– তুমি যে অত ডেসপারেট সেটাই আমাকে ভীষণ টেনেছিল। কিন্তু আমার বোঝা উচিত ছিল যে এই ডেসপারেশন একটা ভেঙে যাওয়া প্রেম থেকেও আসতে পারে। তোমার বাড়ি, পরিস্থিতি ইত্যাদি দেখে আমার মনে হয়েছিল, তুমি বোধহয় ওই পরিবেশটা থেকে বেরতে চাইছ। বেরতে চাওয়ার পিছনে যে অন্য একটা মানুষ, একটা সম্পর্ক থাকতে পারে, আমি বুঝতে পারিনি। আমারই দোষ। 

স্মৃতিলেখা কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন। ঘটনাটা ঘটে যাওয়ার তিন ঘণ্টা পর। শাশুড়ির চোখে চোখ পড়ে যাওয়ার তিন সেকেন্ডের মধ্যে শাম্বর থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছিল অমৃতা। তবু সেই তিন সেকেন্ড যেন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পাপের মতো জেগে উঠেছিল ওর আর স্মৃতিলেখার সামনে। সেই মুহূর্তেই ঘর থেকে ছিটকে বেরিয়ে ও স্মৃতিলেখার পায়ের উপর পড়ে। কাঁদতে শুরু করে ডুকরে।

হতভম্ব শাম্ব ঘরের মাঝখানে একটা স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে থাকে, পূর্বাপর বুঝতে না পেরে। স্মৃতিলেখা সেদিকে তাকিয়ে খুব স্বাভাবিক গলায় বলেন যে এরকম সিনক্রিয়েট ওঁর একেবারে না-পছন্দ, অমৃতা যেন ভদ্রলোককে আগে বিদায় জানিয়ে এসে তারপর ওঁর সঙ্গে কথা বলে।

-চলে যাও, এক্ষুনি চলে যাও আমার বাড়ি থেকে। আর কোনওদিন কখনও আমার সামনে এস না। দয়া কর, আমার সংসারটা ভেঙে দিও না, তাহলে মরা ছাড়া অন্য গতি থাকবে না আমার। স্মৃতিলেখার পা থেকে উঠে গিয়ে পাগলের মতো চিৎকার করেছিল অমৃতা। 

-তুমিই তো বলেছিলে যে তিলে তিলে এই মরে যাওয়া আর সহ্য হচ্ছে না তোমার। আমি কাছে এলে, একটু সময় বেঁচে নেবে। 

-জড়িয়ে ধরতে, চুমু খেতে বলেছিলাম? এখন আমার শাশুড়ি যদি নিজের ছেলেকে বলে, তাড়িয়ে দেয় আমাকে বাড়ি থেকে, তুমি সঙ্গে করে কলকাতা নিয়ে যাবে? কথাগুলো বলার সময় অমৃতা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেছিল, স্মৃতিলেখা আস্তে আস্তে নিজের ঘরের দিকে চলে যাচ্ছেন। 

-তোমার কাছে আসতে হলে চুক্তিপত্রে সই করতে হবে, এমনটা তো জানা ছিল না। শাম্ব একটা ম্লান হাসি হাসল। তারপর দ্রুতপায়ে বেরিয়ে যাওয়ার দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। 

হয়তো ও আশা করেছিল, অমৃতা এসে দরজার লকটা খুলে দেবে। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরও যখন অমৃতা এক পা-ও এগিয়ে এল না, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেই লকটা খুলে ফেলল শাম্ব। আর অমৃতার ঘরে সদ্য লেখা পাণ্ডুলিপিটা ফেলে রেখেই চলে গেল, ঘর থেকে লিফটের দিকে। 

-বিয়ের আগে কতদিনের প্রেম ছিল তোমার এই ছেলেটার সঙ্গে? অমৃতা চুপ করে আছে দেখে, কফিতে শেষ চুমুকটা দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন স্মৃতিলেখা। 

-বছরখানেক মতো হবে। ওই চোদ্দো-পনেরো মাস।

-তা এই প্রেমটা থাকা সত্ত্বেও পলাশকে বিয়ে করার জন্য ক্ষেপে উঠেছিলে কেন?

-ক্ষেপে তো আপনার ছেলে উঠেছিল, আমাকে একবার দেখেই।

-সুন্দরী আবার একইসঙ্গে সেক্স-অ্যাপিলও আছে, এমন যে কাউকে দেখলেই আমার ছেলে খেপে উঠত। ও জৈবিক চাহিদার দ্বারা তাড়িত একজন পুরুষ, আমি মা হয়েই বলছি। কিন্তু তুমি তো ঠিক তেমন মেয়ে নও। তুমি তো প্রেম অনুভব করতে পার। সেই প্রেম যার প্রতি ছিল, যাকে বিয়ের দেড়বছর পরে বরের ট্যুরে যাওয়ার সুযোগে বেডরুমে বসে চুমু খেতে হচ্ছে, জীবনটা তার সঙ্গেই কাটালে না কেন?

-আপনি হয়তো বিশ্বাস করবেন না, কিন্তু সত্যিই আমি কোনও সুযোগ নিতে চাইনি। হ্যাঁ, শাম্ব ডাবিংয়ের কাজে বম্বে এসেছে শুনে ওকে আমিই আসতে বলেছিলাম বাড়িতে, কিন্তু কোনও ধান্দা যদি থাকত তাহলে তো ওর সঙ্গে বাইরেও মিট করতে পারতাম। বম্বেতে কি মেলামেশার জায়গার অভাব? একটা মাল্টিপ্লেক্সে ঢুকে গেলেই হত। আর তাছাড়া আপনি এখন এখানে আছেন, অন্য কিছু করার ইচ্ছে থাকলে এইসময়ই ওকে ডাকতাম কেন?  

অমৃতাকে খানিকটা চমকে দিয়েই স্মৃতিলেখা বললেন, ‘ডেকেছ, তাতেও কোনও মহাভারত অশুদ্ধ হয়নি। নারী-পুরুষ পরস্পরকে আদর করলে সেটা ‘ধান্দা’ বলেও মনে করি না। আমি যে কারণে দৃশ্যটা দেখে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম তা হল, তোমার আর আমার ছেলের বিয়েটা কি ওয়ার্ক করছে না? কিন্তু পলাশের সঙ্গে কথা বলে তো মনে হয়, ও বেশ খুশিই তোমাকে পেয়ে।’  

অমৃতা অল্প কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘আমাদের বিয়েটা ওয়ার্ক করেনি তা নয়। করেছে। ফিজিক্যালি ওয়ার্ক করেছে। পলাশের কাছে আমি সুঠাম একটা শরীর যাকে চাইলে দিনে তিন-চারবার ভোগ করা যায়।’ 

-ভোগ করা যায় মানে? তুমি এনজয় কর না ব্যাপারটা? 

– এনজয়? আমি? আমি তো অবজেক্ট। অবজেক্টরা এনজয় করে নাকি? আপনার ছেলে যেদিন আমায় প্রথম দেখতে এসেছিল, সেদিন আমার সঙ্গে আলাদা করে পাঁচমিনিট কথা বলার সুযোগ পেয়েই জিজ্ঞেস করেছিল, আমার ব্রায়ের সাইজ় কত? আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিলাম পুরো। চুপ করে ছিলাম। তখন বলেছিল যে আমার বুকগুলো ভরাট দেখে ওর খুব ভাল লেগেছে, তাই জিজ্ঞেস করছে। 

শাশুড়ির চোখে চোখ পড়ে যাওয়ার তিন সেকেন্ডের মধ্যে শাম্বর থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছিল অমৃতা। তবু সেই তিন সেকেন্ড যেন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পাপের মতো জেগে উঠেছিল ওর আর স্মৃতিলেখার সামনে। সেই মুহূর্তেই ঘর থেকে ছিটকে বেরিয়ে ও স্মৃতিলেখার পায়ের উপর পড়ে।

স্মৃতিলেখার মুখটা কেমন একটা ঘেন্নায় কুঁচকে উঠল, ‘এই কথাটা যে প্রথম দিনেই জিজ্ঞেস করতে পারে, তাকে তোমার বিয়ে করার যোগ্য বলে মনে হল? গালে একটা চড় মেরে বের করে দিতে পারলে না বাড়ি থেকে?’ 

-আপনিও তো গিয়েছিলেন সঙ্গে…

-আমি গিয়েছিলাম তাতে কী? আমার সামনে এসে বলতে, যে আপনার ছেলে এই কথা বলেছে বলে ওকে চড়িয়ে তাড়িয়ে দিয়েছি। আমি খুশি হয়ে আদর করে দিতাম তোমায়। 

-বলা সহজ। আসলে তখন আমার এমন অবস্থা, যে যার মুখ দেখব তাকেই… 

-বাজে বোকো না অমৃতা। তোমার মতো সুন্দরীর পাত্রের অভাব হত না কখনই। তুমি আসলে লোভে পড়ে গিয়েছিলে। পলাশের মোটা মাইনে, দু’ দুটো গাড়ি, ভিলে পারলেতে কোম্পানির দেওয়া মস্ত ফ্ল্যাট, তোমার চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিল।

ওইরকম অবস্থায়ও অমৃতা হেসে ফেলল কথাগুলো শুনতে শুনতে। 

-হাসছ কেন? 

-হাসব না? আচ্ছা আমি কি বম্বে জীবনে এসেছি তখনও যে ভিলে পারলে, গোরেগাঁও, দাদার আর মালাডের তফাত বুঝব? হ্যাঁ, বড় চাকরি করে সেটা অবশ্যই মাথায় ছিল। তাই বলে যে প্রথম দেখায় ওরকম একটা জিনিস জানতে চায়, তাকে কোনও সুস্থ মেয়ে বিয়ে করতে পারে না। 

-তুমি করলে কেন?

– যে একবছরের উপরে পাশে পাশে ঘুরে বিয়ের বেলায় দায়িত্ব নিতে অক্ষম, তার প্রতি একটা অন্ধ রাগ আমায় দিয়ে যা নয় তাই করিয়েছে। আর রাগে যে অন্ধ, সে তো অসুস্থই।

-বিয়েটা হওয়ার আগে তোমার এক্সকে জানাওনি?

-ও নিজেই জানতে পেরেছিল। জানতে পেরে আটকানোর চেষ্টাও করেছিল অল্পস্বল্প। তারপর একদিন বিয়ের টুকিটাকি বাজার সেরে ফেরার পথে একটু নন্দন চত্বরে গেছি একজন বন্ধুর সঙ্গে, শাম্ব এসে পথ আটকাল। 

-সেদিন প্যাচ-আপ হল না কেন?

-হবে কী করে? ও তো সেই ধরি মাছ না-ছুঁই পানির খেলা খেলতে এসেছিল। যদি বলত যে তখনই কালীঘাটে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করবে আমায়, জানি না কী উত্তর দিতাম। কিন্তু শাম্ব তো একটা ফানুস তৈরি করতে এসেছিল, স্বপ্ন আর মিথ্যার ফানুস। যাচ্ছেতাই অপমান করেছিলাম তাই। 

-কিন্তু করার পরে মনে নিশ্চয়ই মনে একটা জ্বালা হচ্ছিল, নয়তো আজ আবার ওকে ডাকবে কেন?

– বিয়ের পর সবকিছু ভুলে আমি পলাশের সঙ্গেই সংসার করতে চেয়েছিলাম। আজও চাই। কিন্তু ও যে আমায় পুরো মানুষ বলেই মনে করে না। আমি ওর খাই মেটাবার একটা যন্ত্র মাত্র। ওর প্রায় সবসময় অ্যাক্টিভ শরীরের আগুনে আমি হলাম গিয়ে শুকনো কাঠ। 

– এভাবে কি একটা মানুষ বাঁচতে পারে?

-জানি না পারে কিনা। বাঁচতে চাইও না এক-একসময়। সারা শরীরটা কেমন ঘিনঘিন করে। মনে হয় আপনার ছেলের অসহ্য লোভ যেন চটচট করছে সর্বাঙ্গে। মাকড়সার লালার মতো। হাজারবার স্নান করলেও যাবে না। 

-পুরোনো প্রেমটা ফিরে এলে তো যেতে পারে? অমৃতাকে অবাক করে দিয়ে স্মৃতিলেখা বললেন। 

-মানে?

-মানে, ওই তোমার শাম্ব এখন তো কাজ-টাজ করে। কিছু তো রোজগার আছে। এখন তোমাকে পেলে পরে… 

-আপনি কি চাইছেন বলুন তো মা? আমাকে তাড়িয়ে দিয়ে আপনার ছেলের আবার বিয়ে দিতে? 

-তোমার কি মনে হয় যে পলাশ একদিনও মেয়ে না নিয়ে শোওয়ার ছেলে? তুমি চলে গেলে, অন্য কাউকে ধরে আনবে ও। সে আনুক। কিন্তু এবারে যেন একটা মনহীন মেয়েকে ধরে আনে। তোমার এই কষ্টটা আমার সহ্য হচ্ছে না। 

শাম্ব ডাবিংয়ের কাজে বম্বে এসেছে শুনে ওকে আমিই আসতে বলেছিলাম বাড়িতে, কিন্তু কোনও ধান্দা যদি থাকত তাহলে তো ওর সঙ্গে বাইরেও মিট করতে পারতাম। বম্বেতে কি মেলামেশার জায়গার অভাব? একটা মাল্টিপ্লেক্সে ঢুকে গেলেই হত।

অমৃতা কেমন যেন একটু ধন্দে পড়ে গেল। যে কাজের জন্য শাশুড়ির চরমতম তিরস্কারের সম্মুখীন হবে ভেবেছিল, স্মৃতিলেখা যেন সেই কাজটাই ঘুরিয়ে সমর্থন করছেন। কী উদ্দেশ্য ওঁর? অমৃতা এই ফ্ল্যাট ছেড়ে চলে গেলে, ওঁর কী সুবিধা? 

-আপনি অত চিন্তা করবেন না। সব মেয়েকেই কিছু না কিছু কম্প্রোমাইজ করতেই হয়, আমিও করছি। ওইটুকু বাদ দিলে, আপনার ছেলে তো ভালই, আমার খাওয়াপরার যত্ন নেয়। 

-মানে, শুয়োরটাকে খাইয়ে দাইয়ে স্বাস্থ্যবতী করে, যাতে ওকে ছিঁড়ে-কামড়ে খেতে পারে। 

-মা! 

-ভুল কী বললাম? কিন্তু আসল ভুল কোথায় জানো? তোমরা এই লোলুপ লোকগুলোকে মেনে নাও, প্রতিবাদ কর না। যদি করতে তাহলে… 

-আপনিই বা একটা দশবছরের বাপ-মরা ছেলেকে এমনভাবে মানুষ করেননি কেন যাতে সে একটা মেয়েকে, নিজের স্ত্রীকে আর একটু সম্মান করে?

-চেষ্টা যে করিনি তা নয়, কিন্তু স্যাক্সোফোন থেকে বাঁশির আওয়াজ তো বেরোয় না, তাই না?  

-একটু বুঝিয়ে বলুন। 

-বোঝানোর কিছু নেই। তুমি পলাশকে ডিভোর্স করে শাম্বর কাছে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা কর। আফটার অল, ছেলেটা শিল্পী। তোমাকে আরাম না দিক, আকাশটুকু দেবে। 

স্মৃতিলেখার বৈপ্লবিক কথাবার্তা ঠিক ভাল লাগছিল না অমৃতার। ও বিছানা থেকে উঠে গিয়ে জানলার সামনে দাঁড়াল। ভিলে পারলেতে পনেরোশো স্কোয়ার ফিটের এই ফ্ল্যাটটার দাম কম সে কম আট-দশ কোটি টাকা। মাসের ভাড়াই একলাখ টাকার উপরে হবে। এর প্রত্যেকটা জানলা দিয়ে বাইরে তাকালে অপূর্ব ভিউ পাওয়া যায় মুম্বই শহরের। চব্বিশ ঘণ্টা একটা গাড়ি নীচের গ্যারাজে থাকে অমৃতার ব্যবহারের জন্য। রাত্রে নটায় বাড়ি ফিরেই পলাশ একবার ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর উপর। ঘুমনোর আগে আরও একবার। প্রায় রোজই।

সেই সময়টা এক-এক সময় দম আটকে আসে অমৃতার, প্রবল চটকাচটকিতে। কিন্তু সেই সঙ্গম বা আখমাড়াই কতক্ষণ? এক থেকে দেড়ঘণ্টা ম্যাক্সিমাম, ওটুকু পেয়ে গেলে তো আর কোনও দাবি নেই পলাশের। কেবল রাতের ডিনার, সকালের ব্রেকফস্টের বন্দোবস্ত করা, জামা-প্যান্ট-টাই একটু গুছিয়ে রাখা। এত এত আরামে থাকার বিনিময়ে কোন হাউজ ওয়াইফ না করত সেটুকু?

-কী এত ভাবছ বল তো? স্মৃতিলেখা বলে ওঠেন। 

-আমি প্রতিজ্ঞা করছি মা, আজ যা হয়েছে তা আর কখনও হবে না। আমি ভুল করেছি, ভুল। আর ভুলের কোনও অজুহাত হয় না। এই যে পলাশের বাবার ছবি দেওয়ালে, আমি আমার শ্বশুরমশাইয়ের পায়ে হাত দিয়ে প্রতিজ্ঞা করছি, শাম্বকে আর কখনও এই বাড়ির চৌকাঠ পেরতে দেব না। কত লোক তো কত কিছু মেনে নিয়ে সংসার করে। আমি নয় এটুকু মেনেই নিলাম। প্লিজ় আজকের ব্যাপারটা নিয়ে পলাশকে কিছু বলবেন না। 

বলতে বলতে আবার নিচু হয়ে স্মৃতিলেখার পা ছোঁয় অমৃতা। আর স্মৃতিলেখা ওকে পিঠে হাত দিয়ে তুলে দিতে যেতে, ব্যথায় আওয়াজ করে ওঠে। 

-কী হল, অমন আওয়াজ করলে কেন? বলতে বলতে অমৃতার পিঠে ফের হাত দিলেন স্মৃতিলেখা। 

অমৃতা কেমন যেন একটু ধন্দে পড়ে গেল। যে কাজের জন্য শাশুড়ির চরমতম তিরস্কারের সম্মুখীন হবে ভেবেছিল, স্মৃতিলেখা যেন সেই কাজটাই ঘুরিয়ে সমর্থন করছেন। কী উদ্দেশ্য ওঁর? অমৃতা এই ফ্ল্যাট ছেড়ে চলে গেলে, ওঁর কী সুবিধা? 

আবারও ব্যথায় ককিয়ে উঠল অমৃতা। 

-পলাশ তোমাকে মারেও তাহলে? 

-সবসময় নয়। ওকে প্লিজ় করার জন্য, ও যা যা করতে বলে, সবটা করে উঠতে পারি না যখন, তখন।    

– মার খাওয়ার পরও এই সংসারেই থাকতে চাও?

অমৃতা মাথা নিচু করে বলে, প্রতিজ্ঞা করলাম তো আপনার স্বামীর ছবি ছুঁয়ে।  

কথাটা বলে মুখ তুলতেই স্মৃতিলেখা ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিলেন অমৃতার গালে। অমৃতা হতবাক হয়ে গিয়ে তাকাল নিজের শাশুড়ির দিকে। কিছু বলতে পারল না।

স্মৃতিলেখাকে খাবার দিয়ে নিজের ঘরে চলে এসেছিল অমৃতা। কিছুক্ষণ পর স্মৃতিলেখাই নক পর্যন্ত না করে ওর ঘরে ঢুকে বিছানায় বসে বললেন, কেন চড়টা মারলাম জানতে চাইবে না?

-কী হবে জেনে! অমৃতা দাঁত দিয়ে ঠোঁট চাপল। 

-আচ্ছা জেন না তবে। কিন্তু আমি বম্বেতে কেন এসেছি সেটা জানো তো? 

-আপনার ছেলের বাড়ি, আপনি আসতেই পারেন। 

-ও তার মানে পলাশ জানায়নি তোমাকে।  

-কী জানাবে? 

-আমার ক্যানস্যার ডিটেকটেড হয়েছে অমৃতা। কলকাতার ডাক্তাররা সন্দেহ করছেন যে মেটাস্টেসিস শুরু হয়ে গেছে। আমি সেই সংক্রান্ত কতকগুলো পরীক্ষা করাতেই বম্বে এসেছি। পলাশ পরশু ফিরে আমায় নিয়ে হসপিটালে যাবে, তেমনটাই কথা। 

-কী বলছেন আপনি? ও তো আমাকে একবারও… 

-তোমাদের মধ্যে তো কথা হয় না, শুধু কাজ হয়। বলবে কীভাবে? স্মৃতিলেখা হেসে উঠলেন। অমৃতা লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলল। 

-একদম ডিটো বাবার চরিত্র পেয়েছে পলাশ। ওর বাবাও যতদিন বেঁচেছিল, আমাকে একটা শরীরের বেশি কিছু ভাবতে পারেনি। ভেবেছিলাম, আমার সংস্পর্শে ছেলেটা হয়তো অন্যরকম হবে, কিন্তু আমড়া গাছের বীজে আম হয় থোড়াই। 

-আপনিও মেনে নিতেন?

– আরও পঁচিশ-তিরিশ বছর আগের কথা সেটা। মেনে না নিয়ে উপায় ছিল কিছু? তখন তো মোবাইলও ছিল না যে মারলে-ধরলে রেকর্ড করে রাখব। তোমাদের তাও সেই সুবিধাটুকু আছে। 

ভিলে পারলেতে পনেরোশো স্কোয়ার ফিটের এই ফ্ল্যাটটার দাম কম সে কম আট-দশ কোটি টাকা। মাসের ভাড়াই একলাখ টাকার উপরে হবে। এর প্রত্যেকটা জানলা দিয়ে বাইরে তাকালে অপূর্ব ভিউ পাওয়া যায় মুম্বই শহরের। চব্বিশ ঘণ্টা একটা গাড়ি নীচের গ্যারাজে থাকে অমৃতার ব্যবহারের জন্য।

-কী করব, রেকর্ড করে? ফেসবুকে আপলোড করে লোককে শোনাব যে আমার বর কতটা বর্বর? কী লাভ তাতে? চুকচুক করে সিম্প্যাথি জানাবে কয়েকজন; তারপর তাদের মধ্যে যারা মেয়ে তারা বেশিরভাগ ব্যাপারটা নিয়ে খিল্লি করবে আর যারা ছেলে তারা দুঃখ ভাগ করে নেবার ছলে শুতে চাইবে।

-ওই শাম্বও কি শুতেই এসেছিল নাকি? আমি দেখে ফেললাম বলে মাঝপথে কেঁচে গেল ? 

-না, শাম্ব সেরকম ছেলে নয়। হয়তো আবেগপ্রবণ হয়ে গিয়ে আদর করে ফেলেছে। কিন্তু শোওয়ার ধান্দা নিয়ে ও আসেনি আমার কাছে। শুতে চাইলে তো যখন আমরা রিলেশনে ছিলাম, তখনই চাইতে পারত। আমি বাধাও দিতাম না। 

-এই দ্যাখো, তোমার মনে তো দিব্যি প্রেম আছে, ছেলেটার প্রতি! 

-থাকলে পরে কী করব মা? মনের ওপর তো হাত নেই। 

-হক কথা। মনের উপর হাত ছিল না বলেই তো সলিলদাকে ভালবেসে ফেলেছিলাম। 

-কী বলছেন?  

-কেন তুমি বুঝতে পারছ না? তোমার মতো ডানাকাটা পরী হতে না পারি, কিন্তু যৌবনে আমাকেও দেখতে খারাপ ছিল না। আর সলিলদার মুগ্ধতা সেই কথাটাই জানান দিয়ে যেত আমায়, বারবার। 

-আপনি পরকীয়া করতেন?

-ভালবাসতাম। কারণ আমার স্বামীও তোমার স্বামীর মতোই শুধু একটা মাংসের দলাই ভাবতেন আমায়।  

– মাথা কীরকম ঘুরছে। বলতে বলতে স্মৃতিলেখার আর একটু কাছ ঘেঁষে বসল অমৃতা। স্মৃতিলেখা বলে চললেন…

– তখন আমরা দিল্লিতে থাকি। আর যে অঞ্চলটায় বাস, সেখানে বাঙালি প্রায় ছিলই না। আমরা থাকতাম একটা তিনতলা ফ্ল্যাটের ফার্স্ট ফ্লোরে, আমাদের ওপরে থাকত একটা শিখ পরিবার।ব্যস, এছাড়া কোনও মানুষ ছিল না গোটা বাড়িতে। একদিন সামনের দোকান থেকে কয়েকটা জিনিস নিয়ে ফিরছি, একটা লোক সামনে এসে দাঁড়াল।   

-আমায় চিনতে পারছ ঝুমি?

-আমি দু’দিকে মাথা নেড়ে ‘না’ বলার সময় ভাবলাম, লোকটা আমার ডাকনাম জানল কোত্থেকে?  

– আমি তোমার বন্ধু গোপার মামাতো দাদা, সলিল। গোপার বাসরে তুমি যখন গাইছিলে, আমি তবলা বাজাচ্ছিলাম, মনে পড়ছে না? 

দশবছর আগে গোপার বাসরে কয়েক ঘণ্টা যাকে দেখেছি তার মুখ মনে রাখা কি সম্ভব? কিন্তু সলিলদার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু আলাদাই ছিল কারণ অষ্টমঙ্গলায় বাড়ি ফিরলে আমি যখন দেখা করতে গিয়েছিলাম, গোপা আমায় একটা চিঠি ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল যে ওর মামাতো দাদা আমার প্রেমে পড়েছে।

-কী রোম্যান্টিক ছিল সেই সময়টা। তা কী লেখা ছিল সেই চিঠিতে? 

-জানি না। কারণ সেই চিঠিটা না পড়েই ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে দিয়েছিলাম। আসলে তখন বিয়ে প্রায় ঠিক হয়ে গেছে আমার, তাই একটা তবলচির জন্য কোনও আগ্রহ ছিল না মনে। অথচ দশ বছর পর দিল্লির রাস্তায় যখন দেখা হল তখন ওই সলিলদাকেই আমার যেন খড়কুটোর মতো মনে হল। যা ধরে একটা ডুবন্ত মানুষ ভেসে উঠতে পারে। 

-তারপর? অমৃতা গল্পটার সঙ্গে জড়িয়ে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করল। 

-তারপর সলিলদার সূত্রে দিল্লির এদিক ওদিক দু-তিনটে ফাংশানে গাইতে যাওয়া আর প্রতিবারই ফিরে এসে প্রিয়তোষের হাতে বেধড়ক মার খাওয়া। একদিন তো আমার বারণ না মেনে বাড়িতে চলে আসা সলিলদাকে অকথ্য অপমান করে তাড়িয়ে দিল। এও বলল যে আর কোনওদিন ওই চত্বরে দেখলে, পুলিশ ডেকে ধরিয়ে দেবে। কিন্তু তাতেও আমার আর সলিলদার যোগাযোগ বন্ধ করতে পারেনি। 

শাম্ব সেরকম ছেলে নয়। হয়তো আবেগপ্রবণ হয়ে গিয়ে আদর করে ফেলেছে। কিন্তু শোওয়ার ধান্দা নিয়ে ও আসেনি আমার কাছে। শুতে চাইলে তো যখন আমরা রিলেশনে ছিলাম, তখনই চাইতে পারত। আমি বাধাও দিতাম না। 

-আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। তখন তো মোবাইলও হয়নি।যোগাযোগ রাখতেন কীভাবে? 

– সে সব বললে তুমি হাসবে। 

-হাসলে হাসব, আপনি প্লিজ বলুন। 

-একবার তো মাথায় গামছা বেঁধে সবজিওয়ালা সেজে সলিলদা আমার ফ্ল্যাটের সামনে হাঁক দিচ্ছিল। কিন্তু এমনই ক্যালাস লোক যে ‘লওকি’ না বলে “লাউ চাহিয়ে” বলে চেঁচাচ্ছিল। আমি শিগগির নিচে নেমে গিয়ে ডায়ালগ ঠিক করে দিই ওর। 

-কী করতেন ভদ্রলোক এমনিতে?

-বিশেষ কিছু না। একাত্তরের যুদ্ধের সময় পড়াশোনা ইনকমপ্লিট রেখে কলকাতায় পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিল। তারপর আর দেশে ফিরে যায়নি। কোনও এক আত্মীয়ের সূত্রে দিল্লির একটা হসপিটালে চাকরি পেয়ে চলে এসেছিল। থাকত আমার বাড়ির ঠিক দুটো গলি পিছনে, একটা এককামরার ঘরে। অধিকাংশ দিনই নাইট ডিউটি থাকত বলে, বেলার দিকে একটা ট্রাই নিত আমায় দেখার। কোনওদিন সফল হত, কোনওদিন হত না। 

-পলাশের বাবা সন্দেহ করত না? বিশেষত যেদিন বাড়িতে দেখেছিল তারপর থেকে? 

-এমনই সাদামাটা চেহারা ছিল সলিলদার, যে ওই সন্দেহটা করেনি প্রথম-প্রথম। তাড়িয়ে দিলেও, ভেবেছিল ফালতু লোক। ও বরং সন্দেহ করত আমার ঠিক পিছনের ফ্ল্যাটে একটা খুব হ্যান্ডসাম শিখ ছেলে থাকত, তাকে। তার ভয়েই উত্তরদিকের ঘরের জানলাদুটো বন্ধ করে রাখত। কখনও আমি খুলেছি টের পেলে ভয়ানক রেগে যেত। ওই শিখ ছেলেটার জন্যই অতটা নজর পড়েনি সলিলদার উপর।

-পলাশের ভূমিকা কীরকম ছিল সেই সময়টায়? মায়ের পক্ষে না বিপক্ষে? 

-পলাশকে তো ক্লাস থ্রি-তে উঠতে না উঠতে শিমলার বোর্ডিংয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিল, বাচ্চার ঝক্কিতে জীবন উপভোগে বাধা পড়ে যাচ্ছিল তাই। অথচ আমার একটা মেয়ের খুব শখ ছিল জানো।

-নিলেন না কেন? 

-নিতে দিলে তো? কনসিভও করে ফেলেছিলাম একবার। জোর-জবরদস্তি একটা ক্লিনিকে নিয়ে গিয়ে অ্যাবরশন করিয়ে আনল। আবার বাচ্চা হলে ফিগার নষ্ট হয়ে যাবে। বাবুর ফুর্তিতে বাধা পড়বে।তাই। বাই দ্য ওয়ে, পলাশ বাচ্চা চায়?

-না, এখনই নয়। ওরও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একই কথা। বাচ্চা হলে শরীরের অ্যাসেটগুলো নষ্ট হয়ে যাবে… 

-বাপের জিন একেবারে কথা বলে আমার ছেলের মধ্যে।  

-বাদ দিন। আপনি সলিলদার কথা বলুন।

-সলিল তোমারও দাদা? স্মৃতিলেখা হেসে ফেললেন। হাসতে হাসতেই চোখের জল মুছে বললেন, আমারও পাগল-পাগল লাগত দিনরাত ওই বলির পাঁঠা হয়ে বেঁচে থাকতে। তার মধ্যে যেদিন সলিলদাকে একবার দেখতে পেতাম, কিংবা নিদেনপক্ষে ওর গলাটা শুনতে পেতাম, পাবলিক বুথ থেকে ফোন করলে, একটু শান্তি মিলত। তবে সেও তো আর বেশিদিন কপালে ছিল না। 

-কেন? 

-পলাশ মাঝেমধ্যে ট্যুরে গেলে তুমি স্বস্তি পাও, আমার ভাগ্যে সেটুকুও ছিল না। তবু গিয়েছিল দু’দিনের জন্য একটা কনফারেন্সে আর সেই সময়ই একদিন সলিলদাকে বাড়িতে ডেকে এনে… 

-সেক্স? পুরোটা? অমৃতা নিজের শাশুড়ির হাঁটুটা চেপে ধরল। 

-আরে না রে পাগলি। আমাদের অত সাহস ছিল না। ফাঁকা বাড়িতেও না। তবে একটা চুমু খেয়েছিল সলিলদা আমায়। সেও কি ছাই খেতে জানত ঠিকঠাক! 

-পুওর ব্যাচেলর একদম! 

-পুওর বলে পুওর? খেতে পেত না ভাল করে, বাড়িতে ভাইবোনদের টাকা পাঠিয়ে। আমি ওই একদিনই ওকে খুব যত্ন করে খাওয়াতে পেরেছিলাম সামনে বসিয়ে। মাছের মাথা দিয়ে মুগডাল, খাসির মাংস, ভাপা ইলিশ। দিল্লিতে ইলিশ মাছ পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিল পুরো। দেশে থাকতে চাঁদপুরে গিয়ে কতবড় সাইজের মাছ খেয়েছে, তাই বলছিল শুধু। নয় নয় করে তিনটুকরো মাছ খেয়েছিল সেদিন। আমি আর এক টুকরো খাওয়ার কথা বলতে, রুমালে বেঁধে দিতে বলেছিল, পরদিন খাবে বলে। 

-দেননি?

-দিয়েছিলাম কিন্তু ওর বাড়িতে তো ফ্রিজ ছিল না। তাই পচে গিয়েছিল মাছ দুটো। সেই পচা মাছ দিয়েই সাপটে ভাত খেয়েছে এমনটাই দাবি করছিল ভূতটা  আমার খোঁপায় ফুল পরাতে পরাতে। 

-খোঁপায় ফুল? এ তো পুরো ‘হারানো সুর’। 

স্মৃতিলেখা লজ্জা পেয়ে গেলেন। 

-অত কিছু না। সেদিন আসলে দিল্লির একটা অভিজাত বাঙালি ক্লাবে আমার গাওয়ার ব্যবস্থা করেছিল সলিলদা। কিন্তু সেই ক্লাবের মেকশিফট গ্রিনরুমে ওর আমাকে পরিয়ে দেওয়া জুঁইফুলের মালার গন্ধ যে রয়টার্স মারফৎ প্রিয়তোষের নাকে পৌঁছবে, কে জানত।

এমনই সাদামাটা চেহারা ছিল সলিলদার, যে ওই সন্দেহটা করেনি প্রথম-প্রথম। তাড়িয়ে দিলেও, ভেবেছিল ফালতু লোক। ও বরং সন্দেহ করত আমার ঠিক পিছনের ফ্ল্যাটে একটা খুব হ্যান্ডসাম শিখ ছেলে থাকত, তাকে। তার ভয়েই উত্তরদিকের ঘরের জানলাদুটো বন্ধ করে রাখত।

-কী করল শুনে?

-মেরে আমার নাক ফাটিয়ে দিল। চোখে কালশিটে ফেলে দিল। ঘুসির পর ঘুসি মারতে থাকল। তবে সেদিনই নয়। দু’দিন পর একটা শনিবার রাতে। দুপুরে আমায় ছিবড়ে করে, বিকেল হতেই বেরিয়ে গিয়েছিল প্রিয়তোষ। রাত্রি প্রায় সাড়ে নটা নাগাদ যখন ওর নিজস্ব কায়দায় বেল দিল, আমি দরজা খুলতেই দেখি, সলিলদা কাঁচুমাচু মুখে ওর পাশে দাঁড়িয়ে।

-মাই গড!

-তোমার গান শুনব বলে আজ তবলচিবাবুকে ধরে আনলাম। বুধবারের প্রোগ্রামটার ব্যবস্থা উনিই করে দিয়েছেন শুনলাম। যোগাযোগ তলে তলে ভালই আছে তাহলে।

-যোগাযোগের কিছু নেই। ওরা একজন গায়িকা চাইছিল বলে সলিলদা আমার কথা বলেছিল। 

-ভাল তো। তা তুমি একটু চা খাইয়ে ঋণ শোধ কর। যাও। 

-তারপর?

-আমি প্রায় কাঁপতে কাঁপতে দু’কাপ চা নিয়ে কিচেন থেকে ড্রয়িংরুমে ফিরতেই শুনি প্রিয়তোষ বলছে, আমার বউয়ের খোঁপায় ফুলটাও কি ওরা চাইছিল বলেই? 

-কী বলছেন এসব? সলিলদা ভাঙা গলায় বলল। 

-যা ঘটেছে তাই বলছি। আমার গুপ্তচর সর্বত্র ছড়ানো। বলেই নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে প্রিয়তোষ ঠাস ঠাস করে দুটো চড় মারল সলিলদার গালে। 

-আপনি কিছু বললেন না?

-চা টেবিলে রেখে বাধা দিতে গিয়েই তো মার খেলাম। নাক দিয়ে, কান দিয়ে দরদরিয়ে রক্ত পড়ছে, একটা চোখে দেখতে পাচ্ছি না প্রায়, তাও দেখলাম যে মেঝেতে পড়ে যাওয়া সলিলদার বুকের উপরে উঠে বসে লোকটার গলা টিপে ধরেছে প্রিয়তোষ। 

-মাগো!

-মাগো-বাবাগো করার সময় ছিল না তখন। সলিলদার মুখ দেখে বুঝতে পারছিলাম যে লোকটা মরে যাবে আধমিনিটের মধ্যে। আমার হাতে তখন তিরিশ সেকেন্ড সময় আর সারা মুখ রক্তে ভেজা। কীভাবে আটকাই, কীভাবে? এদিক ওদিক হাতড়াতে হাতড়াতে হাতে লেগে গেল একটা হাতুড়ি। আর আমি শরীরের সবটুকু জোর দিয়ে সেটাকে আঁকড়ে ধরে হাওয়ায় তুললাম, প্রিয়তোষের পিছনে দাঁড়িয়ে। সলিলদার তখন জিভ বেরিয়ে গেছে প্রায়।

– এ তো প্রায়, ‘মার্ডার’ সিনেমার কাছাকাছি ঘটনা। 

-কিন্তু প্রিয়তোষ মরেনি। ব্রেন হেমারেজ হয়ে কোমায় চলে গিয়েছিল। প্রায় দু’বছর বেঁচেছিল ওই অবস্থায়। আর তখন একটা রোবটের মতো দিনরাত ওর সেবা করেছি বলে গ্লানি কমে গিয়েছিল অনেকটা।  

-পুলিশ ধরতে পারেনি?

-না। আমার ওই রক্তাক্ত ঠোঁট-নাক ফেটে যাওয়া মুখ দেখে ডাকাত আসার গল্পটা অবিশ্বাস করতে পারেনি। 

-কিন্তু যদি জ্ঞান ফিরে আসত পলাশের বাবার? 

-তাহলে সব স্বীকার করে জেলে চলে যেতাম। তাই বলে সলিলদাকে ওভাবে মরতে দিতে পারতাম না। 

-সে কী করল, ঘটনাটার পর?

-কাঁপছিল থরথর করে। সব হারিয়েও ভিতুরা যেমন কাঁপে। আমি ওর হাতে হাতুড়িটা দিয়ে ইহজীবনের মতো চলে যেতে বলেছিলাম, আমার সামনে থেকে।

-চলে গেল?

-যেতেই চাইছিল ভিতর ভিতর। অতটা চাপ নেওয়ার ক্ষমতা ছিল না।

-তারপর থেকে, আপনি পুরো একা…

-প্রিয়তোষের কোম্পানি ঢেলে টাকা দিয়েছিল। অভাবটা ফেস করতে হয়নি তাই। সারাজীবন বাপের বাড়ি এবং শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের প্রচুর সিমপ্যাথিও পেয়েছি। কলকাতায় ফিরে এসে স্কুলের প্রিন্সিপ্যালের চাকরিটা সেই সূত্রেই। তবে ছেলেকে মানুষ করতে পারিনি। সেটাই দুঃখ। 

– আচ্ছা আমাকে যা যা বললেন, আমি যদি চাউর করে দিই?

-দিলেও ক্ষতি বিশেষ নেই, প্রমাণ করবে কীভাবে?আর প্রমাণ হলেও আমি আছি আর কতদিন? তাই, আমার কথা বাদ দাও। তুমি নতুনভাবে বাঁচ। আমার নিজের জমানো টাকা, সলিলদার মৃত্যুর পর অজানা সব পলিসির নমিনি হয়ে পাওয়া টাকা, আমার বাবার থেকে পাওয়া ফ্ল্যাট, সব তোমার নামে করে দেব আমি। তুমি সংসার কর শাম্বর সঙ্গে। 

– নিজের ছেলের ক্ষতি করে কেন এতটা করবেন আপনি আমার জন্য? আপনি কি ভগবান?

-ভগবান নই, কিন্তু আমি একজন মা। আমি চাই না ,আমার হাজব্যান্ডের যে পরিণতি হয়েছিল, আমার ছেলেরও তাই হোক। 

-অসম্ভব। আমি কখনই আপনার মতো…

আমি ওই একদিনই ওকে খুব যত্ন করে খাওয়াতে পেরেছিলাম সামনে বসিয়ে। মাছের মাথা দিয়ে মুগডাল, খাসির মাংস, ভাপা ইলিশ। দিল্লিতে ইলিশ মাছ পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিল পুরো। দেশে থাকতে চাঁদপুরে গিয়ে কতবড় সাইজের মাছ খেয়েছে, তাই বলছিল শুধু।

-কোন পরিস্থিতিতে মানুষ কী করে, আমরা জানি না অমৃতা। তাই সেই পরিস্থিতি না আসতে দেওয়াই শ্রেয়। আমার ক্ষেত্রে সাপোর্ট দেবার কেউ ছিল না, তোমার ক্ষেত্রে আমি আছি। আর আমার বিশ্বাস, এতেই তোমার, শাম্বর এবং পলাশেরও ভালই হবে। 

-কিন্তু পলাশ আমায় ডিভোর্স দেবে কেন?

-আমি তোমায় অন্যের সঙ্গে শুতে দেখে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছি, শুনলেই দেবে। খানিকটা আতাম-বাতাম করবে, কিন্তু দেবে। বিশেষ করে খোরপোশ ছাড়াই যদি কেস মিটে যায়। 

-আর আমার যদি আপনাকে ছেড়ে যেতে মন না করে? কান্নায় গলা ধরে এল অমৃতার।

-পরজন্ম মানলে বলতাম, তোমার পেটে আসব, মেয়ে হয়ে। এখন বলছি, সলিলদা আর আমি বছরে যে দুটো করে চিঠি দিতাম পরস্পরকে, সেগুলো তোমার কাছে দিয়ে যাব। ওই অক্ষরগুলোতেই আমাকে পাবে, প্রেমহীন খাঁচা থেকে পালিয়ে ধোঁয়া-ধুলোর আকাশে উড়ে বেড়ানোর সাহস পাবে। 

উত্তর দিতে গিয়ে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল অমৃতা। স্মৃতিলেখা ছেলের বউয়ের মাথাটা নিজের কোলে নিয়ে বললেন, 

– স্টপ ক্রাইং। শাম্বর নাম্বার ডায়াল করে ফোনটা আমায় দাও। তোমার দ্বারা হবে না, বুঝে ফেলেছি।   

দু’বার বেজে যাওয়ার পর তিনবারের বেলায় শাম্ব যখন ফোনটা ধরল, অমৃতা তখনও কাঁদছে। ওর গালে আলতো একটা চড় দিয়ে স্মৃতিলেখা গলা তুললেন , হ্যালো শাম্ব, আমি অমৃতার মা বলছি। তুমি শুধু তোমার পান্ডুলিপি নয়, তোমার অমৃতাকেও ফেলে গেছ এই ফ্ল্যাটে। আমি ফিরিয়ে দিতে চাই। কখন আসতে পারবে?       

পেশায় শিক্ষক | মূলত কবি হলেও সাহিত্যের অন্যান্য ক্ষেত্রেও তাঁর স্বচ্ছন্দ পদচারণা | পেয়েছেন কৃত্তিবাস ও বাংলা আকাদেমি শক্তি চট্টোপাধ্যায় পুরস্কার | ‘নেহাত গরিব নেহাত ছোটো’, ‘দাঁড়াচ্ছি দরজার বাইরে’, ‘যতটুকু মেনে নিতে পারো’, ‘পতাকা নয় দিগন্ত’ ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি |

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *