শ্রাবণ শেষ হয়ে এল প্রায়। কলকাতায় বৃষ্টি নেই। ভ্যাপসা গরমে হাঁসফাঁস করার ফাঁকে কলকাতার কি মনে পড়বে আজ ২২ অগস্ট, এক আশ্চর্য শিল্পীর জন্মদিন? এমন এক শিল্পী, যাঁর গানের শরীরে লেগে থাকত পাঁজরের দাগ, উচ্চারণের গহনে ঝলমলিয়ে উঠত কাঁটাতারের ক্ষত, সাম্যদিনের স্বপ্নভাঙা পাথরকুচি। পায়ের নীচে ছড়িয়ে থাকা প্রাতিষ্ঠানিক কাঁচের টুকরোয় লেগে থাকত অমোঘ রক্তদাগ। ভরাট ব্যারিটোন উপচে ছড়িতে পড়ত ফুঁপিয়ে ওঠা ফেনা। রাজনৈতিক কুনাট্যরঙ্গে সারা দিনমান ব্যয় করার ফাঁকে কি কলকাতা একবারও গুনগুনিয়ে উঠবে তাঁর গাওয়া রবীন্দ্রনাথের গান, যে গান তাঁর আশ্রয়, তাঁর মুক্তি, একাকীত্বের দহনবেলায় মাথা রাখার কাঁধ?

দেবব্রত বিশ্বাসের জন্মদিনে আজ হয়তো ঈষৎ নির্বিকারই থাকবে কলকাতা। যেমন ছিল কয়েক দিন আগে, ১৮ অগস্ট, তাঁর মৃত্যুদিনেও। কিন্তু বৃষ্টি হোক বা না হোক, ভালবাসা, আদর আর শ্রদ্ধায় আজ ভিজে যাবে ১৭৪-ই রাসবিহারী অ্যাভিনিউ। আমৃত্যু যে ঠিকানায় থাকতেন বাঙালির চিরকালের জর্জ। এই দোতলা ভাড়া বাড়িতেই কোলের উপর টেনে নিতেন হারমোনিয়াম। গাইতেন রবীন্দ্রনাথের গান, যা আদতে তাঁর বাঁচামরা, তাবৎ যাপন। এই বাড়িতেই তাঁকে ঘিরে ভিড় জমাতেন সমকালের নক্ষত্ররা। কখনও সংগীত, কখনও বিপ্লবের তাওয়ায় সেঁকা হত ইতিহাসের হাতরুটি। বাঙালির বেঁচে থাকার অন্যতম অভিজ্ঞান ওই বাড়ির হাতবদল হয়েছে ঠিকই, কিন্তু রয়ে গিয়েছেন জর্জ বিশ্বাস, রয়ে গিয়েছে তাঁর দেবদারু গাছের মতো স্মৃতি।

কেমন আছে দেবব্রত বিশ্বাসের সেই বাড়ি, যেখানে নিয়মিত আসতেন শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সলীল চৌধুরি-সহ গণনাট্য আন্দোলনের প্রথম সারির যোদ্ধারা? আসতেন অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায়, যাঁকে ইতিহাস চিনেছে উত্তমকুমার নামে, আসতেন উল্কাসদৃশ ঋত্বিক ঘটক। এখন কেমন আছে সেই বাড়ি? প্রায় চার দশক আগে মারা গিয়েছেন যে ভাড়াটিয়া, তাঁর কোনও চিহ্ন কি আদৌ রয়েছে সেখানে?

হ্যাঁ, জর্জ এখনও প্রবলভাবে জীবন্ত তাঁর ফেলে যাওয়া আস্তানায়। ট্র্যাঙ্গুলার পার্ক লাগোয়া ওই বাড়িতে এখন একটি চমৎকার কাফে চালান এক দম্পতি। সেই কাফের সর্বত্র দেবব্রতের ছোঁয়া। নাম- মাড কাফে। হরেক রকম চা-কফি আর বিবিধ স্ন্যাকসের ওই ঠেকে সারাদিন কেবল দেবব্রতর গানই বাজে। প্রতি বছর ২২ অগস্ট পালিত হয় জর্জ-জন্মদিন। গান গেয়ে শোনান বিশিষ্ট শিল্পীরা, ভাষ্যপাঠ করেন একঝাঁক চেনা মুখ। আজ সন্ধ্যাতেও রয়েছে তেমনই আয়োজন।

কী করে দেবব্রতের ভাড়াবাড়ি বদলে গেল পুরোদস্তুর বাঙালি এক কাফেতে, তার পিছনে রয়েছে এক মজার গল্প। মালিক অর্ণব মিত্রের ঠাকুরদা ছিলেন ঢাকা-বিক্রমপুরের বাসিন্দা। দেশভাগের পর তিনি বাসা বাঁধলেন এই শহরে। উত্তর কলকাতায় বিবেকানন্দ রোডের সেই বাড়িটি বহাল তবিয়তে থাকলেও অর্ণবের বড় হওয়া ওঠা দক্ষিণে। সর্দার শঙ্কর রোড আর বালিগঞ্জ মিলিয়ে। প্রথমে সাউথ পয়েন্ট, তারপর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা শেষ করে আর পাঁচটা মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলের মতোই ঢুকে পড়েছিলেন চাকরিতে। কিন্তু মাথার ভিতরে রয়ে গিয়েছিল স্বাধীনভাবে কিছু করার স্বপ্ন। এমন কিছু, যা কেবল ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স বাড়াবে না। চেয়েছিলেন শহরের বুকে একদম অন্য রকম একটি কাফে তৈরি করতে, যেখানে লগ্ন হয়ে থাকবে বাঙালিয়ানা। বছর ১৫ চাকরি করার পর অর্ণব শুরু করলেন নিজের ব্যবসা। ধীরে ধীরে পায়ের তলায় জমি পেলেন আর তখনই ব্যাঙ্কের সঙ্গে যোগাযোগ করে কিনে ফেললেন একটা আস্ত বাড়ি। সেটা ২০০৮ সাল।

অর্ণব কিন্তু জানতেনই না তিনি যে বাড়িটি কিনেছেন, সেখানেই আমৃত্যু থাকতেন দেবব্রত। ঘটনাচক্রে অর্ণবের চার্টাড অ্যাকাউনট্যান্ট বাবাও চেতনায় বামপন্থী এবং দেবব্রতের নিবিড় শ্রোতা। তাই ছোট থেকে জর্জের গান শুনেই বেড়ে উঠেছেন অর্ণব। কী করে অবশেষে জানা গেল স্থানমাহাত্ম্য? অর্ণবের কথায়, “একদিন ওই বাড়ির ঠিকানায় ইলেকট্রিক বিল এল। দেখলাম বিলে দেবব্রত বিশ্বাসের নাম! খটকা লাগল। জানতাম আমার প্রাণের শিল্পী ওই এলাকাতেই থাকতেন, কিন্তু এই বাড়িতেই! খোঁজখবর নিয়ে যখন জানলাম, আমার তো চক্ষু চড়কগাছ! এত আনন্দ হয়েছিল যে বলে বোঝাতে পারব না। তখনই বাবাকে বললাম। জানালাম, কাফে করতে চাই। বাবা বললেন, যা-ই করি, তাতে যেন জর্জবাবুর স্পর্শ থাকে।”

২০১৪ সাল। বাড়িটি কেনার প্রায় ৬ বছর পর শুরু হল মাড কাফের যাত্রা। সমস্ত বাড়ি জুড়ে বছরভর যেন চলে দেবব্রত-উদযাপন। দিনভর বাজে সেই অমোঘ ব্যারিটোন। পাশাপাশি, খাবারদাবারের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রমী অর্ণব এবং তাঁর শিক্ষাবিদ স্ত্রী অনন্যা। মাঝবয়সী দম্পতি চেষ্টা করেন খাবারে বাঙালিয়ানার চিহ্ন রাখতে। তাই পোলাও-মাংস থেকে মাংসের ঘুগনি- আয়োজন থাকে এক ঝাঁক নিখাদ বাঙালি ডিশের। অর্ণব বেশ আত্মবিশ্বাসী গলায় বললেন, “ভালবেসে কাফেটা চালাই, তাই খাবারের কোয়ালিটিতে আপোষ করি না। আমাদের এখানে বাসা মাছ পাবেন না। টাটকা ভেটকি না হলে আমরা ফিশ ফ্রাই করি না।” এর পরই তাঁর সংযোজন, “যত দূর জানি দেবব্রতবাবু নিজেও খেতে, খাওয়াতে, রান্না করতে ভালবাসতেন। আমরাও সাধ্যমতো চেষ্টা করি ভাল খাওয়াতে।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *