। মেহরনগড় থেকে বেরোতেই আড়াইটে বেজে গেল। মেঘনা বলল ডাল বাটি চুরমা খাবে। ড্রাইভার কাকুকে বলা হল। অনেক খোঁজাখুজির পর গজেন্দ্রজি ওদের মোটামুটি একটা পরিষ্কার রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেল। ঠিক হল আজ সবাই ট্র্যাডিশনাল কুজিন ট্রাই করবে। সেইমতো ডাল বাটি চুরমা অর্ডার করলো পিকু।

মেঘনার ধারণা ছিল বাট্টি মানে বাটি। আসলে বাটি হল ছোট ছোট কচুরির সাইজের রুটি। অনেকটা ফ্রেঞ্চ রুটি ‘পেইন অউ লাভিনের’ মতো। আর চুরমা হল ঘিতে ভেজে চিনির রসে ভেজানো ডাল বাটা। বেশ অন্যরকম খেতে। 

ড্রাইভার কাকুও  ওদের সঙ্গে খেতে বসল। যদিও দোকানের অন্যরা একটু বাঁকা চোখে দেখছিল, পিকুরা পাত্তা দিল না।

গজেন্দ্র জিঙ্গর লোকটা খুব ভালো। পিকুদের উমেদ ভবন দেখিয়ে বালসমন্দ লেক ঘুরিয়ে স্টেশনে নামিয়ে দিল। ততক্ষণে সাতটা বাজে। টাকা দেওয়ার সময় সাত্যকি জিজ্ঞাসা করলো এক্সট্রা কত দেবে। গজেন্দ্র কাকু কিছুতেই কিছু এক্সট্রা নেবে না। ওর বক্তব্য তোমরা আমার মতো নিচু জাতের লোককে এক টেবিলে পাশে বসিয়ে খানা খাইয়েছ, আমি কী করে তোমাদের কাছ থেকে আর টাকা নেব। এই বলতে বলতে ড্রাইভার কাকুর চোখ দুটো ছল ছল করে উঠল। মেঘনা ড্রাইভার কাকুর হাত দুটো ধরে বলল “আংকেল, দুঃখ করোনা। একদিন দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। এইসব ভাগাভাগি আর থাকবে না।”

“নহি বিটিয়া, ইয়ে দুখ কি নহি, খুশি কি আঁসু হ্যায়।” গজেন্দ্র মেঘনার মাথায় হাত দিয়ে বলল। 

ওদের ট্রেন রাত পৌনে বারোটায় শুনে ড্রাইভার কাকু অফার দিল “চলো তুমহে কিলাসে রাতকা যোধপুর দিখাকে লাতে হ্যায়। যো মন চাহে দে দেনা”!  সবাই লাফিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ল। সত্যি ভীষণ সুন্দর দৃশ্য। না দেখলে একটা ভালো জিনিস মিস হয়ে যেত। স্টেশনে ফিরে ড্রাইভার কাকুকে পাঁচশো টাকা দিতে গজেন্দ্র খুব খুশি হল। টা টা করে পিকুরা স্টেশনে ঢুকে পড়ল। সাড়ে নটা বাজে, ক্যান্টিনে গিয়ে চিকেন কোরমা আর রুটি অর্ডার দিল সাত্যকি। খাওয়া হলে ক্লোক রুম থেকে জিনিসপত্র নিয়ে তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মের দিকে রওনা দিল ওরা। যোধপুর স্টেশনটা বেশ সুন্দর, পরিষ্কার আর ওয়েল ইকুইপড। ভারতবর্ষের অন্যান্য স্টেশনের থেকে দৃশ্যটা বেশ অন্যরকম। 

সোয়া এগারোটায় ট্রেন এসে দিল প্লাটফর্মে। পিকুদের আগের মতোই একসঙ্গে সিট। যেহেতু রাতে মরুভূমির মধ্যে দিয়ে ট্রেনটা যাবে আর আজ কোজাগরী পূর্ণিমা তাই ঠিক হল ওরা সারা রাত জেগেই কাটাবে। পৌনে বারোটায় ট্রেন ছাড়ল। মেঘনার অস্থির হয়ে পড়লো মরুভূমি দেখার জন্যে। রাত দেড়টা নাগাদ প্রথম মরুভূমির দর্শন পাওয়া গেল। অসাধারণ নৈসর্গিক সৌন্দর্য। বালির ওপর চাঁদের আলো পড়ে মনে হচ্ছে কেউ সোনার থালায় মুঠো মুঠো মুক্তো ছড়িয়ে দিয়েছে। 

ঋতজা আর চুপ করে থাকতে পারল না। গলা ছেড়ে গাইতে শুরু করল, 

‘পূর্ণচাঁদের  মায়ায় আজি ভাবনা আমার পথ ভোলে….’!

একটা দারুণ এ্যাটমোস্ফিয়ার তৈরি হল। একটার পর একটা গান ধরতে লাগল ঋতজা। এরপর গাইল 

‘ও চাঁদ, চোখের জলের লাগলো জোয়ার দুঃখের পারাবারে….’। মেয়েটা দারুণ গায়। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে। বাইরে ওইরকম অফুরন্ত চাঁদের আলোয় সব ভেসে যাচ্ছে আর তার সঙ্গে এই গান। এর পরে ঋতজা রামকেলীতে একটা কম্পোজিশন গাইলো, অসাধারণ। সবাই চুপ। এ এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা।

আস্তে আস্তে পুবের আকাশে হাল্কা একটু আভা ফুটে উঠেছে, চারপাশে ছড়ানো মুক্তোর রং একটু একটু করে সোনালি হতে শুরু করল। আস্তে আস্তে সূর্য উঠছে, বালিয়ারিগুলো যেন গলানো সোনায় ঢাকা পড়ছে আর দূরে লাইন দিয়ে উটের দল একপাশ থেকে অন্যপাশে হেঁটে চলেছে।  

এই স্বর্গীয় অনুভূতি কাটতে না কাটতেই ট্রেন জয়সলমিরে ঢুকে পড়ল। 

জয়সলমিরে ট্রেন থেকে নেমে দুটো রিকসা নিয়ে পিকুরা টুরিস্ট লজে পৌঁছল।

আর টি ডি সির লজ মুমাল। ছিমছাম পরিষ্কার। পৌঁছে জানতে পারল এস পির ভদ্রমহিলার নাম ডঃ কিরণ কঙ্গ। উনি সব বলে দিয়েছিলেন। ফলে কোনও অসুবিধাই হল না। ওপরের তলায় দুটো পাশাপাশি ফোর্ট ভিউ ঘর পাওয়া গেল। দূরে হলেও ঘর থেকে বেশ পরিষ্কার দুর্গ দেখা যাচ্ছে। সঠিক নামকরণ ‘সোনার কেল্লা’!

সবাই স্নান টান করে ফ্রেশ হয়ে নীচে ডাইনিং হলে যখন মিট করল তখন দশটা বাজে। রিসেপশনের ভদ্রলোকই সাজেস্ট করল সকালেই ফোর্ট দেখে আসতে। হেঁটে গেলে আধ ঘণ্টা আর টাঙায় গেলে দশ মিনিট। 

মেঘনাকে দিইয়ে এসপি ডঃ কিরণ কঙ্গকে ফোন করাল পিকু। কিরণ ম্যাডামকে পৌঁছসংবাদ দিয়ে থ্যাংকস জানিয়ে ওরা বেরিয়ে পড়ল দুর্গের দিকে। 

জয়সলমিরে দুটো খুব লক্ষ করার মতো ব্যাপার আছে। 

এক, এখানকার লোকজন যতই গরীব হোক সকলের মাথার পাগড়ি আর পোশাক সবার খুব কালারফুল। 

আর লোকজন ভীষণ সঙ্গীতপ্রিয়। রাস্তায় যেখানে সেখানে বিশেষ করে দুর্গের কাছে বসে রাবনহাত বা খামাইচা আর তার সঙ্গে করতাল বাজিয়ে গান চলছে। মরুভূমির ধূসর রুক্ষ জীবনে বৈচিত্র আনার জন্যেই হয়তো এত রঙের ব্যবহার চারদিকে।

দুর্গে ঢোকার আগে পিকু আর একটা ইনফরমেশন দিল, দুর্গটা দৈর্ঘ্যে ৪৫৫ মিটার আর প্রস্থে ২৩০ মিটার। 

দারুণ সুন্দর ভেতরটা। যেন একটা ব্যস্ত ছোটখাট শহর। বাড়িগুলোর দরজা জানলায় অপূর্ব সব কারুকাজ। বিশেষ করে জানালাগুলো দেখার মতো। 

আরেকটা ব্যাপার লক্ষ করার মতো, এখানে ছেলেদের গোঁফ সত্যিই একটা ইম্পর্ট্যান্ট ব্যাপার। মতি মহলের বাইরে একজন সাড়ে চার মিটার লম্বা গোঁফ পাকিয়ে বসে ছিল। পয়সা দিতে খুলে দেখাল। বিশাল লম্বা গোঁফ। মেঘনা আর ঋতজা দুজনে দুদিকে টেনে ধরতে সাত্যকি মেপে দেখল সত্যিই সাড়ে চার মিটার। অবিশ্বাস্য। জওহর প্যালেস, সব মহল, পোল দেখে শেষে জৈন মন্দির আর লক্ষ্মীকান্ত মন্দির  দেখে যখন ওরা লজে ফিরল প্রায় আড়াইটে বাজে। দুর্গের রঙও ততক্ষণে ধূসর সোনালি হয়ে গিয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই দুর্গের রঙও বদলাতে থাকে।

হাতমুখ ধুয়ে সকলে ডাইনিং হলে এসে বসল লাঞ্চের জন্যে। 

অনেকদিন পর দুপুরে ভাত পাওয়া গেল। সঙ্গে ডাল তরকারি আর ডিমের ঝোল। অমৃতের মতো মনে হল। শেষে চিনি দিয়ে টক দই আর প্যাড়া। 

পিকু রিসেপশনে বলে রেখেছিল ব্রেকফাস্ট আর দুটো মিল ছাড়া ওরা যা খাবে সব যেন ওদের নামে বিল করে, এস পি ম্যাডামকে না পাঠায়। 

রিসেপশনের মেয়েটি মেঘনাদের জানাল আজকেই যদি সম্ভব হয় রাত্রে মরুভূমি দেখে আসতে। সদ্য সদ্য কালই পূর্ণিমা গেছে তো, ভালো লাগবে। 

বিকালে চা খেয়ে একটু তাড়াতাড়িই বেরিয়ে পড়লো ওরা। ওই রিসেপশনিস্টই সব বন্দোবস্ত করে দিল। একটা মারুতি ভ্যান ওদের নিয়ে যাবে, রাতে মরুভূমির মাঝে একটা জায়গায় ডিনার করিয়ে আবার লজে ফিরিয়ে দিয়ে যাবে। 

মরুভূমির মধ্যে তাঁবু টাঙানো একটা জায়গা। জনা পাঁচেক বিদেশি বসে আছে। তখনও সন্ধ্যা হয়নি। পিকুরাও গিয়ে বসল। দুরে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। সে এক মায়াবী দৃশ্য। যত অন্ধকার হতে লাগল টেম্পারেচার, এ্যাটমোস্ফিয়ার, চারপাশের দৃশ্য সব কেমন বদলাতে শুরু করল। অনবদ্য পরিবেশ। দারুণ সুন্দর জায়গাটা, জনমানবহীন।

sand dunes
দুরে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। সে এক মায়াবী দৃশ্য।

দুর থেকে ভেসে আসছে “কেসরিয়া বালোমে আওনি”, বিখ্যাত মান্ড, সঙ্গে হারমোনিয়াম বা খামাইচা, ঢোল আর করথালের আওয়াজ। কারুর মুখে কোনও কথা নেই। হঠাৎ ঝপ্ করে অন্ধকার হতেই মরুভূমি এক অন্য রূপে দেখা দিল। চাঁদের আলো আর তার সঙ্গে আকাশ ভরা হাজার হাজার তারা। সে এক অপরূপ দৃশ্য। 

সাড়ে নটা নাগাদ ডিনার সার্ভ করা হল। বুফে। বাজরার রুটি, ডাল, কের সংগ্রি, লাল মাস আর সঙ্গে আচার। শেষ পাতে কালাকান্দ। সাহেবগুলো খাবার দেখে হামলে পড়ল। মাংসের জায়গায় তো অলমোস্ট গুতোগুতি লেগে গেল। খাওয়া শেষ করে ওরা লজে পৌঁছল সাড়ে দশটা নাগাদ।

অনেক রাত পর্যন্ত মেঘনাদের ঘরে আড্ডা চলল। ঘরের মাঝখানে ঝোলানো ছোট্ট ঝুড়ির শেডের নাইট ল্যাম্পটা জ্বলছিল। বাইরে দূরে চাঁদের আলোয় দুর্গটা দেখা যাচ্ছে। দুর্গের এখন এক অন্য রূপ। ভাবা যায় এই দুর্গের বাইরেই আলাউদ্দিন খিলজির সৈন্যরা দুর্গ ঘিরে দাঁড়িয়ে, আর ভিতরে দাউ দাউ করে জওহরের আগুন জ্বলছে। চারদিক নিস্তব্ধ, কেমন একটা গা ছমছমে রহস্যময় ব্যাপার।

এরমধ্যেই ঋতজা বেশ কয়েকটা সুন্দর গান শোনাল। মেঘনাও গান ধরল- “ঘাটে বসে আছি আনমনা”। সব শেষে ঋতজা চাঁদনী কেদার রাগের ওপর বিলম্বিত তিনতালে একটা বন্দিশ গাইল, অনবদ্য। 

গানটান শুনে পিকুরা নিজেদের ঘরে ফিরে এল। এদিকে সন্তু পিকুর গোয়েন্দাগিরি সম্পর্কে কিরণ ম্যাডামকে এতবার বলেছে যে উনি তো ধরেই নিয়েছেন পিকু খুব বড় দরের গোয়েন্দা। সেদিন রাত্রে কিরণ ম্যাডাম সন্তুকে ফোন ক’রে রিকোয়েস্ট করল পিকু যদি একটা কেসের ব্যাপারে একটু হেল্প করে দেয়। ব্যাপারটা জানলে পিকু যে খুব উৎসাহ নিয়েই কাজটা করার চেষ্টা করবে সন্তু সেটা কিরণ ম্যাডামকে জানিয়েও দিল। সকালবেলা আটটা নাগাদ রিসেপশন থেকে জানাল এস পি কিরণ ম্যাডাম ওদের জন্য অপেক্ষা করছেন। পিকুরা একটু ফ্রেশ হয়েই তাড়াতাড়ি নীচে নেমে এল। 

ম্যানেজার পিকুর সঙ্গে কিরণ ম্যাডামের আলাপ করিয়ে দিল। তারপর একে একে বাকিদের সঙ্গেও আলাপ হল। মেঘনা আর ঋতজা তো এসপিকে দেখে দারুণ ইমপ্রেসড। সাধারণ একটা সালোয়ার কামিজ পরা, অথচ যেমন সুন্দর চেহারা তেমন পার্সোনালিটি। কিরণ, পিকু মেঘনাদের সঙ্গে বসে ব্রেকফাস্ট করতে করতে অনেক গল্প গুজবের পর পিকুকে কিরণ আসল কথাটা বললেন। 

দু’দিন আগে জয়সলমিরের কাছে পোখরান শহরের উত্তরে রামদেওরার একটা ধাবাতে একজন কেনিয়ান খুন হয়। নাম মিস্টার চেলাঙ্গত। চেলাঙ্গতের বয়স বছর পঁয়ত্রিশ। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে জানা গেছে চেলাঙ্গত ড্রাগ অ্যাডিক্ট ছিল। খুনের কারণ কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। তবে পুলিশ সন্দেহ করছে কোনও বড় ড্রাগ মাফিয়া গ্রুপের সঙ্গে চেলাঙ্গত যুক্ত থাকলেও থাকতে পারে। চেলাঙ্গতের কাছ থেকে সেরকম কিছু পাওয়া যায়নি, শুধু একটা পার্স। তাতে কিছু ইন্ডিয়ান কারেন্সি, ইউ এস ডলার আর একটা চিরকুট ছিল। চিরকুটে অদ্ভুত সব কথা লেখা। যার মানে উদ্ধার করা যাচ্ছে না। কিরণ মোবাইলে চিরকুটের ছবি দ্যাখালো পিকুকে, হোয়াটসঅ্যাপও করে দিল। অনুরোধ করল পিকু যদি চিরকুটের লেখাটা ডিকোড করতে পারে। এতটা বলে কিরণ যাওয়ার জন্যে উঠে দাঁড়ালো। যাওয়ার সময় বলে গেল “আপ মানা নহি করনা! ম্যায় একঠো কার ভেজ দুঙ্গি আপ লোগোকে লিয়ে। উ ক্যান ইউজ দ্যাট অ্যাজ লং অ্যাজ ইউ আর হিয়ার।” এই বলে কিরণ ম্যাডাম মেঘনা আর ঋতজাকে একটু জড়িয়ে উইশ করে আর পিকুকে অল দা বেস্ট বলে একটা কার্ড দিয়ে বলে গেল “এনি থিং ইউ নিড জাস্ট গিভ মি এ কল। দিস ইজ মাই নাম্বার।”

দু’দিন আগে জয়সলমিরের কাছে পোখরান শহরের উত্তরে রামদেওরার একটা ধাবাতে একজন কেনিয়ান খুন হয়। নাম মিস্টার চেলাঙ্গত। চেলাঙ্গতের বয়স বছর পঁয়ত্রিশ। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে জানা গেছে চেলাঙ্গত ড্রাগ অ্যাডিক্ট ছিল। খুনের কারণ কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। তবে পুলিশ সন্দেহ করছে কোনও বড় ড্রাগ মাফিয়া গ্রুপের সঙ্গে চেলাঙ্গত যুক্ত থাকলেও থাকতে পারে। চেলাঙ্গতের কাছ থেকে সেরকম কিছু পাওয়া যায়নি, শুধু একটা পার্স। তাতে কিছু ইন্ডিয়ান কারেন্সি, ইউ এস ডলার আর একটা চিরকুট ছিল। চিরকুটে অদ্ভুত সব কথা লেখা।

কিরণ ম্যাডাম চলে যেতে পিকু মোবাইলে চিরকুটের ছবিটা খুলে দ্যাখে তাতে লেখা : 

I was hungry and tired, was looking for something to eat. Julian came and whispered “Chelangat! the cat caught a fish, but the eagle snatched that.” But that was not any respite for my hunger. I continued to be hungry. Finally Bob came and whispered “Don’t worry! The mother is bringing some cooked food.”

রাতে সন্তু ফোন করল। পিকু সন্তুকে সব কথা জানাল। এটাও বলল যে ও চেষ্টা করছে যদি কিছু হিন্ট পায় জানাবে। এর মধ্যে মেঘনার কাছে ঋতজা পিকুর এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাকটিভিটি সম্পর্কে সব জেনে গেছে। পিকু এমনিতে খুব ঠাণ্ডা ছেলে বাইরে থেকে দেখে কিচ্ছু বোঝা যায় না ভিতরে কী চলছে, তাই ঋতজা অবাক হয়ে পিকুকে দেখে আর বোঝার চেষ্টা করে ও কী ভাবছে। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারে না। শুধু দেখে পিকু মাঝে মধ্যে ছাদে চলে যায়। 

রাত্রে খাবার টেবিলে মেঘনা পিকুকে জিজ্ঞাসাই করে ফেলল “কিরে কিছু এগোতে পারলি?” 

পিকু বলল “দেখা যাক। জানতেই পারবি!” 

মেঘনা চেপে ধরল। “তুই নিশ্চই সলভ করে ফেলেছিস। প্লিজ বল। কাউকে বলব না। অন গড প্রমিস।” 

“আরে ধুর! জানলে তো বলব! পাগলের মতো করিসনা! ভাত খা”! পিকু বলল। 

মেঘনা একটু ক্ষুব্ধই হল। 

সেদিন রাতটাও মোটামুটি গানে আর আড্ডাতেই কেটে গেল। তবে সবাই একটু টেন্সড। কী হয় কী হয় চিন্তা। 

ব্রেকফাস্টে সবাই হাজির পিকু ছাড়া। কিরণ ম্যাডামও এসে গেছেন, সবাই বসে আছে পিকুর অপেক্ষায়। পিকু আসতেই কিরণ উঠে গিয়ে পিকুর হাত ধরে বললেন “ইউ আর ইন্ডিড এ জিনিয়াস মাই বয়! হাউ কুড ইউ ফাইন্ড দ্য নাম্বার? অ্যান্ড ইউ নো হোয়াট, দ্য নাম্বার বিলংস টু দ্যা নটরিয়াস ড্রাগ ডিলার ভট্টা সিং রানা। অ্যান্ড বাই ট্র্যাকিং ইট উই হ্যাভ অ্যারেস্টেড রানা। ইন্টেরেস্টিংলি, অল দ্যা কলস মেড অ্যান্ড রিসিভ্ড অন দ্য ফোন আর টেলিফোন বুথ নাম্বারস।” শুনেই পিকু বলে উঠল “জাস্ট টু হাইড দ্য গ্যাঙ্স আইডেনটিটি।” 

“একস্যাক্টলি সো।” কিরণ বেশ উত্তেজিত হয়ে উত্তর দিল।

বাকিরা কেউ কিছুই বুঝতে পারছে না! এর মধ্যে পিকু কী এমন করে ফেলল যে কিরণ ম্যাডাম পিকুর এত প্রশংসা করছেন! সবাই হাঁ করে পিকুর দিকে তাকিয়ে। এরই মাঝে কিরণ পিকুকে জিজ্ঞাসা করলো “হাউ কুড ইউ সলভ দ্য মিস্ট্রি!“

পিকু বলতে শুরু করল-

“চিরকুটটা দেখেই আমার মনে হয়েছিল ওটার মধ্যে কোনও গোপন ইনফরমেশন লুকিয়ে আছে। প্রথমে বোঝার চেষ্টা করছিলাম কি ধরনের ইনফরমেশন থাকতে পারে। কিন্তু চিরকুটটাতে যা লেখা আছে তাতে কোনো ঠিকানা বা নম্বর নেই আর পুরো টেক্সটার কোন মানেই হয়না। তাই অড খুঁজতে খুঁজতে টেক্সটস উইদিন দ্যা ইনভার্টেড কমাজ নজর কাড়ল! অনেক খোঁজাখুজির পর ক্লান্ত হ’য়ে শেষে লেটার্স আর ওয়ার্ডস গুনতে শুরু করাতেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হল। দেখলাম দুটো ইনভারটেড কমা টেক্সটের একটাতে দশটা ওয়ার্ড আছে আর অন্যটাতে আটটা। দ্য ওয়ান উইথ টেন কট মাই আইজ, কারন যেহেতু মোবাইল নাম্বার দশ ডিজিটের হয়। হেন্স আই স্টার্টেড ওয়ার্কিং অন দ্যা টেন ওয়ার্ডস কোট। হোয়েন আই কাউন্টেড দ্য নাম্বার অফ লেটারস ইন ইচ ওয়ার্ড দেন আই স্লোলি স্টার্টেড গেটিং দ্য নাম্বার। ইট গোজ লাইক দিস, “Chelangat! the cat caught a fish, the eagle snatched that”! দ্যা ফার্স্ট ওয়ার্ড হ্যাজ নাইন লেটারস, দ্যা সাবসেকোয়েন্ট ওয়ার্ডস হ্যাভ 3 3 6 1 4 3 5 8 4 নাম্বার অফ লেটারস রেসপেক্টিভলি। হেনস্ আই থট দ্য প্রোবাবল ফোন নাম্বার কুড বি 9336143584 অ্যান্ড আই টুক দ্য চান্স।”

সবটা শুনে সবাই অবাক চোখে পিকুর দিকে তাকিয়ে থাকল। মেঘনার আজ নিজেকে একটু স্পেশাল মনে হলেও পিকুর ওপরে রাগই হচ্ছিল। এতবার জিজ্ঞাসা করা সত্ত্বেও পিকু ওকে কিছুই বলেনি।

সব শোনার পর কিরণ শুধু বলে উঠল “ইউ আর জাস্ট আনবিলিভেবল পিকু! 

সুড উই নট সেলিব্রেট দিস গাইজ!” 

সবাই একসঙ্গে বলে উঠলো “ইয়েস!”

“দেন লেটস্ গো ফর লাঞ্চ টুডে অ্যান্ড সেলিব্রেট দ্য সাক্সেস।” 

পিকুর অনারে দুপুরে হোটেল ফোর্ট রাজওয়াড়াতে দারুণ লাঞ্চ খাওয়ালেন কিরণ ম্যাডাম।

ছবি সৌজন্য: Flickr, Wikipedia

Aroop Dasgupta Author

পড়াশোনা করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেডিয়ো ফিজিক্স বিভাগে। পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন তথ্য প্রযুক্তিকে। প্রায় এগারো বছর নানা বহুজাতিক সংস্থার সাথে যুক্ত থাকার পর উনিশশো সাতানব্বইতে তৈরি করেন নিজের তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা। বর্তমানেও যুক্ত রয়েছেন সেই সংস্থার পরিচালনার দায়িত্বে। কাজের জগতের ব্যস্ততার ফাঁকে ভালবাসেন গান-বাজনা শুনতে এবং নানা বিষয়ে পড়াশোনা করতে। সুযোগ পেলেই বেড়াতে বেরিয়ে পড়েন আর সেই অভিজ্ঞতা ধরে রাখেন ক্যামেরায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *