তৃতীয় পক্ষের স্ত্রী এলোকেশীর কাছে ‘খেঙ্গরার প্রহার’ খেয়ে ডমরুধর মা দুর্গাকে ডেকেছিলেন। তাঁর কাতর প্রার্থনা ছিল, ‘মা! আমি অপরাধ করিয়াছি। বিবাহের সাধ আমার মিটিয়া গিয়াছে। আর ঝাঁটা-পেটা সইতে পারি না। আমাকে কৈলাস পর্ব্বতে লইয়া চল। সেস্থানে চিরকাল আমি আইবুড়ো হইয়া থাকিব। চামুণ্ডারূপিণী এলোকেশীর সহিত আর আমি সংসারধর্ম্ম করিতে চাই না।’ তৎক্ষণাৎ কৈলাস হতে দুর্গার প্রত্যুত্তর আসেনি বটে, কিন্তু খানিক পরেই কপালে-পুরুষ ডমরুর উদ্দেশে আকাশবাণী হয়। আরও এক-শো বছর এলোকেশীকে নিয়ে সুখে ঘরকন্না করার নির্দেশ আসে।
ব্যাপার হল এই রকমই। বাঙালির পূজ্য দেবী তার কাছে আশ্রয়স্থল। তিনি শুধু বিপত্তারণই করবেন না, দুর্গতিনাশিনীই হবেন না, বাঙালি চায় সে-সবের পর কাছেও টেনে নেবেন পরম মমতায়। ছায়া দেবেন। ভক্তি ক্রমে ঢলে পড়বে ভালবাসার দিকে। এই প্রবণতায় বাঙালি শীতলার মতো ভয়াল দেবীকেও গাঁয়ের যুবতী কন্যে হিসেবে দেখেছে। কালীকে ‘কেলে সর্বনাশী’ বলেছে, অবলীলায় তুইতোকারি করেছে। ভীষণদর্শনা, শক্তিরূপিণী দেবীকে বাঙালি বলেছে, ‘গৌরীর আমার ননীর পুতলীতনু’। দেবী চণ্ডীকেও মাটিতে নামিয়ে এনেছে অনায়াসে। সাত ঘড়া ধন দেওয়ার পর কালকেতুর পিছনে পিছনে চণ্ডী আসছেন, তাঁকেও সন্দেহ করতে দ্বিধা করছে না কালকেতু। বাংলার ত্রস্ত নীলিমায় ‘যখন মুকুন্দরাম, হায়, লিখিতেছিলেন ব’সে দু-পহরে সাধের সে চণ্ডিকামঙ্গল’ –
পশ্চাতে চণ্ডীকা জান আগে কালু জায়।
ফিরি ফিরি কালকেতু পাছু পানে চায়।।
মনে মনে কালকেতু করিল যুগতি।
ধন ঘড়া লৈয়া পাছে পালায় পার্ব্বতী।।
পার্বতীর দেওয়া ধনসম্পদ পার্বতীই নিয়ে পালাতে পারেন, বাংলার কাহিনি স্বয়ং দেবীকেও এত দূর রক্ত-মাংসের মানুষের রূপ ও চারিত্র্য দিতে সক্ষম। কাজেই বসন্তকালীন বাসন্তী দিয়ে তার কাজ চলেনি। তাকে অকাল বোধন করে নিতে হয়েছে। উগ্ররূপা মহিষাসুরমর্দিনী হয়েছেন উমা – ঘরের মেয়ে। দিতে হয়েছে পরিবারের আদল। বাপের বাড়ি, শ্বশুরবাড়ির বিন্যাস – প্রাক মেগা সিরিয়াল টানটান স্ক্রিপ্ট!
আগমনী-বিজয়ার গানে সবচেয়ে বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠে ঘরের মেয়ে উমার ছবি। শাক্ত পদাবলীর ‘শরতের বায়ু যখন লাগে গায় / উমার স্পর্শ পাই, প্রাণ রাখা দায়’ থেকে ‘ওরে নবমী-নিশি, না হইও রে অবসান’ পর্যন্ত যে কাতরতার ছবি, তা বাঙালির একান্ত নিজস্ব। ‘বাংলার সাধনা’ বইয়ে ক্ষিতিমোহন সেন সহজ কথায় ঠিক এই পরিপ্রেক্ষিতটিই ধরেছেন – ‘তন্ত্র ও শাক্ত মতবাদ এক কথা আর বাঙালীর জীবনে কী ভাবে তা দিনের পর দিন কাজ করছে তা আর-এক কথা। বাঙালী-শাক্ত তার উপাস্য দেবীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ প্রেমের সম্বন্ধে যুক্ত। সে-প্রেম একেবারে মানবীয়। আগমনী ও বিজয়াগানে ঘরে ঘরে গৌরীর জন্য কন্যাবিরহ-বিধুর পিতামাতার দল কেঁদে আকুল। দেবীকে মা বলে ডেকে দেওয়ান রামদুলাল, রামপ্রসাদ, কমলাকান্ত কত বেদনাই না জানিয়ে গেছেন।’
কতকটা একই রকম কাণ্ডই দেখি, যখন সন্তান হিসেবে দুর্গার সঙ্গে জুড়ে যান লক্ষ্মী-সরস্বতী-কার্তিক-গণেশ। প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে আজ যা আমাদের চেনা ছবি। কিন্তু এই সহাবস্থান একেবারেই পৌরাণিক নয়, অনেক পরের সৃষ্টি, বাঙালির নিজস্ব উদ্ভাবন। দুর্গার সন্তান হিসেবে কার্তিক ও গণেশের উল্লেখ যদিও পুরাণ ও মঙ্গলকাব্যে কিছু দেখা যায়, কিন্তু লক্ষ্মী বা সরস্বতীকে প্রকৃত প্রস্তাবে দেবী দুর্গারই বিবিধ রূপ বলা চলে। অথচ বাঙালি তাঁদেরও দুর্গার কন্যাসমা করে নিয়েছে অবলীলায়। নির্দিষ্ট সময়কাল বলা না গেলেও, এই রূপকল্প যে খুব বেশিদিনের ঘটনা নয়, তা অনুমেয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাগেশ্বরী অধ্যাপক কল্যাণকুমার দাশগুপ্তও ‘প্রতিমাশিল্পে হিন্দু দেবদেবী’ গ্রন্থে সে-কথাই বলছেন। ‘লক্ষ্মী সরস্বতী গণেশ কার্তিক সহ যে দশভুজা মহিষমর্দিনী-দুর্গার পূজা হয় বাংলার সর্বত্র, এবং বাংলার বাইরেও যেখানে বাঙালি আছেন, দেবীর সেই রূপকল্পনার প্রাচীনত্ব বেশিদূর টানা যায় না। বলতে গেলে এটি বাঙালি ভক্ত ও শিল্পীর একান্ত নিজস্ব মনোরচনা। আমার ধারণা দু-শো / আড়াইশো বছর আগে এই ধরনের রূপপ্রমূর্তির নিয়মিত পূজার্চনা শুরু হয়েছিল, যদিও ষোড়শ শতাব্দীর কবিকঙ্কণ মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল-এ সপরিবার অর্থাৎ লক্ষ্মী গণেশাদি সহ দশভুজা চণ্ডিকা বা অম্বিকা পূজার ইঙ্গিত আছে। অনির্ণীত রচনাকালের কালীবিলাসতন্ত্র-তে দেবীর আলোচ্য রূপভেদ আছে, কিন্তু কৃত্তিবাসের রামায়ণ (পঞ্চদশ শতাব্দী), মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল বা রঘুনন্দনের স্মৃতিনিবন্ধ (ষোড়শ শতকে)-তে তার কোনও বর্ণনা নেই, সেই ধরনের প্রতিমা (মৃন্ময়ী রূপে পূজার জন্য) সম্পর্কে কোনও উল্লেখও পাওয়া যায় না।’ অতিকল্পনা-প্রবণ বাঙালির এই মূলচ্যুতিকে অবশ্য কিছুটা আক্রমণই করছেন আর এক পণ্ডিত যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি। ‘পূজা-পার্বণ’ বইয়ে তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য – ‘বর্তমানে দুর্গাপ্রতিমার সহিত লক্ষ্মী সরস্বতী কার্তিক গণেশের প্রতিমাও সন্নিবিষ্ট হইতেছে। কিন্তু লক্ষ্মী সরস্বতী দুর্গারই শক্তি। সুতরাং তাঁহাদের প্রতিমা প্রদর্শনের হেতু নাই। কার্তিক গণেশ প্রতিমাও অকারণ আসিয়াছে। এই চারি প্রতিমা-সন্নিবেশ দ্বারা দুর্গার মহিমা খর্ব হইয়াছে। দুর্গা কুমারী। তাঁহার পুত্রকন্যা নাই। এই কারণে দুর্গাপূজায় কুমারী-পূজা বিহিত হইয়াছে। পুরাণে লক্ষ্মী সরস্বতী দুর্গার কন্যা নহেন। দুর্গা কার্তিক গণেশের মাতা হইতে পারেন না।’ বিশ শতকের মাঝামাঝির এই বইয়ে ‘বর্তমানে’-র প্রবণতা বলে ব্যক্ত করলেও ঠিক কোন সময় থেকে দুর্গার সঙ্গে জুড়ে গেল তাঁর পরিবার, সেই সময়কালের ধারণা এখানেও স্বচ্ছ নয়।
উনিশ শতকের শুরুর দিকের চিত্রাবলি ও বইপত্র ঘাঁটলেও এই রেফারেন্স খুব সহজলভ্য হবে না। ১৮৩২ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত হচ্ছে চার্লস কোলম্যানের ‘দ্য মাইথোলজি অব দ্য হিন্দুজ’। সে-বইয়ের শুরুতেই আর্টপ্লেটে ছাপা হচ্ছে দুর্গার ছবি। সঙ্গে কার্তিক ও গণেশ। কিন্তু লক্ষ্মী-সরস্বতী নেই। বইয়ের ভিতরে একটি লাইন ড্রয়িংয়ে পার্বতীর পাশে দেখা মিলছে তাঁদের। আর লক্ষ্মী প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে সেখানে লেখা হচ্ছে – ‘In fig. 2, plate 23, she is seen with Parvati and Suraswati, emblematical of the three sacred streams of the Gunga, Yamuna and Suraswati।’ অর্থাৎ সরাসরি সন্তান হিসেবে দেখার ব্যাপার সেখানেও নেই। ১৮৩০ থেকে ১৮৪০-এর মধ্যে আঁকা উইলিয়ম প্রিন্সেপের কলকাতার একটি বাড়িতে নাচ-গান-সহ দুর্গা পুজো উদ্যাপনের বিখ্যাত ছবিটি খুঁটিয়ে দেখলেও বোঝা যায়, সেখানে দুর্গা একা। ছেলে-মেয়ে নেই। আরও বেশ কয়েক বছর আগে, উনিশ শতকের প্রথম দশকে সেবক রামের পাটনা রীতিতে করা দুর্গাপুজোর পেন্টিং-এ অবশ্য কার্তিক-গণেশ রয়েছেন দুর্গার পাশে। আছেন দুই দেবীও। কিন্তু তাঁরা লক্ষ্মী-সরস্বতী না কি জয়া-বিজয়া, তা একেবারে নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। কার্তিক ও গণেশের সঙ্গে যথাক্রমে ময়ূর ও ইঁদুর থাকলেও দেবী মূর্তি দু-টির সঙ্গে কোনও বাহন নেই। এক জনের হাতে যদিও পদ্ম, কিন্তু তিনি দুর্গার বাম পাশে, কার্তিকের দিকে রয়েছেন – আজকের হিসেব মোতাবেক সাধারণত যেখানে সরস্বতীর থাকার কথা। অর্থাৎ, যদি ধরেও নিই এই ছবিতে লক্ষ্মী-সরস্বতীই রয়েছেন, তাহলেও এই অনুমান করা খুব ভুল হবে না যে তখনও দুর্গার পাশে তাঁদের অবস্থান একেবারে নির্দিষ্ট হয়ে ওঠেনি। কারণ উনিশ শতকের মধ্যভাগের ব্লকপ্রিন্ট বা কালীঘাটের পটের নানাবিধ নমুনায় মা দুর্গা ও তাঁর পরিবারকে আমাদের চেনা ছকেই দেখা যাচ্ছে।
বাঙালির বিশিষ্টতা হল এইখানেই যে, সে এই চেনা ছক ঘিরেই শুধু কল্পনার বৃত্ত টানেনি, তাকে অতিক্রম করেও এগিয়ে গিয়েছে। মা, মেয়ে হয়ে প্রেমিকা পর্যন্ত ভাবতে পেরেছে দেবীকে। ক্ষিতিমোহন সেন সেই অগ্রগতির একটি ছবি সংক্ষেপে দিয়েছেন – ‘প্রেমপথের পথিক বাংলার প্রাণের মধ্যে এমন একটা মানবীয় রস আছে যে, এই দেবী আদ্যাশক্তিকেও মাতারূপে কন্যারূপে এমন কি অর্ধকালী-লীলায় দেবীকে প্রণয়িনীরূপেও দেখে সে ধন্য হয়েছে।’ আরও পরে এই ঘটনাকেই খানিক এগিয়ে ফিকশনে ধরেছেন ব্যতিক্রমী লেখক কৃষ্ণগোপাল মল্লিক, ‘আমার প্রেমিকারা’ উপন্যাসে। ‘জোড়া ঢাক জোড়া কাঁসির উল্লাস গর্জনের মধ্যে দিয়ে, ধুনুচি নৃত্যের তাণ্ডবের পাশ দিয়ে, পঞ্চপ্রদীপের শিখার ওপর দিয়ে আমি এগিয়ে যাই ওর কাছে। এক পা শিবের পেটে আরেক পা শিয়ালের পিঠে দিয়ে আমি মুণ্ডমালায় চড়ে দাঁড়াই শ্যামার মুখোমুখি। বাঁ পায়ে জড়িয়ে ধরি ওর কোমর। কাঁধ ধরে চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে থাকি অনেকক্ষণ। তারপর আলতো করে দু’গাল দু’হাতে ধরি। নাকে নাক ঠেকাই, জিভের ডগায় জিভ। তিন চোখের পাতায় তিনটে চুমু খাই, চুমু খাই গলার ত্রিবলীরেখায়। ক্রমশ মিশে যাই শ্যামার ঘামতেল মাখা বুকের খাঁজে।’ কৃষ্ণগোপালের বর্ণনা ক্রমে আরও প্রকট হয়ে ওঠে।
আসলে বাঙালির হিন্দু দেবদেবীদের কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এক উদারমনস্ক আবহ। তা শরতের রোদের মতোই ঝলমলে। ধর্মীয় হলেও, তার বীজে ধর্মনিরপেক্ষতার অঙ্কুর। শুধু লক্ষ্মী-সরস্বতী-কার্তিক-গণেশই নন, তামাম দুনিয়ার উদ্ভিদ ও প্রাণিজগতকেও সে একই পরিবারের ছাতায় আঁটিয়ে নিতে চেয়েছে। দেবদেবীর বাহন, নবপত্রিকার পুজো কি এ সবেরই প্রতীক নয়? এই মহাজগতের সকল ফ্লোরা ও ফনা নিয়েই যেন তার বৃহত্তর সংসার। সাম্প্রতিক সময়ে সেই উদারমনস্কতাকেই নানা ভাবে আহত হতে দেখছি। ‘হিন্দু ধর্ম’ গ্রন্থের লেখক তো অবশ্য সেই কবেই আশঙ্কা করেছিলেন, ‘শাক্তভাবে বাংলাদেশ সকলকে একই জগজ্জননীর সন্তান বলে জানলে আজ আর হিংসা-বিদ্বেষের স্থান থাকবে কোথায়? মাকে মন্দিরে কয়েদ করে রাখলে বটে বাইরে এই মারামারি করা চলে। কিন্তু মাকে নিয়ে যে বাংলাদেশ ঘর করেছে। তবে এই মারামারির কি কোনও স্থান আছে?’ উৎসব আসছে। বাঙালির আকাশ কি আবার এক দিন শরতের রোদে ঝলমল করে উঠবে না!
দীর্ঘদিন সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত সুস্নাত এখন মুদ্রণশিল্পের ওপর মনযোগ দিয়েছেন। বোধশব্দ পত্রিকা ও প্রকাশনীর সম্পাদকের দায়িত্ব সামলে সময় পেলেই লেখালেখি করেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। বই প্রকাশের নানা দিক নিয়ে ওয়র্কশপ পরিচালনা করে থাকেন।