আমার বাবা আসলে ছিলেন একজন শিল্পী। নানান ছবি, ছোটখাট ভাস্কর্য এসবে আমাদের বাড়ি বোঝাই থাকত। গাছের গুঁড়ি কেটে, রট আয়রন দিয়ে তৈরি করা সুন্দর সুন্দর জিনিস দেখে দেখে আমরা এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি যে, আর নতুন করে বিস্ময় জাগে না। এসব আমাদের কাছে এত সহজলভ্য বলেই হয়তো বাবার প্রতিটি সৃষ্টির আলাদা করে কদর করা হয়ে ওঠে না। 

শিবপুর  বি.ই. কলেজ থেকে মেকানিক্যাল  ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে বাবা ইঞ্জিনিয়ারিং সংক্রান্ত চাকরিতে না ঢুকে পৈতৃক ব্যবসায় লেগে পড়েন। এডওয়ার্ড কেভেন্টার এবং কার্শিয়াংএর সেলিম হিল চা বাগান আগরতলার ফটিকছড়া চা বাগানের তত্ত্বাবধানে লেগে পড়েন।

বাবার কিন্তু খুব ইচ্ছে ছিল ফাইন আর্টস নিয়ে পড়াশোনা করার। সে মতো চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু বাধ সাধেন বাবার ঠাকুমা মাতৃহারা নাতিকে কলকাতা ছাড়াতে দেবেন না। ফল হল, নিজের ইচ্ছার অবদমন। তবে প্রতিভাকে তো আটকানো যায় না। মাঝেমধ্যেই তার প্রকাশ ঘটতে থাকলচা গাছের গুঁড়ি কাজে লাগিয়ে অসম্ভব সুন্দর সব ভাস্কর্য, কাচের উপর বালি দিয়ে আঁকা রবীন্দ্রনাথের মুখ, এমন নানা রকম বিরল কাজ। কয়েক বছর রট আয়রনে আসবাব তৈরি করেন সম্পূর্ণ নিজের ডিজাইনে, নিজের উদ্যোগে। এটিখনকার কথা,খনও ঘরে ঘরে রট আয়রনের আসবাব এত জনপ্রিয় হয়নি। সে সবের কিছু আছে এখনও তবে বেশ কিছু হারিয়েও গেছে। 

বাবা এগারো বছর বয়সে মাতৃহারা হন। যদিও বাবা পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে সবার বড়তাও এগারো বছর বয়সে মাকে হারানোর যে অভাব, তা এখনও বাবার কথার মধ্যে পাই। মাকে হারানোর পর ঠাকুর্দার খুব আদরের হয়ে ওঠেন বাবা। এখনও খেতে বসে ঠাকুর্দার  কথা বলেন। 

শিল্পীসত্ত্বা যদি সংসারী হতে চায়, তাহলে দু’দিকের কোনও দিক পরিপূর্ণ হয় না। বাবার বোতলবন্দি  শিল্পীসত্ত্বা মাঝেমাঝেই তাঁর সংসারী সত্ত্বাকে হারিয়ে দিয়েছে। দায়িত্ব পালনে অপূর্ণতা রয়ে গেছে। আমরা দুই বোন। দিদি ছোট থেকেই দুরারোগ্য অসুখে আক্রান্ত ছিল। মায়ের অদম্য প্রচেষ্টাকে উপেক্ষা করে দিদি আজ আট বছর হল আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছে। সংসারের সমস্ত দায়িত্ব মা একা হাতে হাসিমুখে পালন করেছেন। 

এখন মা বাবা, গীতা এবং নিরুপম চৌধুরী দুজনে গল্প করে দিন কাটান। বাবা COPD অসুখে ভোগেন কিন্তু অচল না-হবার অক্লান্ত ইচ্ছা এবং গাছের প্রতি একনিষ্ঠ টান বাবাকে এখনও সজীব করে রেখেছে। ডাক্তার বলে দিয়েছেন ওঁর ফুসফুস প্রায় কাজ করে না। কিন্তু তাও বাবা সব সময় অক্সিজেন সিলিন্ডারের ওপর নির্ভর হয়ে থাকতে চান না। রোজ একবার ছাদে যাওয়া তাঁর চাই-ই চাই। গাছ বাবার জীবনী শক্তি। দুই নাতিকেও অসম্ভব ভালোবাসেন। নাতিদের পেয়ে প্রাচীনপন্থী বাবার ছেলের অভাব পূর্ণ হয়েছে। প্রায়ই বলেন – ‘বাড়ি তো ছেলেরাই পাবে।’

পিতৃসত্ত্বা পালন বাস্তবে কী রকম হতে পারে, তা আমি ছোটবেলায় দেখেছি বাবাকে তাঁর বাবার প্রতি ব্যবহারে। ক্যাভেন্টার সংক্রান্ত মামলা মোকদ্দমার কথা বাবা রোজ দাদুকে এসে বলতেন এবং দাদুর নির্দেশ মতো কাজ করে যেতেন একা। বাকি কে কতটা করল, কে করল না তার তোয়াক্কা না করেই।

এখন বাবার ৯৩ বছর বয়স। মায়ের সঙ্গে অবসর জীবন যাপন করেন। সঙ্গী গাছেরা। নিজে হাতে ছাতের গাছে পেঁপে, কাগজিলেবু, আম ফলান এই বয়সেও রবীন্দ্রকবিতা, সংস্কৃত শ্লোক মুখস্থ বলে যেতে পারেন। সোনার তরী, প্রথম দিনের সূর্য, অভিসার , পুরাতন ভৃত্য, দুই বিঘা জমি  এমন কত কবিতা আমি বাবার কাছে শুনে শিখেছি। এককালের রাশভারী বাবার রাগ বয়সের সঙ্গে একেবারে চলে গিয়েছে। দুঃখ একটাই বাবার প্রতিভা জনপ্রিয়তা পেল না। কেউ ভালো করে জানলই না ওঁর কথা। তাই এখন চেষ্টা করি ওঁদের ভালো রাখতে।

অর্থনীতির অধ্যাপিকা ঊর্মিলা সেন ১৯৯৭ সাল থেকে সুরেন্দ্রনাথ সান্ধ্য মহাবিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত। বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ওঁর লেখালেখি একাধিক পত্রপত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে। আবৃত্তি ওঁর নেশা। বর্তমানে তিনি নিউ টাউন বইমেলার সভাপতি।

3 Responses

  1. খুব ভাল লাগলো তোর লেখাটা পড়ে উর্মি I

    তোর বাবার (নিরুপমদার) যে এরকম একটা শিল্পীরসত্তা আছে তা এতো বছর ধরে ওঁনাকে আমাদের মাঝে (প্রায় 58 বছর) পেয়েও তা জানতে পারিনি !! উনি যে এতো বড় শিল্পী তা তিনি কোনো দিনই কাউকে, অন্তত আমাদের – পাড়ার ছেলেদের, জানতে দেননি !!

    ওঁনাকে জগদীশ বাবুর বড় ছেলে এবং পৈতৃক (Keventers) এ যুক্ত ও ভীষণ রাশভারী কম কথার মানুষ বলেই জানতাম l বেশির ভাগ সময় Calcutta র (তখনকার) বাইরে থাকেন l সে ভাবে বললে তোদের দাদুর সাথে আমার যত কথা হয়েছে, তার চাইতে নিরুপমদার সাথে অনেক কম কথা হয়েছে (58 বছরে হয়তো 10 – 20 টা sentence in three /six times)l

    ছোট বেলাতে যদি জানতে পারতাম ওনার এই প্রতিভা, তাহলে আমি ওনার কাছে শিখতে যেতাম l

    অনেক কথা লিখে ফেল্লাম l

    তোরা সাবধানে থকিস সবাই l ভাল থকিস l

    তোদের Toy কাকা

  2. এত সুন্দর ঝরঝরে গদ্য। যেন স্রোতস্বিনী নদী। বাবার কাজ দেখে মুগ্ধ হলাম। আমি জানি আপনিও সেই শিল্পীসত্তা বহন করছেন। সেই শৈল্পিক আঁচ তো আমরা পাই ও সমৃদ্ধ হই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *