“যেভাবে আমাদের বাবা-মারা তাদের সংসার চালিয়ে এসেছে, সেটা আমাদের পক্ষে অচল।”

ওয়াশিংটনে প্রবাসী ভারতীয়দের সংখ্যা বাড়ছে এবং তাদের অনেকেই তরুণ ও প্রযুক্তিবিদ। পথে-ঘাটে, দোকানে, অনুষ্ঠানে তাদের সঙ্গে দেখা হয়, কথা হয়, কখনও কখনও দীর্ঘ আলোচনা হয়। লক্ষ না করে উপায় নেই যে এসব দম্পতিদের মধ্যে স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক কিছুটা অন্যরকম, দেশে যেমন দেখা যায় ঠিক তেমন নয়। তফাতটা বুঝতে গিয়ে কয়েকটি দম্পতির সঙ্গে আমার আলোচনা দীর্ঘতর হল।

প্রথমেই তারা আমায় বুঝিয়ে দিলেন যে দেশে সংসার যেভাবে চলে সেভাবে আমেরিকায় চালাতে গেলে অনেক অসুবিধা। এখানে চাকরবাকর নেই, থাকলেও অতি দূর্মূল্য। আয় বেশি, ব্যয়ও কম নয়, অতএব স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই কাজ করতে হয়। সর্বোপরি এ-সমাজে নারী-পুরুষের সমতা অনেক বেশি। স্ত্রী যদি স্বামীর পিছু পিছু হাঁটে বা স্বামী যদি স্ত্রীকে ভৃত্যসুলভ হাঁকডাক করে, তাদের শুধু হাস্যাস্পদ নয় রীতিমত অন্ত্যজ হয়ে থাকতে হয়। ফলে সমাজে যেমন সব মানুষেরই কতকগুলি মৌলিক অধিকার থাকে – সংবিধানে পর্যন্ত সেগুলি লেখা থাকে – তেমনই নারী-পুরুষের সম্পর্কে উভয়েরই কতকগুলি মৌলিক অধিকারকে সম্মান করে চলতে হয়। না মেনে উপায় নেই।

প্রথম অধিকার: এটা তোমার অধিকার যে অন্যজন তোমার সব কাজ ভাগ করে নেবে।

নীরা ব্যাখ্যা করে বললেন, “এর একমাত্র কারণ নয় যে কাজ অনেক এবং সেগুলি করার জন্য অন্য লোক নেই। সম্পর্কের মানেই তো এই যে অন্যজনের দুঃখকষ্ট সব ভাগ করে নেওয়া। ঘর পরিস্কার, বাসন মাজা, নোংরা ফেলা, জামাকাপড় ধোওয়া, রান্না করা, এসব কাজের কোনও লিঙ্গ নেই। এককালে মেয়েরাই শুধু এগুলি করেছে বলে চিরকালই সর্বত্র তাই চলবে, এ অতি নির্বোধ যুক্তি। আমিই এখন বেশির ভাগ সময় গাড়ি চালাই, রাজই এখন বেশির ভাগ সময় রান্না করে।”

রাজ হাসল। বলল, “রান্না করতে আমার ভালই লাগে। একদিন হয়ত শেফ হতে পারব।”

 

দ্বিতীয় অধিকার: তুমি যা কর, তার জন্য অন্যজন তোমার প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করবে।

দ্বিজেশ বলল, “আমার বাড়িতে দেখেছি ধরেই নেওয়া হত যে সংসারের সব কাজ মার, বাবার দায়িত্ব শুধু মাইনেটা বাড়িতে আনা। মা উদয়াস্ত পরিশ্রম করত আর বাবা বসে চা খেত, সিগারেট পোড়াত। আমি কখনও চাইব না যে কমলিকা, সারাদিন চাকরি করার পর, এসে সব কাজ একা হাতে করবে। অনেক কাজই ও করে, আমি তার জন্য নেহাতই কৃতজ্ঞ। আমি রান্না তেমন করতে পারি না, কিন্তু বাড়ির সব ভারি কাজগুলির দায়িত্ব – ছাদ সারানো কি গাড়ির মেরামত – আমি স্বেচ্ছায় নিজের হাতে নিয়েছি।

কমলিকা বলল, “দ্বিজেশের রাঁধা খাবার খাওয়ার দুর্গতি আমার যতই কম হয় ততই ভাল। কিন্তু আমি অবাক হয়ে দেখি অফিস থেকে ফিরে দ্বিজেশ কত কী করে। যা আগে জানত না, সেগুলিই ধীরে ধীরে শিখে নিয়ে আমাকে এত ভাবে সাহায্য করে বলবার নয়।”

তৃতীয় অধিকার: অন্যজন যতই ব্যস্ত হোক, তোমাকে মনযোগ দেবে, এটাও তোমার অধিকার।

কুলদীপ আর বিনীতা আমার পাড়াতেই থাকে, বেশ কিছুদিন ওদের চিনি। যখন প্রথম এসেছিল, নানান ঝঞ্ঝাটে পড়েছিল, নতুন আগন্তুকদের প্রায়ই যেমন হয়। অবাক হয়ে দেখতাম সব সমস্যায় ওরা দুজনে একসঙ্গে সমাধান খুঁজছে। কুলদীপ সর্বদাই দেখছে কী ভাবে বিনীতার স্কুলের কাজ শেষ হলে একটু বিশ্রাম পায়, বিনীতাও কুলদীপ কাজ থেকে ফিরলেই চা নিয়ে তৈরি। যত কাজই থাকুক, প্রতিদিন সন্ধেয় দুজনে কাছের পার্কে ঘন্টাখানেক বেড়াতে যাবেই যাবে।

জিজ্ঞাসা করাতে একদিন বলেছিল, “আমরা দুজনেই বেশ ব্যস্ত, এখানকার জীবনযাত্রায় সম্পূর্ণ অভ্যস্ত নই। তবু দুজনেই চেষ্টা করি পরস্পরের সঙ্গে সদাই যোগাযোগ রাখতে, একে অন্যের দেখাশুনা করতে। নইলে আর একসাঙ্গে থাকা কেন?”

চতুর্থ অধিকার: তোমাদের মনান্তর যা নিয়েই হোক না কেন, অন্যজন তোমার সঙ্গে শান্তভাবে তা আলোচনা করবে।

শান্তা ও রাজন দক্ষিণের রক্ষণশীল পরিবারের ছেলেমেয়ে। বিয়ের অল্পদিন পরেই এদেশে এসেছে। নতুন জীবন, নতুন কাজ, নতুন অভিজ্ঞতা।

“প্রতি পদে আমাদের দুজনেরই অসুবিধা হতে লাগল,” রাজন বলল। “শান্তা যাই করে আমার মনে হয় ভুল, বিরক্ত লাগে। আমারও মনে হল শান্তা যেন বড় অসুখী, আমার ধরণধারণ ওর ধাতস্থ হচ্ছে না। নেহাতই নিরুপায় হয়ে একদিন আমরা পরস্পরের সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলতে চেষ্টা করলাম।”

শান্তা যোগ দিল, “আমার পক্ষে এই ধরণের আলোচনা সহজ ছিল না। আমার মা মাসি কেউ কোনওদিন তাদের স্বামীর সঙ্গে এরকম আলোচনা করার কথা ভাবতেও পারত না। কিন্তু অনন্যোপায় হয়ে আমরা সেদিন করলাম। ক্রমশ এই ধরণের আলোচনা আমাদের প্রায় দৈনন্দিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল। অসুবিধা হলেই আমরা অন্যজনকে স্পষ্টভাবে জানাবার একটা ধারা শুরু করলাম।”

একটু ভেবে দুজনেই বলল, “এতেই আমাদের বিয়েটা বেঁচে গেল বলতে পার।”

পঞ্চম অধিকার: অন্যজন আন্তরিকভাবে তোমার যত্ন নেবে।

শোভা ও উদয় অবিবাহিত, একসঙ্গে থাকেন গত চার বছর। এমন যুগ্মবাস এখন সারা পৃথিবীময় ঘটছে, ভারতীয়রা তার ব্যতিক্রম হবে কেন? 

উদয় স্পষ্ট বলল, “আমরা একসঙ্গে থাকি এইজন্যই যে সেটা আমার ভাল লাগে, শোভাকে আমার ভাল লাগে। আমার কাছে এটা ভারী স্বাভাবিক যে আমার অন্য দায়িত্ব যাই থাকুক না কেন আমি যেভাবে পারি শোভার যত্ন নেব, ওর কীসে ভাল সেটাই সর্বদা করার চেষ্টা করব। শোভার এই প্রত্যাশাটা যথোপযোগী ও স্বাভাবিক। নইলে আর একসঙ্গে থাকা কেন?”

শোভা বলল, “হ্যাঁ, সেটাই আমার প্রত্যাশা। একই সঙ্গে আমার আশা ও প্রত্যাশা দুইই যে উদয় সব সময় জানবে যে আমি ওর সপক্ষে, আমি ওর ভাল চাইব, ওর যত্ন নেব। ভবিষ্যতের কথা কেউ জানে না, আমরা কোনওদিন বিয়ে করব কি করব না জানি না। কিন্তু যতদিন একসঙ্গে রয়েছি আমি জানি যে উদয় আমার যত্ন নেবে আর উদয়ও জানে যে আমি ওর আপ্রাণ দেখাশোনা করব।”

দাম্পত্যজীবনের মূলসূত্র সম্বন্ধে এমন আশ্চর্য আলোচনা শুনে অবাক না হয়ে পারি না। কত কিছু কত তাড়াতাড়ি এই সব তরুণ-তরুণীরা ভেবে ঠিক করেছে, পুরনো সংস্কারের বোঝা সরিয়ে নতুনভাবে নিজেদের জীবনপদ্ধতি সম্পর্কে ভাবছে।

আমার মনে হল: আসুক আরও এমন অনেক বুদ্ধিমান, উদারচেতা, সংস্কারত্যাগী ছেলেমেয়ে এদেশে কাজ করতে। হয়ত প্রবাসের বেড়া ডিঙিয়ে এসব ধারনা স্বদেশের শহরে-গ্রামেও একদিন পৌঁছে যাবে।।

মণীশ নন্দী দীর্ঘদিনের প্রবাসী। কর্মজীবনে মার্কিন দূতাবাস ও ওয়র্ল্ড ব্যাঙ্কের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অবসর গ্রহণের পর লেখালোখি নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। আ স্ট্রেন্জার ইন মাই হোম ওঁর সদ্যপ্রকাশিত বই।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *