বাংলাদেশের মুক্তি ও স্বাধীনতার সঙ্গে যাঁর নাম অনিবার্যভাবে জড়িয়ে আছে তিনি এই রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা ও স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আর কোনও রাজনৈতিক নেতা বা ব্যক্তির সঙ্গে তিনি তুলনীয় নন। কেননা সামরিক বাহিনী শাসিত পাকিস্তানে নির্জন কারাবাসে থেকেও মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনিই, তাঁরই নামে চালিত হয় নয় মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধ। তাই বাংলা, বাঙালি, বাংলাদেশ, স্বাধীনতা – এই অনুপম শব্দগুলো যেন শেখ মুজিব নামটির সঙ্গে শ্বাসপ্রশ্বাসের মত মিশে আছে। তাই কবি নির্মলেন্দু গুণকে লিখতে হয় এমন একটি কবিতা: স্বাধীনতা, এই শব্দটি কী ভাবে আমাদের হল। কবি লিখছেন —

“শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে রবীন্দ্রনাথের মত দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।
তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,
হৃদয়ে লাগিল দোলা,
জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার সকল দুয়ার খোলা —;
কে রোধে তাঁহার বজ্রকন্ঠ বাণী?
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর
অমর কবিতাখানি :
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
সেই থেকে ‘স্বাধীনতা শব্দটি’ আমাদের।’’

১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মদিন। মাত্র ৫৫ বছর বয়সে ঘাতকদের বুলেট যাঁর দেহ ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল তাঁর জন্ম শতবর্ষ পালন করছে বাংলাদেশ সারা বছর ধরে। তাঁর জন্ম বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গীপাড়ায়। বাবা শেখ লুতফর রহমান, মা সায়েরা খাতুন। ছেলেবেলা থেকেই তাঁর মধ্যে দৃঢতার পরিচয় পাওয়া যায়। অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা নত না করা ছিল তাঁর চরিত্রের সহজাত বৈশিষ্ট্য। তার প্রমাণ তিনি রেখে গেছেন বারবার। অল্প বয়সেও সাংগঠনিক নেতৃত্ব দিতে দ্বিধা করেননি। স্কুল জীবনেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন মুসলিম লীগের কর্মী হিসেবে। এই সংশ্লিষ্টতা ব্যাপকতর হয়ে উঠতে বিলম্ব ঘটেনি। সভা করেছেন, বক্তৃতা দিয়েছেন। মুসলিম লীগের পক্ষে ছাত্র সংগঠন করেছেন। সম্মেলনের আয়োজন করেছেন। ১৯৪১ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা পাশ করে কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে (বর্তমানে মওলানা আজাদ কলেজ) ভর্তি হন শেখ মুজিব। আবাসিক ছিলেন বেকার হস্টেলে। ইসলামিয়া কলেজে ছাত্রাবস্থায় শেখ মুজিবের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেমে থাকেনি। ক্রমেই হয়ে ওঠেন অবিভক্ত বাংলার ও পরবর্তীকালে পাকিস্তানের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর স্নেহধন্য, বলতে গেলে তাঁর রাজনৈতিক ভাবশিষ্য। তেতাল্লিশের মন্বন্তরের সময় দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন মুজিব সক্রিয়ভাবে। লঙ্গরখানা খোলেন নানা জায়গায়। সারাদিন ত্রাণকাজ করে কখনও বেকার হস্টেলে ফিরে আসতেন, কখনও বা লীগ অফিসের টেবিলে শুয়ে থাকতেন। তখনকার দুর্ভিক্ষাবস্থার বর্ণনা করেছেন তিনি মর্মস্পর্শী ভাষায়:

“যুদ্ধ করে ইংরেজ, আর না খেয়ে মরে বাঙালি; যে বাঙালির কোনও কিছুরই অভাব ছিল না। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন বাংলাদেশ দখল করে মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতায়, তখন বাংলার এত সম্পদ ছিল যে একজন মুর্শিদাবাদের ব্যবসায়ী গোটা বিলাত শহর কিনতে পারত। সেই বাংলাদেশের এই দুরবস্থা চোখে দেখেছি যে, মা মরে পড়ে আছে, ছোট বাচ্চা সেই মরা মার দুধ চাটছে। কুকুর ও মানুষ একসাথে কিছু খাবার জন্য কাড়াকাড়ি করছে। ছেলেমেয়েদের রাস্তায় ফেলে দিয়ে মা কোথায় পালিয়ে গেছে।’’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী — শেখ মুজিবুর রহমান পৃ: ১৮)

ভারত ভাগ হবার ঠিক এক বছর আগে কলকাতায় ১৯৪৬ সালের অগাস্ট মাসের রক্তক্ষয়ী দাঙ্গার সময় দুর্গতদের উদ্ধারকাজে আত্মনিয়োগ করেন মুজিব। উদ্ধারের সময় দাঙ্গা উপদ্রুত এলাকায় আটকে পড়া মুসলমানদের যেমন নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে দিয়েছেন, ঠিক তেমন বেশ কিছু হিন্দু পরিবারকেও তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে দেন। কোনও ভেদাভেদ করেননি। অসাম্প্রদায়িকতা ছিল তাঁর চেতনার গভীরে। তার প্রমাণ তিনি দিয়েছেন তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সকল পর্যায়ে। কখনও ব্যতিক্রম ঘটেনি।

দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টি হবার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে যায় ষড়যন্ত্রের রাজনীতি। গোড়াতেই কোপ পড়ে সংখ্যাগুরু বাঙালিদের প্রাণপ্রিয় ভাষার ওপর। মোহমুক্তি ঘটতে দেরি হয়নি শেখ মুজিবের। তিনি অচিরেই দেখতে পান যে পূর্ববাংলা হয়ে উঠছে পাকিস্তানি শাসকদের শোষণের ক্ষেত্র, তাদের পণ্যের শুধু একটি বাজার মাত্র। ততদিনে মুসলিম লীগ ভেঙে গড়ে উঠেছে আওয়ামী মুসলিম লীগ। একসময় মুসলিম শব্দটা উঠে গিয়ে দেখা দেয় আওযামী লীগ। এই রাজনৈতিক সংগঠনটিকে একেবারে তৃণমূল পর্যায়ে শক্ত ভিত দেওয়ার ক্ষেত্রে শেখ মুজিবের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। ১৯৬৩ সালে আওয়ামী লীগ প্রধান হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী অসুস্থ অবস্থায় বৈরুতে শেষ নিঃশ্বাস ফেলেন। তার পর থেকে দলের সার্বিক দায়িত্বভার কার্যত তাঁরই ওপর পড়ে। ১৯৬৬ সালের ১ মার্চ তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। তার আগে ফেব্রুয়ারি মাসের ৫ তারিখে লাহোরে বিরোধী দলগুলোর জাতীয় সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি তোলেন। প্রকৃতপক্ষে এ ছিল পাকিস্তানের অপশাসন আর বৈষম্যমুলক নীতির পরিণাম থেকে মুক্তির প্রাথমিক সনদ। ৬ দফা ১১ দফার রূপ পায় ঊনসত্তরের প্রবল ছাত্র তথা গণ অভ্যুত্থানের মুখে। এই গণজোয়ারে ভেসে যায় সামরিক শাসক আইউব খানের তখ্ত্। তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় কারাবন্দী মুজিবকে প্যারোলে মুক্তি দিতে চায় সরকার। কিন্তু সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন তিনি। চান নিঃশর্ত মুক্তি। গোটা রাজনৈতিক জীবনে মোট ১৩ বছর তিনি কারারুদ্ধ ছিলেন, কিন্তু কখনও মুচলেকা দিয়ে বন্দীদশা কাটাননি। ২২ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পান তিনি অন্যান্য অভিযুক্তদের সঙ্গে। পদত্যাগ করেন ফিল্ড মার্শাল আইউব খান। কিন্তু পুনর্বার ঘোষিত হয় সামরিক শাসন — এবার জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বে। আর তখনই পাকিস্তান নামের ধর্মাশ্রয়ী, সামরিক শক্তির ওপর নির্ভরকারী দেশটির অনিবার্য ভাঙনের বীজ পুষ্টি পেয়ে যায়।

ঊনসত্তরের সেই উত্তাল সময় সদ্য কারামুক্ত শেখ মুজিবকে ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় রমনার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে বিপুল সংবর্ধনা দেওয়া হয়। প্রায় দশ লাখ ছাত্র ও জনতার এক বিশাল সমাবেশে তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বঙ্গবন্ধু‘ উপাধিতে অভিষিক্ত করা হয়। ঐ বছরেই ৫ ডিসেম্বর তারিখে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আওয়ামী লীগের এক আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধু পূর্ব বাংলার নাম দেন ’বাংলাদেশ’। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তিনি বলেন, “একসময় এ দেশের বুক হইতে, মানচিত্রের পৃষ্ঠা হইতে ’বাংলা’ কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকুও চিরতরে মুছিয়া ফেলার চেষ্টা করা হইয়াছে। …একমাত্র ’বঙ্গোপসাগর’ ছাড়া আর কোনো কিছুর নামের সঙ্গে ’বাংলা’ কথাটির অস্তিত্ব খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই। … জনগণের পক্ষ হইতে আমি ঘোষণা করিতেছি — আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম ’পূর্ব পাকিস্তান’-এর পরিবর্তে শুধুমাত্র ’বাংলাদেশ’।

১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর এক প্রলয়ংকরী ঘূর্ণীঝড়ে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় ১০ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারায়। আর্ত দুর্গত মানুষদের প্রতি পাকিস্তানি শাসককুলের চরম ঔদাসীন্য দেখে নিন্দায় সোচ্চার হন বঙ্গবন্ধু। নির্বাচনী প্রচার বাতিল করে উপস্থিত হন তিনি দুর্গত এলাকায়। ন’দিন ধরে উপদ্রুত এলাকাগুলোতে ব্যাপক সফর চালান। ২৬ নভেম্বর দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি খোলাখুলি বলেন, …“শাসকদের মধ্যে যাঁরা মনে করেন যে, জনগণের ইচ্ছাকে উপেক্ষা করা যাবে, তাঁরা হুঁশিয়ার হোন, বাংলাদেশ আজ জেগেছে। বানচাল করা না হলে বাংলার মানুষ নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের রায় ঘোষণা করবে। আর যদি নির্বাচন বানচাল হয়ে যায়, তাহলে ঘূর্ণীঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে নিহত দশ লক্ষ লোক আমাদের উপর যে দায়িত্ব অর্পণ করে গেছে, তা সম্পাদনের জন্যে, আমরা যাতে স্বাধীন নাগরিক হিসেবে বাঁচতে পারি তার জন্যে, আমরা যাতে নিজেদের ভাগ্যনিয়ন্ত্রা হতে পারি তার জন্যে, প্রয়োজনবোধে আরো দশ লাখ বাঙালি প্রাণ দেবে।’’

কী অমোঘ এক সত্য! তবে দশ লাখ নয়, ত্রিশ লাখ বাঙালিকে প্রাণ দিতে হয় মুক্তিযুদ্ধে। সত্তরের ৭ই ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হলো সাধারণ নির্বাচন। বঙ্গবন্ধুর আকাশচুমী জনপ্রিয়তার হাত ধরে আওয়ামী লীগ তখনকার পূর্ব পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টি লাভ করে। কিন্তু বাঙালিদের হাতে পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা তুলে না দেওয়ার চক্রান্ত চলতে থাকে। একের পর এক আলোচনা ব্যর্থ হয়। ষড়যন্ত্রের অশুভ আঁতাতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন ইয়াহিয়া-ভুট্টো। ১৯৭১-এর ১ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার ঘোষণা দিলে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয় ৩ মার্চ। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বিশাল জনসমুদ্রের সামনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দৃপ্ত কন্ঠে ঘোষণা করলেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’’

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর আর কোনও পিছুটান ছিল না। ৭ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই চালিত হয় সকল কর্মকাণ্ড। ওদিকে পাকিস্তানি শাসকদের বাঙালি নিধনের নীল নকশা তৈরি হয়ে গিয়েছে। ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর — অপারেশন সার্চলাইট। পাশবিক আক্রমণ চালায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়, পিলখানায় ইস্ট বেঙ্গল রাইফেলস-এর সদর দপ্তরে, রাজারবাগ পুলিশ লাইনে। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার আগে তিনি স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তা পাঠান চট্টগ্রামে ওয়ারলেসের মাধ্যমে। ২৬ মার্চ বন্ধ থাকা চট্টগ্রাম বেতারের ট্রান্সমিটার অন করিয়ে এই বার্তা প্রথম প্রচার করেন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট রাজনীতিক এম.এ.হান্নান। স্বাধীনতার এই বার্তা প্রচারের লক্ষ্য নিয়েই চট্টগ্রাম বেতারের এক দল কর্মী (মোট দশ জন, প্রতিবেদক সহ। দু’জন বেতারের কর্মী ছিলেন না) ঐ শহরের উপকন্ঠে কালুরঘাটের ট্রান্সমিটার ভবন থেকে ২৬ মার্চ তারিখেই শুরু করেন স্বাধীন বাংলা (বিপ্লবী) বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান। এখান থেকেই বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার বার্তা পাঠ করেন তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান। এই গোপন বেতার কেন্দ্র অনুষ্ঠান প্রচার অব্যাহত রাখে আগরতলায় কালুরঘাট থেকে তুলে আনা একটি মোবাইল ট্রান্সমিটার  ও ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ-এর ট্রান্সমিটার মারফত। ২৫ মে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের তত্ত্বাবধানে শক্তিশালী ট্রান্সমিটার থেকে নবকলেবরে শুরু হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রাত্যহিক অনুষ্ঠান। তা চলে চূড়ান্ত বিজয় পর্যন্ত। কলকাতায় বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের একটি ভবনে সমবেত হতে থাকেন ঢাকা সহ বিভিন্ন বেতারকেন্দ্রের কর্মীরা, বিশিষ্ট সাংবাদিকরা, শিল্পী, সংগীতপরিচালক, নাট্যকর্মী, লেখকবৃন্দ। সকলের মিলিত শ্রমের ফসল প্রতিদিন পৌঁছে যায় অবরুদ্ধ দেশবাসীদের কাছে। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে এ ছিল শব্দসৈনিকদের আর এক লড়াই। বলা বাহুল্য, কলকাতায় বাংলাদেশের লেখক, শিল্পী, বেতারকর্মী ও কলাকুশলীরা স্বতঃস্ফূর্ত সাহায্য ও সমর্থন পেয়েছেন কলকাতাবাসীদের কাছ থেকে।

একাত্তর সালের ১৭ এপ্রিল ঘোষিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রবাসী গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার। সরকারের শীর্ষে থাকেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। তাঁর অবর্তমানে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব অর্পিত হয় সৈয়দ নজরুল ইসলামের ওপর। প্রধানমন্ত্রী পদে অভিষিক্ত হন বঙ্গবন্ধুর বিশিষ্ট সহযোগী তাজউদ্দিন আহমদ। তাঁরই সুযোগ্য নেতৃত্বে ন’মাস ধরে সুচারুভাবে চালিত হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী থেকে বেরিয়ে আসা সেনা অফিসারদের অধীনে পরিচালিত হয় সে যুদ্ধ। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সরকার সর্বতোভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর আগ্রাসন এড়াতে ভারতের পশ্চিম বঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম ও অন্যান্য জায়গায় আশ্রয় নেন এক কোটি শরণার্থী। নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও মিসেস ইন্দিরা গান্ধী এই সব দুর্গত মানুষদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে দ্বিধা করেন নি। বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবি নিয়ে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন অর্জন করতে নানা দেশে দরবার করে বেড়ান তিনি।

ভারত সরকার ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়। তার আগেই ৩ ডিসেম্বর গঠিত হয়েছে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ড। মুক্তিবাহিনীর সহায়তায় ভারতীয় বাহিনী বিভিন্ন রুটে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে থাকে। পিছু হটতে থাকে পাকিস্তানি দখলদার সেনারা। ১৬ ডিসেম্বর নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর এলো কাঙ্খিত বিজয়। ঢাকায় আত্মসমর্পণ করল পাকিস্তানি সেনারা ভারত আর বাংলাদেশের যৌথ কমান্ডের কাছে। ২২ ডিসেম্বর প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সদস্যরা ফিরে এলেন ঢাকায়, প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিলেন মুক্ত, স্বাধীন স্বদেশভূমিতে। কিন্তু তখনও স্বাধীনতার প্রাপ্তি ঠিক পূর্ণতা পায়নি। সে পূর্ণতা এলো ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডন আর দিল্লি হয়ে ঢাকার তেজগাঁ বিমানবন্দরে এসে পৌঁছলেন বঙ্গবন্ধু। স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখলেন। রেসকোর্স ময়দানে তাঁর আসার অপেক্ষায় তখন লাখ লাখ মানুষ। কখন আসবেন তিনি? আবেগাপ্লুত কন্ঠে তিনি বললেন, “আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে, আমার জীবনের সাধ আজ পূর্ণ হয়েছে, আমার বাংলার মানুষ আজ মুক্ত হয়েছে।’’

যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের কর্ণধার হয়ে পর্বতপ্রমাণ সমস্যার মোকাবিলা করতে হলো বঙ্গবন্ধুকে। ভারতের সক্রিয় সাহায্য আর সমর্থনের জন্য প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও তাঁর সরকারকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান তিনি। বঙ্গবন্ধুর অনুরোধ মেনে ১৯৭২ সালের ১২ মার্চ ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যরা বাংলাদেশ ছেড়ে স্বদেশে ফিরে যায়। তার আগে ৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডের বিশাল জনসভায় ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর উপস্থিতিতে। ১৭ মার্চ শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ সফরকালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ভাষণ দেন। বিরাট আকারে নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হয় তাঁকে। মুজিব-ইন্দিরা বৈঠকে স্বাক্ষরিত হয় ২৫ বছর মেয়াদি মৈত্রী ও সহযোগিতা চুক্তি। বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থিত করতে সর্বতোভাবে সচেষ্ট হন তিনি। পাকিস্তানের তখনকার দুই বন্ধু দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর চীনের বিরোধিতা কাটিয়ে, সব বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে ১৯৭৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সর্বসম্মত অনুমোদনে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে। বাংলাদেশ হয় জাতিসংঘের ১৩৬তম সদস্য রাষ্ট্র। ২৫ সেপ্টেম্বর সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে তিনিই প্রথম বাংলায় ভাষণ দেন এবং সাধুভাষায়। দীর্ঘদেহী, গলাবন্ধ কোট আর কালো ফ্রেমের চশমা পরা সুদর্শন এই মানুষটি বক্তৃতামঞ্চে এসে দাঁড়ালেন যখন, উপস্থিত সবাই আসন থেকে উঠে তাঁকে স্বাগত জানান। তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভরাট কন্ঠে বঙ্গবন্ধু বিশ্বব্যাপী শোষিত মানুষের অধিকার রক্ষা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠার কথা বললেন। উল্লেখ করলেন একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশে মুক্ত নাগরিকের মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য বাঙালির শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সংগ্রামের কথা। বঙ্গবন্ধু বলেন, “যে মহান আদর্শ জাতিসংঘের সনদে রক্ষিত আছে, আমাদের লক্ষ লক্ষ মানুষ সেই আদর্শের জন্য ত্যাগ স্বীকার করিয়াছেন।’’ বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম, তিনি বলেন, সার্বিক অর্থে শান্তি ও ন্যায়ের সংগ্রাম।

বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শেখ মুজিবের ঘোষিত নীতি ছিল — সকলের সঙ্গে বন্ধুতা, কারও প্রতি বিদ্বেষ নয়। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রতি তাঁর সক্রিয় সমর্থন ছিল। তবে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের সার্বিক পরিস্থিতির কথা মাথায় রাখতে হয়েছিল তাঁকে। নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশের পক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়নের সুস্পষ্ট সমর্থন ছিল। ফলে মস্কোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে তিনি ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে মস্কো সফর করেন। ঢাকা আর মস্কোর মধ্যে গড়ে ওঠে অর্থনীতি আর শিক্ষা ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে গভীর সম্পর্ক। ভেঙে যাওয়া পরিকাঠামো ঠিক করতে ভারত যেমন এগিয়ে আসে, সোভিয়েত ইউনিয়নের দিক থেকেও ব্যাপক সাড়া মেলে। অবশ্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশে ভারতের শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সরকারের নৈতিক, কূটনৈতিক এবং সামরিক সমর্থনের প্রেক্ষাপটে ঢাকা-দিল্লির বন্ধুত্ব যে শেখ মুজিবের কাছে বিশেষ গুরুত্ব পাবে, সেটা বলাই বাহুল্য। ইন্দিরা গান্ধী আর বঙ্গবন্ধুর মধ্যে গড়ে উঠেছিল পারস্পরিক সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধের এক সম্পর্ক।

একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত, সম্পদ হারানো নবীন দেশে চারদিক থেকে সমস্যার পর সমস্যা তাড়া করে এল। সক্রিয় হয়ে উঠলো দেশীয় কুচক্রীরা। তাঁর সোনার বাংলা গড়ে তোলার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হওয়ার আগেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এক দল বিশ্বাসঘাতক, নব্য মীরজাফর সেনা অফিসারদের হাতে সপরিবারে নিহত হলেন বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান ৩২ নম্বর ধানমণ্ডির ঐতিহাসিক বাসভবনে। জার্মানিতে অবস্থান করার কারণে প্রাণে বেঁচে যান তাঁর দুই কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর শেখ রেহানা। তার অব্যবহিত পরের ইতিহাস রক্তাক্ত। তারই প্রেক্ষাপটে ক্ষমতা হাতে নেন জেনারেল জিয়াউর রহমান, যিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার। সামরিক লেবাস ছেড়ে তিনি কিছু দলছুট রাজনীতিকদের নিয়ে গড়ে তোলেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। তিনি নিহত হবার পর ক্ষমতায় আসেন আরেক সেনাপতি — এইচ এম এরশাদ। তিনিও এক সময় সামরিক পোশাক ছেড়ে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব হাতে তুলে নেন এবং স্থাপন করেন জাতীয় পার্টি। তবে সেই সেই ইতিহাস আলোচনার পরিসর এ নয়।

শতবর্ষের বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করতে গিয়ে পরিশেষে তাঁর গুণমুগ্ধ বাংলা সাহিত্য ও বাঙালির বৌদ্ধিক জগতের খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব প্রয়াত অন্নদাশংকর রায়ের কবিতার দুটি পংক্তি মনে পড়ছে:

“যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান
ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।”

আবদুল্লাহ আল ফারুক বাংলাদেশের প্রবীণ বেতার কর্মী। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র স্থাপকদের মধ্যে তিনি একজন। জার্মানির আন্তর্জাতিক বেতার সংস্থা ডয়েচে ভেলে-এর বাংলা বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন দীর্ঘ সময়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *