তখন আমার বছর পাঁচ ছয় বয়স। এলাহাবাদে দিদিমার বাড়ি থেকে পাকাপাকিভাবে কলকাতা চলে আসছি বাবা মায়ের কাছে। হাওড়া স্টেশনে ফলের দোকানের সামনে খুব উজ্জ্বল রঙের ব্যাকগ্রাউন্ডে একটা লোক আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। লোকটার একমাথা চুল আর একগাল দাড়ি। আদ্দির পাঞ্জাবি আর জিনস পরে ঝকঝকে দুপাটি দাঁত বের করে হাসছে। পরে জানলাম ওই লোকটাই আমার বাবা, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত। আমার বন্ধু, আমার কমরেড, আমার কলিগ, আমাদের নাটকের দলের মাথা, আমার ‘দাড়ি বাবা’।

ফড়িয়াপুকুর এলাকায় মডেল কেজি স্কুলে তখন আমি পড়ি। স্কুলের পরে বাবা আমাকে নিতে আসত। তারপর দুজনে হাত ধরাধরি করে শ্যামবাজারে নান্দীকারের যেতাম। দুপুরটা আমার নান্দীকারেই কাটত। মা বাড়ি থেকে ভেজিটেবল স্টু আর ভাত পাঠিয়ে দিত, আমি বাবার কাছে খেতাম। খেতে কোনওরকম ঝামেলা করলে বাবা খাবারটা নিজে খেয়ে নেওয়ার ভান করে বলত ‘গিলি গিলি গপ্’ আর ওমনি আমিও বাকিটা গপ গপ করে খেয়ে নিতাম। বাবা যদি সত্যিই খেয়ে নেয় তখন আমি কী খাব? আরও একটা কাজ বাবা নিয়ম করে করত। রোজ রাতে ঘুমের আগে আমাকে কোনও না কোনও গল্প পড়ে শোনাত। কখনও রাশিয়ান গল্প কখনও শিব্রাম, কখনও সুকুমার রায়। শিব্রামের গল্প পড়াটা আলাদা করে মনে আছে কারণ শিব্রাম পড়তে পড়তে বাবা নিজেই হেসে কুটোপাটি খেত। আমি অত বুঝতাম না। বাবা যখন হাসছে তখন আমাকেও হাসতে হবে ভেবে একটু হেসে নিতাম।

আমি বরাবরই একটু স্বাধীনচেতা। তাই যখন বড় হচ্ছি, মায়ের সঙ্গে কিছু বিষয়ে মতবিরোধ হত, কথা কাটাকাটিও। অনেক সময় হয়তো মা জোর করে আমার ওপর নিজের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়েছে কিন্তু বাবার সঙ্গে বরাবর একটা যুক্তিপূর্ণ আলোচনার জায়গা ছিল। বাবা কখনওই আমার ওপর কোনও সিদ্ধান্ত, মতামত চাপিয়ে দেয়নি। আমি না বলেছি তাই তুমি এটা করবে না, এরকম ব্যাপারটা ছিল না। একবার হয়েছে কি, আমি লুকিয়ে আমাদের বাড়িতে থাকা কিছু পর্নোগ্রাফিক বই পড়তে গিয়ে বাবার কাছে ধরা পড়েছি। বাবা কিন্তু আমাকে বকাঝকা না করে একটা দীর্ঘ চিঠি লিখেছিল। চিঠির বিষয়বস্তু ছিল সাহিত্য। কেন ওই বইগুলো উঁচুদরের সাহিত্য হিসেবে গণ্য হয় না, অন্যান্য সাহিত্যের নিরিখে ওগুলো কেন পিছিয়ে রয়েছে, কেন আমার অন্য বই পড়া উচিত, এই সমস্ত বিষয় নিয়ে একটা আলোচনা করেছিল। আর আমাদের মধ্যেকার এই লজিকাল ডিসকাশনের জায়গাটা আজও একইরকম রয়েছে। প্রচুর বিষয় নিয়ে আমাদের মতবিরোধ হয়। থিয়েটার নিয়ে, দল নিয়ে, অভিনয় নিয়ে। আলোচনার মাধ্যমেই সেগুলোর সমাধান করা হয়। কখনও আমরা একমত হই, কখনও উই এগ্রি টু ডিসএগ্রি।

যখন আমার প্রথম বিয়েটা থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম তখনও বাবা একবারের জন্যও বলেনি এটা কোরও না। বলেছিল এটা তোমার জীবন, তোমার সিদ্ধান্ত। কিন্তু যাই সিদ্ধান্ত নেবে তার দায়ভারও তোমাকেই বইতে হবে। কখনও সখনও বাবার এই মনোভাব আমার একটু বেশি কঠিন, রূঢ় বলে মনে হয়নি এমন নয়। কিন্তু পরে তলিয়ে ভেবে বুঝেছি, হয়েছে বাবার এই স্টান্স আমাকে মানুষ হিসেবে অনেক শক্তিশালী করে তুলেছে।
তবে এসব যেমন সত্যি, তেমনই বাবা যে ছায়ার মত আমার সঙ্গে সেঁটে থেকেছে সেটাও কিছু কম সত্যি নয়। কখনও বিপদে পড়লে যে বাবাকে পাশে পাব সেটা নিয়ে কোনও সন্দেহ কখনও ছিল না, আজও নেই। একবারের ঘটনা বলি। তখন আমি অ্যাসেমব্লি অফ গড চার্চে একটু উঁচু ক্লাসেই পড়ি। ক্লাসের কয়েকটা ছেলের সঙ্গে আমার খুব একচোট ঝামেলা হয়েছে। সেই ঝামেলা এমন সিরিয়াস জায়গায় পৌঁছে গেছে যে আমার মার খাওয়া কেউ রুখতে পারবে না। যাইহোক, বাবাকে সবটা খুলে বললাম। বাবা পরেরদিন আমার সঙ্গে স্কুলে গেছিল। একটু দূরে দাঁড়িয়ে গেটের দিকে নজর রেখেছিল। আমিও কনফিডেন্ট ছিলাম কোনও ঝামেলা হলে বাবা আছে।

আমার অভিনয়ের সবথেকে বড় ক্রিটিকও আমার বাবা। নান্দীকারে আমার প্রথম নাটক গোত্রহীন। এর আগে ছোটখাট এক্সট্রার রোল পেয়েছি, কিন্তু সেগুলো সিরিয়াস কিছু নয়। গোত্রহীনে আমার বিপরীতে ছিলেন দেবুদা (দেবশঙ্কর হালদার)। দেবুদার সঙ্গে অভিনয় করতে গিয়ে বুঝলাম, আমি অনেক পিছিয়ে রয়েছি, অনেক কিছু শেখা বাকি। তখন বাবা বলেছিল গৌতমদা (গৌতম হালদার), দেবুদা এদের কাছে শিখতে। গোত্রহীনের আর একটা কঠিন জিনিস ছিল, ওখানে বাবা আমার প্রেমিকের ভূমিকায় অভিনয় করছিল। সে এক ভয়ঙ্কর ব্যাপার। তার ওপর আমার স্টেজে নাটক চলাকালীনও বাবা আমাকে ইশারায় নানারকম ইন্সট্রাকশন দিতে থাকত। হয়তো আমি আলোর বৃত্তের বাইরে দাঁড়িয়ে সংলাপ বলছি, বাবা আমাকে ইশারা করে আলোর সামনে নিয়ে আসত। মাঝে মাঝে বিরক্তও লাগত। প্রচন্ড ইমোশনাল একটা দৃশ্য চলছে, তার মধ্যে বাবার ইশারাও চলছে। তবে মজার কথা হচ্ছে, বাবার এই ব্যাপারটা আবার এখন আমার নিজের মধ্যে আমি দেখতে পাই, দলের ছেলেমেয়েদের শেখাতে গিয়ে।

পরে থিয়েটার টেলিভিশন বড়পর্দায় যত অভিনয় করেছি, তার প্রত্যেকটা বাবা খুঁটিয়ে দেখেছে (এখনও দেখে) এবং নিজের স্পষ্ট মতামত জানিয়েছে। আমার স্বামী সপ্তর্ষি টেলিভিশনে যে সিরিয়ালটা করে, তারও প্রতিটা এপিসোড বাবা মন দিয়ে দেখে এবং ওকে বলে, কোনখানটায় হয়তো একটু অন্যরকম করে করা যেত, কোনখানে ঠিক হয়নি, এইসব। আর শুধুমাত্র অভিনয়ের ক্রিটিক নয়, বাবা একজন খুব ভালো কালচরাল ক্রিটিক। অনেক সময় এমন অনেক কথা বাবা বলেছে যেগুলোর সঙ্গে আমি একমত হইনি, কিন্তু দেখেছি পরে সেগুলো মিলে গেছে। এই লকডাউন চলাকালীন যখন থিয়েটারের ভবিষ্যৎ নিয়ে সকলে নানা কথা বলছে, আমি বাবাকে জিজ্ঞেস করেছি। এসব মিটে গেলে কি দর্শক আবার হলে ফিরবে? বাবা খুব দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছে, সবাই ফিরবে। কারণ মানুষ ভালো সময়টাকেই মনে রাখতে চায়। পৃথিবী পুরনো ছন্দে ফিরলেই সকলে আবার নাটক দেখতে ভিড় করবে।

বাবাকে সবাই ছেলেধরা বলে। বাবা একজন অসম্ভব ভালো স্কাউট। দলের জন্য ছেলেমেয়ে খুঁজে নিয়ে আসতে বাবার জুড়ি নেই। আর শুধু খুঁজে নিয়ে আসাই নয়, দলের প্রত্যেকের সমস্ত খুঁটিনাটি বাবার নখদর্পণে। কার বাড়িতে কে কে আছে, কারুর কোনও পারিবারিক সমস্যা, কোনও শারীরিক সমস্যা হয়েছে কিনা, কে কোনটা ভালো পারবে এই সমস্ত ব্যাপারে বাবার নজর থাকে। এমনও হয়েছে যে দলের একজন ঠিক করেছে নান্দীকার ছেড়ে দেবে। বাবা তার বাড়ি পর্যন্ত ধাওয়া করেছে। কেন আসবে না, কী অসুবিধে, তার মনের কী অবস্থা এসব কিছু খুঁচিয়ে বের করে তাকে বুঝিয়েসুঝিয়ে দলে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে।

দলের প্রত্যেককে বাবা নিজের পরিবারের সদস্য বলে মনে করে। তাদের বাবার নাম থেকে শুরু করে আর সমস্ত তথ্য বাবার মুখস্থ। আমি জানিনা এটা কীকরে করতে পারে। অবশ্য শুধু দলের নয়, যেকোনও কারুর সঙ্গে একবার আলাপের পরে, তার সমস্ত কথা দশ বছর পরেও গড়গড় বলে দিতে পারে বাবা। আমার মনে হত বাবার স্মৃতিশক্তি খুব প্রখর তাই হয়তো এমনটা করতে পারে। কিন্তু এখন মনে হয়, মানুষের প্রতি, সম্পর্কের প্রতি বাবা অনেকটা গুরুত্ব দেয় বলেই পারে। কোনওরকম উদাসীনতা থাকলে বোধহয় পারত না। বাবাকে দেখে আমাদের মধ্যেও এই ব্যাপারটা আপনা থেকেই চলে এসেছে। এখনও রোজ সকাল এগারোটায় বাবা ঠিক নান্দীকারে পৌঁছে যায়।
আমাকে যে লোকটা চট করে পড়ে ফেলতে পারে, সে হচ্ছে আমার বাবা। তখন সবে সপ্তর্ষির সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব গড়ে উঠছে। ঠিক প্রেম তখনও হয়নি। বাবাকে একদিন বললাম, অনেকদিন বাদে একটা ছেলের সঙ্গে কথা বলতে আমার বেশ ভালো লাগছে, কিন্তু আমি ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছি না। বাবা সঙ্গে সঙ্গে বলে কে সপ্তর্ষি তো? আমি জানি, আমি তো চাই এটা হোক। আমি তো অবাক। পরে যখন আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম বিয়ে করব, রেজিস্ট্রারের কাছে একমাস আগে যে নোটিসটা জমা দিতে হয়, সেটা দিতে গেছিলাম আমি বাবা আর সপ্তর্ষি। নোটিস জমা দিয়ে বেরিয়ে বাবা সপ্তর্ষিকে বলল, নাও এবার পাগল সামলাও।

বাবা যেরকম সারাজীবন নান্দীকারে ছাত্র তৈরি করে এসেছে, আমিও নাকি এখন তেমনই করি। যে জন্য শিবু (শিবপ্রসাদ) আমাকে বলে রুদ্রপ্রসাদ পার্ট টু। আসলে বাবা বা মা কেউ আমাকে কখনও জোর করে নান্দীকারে আসতে বলেনি। কিন্তু ছোট থেকে যে পরিবেশটা আমাকে ওরা দিয়েছে, নান্দীকার তার এত বড় একটা জায়গা জুড়ে ছিল, যে অন্য কিছু করার কথা আমার মনেও হয়নি।
সব শেষে যেটা বলার, আমি উপলব্ধি করেছি যে নান্দীকার অনেককে অনেক কিছু দিয়েছে। টাকাপয়সা হয়তো দিতে পারেনি। কিন্তু আত্মবিশ্বাস দিয়েছে, সাহচর্য দিয়েছে, নিজেকে চিনতে জানতে সাহায্য করেছে। যেগুলো টাকার চেয়ে বেশি মূল্যবান বলেই আমি মনে করি। নান্দীকার মানে যারা শুভ কাজ করে – আমি সারাজীবন এই কাজটা করে যেতে চাই। আর চাই রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, নান্দীকারের ‘স্যর’ যেন এখনকার মতোই আজীবন প্রতি শোয়ে নিয়ম করে হলের একটা চেয়ার দখল করে বসে থাকে।
সোহিনী হালদার খ্যাতনামা অভিনেত্রী ও নাট্যকার। পারমিতার একদিন ছবির জন্য জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন। নাটকের মঞ্চের বাইরেও, ছোট এবং বড় পর্দায় ওঁর অভিনয় দর্শককে মুগ্ধ করেছে। বাবা রুদ্রপ্রসাদ ও মা স্বাতীলেখার মতোই সোহিনী নান্দীকার নাট্যদলের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত।