আগুন, বই আর গোলাপ

আগের পর্বের লিংক: [] [] [] [] [] [] [] [] [] [১০] [১১] [১২] [১৩] [১৪] [১৫]

রবিশঙ্করকে নিয়ে লেখাটা বেরবার পর একটা ফোন এল বাবলুদার কাছ থেকে। বক্তব্য: অরূপ তোমাকে একবার দেখা করতে বলেছে। আমি তো রীতিমতো অবাক।
– আমায়? হঠাৎ! 
বাবলুদা বললেন,
– দেখই না গিয়ে ওর অফিসে। অবভিয়াসলি আনন্দবাজারে।
আমাদের ফোনের কথাবার্তা শুনে মেজদি গীতা বলল,
– দ্যাখ তোকে দিয়ে কোনও লেখাটেখা করতে বলবে। ভালোই তো।
সেই প্রথম আনন্দবাজারে যাওয়া। আর গিয়ে পড়লাম রিসেপশনের এক গোঁফওয়ালা ভদ্রলোকের সামনে। প্রায় হুঙ্কার ছেড়ে জবাব চাইলেন, কী চাই? 
– দেখা করতে এসেছি। 
ফের হুঙ্কার
– কার সঙ্গে?! 
কোনওমতে উগরোলাম,
– অরূপবাবুর সঙ্গে।
– কে অরূপবাবু? 
– অরূপ সরকার। 
ভদ্রলোক বোধহয় সামান্য চমকালেন।
– আমাদের জেনারেল ম্যানেজার? 
পাশে কাউন্টারে লোকজন দেখে গলা নামিয়ে বললাম,
– হ্যাঁ। 
এবার প্রায় স্বাভাবিক স্বরে গোঁফু ভদ্রলোক বললেন,
– কী ব্যাপারে?
সত্যি কথাটাই বললাম।
– উনিই ডেকেছেন। তবে কী জন্য তো জানি না।
ভদ্রলোক ফোন তুলে ডায়াল করে কাকে যেন জিজ্ঞেস করলেন,
– স্যার, একটি অল্পবয়েসি ছেলেকে কি আপনি…”
বলতে বলতে আমার থেকে নাম জিজ্ঞেস করে ফোনে বললেন, শঙ্করলাল ভট্টাচার্য। 
তারপর ফোনে “হ্যাঁ স্যার, হ্যাঁ স্যার” করে আমার দিকে চেয়ে বললেন, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, যান। চারতলা। এই নিন স্লিপ।”

এই আমার প্রথম সাক্ষাৎ সাবেক আনন্দবাজারের ডাকসাইটে রিসেপশনিস্ট গোঁফুদার সঙ্গে। হাঁকডাক আর বেধড়ক খবরদারির আড়ালে সে-রসিক ও হৃদয়বান মানুষটির নাম শান্তিরঞ্জন সেনগুপ্ত। পরে আনন্দবাজারে কাজ করতে করতে অঢেল গল্প শুনেছি ওঁর। তার মধ্যে একটি তো অতি উপাদেয়। বলা হচ্ছে যে, বুদ্ধদেব বসু রিসেপশনে দাঁড়িয়েছেন। শান্তিবাবু হুঙ্কার ছাড়লেন,
– কাকে চাই?
বুদ্ধদেব ওঁর স্বভাববিনয়ে বললেন, অশোকবাবুকে।
ফের শান্তিবাবুর হুঙ্কার। 
– কোন অশোকবাবু?
বেগতিক দেখে বুদ্ধদেববাবু বললেন, 
– আমি এখানকার একজন অশোকবাবুকেই চিনি। অশোককুমার সরকার। 
বলে বুদ্ধদেববাবু বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন অফিসে ঢোকার মুখে আনন্দবাজারের বড়সড় কর্মী কেউ লেখককে দেখে “আরে বুদ্ধদেববাবু আপনি!” বলে আহ্লাদ প্রকাশ করাতে শান্তিবাবুর মগজে খেলল ইনিই হয়তো স্বয়ং বুদ্ধদেব বসু। তখন চেয়ার ছেড়ে শান্তিরঞ্জন ছুটলেন ‘তপস্বী ও তরঙ্গিনী’-র লেখককে ঘরে তোলার জন্য। তখন মুখে সমানে আউড়াচ্ছেন, – আরে, বলবেন তো আপনি বুদ্ধদেব বসু। আপনাকে নামে চিনি, মুখে তো চিনি না।

Buddhadev Basu
আরে, বলবেন তো আপনি বুদ্ধদেব বসু

যাই হোক, স্লিপ নিয়ে চারতলায় উঠে জিজ্ঞেস করে করে যে-ঘরে গিয়ে পৌঁছলাম সে-ঘরটা অরূপবাবুর ছড়ানো-বিছনো সেক্রেটারিয়েট। অরূপ সরকারের সেক্রেটারি, টাইপিস্ট এঁরা সব বসেন। সে-ঘরে ঢুকতেই সচিব ভদ্রলোক (পরে নাম জানলাম ধীরাজবাবু) আমায় বললেন,
– আপনি বসুন। আমি স্যারকে জানাচ্ছি।
তারপর স্যারের দরজা ঈষৎ ফাঁক করে মাথা গলিয়ে কী একটা বলেই আমার কাছে ফিরে এসে বললেন,
– হ্যাঁ, হ্যাঁ, যান। স্যার ডাকছেন। 
পরে দিনে দিনে বুঝেছি স্যারের এই ডাকটাই ছিল একটা নতুন জীবনের ডাক…
একটা ইয়াব্বড় টেবিলের ওপারে একটা অমায়িক হাসি মুখে ছড়িয়ে বসে অরূপ সরকার। অ্যাদ্দিন বাবলুদার ছাত্র ও ভক্ত হিসেবে চিনে এসেছি যাঁকে, হঠাৎ তিনি দেশের সর্ববৃহৎ সংবাদপত্রের জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে সামনে বসে একটা অমায়িক হাসি হাসছেন দেখে আমার কথাই শুরু হচ্ছে না। একটা সৌজন্যমূলক ‘কেমন আছেন?’-ও বলে উঠতে পারছি না। দেখলাম বেল টিপে বেয়ারাকে দু’কাপ কফি দিতে বললেন আর আমার দিকে স্টেট এক্সপ্রেস ৫৫৫-এর ভর্তি প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিয়ে মুখের সেই হাসিটাই ধরে রেখে শোনালেন, “নাও, শুরু করো।”

Ustad Amjad Ali Khan
আমজাদের সরোদ শোনা হয়?

শুরুটা কফি আর সিগারেট দিয়ে হলেও কথাবার্তা সরে চলে গেল বিলায়েত খাঁ-র সেতারে। বোধহয় বাজিয়ে দেখতে চাইছিলেন রবিশঙ্করের বাইরে আমার সেতারে আগ্রহ কতটা। হয়তো উনি তখনও জানতেন না যে আমি অনেকদিন ধরেই খাঁ সাহেবের বাড়িতে যাওয়া-আসা করি। ফাঁকা সময় পেলে বড়ে গুলাম আলি খাঁ, আমির খাঁ, আলি আকবর, রবিশঙ্কর, বিলায়েত খাঁর এলপি, ইপি বা ৭৮ চালিয়ে কাটিয়ে দিই। মা শুধু তখন থেকে থেকে চা করে পাঠিয়ে দেয় কাজের মেয়েটাকে দিয়ে। তো অরূপ যখন জিজ্ঞেস করলেন,
– বিলায়েতের বাজনার কোন জিনিসটা টানে তোমায়?
আমি বলেই ফেললাম,
– ওঁর সেতার থেকে যে গান ভেসে ওঠে। To me he is khayal on strings. 
আমার আজও মনে আছে অরূপ কীরকম বশ হয়েছিলেন সেদিন আমার এই মন্তব্যে। আর একটা সিগারেট অফার করতে করতে বললেন,
– আমজাদের সরোদ শোনা হয়? 
– ওঁর কলকাতার সব প্রোগ্রামই তো শুনি। ব্রিলিয়ান্ট। 
– লিখতে পারবে ওকে নিয়ে?
– কোথায়?
– একটা আপস্কেল ব্রোশিওরে। বাকি লেখার সম্পাদনার ভারও তোমার। করবে?
– করব। 
অমনি অরূপ সরকারের সেই কালে কালে বিখ্যাত হওয়া উল্লাসধ্বনি, ‘Done!’ দু’কাপ কফি আর ছ’টা ৫৫৫ খেয়ে বেরিয়ে আসছি যখন সেদিন এক অদ্ভুত দোলা বুকের ভেতরে। বই, গান, লেখালিখি, চা, কফি, সিগারেট আর আড্ডাই তো আমার ভালোবাসার ধন। আর এই সবই আজ এক জায়গায় এসে মিশেছে। অরূপ যেন– গডসেন্ড। ঈশ্বরদত্ত। বাড়ি ফিরে মেজদিকে বলতে ও ঠিক এই শব্দটাই ব্যবহার করেছিল সেদিন— গডসেন্ড। আরও বলেছিল, – তুই তো আমজাদের বাজনা পছন্দ করিস। লিখে ফ্যাল একটা পিস। 

Amjad Ali
কলামন্দিরে সে রাতে একটা দীর্ঘ সুরেলা আলাপ করলেন বেহাগে

সেই ‘পিস’ সেই রাতে লিখেছিলাম, তবে একটা অদ্ভুত ঢংয়ে। নিজের নামের ইংরেজি আদ্যক্ষর S এবং B-কে দুই চরিত্র করে এক সংলাপে মুখোমুখি করে। বিষয় আমজাদ আলি খাঁ। আমজাদের বাজনার যাবতীয় রকমসকম নিয়ে তর্ক-বিতর্ক, ভালো লাগা, ভালোবাসা। দু’দিন পর লেখাটা অরূপকে দিতে ভদ্রলোক তুফানগতিতে তাতে চোখ চালিয়ে ওঁর পরিচিত হাসিটা হেসে বললেন,
– বাহ্! বেশ লিখেছ। তোমার ইংরিজিটাও খুব ভালো।
বলেই বেল টিপে চায়ের অর্ডার হল। দামি পোর্সিলিনের সে চা আসতেই হাতের কাছে এসে পড়ল সদ্যোন্মুক্ত বেনসন অ্যান্ড হেজেস প্যাকেট। চায়ে চুমুক দিয়ে বেনসন ধরাতেই টেবিলের ওপার থেকে ভেসে এল রোমাঞ্চকর এক বাক্য—
– বাংলায় লেখাটেখা হয়?
মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বুঝিয়ে মনে আছে বলতে পেরেছিলাম,
– কী বলছেন? ওটাই তো আমার ভাষা!
তাতে টেবিলের ওপারের নীরব হাসিটাও বড় সুন্দর ছিল। তারপর সংক্ষেপে একটাই কথা, “জানা রইল।”

কলামন্দিরে আমজাদ আলি খাঁর সেদিনের বাজনা ছিল এক কথায় ফাটাফাটি। একটা দীর্ঘ সুরেলা আলাপ করলেন বেহাগে, যেখানে আলাপের দশটি পর্ব প্রায় নিখুঁতভাবে তুলে ধরা। প্রত্যেকটি পর্বেরই একটা বৈশিষ্ট্য, একটা চরিত্র, একটা রূপ। সেই পর্ব থেকে পর্বান্তরে যাওয়ারও একটা চলন আছে। যা ধ্রুপদ আলাপের গঠন ও ভঙ্গিমা থেকে যন্ত্রে আনা হয়েছে। মিঞা তানসের ধ্রুপদধারা, যা বংশ পরম্পরায় গোয়ালিয়রে ‘স্বরাট’, সেই গোয়ালিয়রেই কিন্তু দীর্ঘ বসবাস ‘বঙ্গাশ’ ঘরানার সরোদিয়াদের। যে-ঘরের মুকুটমণি উস্তাদ হাফিজ আলি খাঁ হলেন আমাদের চোখের সামনে জাজ্জ্বল্যমান উস্তাদ আমজাদ সাহেবের পিতা। অপূর্ব সুরেলা হাত ও স্ট্রোক ছিল হাফিজ সাহেবের। আর সেই মাধুর্যেরই উত্তরাধিকারী পুত্র আমজাদ। আলাপ শেষ করে তরুণ উস্তাদ খাপ থেকে সরু সোনার চশমা বার করে চোখে পরলেন। আর সুর মেলালেন বাগেশ্রী গতের জন্য। 

অরূপ আমায় বাড়তি টিকিট দিয়েছিলেন যাতে কোনও বান্ধবীকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারি। সেই সন্ধ্যায় সঙ্গে নিয়েছিলাম আমার ফরাসি ক্লাসের বান্ধবী সুমিতা দত্তকে, যার জীবনের স্বপ্নই ছিল প্যারিসে জীবন কাটানো। ডাকসাইটে সুন্দরী সেটাই করে দেখিয়েছিল। প্যারিসে পড়তে গিয়ে সারাজীবনের জন্য থেকে গেল ওখানে। যাবার আগে একদিন আমায় জিজ্ঞেস করেছিল, “তোমার ইচ্ছে করে না? প্যারিসে যেতে এবং থেকে যেতে?” কপালে হাত জড়ো করে বলেছিলাম, বেঁচে থাক আমার বাংলা। তো আমজাদের বাজনার সামান্য বিরতিতে ওঁর ওই আলাপের কথাই বলছিলাম সুমিতাকে। শুনতে শুনতে ও বলেছিল,
– তোমার উচিত মিউজিক রিভিউ করা।
তাতে বলেছিলাম,
– জানি না, তাতে শোনার আনন্দ কমে যাবে কিনা। সারাক্ষণ মাথায় ঘুরবে শিল্পী কী করছেন, কোথায় কী লাগালেন ইত্যাদি, ইত্যাদি। তার চেয়ে বাবা তোমার পাশে বসে প্রাণ খুলে গান শুনছি এই না কত! 
কপাল এমন, পরদিন বরাত এসেছিল আমজাদ আলি খাঁ-র এই বাজনা নিয়ে সমালোচনা লিখে দিতে হবে ‘দেশ’ পত্রিকার জন্য! হলে বসে তো কোনও নোট-টোট নিইনি, তাহলে? ফোনের ওপার থেকে বার্তা এল, “তোমার শোনার স্মৃতিটাই তো নোট। গো অ্যাহেড।” লিখলাম। সে লেখা বেরলো। তারপর নানা অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্র আসা শুরু হল অফিসের পিওনের হাতে। সঙ্গে সম্পাদক সাগরময় ঘোষের হাতে লেখা চিরকূট— অমুক তারিখে চাই। তমুক তারিখে চাই। শুরু হয়ে গেল ‘দেশ’ পত্রিকার ‘সঙ্গীত সমালোচক’ হিসেবে আমার এক নতুন জীবন।      (চলবে)

 

*পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২
*ছবি সৌজন্য: Facebook, Alchetron
Sankarlal Bhattacharya Author

শংকরলাল ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট, কলকাতায়। ইংরেজি সাহিত্যে স্বর্ণপদক পাওয়া ছাত্র শংকরলাল সাংবাদিকতার পাঠ নিতে যান প্যারিসে। তৎপরে কালি-কলমের জীবনে প্রবেশ। সাংবাদিকতা করেছেন আনন্দবাজার গোষ্ঠীতে। লিখেছেন একশো ত্রিশের ওপর বই। গল্প উপন্যাস ছাড়াও রবিশংকরের আত্মজীবনী 'রাগ অনুরাগ', বিলায়েৎ খানের স্মৃতিকথা 'কোমল গান্ধার', হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিমালা 'আমার গানের স্বরলিপি'-র সহলেখক। অনুবাদ করেছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা থেকে সত্যজিৎ রায়ের চিত্রনাট্য পর্যন্ত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *