মৃণাল দা’র ছবি দেখেই আমরা বড় হয়েছি বলা চলে। বিশেষ করে ৭০-এর দশকে যখন আমরা যুবক, ওঁর ছবিগুলো অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। পরবর্তীকালে কর্মসূত্রে ওঁর খুব কাছাকাছি যাবার সুযোগ পেয়েছিলাম। ১৯৯৭ সালে, আমি কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভাল কমিটির সঙ্গে যুক্ত হলাম। নন্দনে মাতব্বরি করা শুরু হল। আমার ওপর বেশ কিছু দায়িত্বও ছিল তাই বেশ খানিকটা সময় কাটত নন্দন চত্বরে। মৃণালদার বাড়িও কাছাকাছি ছিল তাই প্রায়ই চলে আসতেন নন্দনের আড্ডার টেবিলে। ওখানে একটা লম্বা টেবিল ছিল– নাম দেওয়া হয়েছিল আড্ডার টেবিল। ওই টেবিলে একসঙ্গে তিনটে আড্ডা চালানো যেত; এমাথায় একটা, ওমাথায় একটা, মাঝখানে একটা। এক কোণে হয়তো গৌতম (ঘোষ) বসে তর্ক করছে বসন্তদার (চৌধুরী) সঙ্গে, মাঝে আমি আর মৃণাল দা, অন্য দিকে আরও কেউ। আর ছিল অফুরন্ত চায়ের জোগান। সেই থেকেই মৃণাল দা’র সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সূত্রপাত। তবে তখনও ওঁর বাড়ি যাইনি। কথাবার্তা যা হত ওই নন্দনেই। ওঁর সঙ্গে আলাপের কারণেই সেই সময়ে ওঁর যে ছবিগুলো আমার দেখা বাকি ছিল, সেগুলো সব দেখে নিয়েছিলাম। পাশে বসে একসঙ্গে অনেক ছবিও দেখেছি ফেস্টিভালে। ভয়ানক মনোযোগী দর্শক ছিলেন এবং সুচিন্তিত মতামত দিতেন। 

আমি তখন কালচার সেক্রেটারি। এর পর ২০০৯ সালে ইউপিএ ২ সরকার ক্ষমতায় এলে আমাকে বলা হল মিনিস্ট্রি অফ কালচারের সঙ্গে ইনফরমেশন অ্যান্ড ব্রডকাস্টিং-এরও দায়িত্ব নিতে। তখন আমি সকালে এক দপ্তর, সন্ধেয় অন্য দপ্তর এইভাবে কাজ সামলাতাম। মাঝেমাঝেই আমাকে দেখা যেত শাস্ত্রী ভবনের করিডর ধরে ছুটতে। যাইহোক আমি দায়িত্ব নেবার পরে জানতে পারলাম, একটা প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে মৃণাল দা’র ছবিগুলো নাকি কান ফিল্ম ফেস্টিভালে যেতে পারছিল না। এনএফডিসি আর ন্যাশনাল ফিল্ম আর্কাইভ, এর জন্য আংশিক দায়ী ছিল। তারপর একটা মার্কিন প্রযুক্তির সাহায্যে আমরা ওঁর ছবিগুলো রেসটোর করে কানে যাবার উপযুক্ত করে তুলি এবং ২০০৯ কান ফিল্ম ফেস্টিভালে ওঁর ছবি দেখানো হয়। এর পর মৃণাল দা’র সঙ্গে যোগাযোগ আরও গাঢ় হয়, ওঁর বাড়িতে আমার যাতায়াত শুরু হয়। 

Mrinal Sen, Soumitra Chatterjee and Jawhar Sircar
বাঁ দিকে থেকে: মৃণাল সেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, জহর সরকার। সৌজন্যে জহর সরকার।

উনি তো দারুণ আড্ডা দিতে পারতেন, প্রচুর গল্প করতেন। তার মধ্যে একটা গল্প খুব ভালো করে মনে আছে। উনি যখন ভুবন সোম করছেন তখনকার কথা। সিনেমায় সরকারি বাজেট খুব সীমিত হয়। মৃণাল দাও খুব সামান্য টাকা নিয়েই ছবির কাজে হাত দিয়েছিলেন। ছবির কাজ চলছে। মৃণাল দা কলকাতা-বম্বে (মুম্বই) যাতায়াত করছেন। একবার খোয়াজা আহমেদ আব্বাসের (কে এ আব্বাস) সঙ্গে দেখা। আব্বাস তখন ‘সাত হিন্দুস্তানি’ ছবির কাজে হাত দিতে চলেছেন কিন্তু উৎপল দত্তর ডেট পাচ্ছেন না। মৃণাল দা’র কাছে তদ্বির করলেন উৎপল দত্তের জন্য। তখন মৃণাল দা আব্বাসকে বলেন যে “আমি উৎপলকে বোঝাতে পারি কিন্তু তোমাকেও আমার একটা কাজ করে দিতে হবে। আমি একটা ভাল গলা খুঁজছি ভয়েসওভারের জন্য। সেটা তোমাকে খুঁজে দিতে হবে”। তখন দুই পরিচালকের মধ্যে এক ধরনের সমঝোেতা হল– মৃণাল দা উৎপল দত্তকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে আব্বাসের কাছে পাঠালেন, আর আব্বাসও ভয়েসওভারের জন্য একজনকে পাঠিয়ে দিলেন মৃণাল দার কাছে।  তিনি অমিতাভ বচ্চন। মৃণাল দা বলেছিলেন, “ছেলেটা তালগাছের মতো লম্বা, কিন্তু গলাটা বেশ ভাল। বলল কলকাতায় কাজও করেছে। রেকর্ডিঙের শেষে যখন ওকে চেক দিলাম আমাকে প্রণাম করতে চলে এল। বলে কিনা এতদিন কাজ করে এই প্রথম পারিশ্রমিক পেল।”

Bhuvan Shome
ভুবন সোম ছবির একটা মজার গল্প বলেছিলেন।

এত রকমের গল্প মৃণাল দার মুখে শুনতে শুনতে একদিন ভাবলাম, লোকটার তো বয়স বেড়ে যাচ্ছে। এইসব গল্প তো কোথাও ধরে রাখতে হবে। ঠিক হল দূরদর্শনের তরফে ওঁর একটা সাক্ষাৎকার নেওয়া হবে। ভাবা তো হল, কিন্তু কাজটা খুব সহজ ছিল না। একদিকে সরকারি নিয়মের জাঁতাকল, অন্যদিকে মৃণাল দার মর্জি। উনিই একজনের নাম করলেন– অনন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়। দূরদর্শনের বেশ উচ্চপদস্থ কর্মী ছিলেন। মৃণাল দার ওঁকে পছন্দ করার আর একটা কারণ ছিল চা। অনন্যা ছিলেন মকাইবারি চা বাগানের যাঁরা মালিক, সেই পরিবারের সদস্য। উনি মাঝেসাঝে চা পাঠাতেন মৃণাল দার জন্য। চা খেতে খুব ভালবাসতেন। আমিও ভাল চা পেলে মাঝেমাঝে পাঠিয়ে দিতাম। ঠিক হল ক্যামেরা আর সাউন্ড করবেন অনন্যা। কিন্তু সাক্ষাৎকার নেবে কে? এই নামটাও মৃণালদাই দিলেন। শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়। আমি একদিন শমীকদার সঙ্গে গিয়ে দেখা করলাম। কাজটা করতে রাজি হলেন, কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই দূরদর্শনের তরফ থেকে একটা অফিসিয়াল চিঠি চাইছিলেন। আমি ওঁকে বুক বাজিয়ে বললাম, “আমি তো বলছি, আমিই দূরদর্শন।” শমীকদা হেসে বলেছিলেন, “অফিসে গিয়ে দ্যাখো, বুঝতে পারবে।” অফিসে ফিরে বুঝলাম শমীকদার অভিজ্ঞতা ঢের বেশি। আমি মোটেও দূরদর্শন নই, আমলামাত্র। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে শেষমেশ চিঠি বের করা হল। ঠিক ছিল দু’টো এপিসোড করার, কাজ শুরু হতে সেটা চারটে এপিসোডে গিয়ে দাঁড়াল। সাক্ষাৎকারটা দূরদর্শনের আর্কাইভে রয়েছে। কেউ যদি এটা নিয়ে কোনওরকম গবেষণামূলক কাজ করতে চান, দূরদর্শন অফিসে গিয়ে যোগাযোগ করতে হবে। এই সাক্ষাৎকারটা করতে পেরে আমি বেশ তৃপ্তি পেয়েছিলাম। ওঁর মতো একজন মানুষের স্মৃতিচারণ, বিশ্লেষণ, এসবের একটা রেকর্ড থাকার খুব দরকার ছিল। 

Read more: Mrinal Sen Centenary Tribute

আর একটা কথা মৃণাল দা সম্বন্ধে না বললেই নয়। নানান বিষয়ে অগাধ পড়াশোনা থাকার কারণে, পড়াশোনা করতে ভালবাসে এমন মানুষদের উনি বিশেষ পছন্দ করতেন, তাদের সঙ্গে আড্ডা দিতেও ভালবাসতেন। আর কেউ অল্পশিক্ষিত ওপপরচালাকি করলেই নিমেষে ধরে ফেলতেন।

ছবি সৌজন্য: সমন্ত্যক চট্টোপাধ্যায়, জহর সরকার, ফেসবুক

Jawhar Sarcar

জহর সরকারের জন্ম ১৯৫২ সালে। সেন্ট জ়েভিয়ার্স স্কুল, প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর শিক্ষা। ১৯৭৫ সালে আইএএস পাশ করে প্রশাসনিক কেরিয়ারের সূচনা। দীর্ঘদিন প্রসার ভারতীর সিইও পদে আসীন ছিলেন। তার আগে ভারত সরকারের তথ্যসংস্কৃতি বিভাগের সচিব-সহ একাধিক পদ অলঙ্কৃত করেন। সংস্কৃতি সচিব হিসেবে জাদুঘর, মহাফেজখানা, গ্রন্থাগার সংস্কার ও আধুনিকীকরণের উদ্য়োগী হন এবং ব্রিটিশ মিউজ়িয়াম পদক লাভ করেন। ১৯৯৭ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত মুখ্যত তাঁরই উদ্যোগে কলকাতায় আন্তর্জাতিক ফিল্মোৎসব হয়। কাজের পাশাপাশি একনিষ্ঠভাবে চালিয়ে গিয়েছেন গবেষণা এবং লেখালিখি। ইতিহাস, সংস্কৃতি, নৃতত্ত্ব, সমাজনীতি, গণমাধ্যম এবং আরও বহুবিধ বিষয়ে অজস্র প্রবন্ধ রচনা করেছেন। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ,ভারতীয় ইতিহাস সংসদ, এশিয়াটিক সোসাইটির মতো একাধিক বিশ্রুত প্রতিষ্ঠানের আজীবন-সদস্য জহরবাবু বাংলা এবং ইংরিজি সংবাদপত্রে এখনও নিয়মিত লেখেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *