কবি বিষ্ণু দে কি চমৎকার ভাবেই না লিখেছিলেন – ‘আশ্বিন আনে চোখের মুক্তি নীলে।‘ ভাবতে অবাক লাগে নীল আকাশ আর পেঁজা মেঘকে সাক্ষী রেখে এক শরৎকালেই বাঙালি দর্শককে ‘মুক্তি’ নামের চলচ্চিত্রটি উপহার দিয়েছিলেন রাজকুমার প্রমথেশ বড়ুয়া। ‘মুক্তি’ (১৯৩৭) হয়ত খুব প্রাথমিক অর্থেই দর্শকের কান আর চোখের মুক্তিও।

মুক্তি ছবির দৃশ্যাবলী

প্রথমত আমরা আউটডোরে শিকার দৃশ্য ও সত্যিকারের পাহাড়ি নিসর্গ দেখতে অভ্যস্ত ছিলাম না। প্রমথেশ বড়ুয়া ও কানন দেবী আমাদের ছুটির নিমন্ত্রণে টেনে নিলেন প্রিন্স বড়ুয়ার নিজের রাজ্যপাট যেখানে – সেই অসমের গৌরীপুরে। তিরিশের দশকে এমন ল্যান্ডস্কেপ বাংলা ছবিতে শুধু অভিনব নয়, এমন নয়নাভিরাম যে নাগরিক মধ্যবিত্তের চিন্তার অতীত। তবে ‘মুক্তি’ মূলত প্রশংসিত হয় তার গানে। সে যুগের ‘দেশ’ পত্রিকা লেখে – ‘মুক্তি’ কে আমরা উচ্ছসিত প্রশংসা করতে পারি। কোন বাংলা ছবিতে এতগুলি সুন্দর গানের সমাবেশ আর দেখা যায় নাই।‘ ১৯৩৭ সালের সেই অকটোবর মাসের ‘বসুমতী’ও লেখে – ”গীতি সম্পদে মুক্তি হইয়াছে অতুলনীয়। বাংলা ছবির ইতিহাসে ‘মুক্তি’র একটি বিশিষ্ট স্থান হইয়া রহিল।”

বলা ভালো ‘মুক্তি’ তে তিনটি রবিবাবুর গান রয়েছে। রবীন্দ্রসঙ্গীত কথাটির তখনও তেমন চল হয় নি। ছবিতে তিন তিনটি রবীন্দ্রসঙ্গীত ছিল। তার একটি আবার রবীন্দ্র-সুরারোপিত নয়। রবীন্দ্রনাথ যে মনের দরজা কতদূর খোলা রাখতে পারতেন, কি অনায়াসে, কি মুক্ত চিত্তে তিনি অনুমতি দিয়েছিলেন নিতান্ত তরুণ পঙ্কজকুমার মল্লিকের সুরারোপে। ‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে’ গানটি বাঙালির ঘরে ঘরে পৌঁছে গেল। যাঁরা দেবব্রত বিশ্বাসের কণ্ঠরোধ করেছিলেন শাস্ত্রীয় মতানুসারী না হওয়ায় তারা যদি জানতেন, প্রাণ লাবণ্যময় বলেই স্বয়ং মহাকবি কত ‘ব্লাসফেমি’ অনুমোদন করে গেছেন। তখন তো প্লেব্যাক ব্যবস্থা ছিল না। নায়িকা হিসেবে কানন দেবী যখন নিজেই গাইলেন ‘আজ সবার রঙে রঙ মেশাতে হবে’ বাঙালির হৃদয়ও রঙিন হয়ে গেল। আগেও রবীন্দ্রনাথের গান ব্যবহৃত হয়েছে ‘চিরকুমার সভা’য়। কিন্তু এই প্রথম, কানন দেবীর গলায় গানটি শুনে ছাপোষা, মধ্যবিত্ত গৃহিণীও গুনগুন করে উঠলেন রান্নাঘরে – ‘আমি কান পেতে রই।‘

উত্তরপুরুষদের মধ্যে প্রমথেশ বড়ুয়ার কথা সশ্রদ্ধ বিস্ময়ে বারবার উল্লেখ করে গেছেন ঋত্বিক ঘটক। শুধু তাঁর সাবজেক্টিভ ক্যামেরা প্রয়োগের বিষয়ে নয়, তাঁর অসামান্য সম্পাদনার বোধ সম্পর্কেও ঋত্বিকের অসম্ভব পছন্দের ছিল ‘মুক্তি’র সূচনাদৃশ্য পর্যায়। এই যে আখ্যানের ক্রমউন্মোচন – দরজার পর দরজা খুলে যাওয়া – এইটা ছবির প্রথম সম্পাদক সুবোধ মিত্র বুঝতেই পারেননি। তিনি প্রথাগত সম্পাদনার নিয়ম মেনে অতগুলো দরজা খোলা কেটে দিয়ে একেবারেই মিডশট থেকে দরজায় টোকা দেওয়া দেখাতে ইচ্ছুক ছিলেন। কিন্তু প্রমথেশ বড়ুয়া, যেহেতু আধুনিক অর্থে চলচ্চিত্রে অথরশিপের বশবর্তী ছিলেন, তিনি সম্পাদক বদল করতে অনুরোধ জানালেন, বিরক্তিবশতই, নিউ থিয়েটার্সের সর্বাধিনায়ক বি. এন. সরকারকে। নতুন সম্পাদক কালী রাহা পরিচালকের নির্দেশ অনুযায়ী দরজার শটের ক্রমবিন্যাস করলেন। বাকিটা ইতিহাস। সুবোধ বাবু সবিস্ময়ে সরকার সাহেবের কাছে জানতে চান ওই দরজা খোলার কী এমন রহস্য আছে। বি. এন. সরকারের সহাস্য জবাব ছিল – ‘তা বুঝতে পারলে তো তুমি বড়ুয়ার মতো ডাইরেক্টর হয়ে যেতে।‘

মৃণাল সেন এই ছবিতে শিল্প ও সমাজের বিরোধ দেখতে পেয়েছিলেন। তাঁর ভাষায় “এই ‘বিদ্রোহী’ চিত্রনির্মাতা তৎকালীন সমাজের প্রতি তাঁর তীব্র ঘৃণা জানিয়েছেন এক অঙ্কনশিল্পীর চরিত্র চিত্রণের মধ্য দিয়ে।“ মৃণাল সেন বড়ুয়া সাহেবের শিল্পীসত্তাকে রোমান্টিকতার দৃষ্টান্ত ভাবেন বলেই তাঁর মতে শিল্পী সভ্যতার কৃত্রিমতা থেকে নিসর্গের অন্তরে চলে যায়। তপন সিংহ তাঁকে একজন ‘টোটাল ফিল্মমেকার’ ভাবতেন।

‘মুক্তি’র কানন দেবী তো সদ্যস্নাতা শরৎকালের শিউলি ফুল। আর প্রমথেশ বড়ুয়ার গৌরবর্ণ তো বাংলা সিনেমার সবাক যুগের উৎসব ঋতু। কি সম্মোহন ওই মুখের! বাঙালি তাকেই প্রাণের রাজাধিরাজ হিসেবে বরণ করেছিল। তিনিই আমাদের চলমান চিত্রমালার ইতিহাসের প্রথম নক্ষত্র। একটা যুগ, একটা প্রজন্ম, লাহোর থেকে কলকাতা, গুজরাট থেকে পুরো দেশ, আকুল ভাবে তাঁর নাম শুনেছে, তাঁর মতো ভ্রূভঙ্গি করেছে। তাঁর কেশবিন্যাস ও পরিধেয় অনুকরণ করেছে। ‘স্টার’ বলতে যদি ‘স-জীবনী’ অভিনেতা বোঝায় তো প্রমথেশ আমাদের প্রথম পুরুষ স্টার। কাননদেবী আমাদের বাসনার উন্মোচন। তাঁদের অভিনয় জীবনের পানপাত্র থেকে উপচে পড়েছে। প্রমথেশ ও কানন উৎকীর্ণ রয়েছেন আমাদের সিনেমার আধুনিকতার পরতে পরতে। ‘মুক্তি’-র পরিচালক শুধু নট নন, তিনি নিজেও সেই আদিযুগে আমাদের স্বপ্ন থেকে জাগরণ, আমাদের মলিন জীবন থেকে মুক্তি পাহাড়ের কোলে আলোছায়ায়। আজ যারা বড়ুয়াসাহেবকে আড়ালে রেখে বাংলা চলচ্চিত্র বিষয়ে মন্তব্য করেন, তারা শুধু ইতিহাসচ্যুত নন, তারা সময়ের মুদ্রাও খেয়াল করেন না।

sanjay-mukhopadhyay

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেমার মাস্টার মশাই ছিলেন বলে বা সরকারি প্রতিষ্ঠান 'রূপকলা কেন্দ্র'-র অধিকর্তা ছিলেন বলে তাঁর নামের পাশে 'চলচ্চিত্রবেত্তা' অভিধাটি স্বাভাবিক ভাবেই বসে যায়। আসলে কিন্তু সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় একজন চিন্ত্যক ও আমাদের সাংস্কৃতিক আধুনিকতার ভাষ্যকার। কাব্য বা উপন্যাস, চিত্রকলা বা নাটক,জনপ্রিয় ছায়াছবি বা রবীন্দ্রসংগীত-যে কোন পরিসরেই সঞ্জয় এক ধরনের মৌলিক ভাবনার বিচ্ছুরণ ঘটান। সেই মনোপ্রবণতায় আকাদেমিয়ার জীবাশ্ম নেই বরং ছড়িয়ে থাকে মেধার কারুবাসনা। আলোচনাচক্রে, দেশে ও বিদেশে,বৈদ্যুতিন মাধ্যমের ভাষনে তিনি প্রতিষ্ঠিত বক্তা। ঋত্বিক ঘটকের প্রবন্ধাবলী সহ সম্পাদনা করেছেন একাধিক গ্রন্থ। অনুবাদ করেছেন ছটি বিখ্যাত সিনেমার চিত্রনাট্য। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা আট। একমাত্র উপন্যাস 'বুনো স্ট্রবেরি' ইতিমধ্যেই তরুণ মহলের নজরে। হাইকোর্টসঙ্কুল এই শহরে তিনি নিজেকে 'আমুদে বাঙাল' ভেবেই খুশি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *