জলঙ্গী নদীর ধারে সেই গ্রাম। সেখানে এক অমাবস্যার প্রাকসন্ধ্যায় মার জন্ম হয়। আকাশে তখন আলো থাকলেও মাটিতে অন্ধকার নেমে এসেছে। মা এমনিতেও বুঝতে পারত না, অমনিতেও বোঝেনি। অন্ধকার থাকায় ভেবেছে পেটের ভেতরেই আছে। কান্নাকাটি করে একরাশ কালো পায়খানা করে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। ধাইমা সেটা পরিষ্কার করবে জেনে ক্লান্ত দিদিমাও তখনই আঁতুড়ঘরে ঘুমিয়ে পড়ে। সদ্যোজাতর কাঁথা পরিষ্কার করে এসে ধাই দেখে মা মেয়ে পাশাপাশি শুয়ে নিশিন্তে ঘুমোচ্ছে। দুজনের গায়ের রঙে ছিল সাদা-কালোর মেরুপার্থক্য। অনেকটা আকাশের দিন আর মাটির অন্ধকারের মতো। পাড়ার এয়োতিরা লন্ঠনের আলোয় সে দৃশ্য দেখছিল। হঠাৎ করে সন্ধ্যার পোকারা ডাকতে শুরু করলে আকাশও কালো হয়ে যায় নিমেষে। এক মহিলা আকাশপানে তাকিয়ে বলে, কি কালো রাত গো বাবা, যেন গর্ভের আঁধার!

জলঙ্গী নদীর ধারে সেই গ্রাম। গ্রামের নদীঘেঁষা ক্ষেতগুলোর আলপথে ঢোলকলমী ফুটে থাকত। আর দূরের মাঠের কিনার ঘেঁষে মেঠো জুঁই খেলা করত সারাবছর। মেঠো জুঁইয়ের সাদা বিন্দুর পর ভেঁপুর মত ঢোলকলমী দেখা দিলেই তিন বছরের মা বুঝতে পারত নদী ডাকছে। চোখ তুলেই দেখতে পেত, সামনের ঢাল পেরিয়েই খোলা আকাশের নিচে নদীর অন্য যুগ—নদীই কখনও আছে কখনও নেই, কখনও বইছে…আকাশ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে। 

মজার নদী। জল শুধু বয়েই যায়। গরমকালে ঠাণ্ডা, শীতকালে গরম। নদীর এক জায়গায় চড়া। সেখানে হেঁটে পার হওয়া যায়। তার আগে পরে মানুষ ডুবে যায়, মোষও ডুবে যায়। মার পাড়ে দাঁড়িয়ে স্নান করা নিয়ম। আর দিদিমার কোলে চড়ে জলে হাত পা নাড়া। মা অবশ্য বুঝেছিল নদীর কাজ স্নান করা, কাপড় কাচা, শৌচ করা, মোষের গা ধোয়ানো আর ছোট ছোট খাল করে মাঠে মাঠে ঢুকে ফসলের গোড়ায় জল দেওয়া। 

সেই গ্রামে রোদ ছিল কাঁচা গম রঙা। বেলা যত গড়াত রোদের রঙ পাকা গমের মত হত। সকাল ও সন্ধ্যায় পাখির আকাশ ভাঙা ডাকাডাকিকে মা দিনের শুরু ও শেষের চিহ্ন বলেই জানত। মা জানত গমের হিসেব। বিঘে প্রতি কত কুইন্টাল গম হয়, তাতে কত কেজি আটা হয়, সেই আটায় কটা রুটি হয়। ছ বছর বয়সে মার পেট ভরাতে লাগে গোটা তিনেক রুটি। দুপুর গড়াবার আগে কাঁচা আর পাকা গমরঙ আলোর সন্ধিক্ষণে, ধুলোট পায়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে গমের ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে মা দেখে ফেলত এক সুন্দর ভবিষ্যৎ। ফসল কাটা—শিস ছাড়ানো—কলঘর—মন হারান সাদা গন্ধের আটা—আর সেই আটার আশ্চর্য সব রুটি। পেট, মন, মাথার একীভবন, একীকরণ। তৃপ্তি তৃপ্তি তৃপ্তি। 

জলঙ্গী নদীর ধারে সেই গ্রাম। গ্রামের নদীঘেঁষা ক্ষেতগুলোর আলপথে ঢোলকলমী ফুটে থাকত। আর দূরের মাঠের কিনার ঘেঁষে মেঠো জুঁই খেলা করত সারাবছর। মেঠো জুঁইয়ের সাদা বিন্দুর পর ভেঁপুর মত ঢোলকলমী দেখা দিলেই তিন বছরের মা বুঝতে পারত নদী ডাকছে। চোখ তুলেই দেখতে পেত, সামনের ঢাল পেরিয়েই খোলা আকাশের নিচে নদীর অন্য যুগ—নদীই কখনও আছে কখনও নেই, কখনও বইছে…আকাশ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে। 

তৃপ্তির ম্যাজিক ছড়ানো ছিল দিদিমার ছোটবেলাতেও। দিদিমার গা ছিল তিলের মত কালো মখমলে আর ঠোঁট ছিল পিউপিলের মত গভীর। ডাঁই করা রাই আর তার পাশে বসে থাকা দিদিমাকে আলাদা করা যেত না। চার বছরে বিয়ে হয়ে দিদিমা শশুরবাড়ি চলে আসে। বারো বছর বয়সের স্বামী ছিল তার বাবা ও মা। স্বামীর কাঁধে চড়ে তার টইটই করে ঘোরার গল্প গ্রামের ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে।

ক্ষেত, পুকুর, মাটির রাস্তা, আমগাছের সারি, বাঁশ বন, খেজুর গাছের ঝোপ, পানের বরজ, ঢোলকলমী, মেঠো জুঁই, এরা সবাই দেখেছে ওদের সেই ঘুরে বেড়ানো। জলঙ্গীর জলে ছায়া পড়েছে স্বামীর কাঁধে চেপে থাকা দিদিমার। সেই ছায়াকে ছুঁয়ে জলঙ্গীর জল বয়ে গেছে, সাগরে মিশেছে। ভূ-খণ্ডের জলকণার মধ্যে সেই ছায়ার উষ্ণতা রয়ে গেছে।

দিদিমার বয়স যত বেড়েছে, গৌরাঙ্গ, সুদর্শন, কীর্তনিয়া স্বামীর গর্বে তত গরবিনী হয়েছে। এগার বছরে ঋতুমতী হয়ে চোদ্দতে গর্ভবতী। বেশ কয়েকটা সন্তানের পর মার জন্ম। সেদিন চ্যাটচ্যাটে গরমের পর গোধূলি লগ্নে ঝড় ওঠে। তারপর ঝপ করে রাত নেমে আসে। জলঙ্গীর ধারের গ্রামগুলোতে মোটা দড়ির মত বৃষ্টি শুরু হয়। এরকম শক্ত বৃষ্টিতে গরম মরে যায়, মন ভাল হয়ে যায়, স্মৃতিও উসকে ওঠে। 

সেদিন দিদিমা ও তার স্বামী ছাড়া বাড়িতে আর কেউ ছিল না। এও এক বিরল ঘটনা। জলের ছাঁট আটকাতে জানলা বন্ধ করতেই ঘর যুগপৎ ঠাণ্ডা ও ভ্যাপসা। বাইরে গোগ্রাসী শব্দ, ভেতরে বড় বড় শ্বাস পড়তে লাগল। নিজেদের অজান্তেই শরীরের মাংসগুলো যৌনতার বাঁধনে বাঁধা পড়ে। বুঝতে না বুঝতেই রমণ। রমণীয়। দিদিমার জঠরে মার ভ্রূণ যাত্রা শুরু হল।  

পেটের ভেতরের অন্ধকার মাকে বিব্রত করেনি। খুব আনন্দে সে খেলে বেড়াত। হাত পা ছুঁড়ত। এদিক ওদিক লাফ দিত। চোখ বন্ধ করে, মুখ বন্ধ করে শরীরে খাবারের স্বাদ পেত। শিহরিত হত। পেট থেকে বেরিয়ে, একটু বড় হয়ে দেখে, খাবার স্বতঃসিদ্ধ নয়। মাটি হাওয়া জল আকাশের মধ্যে জন্মান খাবারের ভাগাভাগিতে গুচ্ছের রেষারেষি। মাটিতে ভাগ থাকলেও আকাশটা বেশ মস্ত। হাওয়া সকলের, আর জল ও জলঙ্গী অফুরান। 

সেই ভূ-খণ্ডে মা বড় হতে থাকে। গ্রামের ফসল, আকাশ, জল, হাওয়া জীবনের রসদ হয়ে শরীরে ঢুকতে থাকে। মা বড় হতে থাকে।

একদিনকার কথা। মা তখনও তেমন বড় হয়নি। তার শরীর তখনও মানব জীবন জন্মের রহস্য চেনেনি। আমি তখনও অনেক দূরের এক সম্ভাবনা। খুব ভোরে মা আর দিদিমা জলঙ্গীর ধারে দাঁড়িয়েছিল। তখন কেউ কোথাও নেই। ফসলের মাঠেও কেউ এসে পৌঁছয়নি। সূর্য ওঠে। নদীর জলেও একটা সূর্য দেখা দেয়। 

মা: মা! নদীর সূর্যটাকে ধরব। 

দিদিমা: চল ধরি।

দুজনে নদীতে নেমে যায়। 

জন্ম নদিয়া। বেড়ে ওঠা কলকাতা। আপাতত ঠিকানা দিল্লি। বিধিবদ্ধ পড়াশোনা জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়। ফরাসি ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে। পেশা লেখালিখি, ভিডিও তৈরি ও অনুবাদ।

16 Responses

  1. পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল কোনো লেখিকা লিখেছেন। খুবই ভালো লাগল। শুধু আমার মা নয় সবার মায়ের কথাই গল্পটা মনে করিয়ে দেয়।

  2. গল্পটা পড়ার আগে মনে হচ্ছিলো যে কোভিডের সময় আমি আমার গ্রামের বাড়িতে আটকে আছি. এই গল্পটা যেন আমার ছোট বেলার সব স্মৃতি মনে করিয়ে দিলো. লেখককে ধন্যবাদ গল্পটার জন্য. আমি খুব প্রিভিলিজড এবং লাকি ফিল করছি গল্পটা পড়ার পর.

  3. ফরহত আমেজ দিনাজপুরী:

    আমার শৈশব কেটেছে গ্রামে। গ্রাম বাংলার উদার প্রকৃতি, গাছ গাছালির সবুজ উৎসব, নদীর ছলাৎ ছল শব্দ, পুকুরে সাদা হাসের চইচই, রং বেরঙের ফুল ফল আমার মনের মনিকোঠায় আজীবন স্থান করে নিয়েছে। এই ছোট গল্প সেই সব স্মৃতি মনে করিয়ে দিল। আবার আমি যেন গ্রামে ফিরে গেলাম। অংশ হয়ে গেলাম গল্পে বর্ণিত সজীব প্রকৃতির। নদীস্নানের সুপ্ত অভিলাষ ছিল শৈশবে। তা পূর্ণ হয়নি। সাতারও শেখা হয়ে উঠেনি। এক জীবনে কী আর সব হয়! আমার একান্ত আপন এই বেদনাঘন স্মৃতিও গল্পটি উসকে দিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *