আগের পর্বের লিংক: [] [ ২] [] [] [] [] [] [] [ ৯] [১০] [১১] [১২] [১৩][১৪]

আমি চুপ করে শুনছি। জুড়ান কত জানে! জুড়ানকে দেখলে কি বোঝা যায় সে এই রকম? সত্যিই তো মানুষ দেখলে কি ধরা যায়, সে কেমন? চঞ্চলচন্দ্র হিব্রু ভাষা জানেন। জেরুজালেম ঘুরে এসেছেন।   আশ্চর্য! এসব কথা নীলমাধব জানে না। বলেওনি কোনওদিন। হিব্রু যে ইহুদিদের ভাষা, তা জুড়ান জানে। ইহুদিদের দেশ ইস্রায়েল। ইস্রায়েলের রাজধানী তেল আভিভ, যিশু খ্রিস্টের জন্মস্থান জেরুজালেম ইস্রায়েলে। চঞ্চলচন্দ্র জেরুজালেম কেন, গ্রিস গেছেন, ইতালি গেছেন, আমেরিকায় ছিলেন অনেকদিন, শুনেছি উত্তর মেরুর কাছে আলাস্কায় পর্যন্ত ছিলেন। চঞ্চলচন্দ্র নীলমাধবকে পছন্দ করেন না, জুড়ানকে পছন্দ করেন। ওঁর নিজের কথা সব বলেন, কত কিছুই জানেন উনি।
– দ্যাখো অনুতোষ, নীলমাধব খুব তাড়াতাড়ি ফেঁসে যাবে। তখন হৈহৈ পড়ে যাবে চাদ্দিকে, টিভির লোক ছুটে আসবে।  

জুড়ান রায় অনেকটা সময় থাকল আমাদের ফ্ল্যাটে। একই কথা বলতে লাগল। আমি ভাবলাম বলি, বসন্ত মল্লিকের যুবতী কন্যার কথা। বসির নয়, আসলে সে ফরিদপুরের মধুতলার বসন্ত হবে। ভাবলাম বলি, নীলমাধব কেন যায় হাবড়ায়? কিন্তু বলতে সাহস হল না। জুড়ানচন্দ্র রায়ের অভ্যাস কথা চালাচালি করা।  সুতরাং কথাটা কতদূর চলে যাবে, তা আমি জানি না। তবে জুড়ান রায়ের যা অভ্যাস, ও সব জেনে ফেলবে মনে হয়, আমাকে কিছু বলতে হবে না। হুঁ, তাই। জুড়ানের কাছে কিছুই গোপন থাকবে না, পরেরদিন বললেন গুণেন সরকার। নীলমাধব দুশ্চরিত্র মানুষ। তা জুড়ানের জানতে অসুবিধে কোথায়?  কিন্তু এও ঠিক, আমরা যে সত্য নিয়ে কথা বলতে চাই, জুড়ান তার বিপরীতে যায়। নারীঘটিত কিসসা নিয়ে জুড়ানের মাথাব্যথা নেই। সে অন্য পথে হাঁটছে। জুড়ান বলল:
– হারামিটা সেই ছ’মাসে ক’টা রেপ করেছিল কে জানে!
এসব কী বলছ  জুড়ান! ছি! আমি প্রতিবাদ করলাম।
– কিসের ছি? রাজাকাররা কত রেপ করেছিল জানো? তুমি জান না, আমি জানি। উদ্বাস্তু শিবির সব খবর দিয়েছে।
আমার মনে হল জুড়ান বিপজ্জনক হয়ে যাচ্ছে। খুব। বলছে:
– বাংলাদেশে যে তালিকা তৈরি হয়েছে ধর্ষক এবং লুটেরার, তার ভিতরে নিলাম মোল্লার নাম নেই তা   বলবে কে? আরে সেই সময়ের পাকিস্তানে কি সব রাজাকার মুসলমান ছিল? তাহলে বরিশালের ভূপেন বিশ্বাস, নড়াইলের খোকন রায়, চট্টগ্রামের ত্রিদিব  রায়, এরা কারা?

 

আরও পড়ুন: রঞ্জিতা চট্টোপাধ্যায়ের কলমে: কণ্ঠ ছাড়ো জোরে

 

আমি হতভম্ব। এসব নাম আমি কী করে জানব? জুড়ান জানে। জুড়ান নিজে জেনেছে, না তাকে ওই  চঞ্চলচন্দ্র জানিয়েছে, তা জুড়ানই  বলবে। বলছে খ্রিস্টান রাজাকারও ছিল। সংখ্যায় কম হলেও তো ছিল। ছিল যদি, তবে বর্ডার পার হয়ে ফিরে যেতেই পারত। ফেরার উপায় ছিল না। লুটের মালের ভাগ দিতে হত যে! কিন্তু এখনও লোক আসে। কারা আসে? না, লুটেরারা ভাগ নিতে আসে। পায় না। নীলাম্বর পালোধী হার্ট অ্যাটাকে মারা গেল কেন? বাংলাদেশ থেকে লতিফ মোল্লা আর খতিব মোল্লা, দুজ’ন এসেছিল। তাদের বাবা মতিন মোল্লা ছিল নীলাম্বরের সাগরেদ। বা উল্টোটা। সাড়ে সাত সের লুটের গয়না নীলাম্বরের কাছে রেখেছিল মতিন। তা নিয়েই চলে এসেছিল নিলাম মোল্লা। আর ফেরত দেয়নি। দুই ভাই বাবার কাছে শুনেই এসেছিল। কিন্তু গয়না কোথায়? সব বেচে দিয়ে জমি কিনে নিয়েছিল নীলাম্বর। তারা ভয় দেখাতেই লোকটা মরে গেল। না মরলে তারা বাংলাদেশ পুলিশ নিয়ে আসত। এসব আমি কিছুই জানি না। কিন্তু সত্য হবে কিনা, সন্দেহ খুব। জুড়ান যেন আগডুম বাগডুম বকছে। বকতে বকতেই চলে গেল রাত বাড়তে। 

একদিন সকালে চঞ্চলচন্দ্র চন্দ্রকে দেখা গেল রাস্তায়। দীর্ঘকায় মানুষ। মাথা উঁচু করে হাঁটেন। প্রাতর্ভ্রমণে একা। নীলমাধব বললেন:
– লোকটার খুব দম্ভ। কারও সঙ্গে মিশতে পারে না। লোকটার আচরণ সন্দেহজনক। 

একটা লোক একা থাকে, একা হাঁটে, সমস্তটাই আমার কাছে বিচিত্র। কিন্তু নীলমাধবের কাছে সন্দেহজনক। আমি দেখতে লাগলাম একবার আকাশ দেখলেন চঞ্চল, একবার গাছগাছালি, মোবাইলে ছবি তুলছেন চারপাশের। আমি ভাবলাম ছবি তুলি পুকুর আর দ্বীপের। কিন্তু তোলা হল না। ছবি মোবাইলে থাকবে, তারপর মেয়েকে পাঠানো যেতে পারে। তারপর কী করব? আর নীলমাধব ভাবতে পারে, আমি চঞ্চলচন্দ্রের অনুকরণ করছি। নীলমাধব দেখেছে তো মানুষটাকে। নীলমাধব খারাপ মন্তব্য করেছে তার সম্পর্কে। তাতে কেউ কোনও কথা বলল না। কেন বলবে? এই কথা কি নীলমাধব আজ প্রথম বলল? অনেকবার বলেছে। সুতরাং নতুন কী?

প্রাতর্ভ্রমণে অনেক বয়স্ক মানুষ আসেন। সকলেই যে আমাদের  সঙ্গে থাকেন তা নয়। ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে তাঁরা আয়ু সঞ্চয় করেন। জগিং করেন। ব্যায়াম করেন, প্রাণায়াম করেন। করতে করতে ঈশ্বরের কাছে আয়ু প্রার্থনা করেন। আবার প্রাতর্ভ্রমণে আসা কিশোরী, যুবতীদের সঙ্গে আলাপ করেন। তাঁদের ডাকেন। তাদের কল্ধ্বনি শোনেন। তাও বুঝি আয়ু বাড়ায়। এরই ভিতর বিজন বসাক কেমন ঘুমের ঘোরে চলে গেলেন। বিজন আমাদের পরিচিত ছিলেন। আমাদের সঙ্গে থাকতেন না বটে, কিন্তু মুখোমুখি হলেই গুড মর্নিং বলতেন। জোড়হস্তে নমস্কার করতেন। আমরা ভেবেছিলাম, বিজন বসাকের শোকসভা করব সকালে একদিন। আজ হবে কাল হবে করে হয়নি। ভুলিনি, কিন্তু বলিওনি কাউকে যে শোকসভাটি হয়নি। চঞ্চলচন্দ্র নিয়ে নীলমাধবের মন্তব্যে আমি হিব্রু ভাষার  কথা বলতে গিয়ে সামলে নিলাম। বললাম:
– অনেক ভাষা জানেন শুনেছি।
ভাষা গায়ে লেখা আছে? নীলমাধব জিজ্ঞেস করল। 
না। মানে মনে হয়। আমি বললাম।
– মনে হলেই হল? স্পাইদের বেশি  ভাষা জানতে হয়। আমি থানাকে বলেছি লক্ষ রাখতে। নীলমাধব বলল।
কেন? জিজ্ঞেস করলেন গুণেন সরকার।
– সন্দেহ হয় তাই! ছদ্মবেশে আছে কি না বলবে কে? স্পাই। বুঝছ না, এই যে একের পর এক সন্ত্রাসবাদী ধরা পড়ছে, দেখে বুঝবার উপায় নেই, কিন্তু গোয়েন্দারা খবর পেয়ে যাচ্ছে… তাই থানায় খবর দিয়েছি। বড়বাবু আমাকে খুব সম্মান করেন। 

আমি ভাবলাম বলি, বসন্ত মল্লিকের যুবতী কন্যার কথা। বসির নয়, আসলে সে ফরিদপুরের মধুতলার বসন্ত হবে। ভাবলাম বলি, নীলমাধব কেন যায় হাবড়ায়? কিন্তু বলতে সাহস হল না। জুড়ানচন্দ্র রায়ের অভ্যাস কথা চালাচালি করা।  সুতরাং কথাটা কতদূর চলে যাবে, তা আমি জানি না। তবে জুড়ান রায়ের যা অভ্যাস, ও সব জেনে ফেলবে মনে হয়, আমাকে কিছু বলতে হবে না।

নীলমাধবের কথা শুনতে শুনতে আমার মনে বিরক্তি  এল। এক ব্যক্তি ওঁদের হাউজিংয়ে থাকতে এসেছেন ভাড়ায়। তিনি নিজের মতো করে থাকতে চান। নীলমাধব তা দেবে না। এক ব্যক্তির মতের সঙ্গে নীলমাধবের মত মিলবে না, তাই নীলমাধব তাকে হ্যারাস করবে। অথচ ওই হাউজিংয়ের মালিক নীলমাধব নয়। সে দুটি মাত্র ফ্ল্যাটের মালিক। বাকিটা অন্য লোকের। অনেক ফ্ল্যাটের মালিক এখানে থাকে না। তালা মারা আছে। অনেক ফ্ল্যাটে কমবয়সী দম্পতি থাকে। দু’জনেই চাকরিতে যায়। ছুটির দিনে বেড়াতে যায়। তাদের ফ্ল্যাটে আত্মীয়স্বজন আসে। তাদের নিয়ে নীলমাধবের কোনও সমস্যা নেই। সমস্যা  চঞ্চলচন্দ্র। নীলমাধব বলছে, চঞ্চলচন্দ্র যে সন্দেহভাজন, তা তার আচরণে ধরা যায়।

চুপ করে থাকলাম। বুঝলাম নীলমাধব চঞ্চলচন্দ্রকে ঝামেলায় ফেলতে চায়। যেন জুড়ানেরই আর এক চেহারা। যাকে পছন্দ  কর না তুমি, দাগিয়ে দেবে? নীলমাধবকে আমি সমীহ করি। কেন সমীহ করি? নীলমাধব ধনী। তাঁর এপাড়ায় খুব প্রতিপত্তি। কাউন্সিলর, এমএলএ, এমপি, সকলের সঙ্গে সখ্য। ওর ফ্ল্যাটে তাঁরা আসেন। তখন তাঁদের খুব ভাল করে আপ্যায়ন করে নীলমাধব। বিজয়ার সময় বড় মিষ্টির হাঁড়ি পাঠায় থানায়, বড়বাবুর জন্য বিশেষ উপহার পাঠায়। তা হয়তো বিদেশি দামী মদ হতে পারে, কিংবা দামী শাড়ি হতে পারে। গয়নাও হতে পারে।

এমন একটা মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক রাখায় লাভ অনেক। সেই নীলমাধব ক্ষুব্ধ হলে বিরূপ হবে আমার উপর। সে বিরূপ হলে থানা বিরূপ হবে। থানায় আমি অবশ্য কোনওদিন যাইনি। যেতে হয়নি। কিন্তু হতেও তো পারে! গুণেন সরকারের হয়েছিল মোবাইল ফোন হারিয়ে গেলে। যে কোনওকিছু হারিয়ে গেলে, চুরি হয়ে গেলে থানায় ডায়েরি করতে হয়। চেনা মাধ্যমে গেলে সব কাজেই সুবিধে হয়। না হলে থানায় গিয়ে বসার অনুমতিও পাব না। গুণেনের সেই অভিজ্ঞতা। 

নীলমাধবের কথা বলেনি গুণেন। মাথায়ই আসেনি। পরে সব শুনে নীলমাধব বলেছিল, সে বড়বাবুকে ফোন করে দিলেই কয়েক মিনিটে কাজ হয়ে যেত। দেড় ঘণ্টা দাঁড়াতে হত না এফআইআর করতে।  নীলমাধব ক্ষুব্ধ হলে অনেকরকম অসুবিধে হতে পারে। পাড়ার পুজো কমিটির মাথায় নীলমাধব।  আচমকা আমার দেয় চাঁদা এক হাজার দু’হাজার হয়ে যেতে পারে। যখন তখন যে কোনও কারণে চাঁদা দিতে হতে পারে। রক্তদান শিবির, শনি পুজো, শেতলা, গণেশ পুজো। আমি এর বিরোধিতা করতে পারব না। আমার সে দম নেই। জুড়ান রায়ের আছে। আমি মাথা নামিয়ে নিলাম। নীলমাধবের অনেক শক্তি। নীলমাধবই থানা। চঞ্চলচন্দ্র ঝামেলায় পড়ে যাবে।  

 

আরও পড়ুন: রাজেশ গঙ্গোপাধ্যায়ের অনুবাদে লাতিন আমেরিকার কবিতা

 

নীলমাধব খুব রেগে আছে তার প্রতিবেশি চঞ্চলচন্দ্রের উপর। কয়েকদিন বাদে বলল:
– লোকটার রুচি বলে কিছু নেই। রাস্তার ধারে বসে থাকে একটা  ভিখিরি, ডাকুর লন্ড্রিতে জামাকাপড় আয়রন করত আগে। তাকে ঘরে ডেকে নিয়ে ভাত খাওয়ায়।
– তাতে কী হয়েছে? জিজ্ঞেস করল কার্তিক দত্ত। – গরিবকে ভাত দিলে পুণ্য হয়। 
পূণ্য করতে নয়। কারণ আছে, বুঝতে পারছেন না? সেই ভিখিরি লোকটাও সন্দেহজনক। এমন তো হতে পারে ভাত দেওয়ার নামে পরামর্শ করে, তথ্য আদান প্রদান করে। 
মাথা নাড়েন কানাই রায়। বলেন:
– সে তো শুয়ে থাকে ২১ নং বাড়ির ব্যালকনির নীচে, এখন আর কাজ করতে পারে না। কেউ কেউ তাকে খেতে দেয়। লোকের দয়ায় বেঁচে আছে। 
– একেবারে  ভিখিরি? জামা-কাপড় চুরি করতে কাজ চলে যায়? সাশপিসিয়াস ক্যারেক্টার, ওর সঙ্গে চঞ্চলচন্দ্রের সম্পর্ক কী?    

তাও বটে। সম্পর্ক কী? কিন্তু ঐ বুড়ো তার কাজ করতে পারত না ভাল করে। ভারি ইস্তিরি টানার ক্ষমতা চলে গিয়েছিল। শুধু হাঁপাত যে, তাও দেখেছি। তাই খিটখিটে হয়ে গিয়েছিল। শরীর নিত না অত পরিশ্রম, বন্ধ ঘরে জ্বলন্ত উনুনের পাশে দাঁড়িয়ে ভারি লোহার ইস্ত্রি টানা। মায়া হত লোকটার উপর। নীলমাধবের মনে মায়া নেই।

Amar Mitra

অমর মিত্রের জন্ম ১৯৫১ সালে বসিরহাটে। তবে বহুদিনযাবৎ কলকাতাবাসী। ১৯৭৪ সালে 'মেলার দিকে ঘর' গল্প দিয়ে সাহিত্যিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ। প্রথম উপন্যাস 'নদীর মানুষ' ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হয় অমৃত পত্রিকায়। প্রথম গল্পের বই 'মাঠ ভাঙে কালপুরুষ'-ও ১৯৭৮ সালেই। রাজ্য সরকারি চাকরি করেও আজীবন সাহিত্যসাধনায় ব্রতী। ২০০৬ সালে 'ধ্রুবপুত্র' উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার। ২০০১ সালে বঙ্কিম পুরস্কার পেয়েছেন 'অশ্বচরিত' উপন্যাসের জন্য। এছাড়াও ২০০৪ সালে শরৎ পুরস্কার ও ২০১০ সালে গজেন্দ্রকুমার মিত্র সম্মান পেয়েছেন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *