আগের গল্প পড়তে: [] [] [] [] [] []

ধরিত্রী 

মধুশ্রী তখন সাতাশ। লাবণ্যে থইথই। কোঁকড়া চুলের ঘের মুখমণ্ডলে এনেছে নিবিড় প্রশান্তি।  মাতৃমহিমা এমনই। গর্ভের সন্তান সাত মাসের। তাই নিয়েই ডিউটি করতে গেছিল মধুশ্রী। সাত বছর আগের কথা। অংশুমান, মধুশ্রী সদ্য বাড়ি কিনেছে। ইংল্যান্ডের কেন্দ্রে। যাকে বলে হার্ট অফ ব্রিটেন। জায়গাটার নাম লেস্টার। স্টেশন থেকে নেমে ‘স্টোনি গেট’ বললেই লোকে দেখিয়ে দেবে। ভিক্টোরিয়া পার্কের কাছে। স্থানীয় লোকজন একদম কলকাতার মতো। রাস্তা গুলিয়ে গেলে দেখিয়ে দেয়। আগ বাড়িয়ে কথা বলে। এখানে না এলে বিলেত সম্পর্কে একটা ভুল ধারণা গড়ে উঠত মধুশ্রীর। শান্তিপূর্ণ  পরিবেশ। গুজরাতি, পাঞ্জাবি, দক্ষিণ ভারতীয়দের বাস। কয়েক ঘর বাঙালিও আছে।

টিউবে চেপে মধুশ্রী অন্য দিনের মতোই গ্লস্টারে গেছিল। এইসময় একা ড্রাইভ করা উচিত নয়। নব্বই মাইল দূরে গ্লস্টার। মেট্রো থেকে নেমে হেঁটে মিনিট তিনেকের রাস্তা। গ্লস্টার হাসপাতালে ঢুকতে না ঢুকতেই একটা মেয়ে এসে মধুশ্রীর হাত ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিল। সোনালি চুল, নীল চোখের তরুণী। একঝলক তাকিয়েই বুঝে ফেলেছিল মধুশ্রী। গর্ভবতী। তারপর সেই অষ্টাদশীর গর্ভপাত করতে হয়েছিল সেদিন। কাজটাই তো এমন। রিপ্রোডাকটিভ অ্যান্ড সেক্স মেডিসিন। মায়েদের শারীরিক ও মানসিক নিরাপত্তার গুরুদায়িত্ব। ভ্রূণ কোনওভাবেই যেন মায়ের ক্ষতি না করতে পারে। অপরিকল্পিত গর্ভাধানের ফসলকে পৃথিবীতে না আসতে দেওয়াই শ্রেয়। পরিত্যক্ত অনাথ তো কম দেখেনি। বিমর্ষ হয়ে ভাবত মধুশ্রী, এমন বাবা মা কীভাবে হয়, যারা সন্তানদের ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে যায়! এর থেকে ভ্রূণ অবস্থায় উপড়ে নেওয়া ভাল। 

গর্ভপাত করানোর সময় কুলকুল করে ঘামছিল মধুশ্রী। এ পর্যন্ত  প্রায় শখানেকের বেশি অ্যাবরশন করেছে। কিন্তু সেদিন যে নিজের পেটের মধ্যে একজনের উপস্থিতি টের পাচ্ছিল! টুকুস টুকুস নড়ছে! সেই মুহূর্তে বড্ড কঠিন লাগছিল কাজটা। দেশে থাকতে প্রথম সন্তান হওয়ার সময় মা কিছুতেই ফলন্ত আমগাছটা কাটতে দিতে চায়নি। গাছটা পোকায় ভরে গেছিল। আমগুলো কাঁচা অবস্থাতেই ঝরছিল। ওষুধ দিয়েও কাজ হয়নি। তার উপর এক বিশাল মৌমাছির চাক। হুল ফুটোচ্ছিল বাড়ির প্রায়  সবাইকেই। তবু সেই মৌমাছির চাকে আগুন ধরাতে দেয়নি মা। বলেছিল, এসময়ে সহ্য করতে হয়। ধরিত্রী হতে হয়। প্রথমেই কন্যাসন্তান। মিঠি। খুব খুশি হয়েছিল অংশুমান। 

নীল চোখের ব্রিটিশ তরুণীর কান্না সেদিন মুহ্যমান করে দিয়েছিল মধুশ্রীকে। ইংল্যান্ডের জাতীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় মায়ের ইচ্ছেই শেষকথা। কাজেই রোগিনীর সেই ভ্রূণ নষ্ট করতে হয়েছিল মধুশ্রীকে। হৃদয়সমুদ্র উথালপাথাল। একটা কচি ফোঁপানোর শব্দ নিজের নাভি থেকে উঠে আসছিল দুই কানে। মা, মাগো’

তারপর তিনদিন কাজে যেতে পারেনি মধুশ্রী। দিনরাত এক করেও ঘুম আসত না। শেষপর্যন্ত কোল আলো করে এসেছিল তার সন্তান। ফুটফুটে ছেলে ম্যাম্বো। তবুও সেই ধূসর দিনগুলো ভুলতে পারেনি মধুশ্রী। তারপর কত হাসি, আনন্দে কেটে গেছে দিন। ছেলেমেয়ে দু’জনেই বড় হচ্ছে তরতরিয়ে। মধুশ্রী এখন তৃপ্ত নিজের কর্মজগতে। অজস্র মহিলারা নিজেদের জরায়ুর স্বাধীনতা উদযাপন করতে পারে মধুশ্রীর মতো ডাক্তারদের জন্য। প্রাথমিকভাবে সে তার রোগিনীদের পরামর্শ দেয় যাতে শিশুর জন্ম দেওয়া সম্ভব হয়। একান্তই রোগিণী রাজি না হলে এবং ভ্রূণের বয়স তেইশ সপ্তাহের কম হলে  তবেই মধুশ্রীরা রাজি হয়। মাতৃত্ব তো নারীর বাধ্যবাধকতা নয়, চয়েস। 

Mother and Child 1
এখন সেই অপরিকল্পিত ফসল জন্ম দিতে চাইছেন না দম্পতিরা

তবে হঠাৎই পৃথিবী গিয়েছে পাল্টে। গত দুমাস ধরে গ্রহটা রোগশয্যায় বিপর্যস্ত। এখানেও হুহু করে বাড়ছে গর্ভপাত। লন্ডনে একজন মাত্র মায়ের সদ্যোজাত বাচ্চা কোভিডাক্রান্ত হয়েছে। বাকি মায়েদের চারমাসের পর থেকে সংক্রমণের খবর আসছে, যদিও সংখ্যাটা এমন কিছু বেশি নয়। মধুশ্রী জানে, আসলে মায়েরা ভয় পাচ্ছে। অনাগত সন্তান ভাইরাসে আক্রান্ত হবে, সেই ভয়ের থেকেও বেশি হল কীভাবে সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখবে। হয়তো পরিকল্পনা করেই সন্তান নিয়েছিল। এখন লকডাউনের জেরে সঙ্গী অনেকদূরে আটকে। একাকী সন্তান প্রসব, যত্নআত্তি বড্ড মুশকিল। বিশেষত এই কঠিন সময়ে। খিলকুলুপ আঁটা গ্লস্টার শহরে এখন অবাঞ্ছিত মাতৃত্বও বেড়েছে। চারদেওয়ালের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর অনর্গল দিনরাত যাপন। এখন সেই অপরিকল্পিত ফসল জন্ম দিতে চাইছেন না দম্পতিরা। হয়তো তাদের কারও কারও একাধিক সন্তান। 

আসল সমস্যা হল আর্থিক মন্দা। দোকান, বাজারশপিং মল, রেস্টুরেন্ট বন্ধ। ক্যাব ড্রাইভাররা বেকার। হোটেল, ক্লাব, পার্লার বন্ধ। অসংখ্য মানুষ কর্মহীন। আয়হীন। বেকার অবস্থায় কে বা চায় অনাগত সন্তানকে জন্ম দিতে? মানুষ তো শুধু প্রাণী নয়! জৈবিক ধর্ম ছাড়াও তো তার মন আছে। গর্ভের সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখার স্বপ্ন আছে। মধুশ্রী তাই যখন মায়েদের থেকে গর্ভপাতের কারণগুলো জানতে পারে, হা হুতাশ করা ছাড়া তার উপায় থাকে না। নৈতিকভাবে মায়ের পাশে দাঁড়াতে হবে এমনই নির্দেশ আছে সরকারের। মধুশ্রী  বর্ম এঁটে, মাস্ক পরে চলে যায় সেইসব ভ্রূণদেরকে ছেঁটে ফেলতে। একের পর এক।

আজকাল কিছুই ভাল লাগে না মধুশ্রীর। এমনিতেই কাতারে কাতারে মৃত্যু গোটা ইংল্যান্ড জুড়ে। আমেরিকা, ইতালিতে ভয়াবহ মৃতের সংখ্যা। ভারতবর্ষের জন্য মন আনচান। এই পরিস্থিতিতে তার হাতেও এত বেড়ে গিয়েছে ভ্রূণমৃত্যুর হার যে মধুশ্রী ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। এত এত শিশুমৃত্যু তার জন্য? গ্লস্টার যাওয়া আসা করতে গিয়ে গাড়িতে আনমনে ধাক্বা লাগিয়ে ফেলে। পথের পাশে সার সার পিটুনিয়াগুচ্ছ গুচ্ছ লাল, হলুদ গোলাপ কিছুই তার মনকে চাঙ্গা করতে পারে না। পৃথিবীর বাইরে কোনও এক ব্ল্যাকহোল থেকে প্রচুর শিশুর কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে হঠাৎ করে। ভুল করে রাস্তার পাশে আচমকাই গাড়িটা দাঁড় করিয়ে ফেলেছিল মধুশ্রী। জানলায় পুলিশের টকটক শব্দ।
ম্যাডাম, এনি প্রবলেম?
এদেশে ট্র্যাফিক নিয়মকানুন খুব কড়া।
প্লিজ শো ইওর লাইসেন্স।
ফাইন দেওয়ার খবর দ্রুত পৌঁছে গেল অংশুমানের কাছে।
কী হয়েছে তোমার? এ তো নতুন নয়। তোমার স্পেশালাইজেশনটাই তো এমন, যাতে এইসব মায়েদের জন্য সার্ভিস দেওয়া যায়। ভারতবর্ষে এই মায়েদের জন্য তুমি এতকিছু করার ক্ষমতা  পেতে না। তাহলে?
মধুশ্রী চুপ। সে যখন ট্রেনিং নিয়েছিল ইংল্যান্ডে এসে, একজন প্রবাসী বাঙালি, প্রবীণ চিকিৎসক তাকে বলেছিলেন
এইসব ম্লান মূঢ় নারীদের মুখে দিতে হবে ভাষা। পারবে তো?

Dodo
ডোডো… ধরিত্রীর এমন ভ্রূণহত্যা কারা করে?

লুক, মধুশ্রী। আমার দিকে তাকাও।
অংশুমান একটা ড্যাফোডিল ঝোপের কাছে তাকে নিয়ে গেল। এই বাগান দেখাশোনা করে অংশুমান। ভারি সুন্দর ফুলে প্রজাপতিতে ছাওয়া।
আমাদের হাতে কিছুই নেই মধুশ্রী। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো, যেমন ধরো সুইডেন, নরওয়েতে গত কুড়ি বছর ধরে এমনিই মহিলারা মাতৃত্ব নেয় না।
এক কাপ কফি বানিয়ে আনল অংশুমান।
তুমি তো অবুঝ নও মধু। এই পৃথিবী শুধু মানুষের নয়। প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে প্রচুর প্রাণ চলে যাচ্ছে। নিরন্তর মৃত্যু। কখনও ভেবেছ, আমরা, মানুষেরা দিনে দিনে বাড়তে বাড়তে কত প্রাণী, কত প্রজাতিকে অবলুপ্ত করে দিয়েছি?
ইয়েস মাম্মাথিংক অ্যাবাউট ডোডো। দ্য বার্ড টোট্যালি এক্সটিঙ্কট ফ্রম আর্থ।
ম্যাম্বো বলে উঠল। অংশুমানও কফির কাপে লম্বা চুমুক দিল। বলল,
– প্রতি বছর প্রায় দশ হাজার প্রজাতির প্রাণী আমরা হারিয়ে ফেলছি চিরতরে। এই পৃথিবী তো একদিন  ওদেরও ছিল, তাই না?
মধুশ্রী তাও উদাসীন। মিঠি ঘর থেকে ছুটে এল।
– এরপরও তুমি এত ভাবছ মাকী হত যদি তুমি আমাকে চাষের জমিতে কুড়িয়ে পেতে? কী নাম রাখতে মা? সীতা

মধুশ্রীর কাঁধ ঝাঁকাতে থাকে মিঠি। বাগানের প্লাম গাছে থোকা থোকা লাল প্লাম। এই গ্রীষ্মে তাদের মরিশাস ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান ছিল। অস্থির চোখে মরিশাসের সৈকতে একটা কল্পনার ডোডোপাখি খুঁজতে থাকে মধুশ্রী। নীল সমুদ্রের পাড়ে খয়েরি পালকের অজস্র ডোডো। সোনালি হলুদ ঠোঁট। ধরিত্রীর এমন ভ্রূণহত্যা কারা করে? সভ্য মানুষ?

Darjeeling
দূর নভোনীলে একাকী কাঞ্চনজঙ্ঘা সব কিছুর সাক্ষী হয়ে থাকে

ঘুমন্ত বুদ্ধ  

এপ্রিলের সেই সকালটার কথা মনে পড়ল অতনুর। কাচের জানলার বাইরে যদ্দূর চোখ যায় ধপধপে সাদা বরফ আর বরফ। আগের দু’দিন একনাগাড়ে বৃষ্টি পড়ে গোটা দার্জিলিং ঢেকে গেছিল বরফে। এইরকম খামখেয়ালিপনা প্রকৃতি কমই করে। দার্জিলিংয়ে গ্রীষ্মকালে তুষারপাত এক বিরল ঘটনা। অথচ সেই দুর্দান্ত সময়ে কোনও টুরিস্ট ছিল না তালাবন্ধ দেশে। 

বাস্তবিক, একশো বছর বাদে এসেছে এক অদ্ভুত সময়। মানুষ যখন প্রকৃতির সঙ্গে চু কিতকিত খেলতে খেলতে দুমদাম ঘুঁষি মারে, প্রকৃতিও বোধহয় এভাবেই প্রতিশোধ নেয়। কে বলবে এটা ট্যুরিস্ট  সিজন। প্রতিবছর জুন মাসে ম্যালে থিকথিকে ভিড় থাকে। আশপাশের লোহার চেয়ারে পর্যটকরা বসে আরাম করে মজলিসে ব্যস্ত থাকেন। কবি ভানুভক্তের মূর্তির পায়ের কাছে স্থানীয় খেটে খাওয়া লোকেদের ভিড় হয়। কেউ বা কেটলিতে চা বিক্রি করেন, কেউ ভুট্টা সেঁকেন উনুনে। রঙিন উলের পোষাকের পশরা সাজিয়ে বসা হরেক বিপণি। একজন লোকাল মেয়ে কী পরিশ্রমটাই না করে শীতের গরমজামা, মোজা দস্তানা বিক্রি করতে। সকাল থেকে রাত অবধি দোকান খুলে একাই সব টাঙায়। নামায়। ঘামে চকচক করে মেয়েটার লালচে গাল। ম্যাল থেকে যে রাস্তাটা বেঁকে রাজভবনের দিকে গিয়েছে সেখানটা ক্রেতা বিক্রেতার দরাদরিতে মুখর থাকে। মাঝে মাঝে অতনুর মনে হত সে কলকাতাতেই আছে। গড়িয়াহাট কিংবা হাতিবাগান। জাস্ট কাঞ্চনজঙ্ঘা উঠে এসেছে কলকাতায়। 

কিন্তু এখন? এ যেন এক নিঃশব্দ ঘুমন্ত উপত্যকা। ভোরে পাখির ডাকে তবু কিছুটা প্রাণবন্ত লাগে। মৌটুসি, বসন্তবৌরি, কিচিরমিচির করে। বেলা বাড়লে যেকে সেই। পাইন, মেপল, এপ্রিকট গাছের ফাঁক দিয়ে গোটা দার্জিলিং একাকিত্বের চাদর টেনে নেয় শরীরে। দূর নভোনীলে একাকী কাঞ্চনজঙ্ঘা সব কিছুর সাক্ষী হয়ে থাকে। এই নিয়ে অতনুর সাত বছর হল দার্জিলিংয়ে। একটা নামকরা রিসর্টের কর্মচারী সে। এ বছর মহামারীর জন্য কোটি কোটি টাকার ব্যবসা বন্ধ। পুরো আর্থিক ক্ষতি ট্যুরিজম ব্যবসার সঙ্গে জড়িত সমস্ত মানুষের। গরীবগুর্বো স্থানীয় লোকেদেরও। নব্বই শতাংশ হোটেল স্টাফ পাহাড় থেকে নীচে নেমে গেছে লকডাউন ঘোষণার পরে পরেই। অতনুর মতো কয়েকজন বাড়ি ফিরতে চায়নি। ওরা দার্জিলিংকে ভালবাসে। নিজের নিজের কাজটাকেও। না-ই বা হল পর্যটক। হোটেলের ঘরদোর ঝাড়ামোছা, দেখভাল,  বাগান মেরামত, এসব দায়িত্ব থাকেই। সবথেকে বড় কথা হল, বাড়ি ফেরার দায়দায়িত্ব কে নেবে? তাদের মতো কীটপতঙ্গদের কথা কে আর ভাবে

সোনালি রোদ পড়েছে কাঞ্চনজঙ্ঘার চুড়োয়। গত বছরেও এসময় গ্লেনারিজ় আর কেভেন্টার্স গমগম করছিল টুরিস্টে। কালোসাদা ফটোগ্রাফিতে সাজানো কেভেন্টার্স রেস্তোরাঁর মধ্যে ফিল্মস্টার রণবীর কাপুরের ছবি টাঙানো আছে। এখানেই শুটিং হয়েছিল ‘বরফি’ ছবির। যাদের ফটো কোনওদিন থাকবে না, সেই লাখ লাখ রঙিন ভ্রামণিকের ছবি কিন্তু অতনুর মনে গেঁথে আছে। মধুচন্দ্রিমায় আসা নবদম্পতি, ভেকেশনে সপরিবারে আসা উজ্জ্বল মুখগুলো, সবুজ গোঁফ ওঠা চ্যাংড়া ছেলেদের অত্যুৎসাহী ট্রেকিং গ্রুপ। কলকল করা বাচ্চারা, যারা হিমালয়ান ভালুক দেখতে আসে পাহাড়ি চিড়িয়াখানায়। এরা ছাড়া দার্জিলিং মৃত। 

Darjeeling 1
এ যেন এক নিঃশব্দ ঘুমন্ত উপত্যকা

অতনু চুপচাপ বসেছিল ম্যালে। ঘোড়াওয়ালাগুলো ঘোড়া চরাতে নিয়ে এসেছে। সওয়ার না হলেও ওদেরকে তো খাইয়ে পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। সাহেবুল, বীরেন তামাং, সবাইকেই চেনে অতনু। চোখে চোখে কথা হয়। মনমরা মানুষগুলো অপেক্ষা করে আছে কবে আবার মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে উঠবে দার্জিলিং। সেই মেয়েটা আসছে হেঁটে। উলের টুপি, সোয়েটার নিয়ে যে রোজ বসত পশুপতিনাথ মন্দিরে। কতদিন দোকান বন্ধ। মেয়েটার গাল আপেলের মতো লালচে। বৃদ্ধ নেপালি গাইড বলরাম ছেত্রী বিড়ি ধরিয়ে অতনুর দিকে তাকাল।

এই নিয়ে অতনুর সাত বছর হল দার্জিলিংয়ে। একটা নামকরা রিসর্টের কর্মচারী সে। এ বছর মহামারীর জন্য কোটি কোটি টাকার ব্যবসা বন্ধ। পুরো আর্থিক ক্ষতি ট্যুরিজম ব্যবসার সঙ্গে জড়িত সমস্ত মানুষের। গরীবগুর্বো স্থানীয় লোকেদেরও। নব্বই শতাংশ হোটেল স্টাফ পাহাড় থেকে নীচে নেমে গেছে লকডাউন ঘোষণার পরে পরেই। অতনুর মতো কয়েকজন বাড়ি ফিরতে চায়নি। 

হবেই হবে জানতাম।
মানে?
চিনে কী হচ্ছে জানো? এভারেস্ট কেটে রাস্তা হচ্ছে। ভাবো, কী বিজনেস। পাপের সাজা পেতে হবে না?
কিন্তু কাকাএখানে তো কেউ কাঞ্চনজঙ্ঘার চুড়োয় ওঠে না। সবাই জানে যে এটা বৌদ্ধধর্মে মানা আছে।
ব্যস? তাতেই হয়ে গেল? তুমি কী ভাবছ উনি কিছু দেখছেন না?
অতনু হেসে ফেলল। সে নিজেকেই বোঝে না যে আস্তিক না নাস্তিক। খিদে ছাড়া জীবনের আর কোনও ধর্মের প্রবল অস্তিত্ব আছে এখনও অজানা।
কে দেখছে কাকা?
বলরাম ছেত্রী হাত দিয়ে দেখান। ঝকঝকে কাঞ্চনজঙ্ঘা। যেন  বুদ্ধদেব শুয়ে আছেন প্রগাঢ় ঘুমে।
– একদিন দেখো সব ভেঙেচুরে নেমে আসবেন উনি। ওঁর শান্তির ঘুম যারা নষ্ট করছে তাদের জন্যই আজ দুনিয়াতে এই রোগ ব্যাধির রমরমা। 

অতনু কী বলবে ভেবে পেল না। মা বলত, মানুষের পাপের ভারে কল্কি অবতার আসবে। সত্যিই কী সেই সময় এগিয়ে এসেছে? লালচে গালের নেপালি মেয়েটা হেঁটে আসছে। ওকে আজ একটা গোলাপ দেবেই অতনু। আবার সব ঠিকঠাক করে নিতে হবে। গাছপালা লাগিয়ে, ফুলে ফুলে ভরিয়ে দিতে হবে দার্জিলিং। খেটে খাওয়া লোকগুলো খেয়াল রাখতে হবে। এযাত্রায় বাঁচতেই হবে আর বাঁচিয়ে রাখতে হবে ভালোবাসার এই শৈলশহরটাকে।

 

*ছবি সৌজন্য: Artmajeur, Yohaku, Fineartamerica

পেশায় ডাক্তার দোলনচাঁপা নতুন প্রজন্মের লেখকদের মধ্যে পরিচিত নাম। মূলত গল্প এবং উপন্যাস লেখেন বিভিন্ন ছোটবড় পত্রপত্রিকায়। 'চন্দ্রতালের পরীরা' এবং 'ঝুকুমুকু' তাঁর লেখা জনপ্রিয় কিশোরসাহিত্যের বই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *