আমার বাবা গৌতম চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে যদি আমায় লিখতে হয়, তাহলে হয়তো একটা বই লিখতে হবে। বাবা মারা গিয়েছেন একুশ বছর হয়ে গেল, আজও উনি নিশ্চিতভাবেই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ইনস্পিরেশন। এবং তা শুধু আমার ক্ষেত্রেই নয়, এ রকম বহু মানুষকে আমি চিনি যাঁরা একই কথা বলবেন। তাই উনি কে ছিলেন, জীবনে কী কী করেছেন, শিল্পের জগতে ওঁর অবদান কী, এসব না লিখে ভাবলাম, তাঁর সঙ্গে কাটানো আমার জীবনের কিছু মুহূর্ত যদি সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিই।
আমার জন্ম হয় ১৯৮২ সালের ১২ অগস্ট। বাবা সেই সময় তাঁর প্রথম ফিচার ফিল্ম ‘নাগমতী’র (জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত) শ্যুটিং শেষ করে সঙ্গীত পরিচালনার কাজ করছিলেন। যখন মা লেবার রুমে, সেই সময় নিজে ওয়েটিং রুমে পায়চারি করতে করতে বাবা ‘দরিয়ায় আইল তুফান’ গানটা লেখেন। এবং পরে পবন দাস বাউলকে দিয়ে রেকর্ড করান। সেটাই আমার শোনা প্রথম গান। আমার কানের কাছে ক্যাসেট প্লেয়ারে গানটা চালিয়ে বাবা নাকি শুনিয়েছিলেন। আমার জন্মের পরে আম আমার শোনা প্রথম গান।
একদম ছোটবেলা থেকেই বাবা লক্ষ্য করেছিলেন যে আমার রিদমের প্রতি একটা আকর্ষণ আছে। ঘুমনোর সময় আমি যদি কান্নাকাটি করতাম, তখন আমার মাথায় হাত দিয়ে বাবা আলতো করে কোনও একটা গ্রুভ বাজালে আমি শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম। আর ছোটবেলায় বেবিফুডের টিন নিয়ে বাজাতে থাকতাম। এসব দেখে বাবা স্থির করেন যে, আমাকে ড্রামকিট কিনে দেবেন।

আশির দশকের মাঝামাঝি শিশির মঞ্চে সে সময়কার নামকরা নৃত্যশিল্পী কাবেরী দাসের সঙ্গে বাবা একটা অনুষ্ঠান করেন। নাম ছিল ‘In search of Duende’। অনুষ্ঠানের মাঝে একটা ছোট্ট অংশে আমাকে ড্রামস বাজাতে বলেন বাবা। আমার বয়স তখন বড়জোর চার। কিছুদিন আগেই হাতে পেয়েছি ড্রামকিট। অনুষ্ঠানের জন্য বাবা আমাকে নিয়ে বসে অনেকটা সময় ধরে বাজনা তুলিয়েছিলেন। এখন ভাবি, একটা চার বছরের বাচ্চাকে বাজনা তোলানো কতটা কঠিন ব্যাপার! অনেক ধৈর্য ধরে, অনেকটা সময় নিয়ে বাবা আমাকে ওই অনুষ্ঠানের জন্য তৈরি করেছিলেন। কী ভাবে মঞ্চে ঢুকব, কী ভাবে বাজাব, শেষে কী ভাবে দর্শকদের সামনে বাও করব, সবকিছু শিখিয়েছিলেন। আমার জীবনের প্রথম মঞ্চে ওঠা এবং পারফর্ম করা এই ভাবেই, চার বছর বয়সে। শিশির মঞ্চকে ওই বয়সে প্রায় একটা স্টেডিয়ামের আকারের মনে হয়েছিল। এই পুরো ঘটনার স্মৃতিটাই আমার কাছে খুব দামি।

বাবা যখন ইউরোপ গিয়েছিলেন প্রথমবার, তখন প্রথম পিৎজা খেয়েছিলেন। বাবার এত ভালো লেগেছিল, যে পিৎজা বানানো শিখেছিলেন। তাই আমি এটা বলতে পারি যে ভারতবর্ষের বেশিরভাগ মানুষ পিৎজা জিনিসটা কী, জানার অনেক আগে আমি বাড়িতে বানানো পিৎজা খেতাম। বাবার বানানো পিৎজা অনেকটাই অথেনটিক ইতালিয়ান পিৎজার মতো ছিল। আমেরিকান ভার্শানটার থেকে একটু আলাদা। আমার এটাও মনে আছে, ছোটবেলায় কেউ যদি জিজ্ঞেস করত আমার সবচেয়ে প্রিয় খাবার কী, আমি বলতাম ‘পিৎজা’। আমার অষ্টম জন্মদিনে বাবা আমার সব বন্ধুদের পিৎজা বানিয়ে খাইয়েছিলেন। এভরিওয়ান লাভড ইট আর খুব অবাক হয়ে গিয়েছিল, যে এটা কী খাবার। আমার তখন খুব গর্ব হয়েছিল বাবাকে নিয়ে।
আমার ছোটবেলায় বাবা পাড়ার বাচ্চাদের নিয়ে সুকুমার রায়ের ‘আবোল তাবোল’ করিয়েছিলেন। কবিতাগুলোকে সুর দিয়ে পারফর্ম করিয়েছিলেন বাচ্চাদের দিয়ে। আসলে বাবা এটা নিজের ছোটবেলাতেও সমবয়সী বন্ধু ও বয়সে ছোটদের নিয়ে করেছিলেন। আমার এখনও মনে আছে, পাড়ার সব বাচ্চারা মিলে আমরা নিয়মিত মহড়া দিতাম। পাড়ায় সবাই খুব involved হয়ে বাবার পরিচালনায় অনুষ্ঠানটা করেছিল। কোরিওগ্রাফি থেকে শুরু করে কস্টিউম, মিউজিক, সব বাবা নিজেহাতে করেছিলেন। সেই রিহার্সালগুলো, সেই অনুষ্ঠানটা আমার সারাজীবন মনে থাকবে। আমি আর আমার এক বন্ধু মিলে ‘নারদ নারদ’ করেছিলাম। তার দু’এক বছর পর বাবা আমাদের বন্ধুদের নিয়ে সুকুমার রায়ের ‘ঝালাপালা’-ও করিয়েছিলেন। এখন ভাবি যে, কতটা গুরুত্ব দিয়ে, নিজের ব্যস্ত জীবন থেকে কতটা সময় বার করে আমাদের সবাইকে নিয়ে এই কাজগুলো করেছিলেন। সেগুলো কিন্তু সত্যিই আমাদের এক এক জনের সেরা পারফর্ম্যান্স হয়েছিল। আসলে বাবার এই ক্ষমতাটা ছিল। গেটিং দ্য বেস্ট আউট অফ এভরিওয়ান হি ওয়র্কড উইথ।

আর আমি বলতে চাইব বাবার হাত ধরে আমার প্রথম রেকর্ডিংয়ের কথা। ‘লক্ষ্মীছাড়া’র গোড়াপত্তনের কথা। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে যখন ভারতে স্যাটেলাইট টেলিভিশন এল, এমটিভি-ও এল তার হাত ধরেই। সেখানে সব আন্তর্জাতিক শিল্পীদের মিউজিক ভিডিও দেখে বাবার খুব ইচ্ছে হয় বাংলা গানের মিউজিক ভিডিও তৈরি করার। উনি কিছু শিল্পীদের বেছে নেন, যাঁরা তখন মূলধারার গানবাজনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তাঁদের দিয়ে তাঁদের নিজেদের গান, বাবার বেশ কিছু গান, মহীনের ঘোড়াগুলির গান, বাবার খুব প্রিয় অরুণেন্দু দাসের গান, রেকর্ড করেন এবং তার ভিডিও-ও তৈরি করেন। আমরা, পাড়ার বন্ধুরা এমনিই গানবাজনা করতাম বাড়িতে। বাবা আমাদের নিয়ে তৈরি করেন ‘লক্ষ্মীছাড়া’। ওঁরই দেওয়া নাম। তারপরেই আমাদের দিয়ে রেকর্ড করান ‘পড়াশোনায় জলাঞ্জলি ভেবে মূর্খ বলছ কী।’

আমাদের তখন বড়জোর বারো তেরো বছর বয়স। এই গানগুলো নিয়েই প্রথম তৈরি হয় ‘মহীনের ঘোড়াগুলি সম্পাদিত’ বাংলা গানের অ্যালবাম ‘আবার বছর কুড়ি পরে’ যেটা বেরোয় ১৯৯৫ সালের বইমেলায়। একদম ইনডিপেনডেন্ট রিলিজ়। বাবার বন্ধুদের প্রকাশনা সংস্থা ছিল ‘এ মুখার্জি এন্ড কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড।’ তাদের স্টলে বুকলেট-সহ ক্যাসেটটা পাওয়া যাচ্ছিল বইমেলায়। বাইরে কোথাও কোনও বিজ্ঞাপন ছিল না। গানগুলো আর অ্যালবামটার কথা যাতে সকলে জানতে পারে, তাই ওই স্টলের সামনে গোল করে বসে অ্যালবামের গানগুলো গাওয়া হত। সেই গান শুনতে লোকজন জড়ো হত এবং জিজ্ঞেস করত এই অচেনা গানগুলো কার। তখন তাদের বলা হত, স্টলে ক্যাসেট পাওয়া যাচ্ছে। এই ভাবেই ওই অ্যালবামের অডিয়েন্স তৈরি হওয়া শুরু হয়। বাবা যে ভাবে এই গানগুলো নিয়ে মানুষের কাছে পৌঁছনোর কথা ভেবেছিলেন, সেটা ভাবলে আজও হতবাক হয়ে যাই। আজ তো ওই অ্যালবামগুলো ‘কাল্ট’। ইনডিপেনডেন্ট মিউজ়িক আর ইনডিপেনডেন্ট বিজ্ঞাপনের এটা সেরা উদাহরণ।
সে বছর বইমেলার শেষ দিনে ওই স্টলের সামনে থেকে বাবার সঙ্গে আমরা কয়েকজন পুরো মেলাপ্রাঙ্গণে ‘পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে’ গাইতে গাইতে একটা সফর শুরু করি। তাতে আস্তে আস্তে আরও লোকজন যোগ দিতে থাকে। শেষের দিকে সেটা একটা বিশাল মিছিলের আকার ধারণ করে। মেলাপ্রাঙ্গণ থেকে আমরা সবাই মিলে গানটা গাইতে গাইতে পার্ক স্ট্রিট মোড় পর্যন্ত যাই। এই অভিজ্ঞতা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমার মনে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।
বাবার সঙ্গে কয়েকবার আমার পারফর্ম করার সৌভাগ্য হয়েছে। আজ আমার কেরিয়ার পঁচিশ বছরের। অনেকের সঙ্গে পারফর্ম করেছি। কিন্তু পারফরমার হিসেবে বাবার ধারেকাছে আজও কাউকে পৌঁছতে দেখিনি। আরও অনেক অনেক গল্পই বাকি রয়ে গেল। কিন্তু গোড়াতেই তো বললাম, সব লিখতে গেলে একটা বই লিখতে হবে।
গৌরব চট্টোপাধ্যায় গাবু নামেই কলকাতার সঙ্গীতপ্রেমীদের মধ্যে জনপ্রিয়। বাংলা রক ব্যান্ড লক্ষ্মীছাড়ার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য গাবুর বাবা গৌতম চট্টোপাধ্যায় ছিলেন বাংলা নিউ ওয়েভ মিউজিকের পথিকৃৎ। ইন্দো-জ্যাজ ব্যান্ড কেন্দ্রাকা-র সঙ্গে যুক্ত গৌরব নিজেও বিক্রম ঘোষ, পূর্বায়ন চট্টোপাধ্যায়, দেবাশিস ভট্টাচার্যের মতো খ্যাতনামা শিল্পীদের সঙ্গে ড্রামস বাজিয়েছেন। গাবুকে বাংলা ছবির সঙ্গীত পরিচালকের ভূমিকাতেও দেখা যায়।